#শ্রাবণের_মেঘ🌿
#পর্ব_২৩
#Tabassum_Kotha
ব্যালকোনিতে রাখা চেয়ারটায় থম মেরে বসে আছে কথা। গালে পানির শুকিয়ে যাওয়া রেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। হয়তো এতোক্ষণ কান্না করছিল, কিন্তু এখন চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। এখনও অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশের এই মন ভাঙা কান্না কখন শেষ হবে কে জানে!
কথার ঘরের দরজায় টোকা পরছে, অপর পাশ থেকে কলি বেগম অনবরত কথাকে ডেকে যাচ্ছেন। কলি বেগমের ডাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কথা উঠে দরজা খুলে দিলো।
— তোর হয়েছে টা কি বলবি? নিতুদের বাসা থেকে এসেই ঘরে খিল এটেছিস। আর বেরুস নি। খাবারও খেলি না।
— কিছু না। শরীর টা ভালো লাগছিল না। তাই একটু শুয়ে ছিলাম।
— দেখি দেখি জ্বর এলো নাকি আবার!
— না এমনিতেই মাথায় একটু ব্যথা।
— পরীক্ষার আগে কেউ বৃষ্টিতে ভিজে? এই নে খাবার। খেয়ে ঘুমিয়ে পর। ড্রয়ারে জ্বরের ঔষধ আছে। শরীর গরম করলে ঔষধটা নিজ দায়িত্বে খেয়ে নিস।
— হুম।
.
কলি বেগম চলে গেলে কথা খাবার টা টেবিলেই রেখে দেয়। নীল আর মুনতাহাকে একসাথে দেখে তার পেট ভরে গেছে। এখন খাবার না খেলেও চলবে।
কথা খাবার প্লেট রেখে ব্যালকোনির কাচ বন্ধ করতে যেতেই নীল ব্যালকোনি দিয়ে হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকে পরে। নীল পুরো ভিজে গেছে। বোঝাই যাচ্ছে পুরো বৃষ্টি মাথায় নিয়েই এসেছে এখানে। নীল ভিতরে ঢুকে এলে কথা একটু পিছিয়ে দাড়ায়।
কথার চোখে মুখে অভিমান স্পষ্ট। তার ইচ্ছে করছে নীল এর বুকে নিজেকে লুটিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ কান্না করে অভিমানটা দূর করতে। কিন্তু কোনো একটা সংকোচবোধ তাকে জাকড়ে ধরে রেখেছে, তাই তো নিজের মনকে শক্ত করে সে নীল এর থেকে অনেক দূরে দাড়িয়ে আছে।
.
আচমকা নীল কথাকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে তার সাথে মিশিয়ে নিলো। হঠাত করে জরিয়ে ধরাতে কথা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। এমন হুট করে নীল কথাকে নিজের বুকে নিয়ে নেবে সেটা হয়তো কথা বুঝে উঠতে পারে নি। কেনো যেনো কথার ভীষণ রাগ হচ্ছে। এতোটা কষ্ট দিয়ে এখন ভালোবাসা দেখাতে এসেছে, ব্যাপার টা কথা কিছুতেই হজম করতে পারছে না।
— প্লিজ ক্ষমা করে দে! আমি সবাই কে বলে দেবো বিয়ের কথা। আর বিশ্বাস কর মুনতাহা আর আমার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই।
কথা চুপ করে আছে। নীল এর কথার ভালো মন্দ কিছু একটা উত্তর তার দেওয়া উচিত, কিন্তু সে নিজেকে মানাতে পারছে কিছুতেই।
কথাকে নিজের বুক থেকে তুলে আবারও জিজ্ঞেস করলো নীল,
— কিছু একটা বল! এভাবে চুপ করে থাকিস না। তুই এভাবে থাকলে বুকের ভিতর টা পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
— চলে যান আপনি এখান থেকে।
— কথা এবার তুই বারাবারি করছিস। বিকেলেও আমার কথা না শুনেই ভুল বুঝে চলে এসেছিস। আর এখনও আমার কথা শুনতে চাস না।
— কি শুনবো আপনার কথা? আপনার বিশ্বাসঘাতকতার প্রমাণ আমি নিজে চোখে দেখে এসেছি। আর কিছু শোনার ইচ্ছে আমার নেই।
— আমার উপর কেনো তুই বিশ্বাস করতে পারছিস না? কেনো কথা? ভালোবাসার ভিত্তিই তো বিশ্বাস তাহলে কেনো তুই আমার উপর বিশ্বাস করতে পারছিস না?
— কেনো সবসময় আমাকেই ভালোবাসার, বিশ্বাসের প্রমাণ দিতে হবে? কেনো? আমিই কেনো প্রতিবার প্রমাণ দেবো? নীরবের সাথে আপনি আমাকে একবার দেখে কতোটা অপমান করেছিলেন মনে আছে? তখনও আমাকে আমার নির্দোষ হওয়ার প্রমাণ দিতে হয়েছে। আদনানের সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর আপনাকে বিয়ে করে আমার ভালোবাসার প্রমাণ দিতে হয়েছে। বলতে পারেন কেনো আমাকেই সবসময় প্রমাণ দিতে হয়?
কথার দুচোখ বেয়ে অশ্রুধারা বেয়ে পরছে। কথার চোখের পানি নীল এর বুকের বা পাশে তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে। নীল কিছু না বলে কথার চোখের পানি মুছে দিয়ে কথাকে পুনরায় বুকে জরিয়ে নিলো। নীল এর বুকে মাথা রাখতেই কথা আগের থেকেও জোরে কান্নায় ভেঙে পরলো।
কথা কান্না করে যাচ্ছে আর নীল তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে পরম যত্নে। ধীরে ধীরে কথার কান্নার গতি কমে আসছে। এতোক্ষণ শুধু নীলই কথাকে জরিয়ে ধরেছিল। এখন কথাও নীলকে হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে নেয়।
নীল কথার মুখটা তার দুহাতের আজলে নিয়ে তার কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়।
— আপনি ওই মুনতাহার সাথে আর কখনও কথা বলবেন না!
— আর কখনও কথা বলবো সত্যি!
— কথা দিন!
— আমার কথাকে ছুঁয়ে কথা দিলাম।
— আর কখনও আমাকে ছেড়ে যাবেন না।
— আরেহ পাগলী আমি কি তোকে ছেড়ে গিয়েছি নাকি!
— জানি না!
কথা পুনরায় নিজেকে নীল এর বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। নীলও পরম আবাশে কথাকে জরিয়ে ধরে ঘুমিয়ে পরলো!
.
.
.
🌿
🌿
.
.
.
” মুনতাহা আর নীল এর বিয়ের কথা টা পাকা করে ফেলা উচিত আমাদের।”
নজরুল সাহেবের সামনে চায়ের ট্রে টা রাখতে রাখতে নয়নতারা বেগম কথাটা বললো।
— আগে আমি নীল এর সাথে কথা বলে দেখি নেই। তারপর বিয়ের কথা পাকা করবো।
— নীল এর সাথে কথা বলতে হবে কেনো? আপনি আর আমি যা ঠিক করবো সেটা নীল হাসি মুখে মেনে নেবে।
— আমিও এটাই ভেবেছিলাম নিতুর বেলায়। কিন্তু সেটার পরিণতিটাও দেখা হয়ে গেছে আমার।
— নীল আমার কথার বাইরে আর কথাই বলবে না!
— যতো দিন যাচ্ছে নিজের সন্তানদের উপর থেকে বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। তাই দ্বিতীয়বার বদনামের ভাগী হতে চাই না। নীল এর সাথে কথা বলে নীল এর ইচ্ছাতেই বিয়ে হবে।
নজরুল সাহেবের সাথে যুক্তিতে হেরে গিয়ে চরম বিরক্তি নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন নয়নতারা বেগম। এতো সহজে সে হেরে যাবে না। নীল ছোট থাকতে মুনতাহার মা কে সে কথা দিয়েছে মুনতাহা কে নীল এর বউ বানাবেন। এতো বছরের দেওয়া কথা নীল এর বাচ্চামোর সামনে ফিকে পরে যাবে এটাতো সে মানতে পারে না।
.
.
.
” বাবা আমি কথাকে বিয়ে করতে চাই।”
খান বাড়ির উঠোনে জিপ দাড় করিয়ে হন্তদন্ত হয়ে নজরুল সাহেবের কাছে ছুটে এসে কথাটা বললো নীল।
একটু আগে নয়নতারা বেগমের দিয়ে যাওয়া চায়ের কাপে এইমাত্র চুমুক বসিয়েছিলেন নজরুল সাহেব। ঠিক তখনই নীল এর মুখ থেকে এই ধরনের কথা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো তার। নজরুল সাহেব বেশ ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ হওয়াতে চিল্লা চিল্লি না করে খুব শান্তভাবে পুনরায় কাপে চুমুক বসালেন।
— বাবা, আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই নি কিন্তু আমি কথাকে ভালোবাসি। আর কথাকে বিয়ে করতে চাই। সেটাও খুব দ্রুত।
— হুম। বুঝলাম। বসো। অনেকদিন হয় তোমার সাথে কথা হয় না।
— বাবা আমাকে ক্ষমা করে দাও। কিন্তু আমি নিরুপায়।
— নীল আমি বেশ সন্তুষ্ট যে তুমি এই কথাটা সবার আগে আমাকে জানিয়েছো। নিতুর মতো ভুলভাল কোনো কাজ করো নি।
নজরুল সাহেবের কথায় নীল বেশ অস্বস্তিতে পরে যায়। কারণ সে আরও আগেই কথাকে লুকিয়ে বিয়ে করেছে। এখন যদি সে এই কথাটা তার বাবা কে বলে তাহলে হয়তো তার বাবা ভুলভাল কোনো কাজ করে বসবেন।
হাতের কাপটা সামনের টেবিলে রাখা ট্রে তে রেখে নীল এর দিকে মুখ ঘুরিয়ে নজরুল সাহেব বলা শুরু করলেন,
— দেখো নীল বেশ কিছুদিন যাবত আমার শরীর টা খারাপ যাচ্ছে। নিতুর বিয়েটা জলদি করানোর একটাই কারণ ছিল, আমার কিছু হওয়ার আগে নিতুর ভবিষ্যত ঠিকঠাক করা। তুমি আর নীরব দুজনেই নিজের দায়িত্ব নিতে সক্ষম। আমার যাওয়ার নয়ন আর তাহেরার কোনো সমস্যা তোমরা হতে দেবে না এটা আমার বিশ্বাস। আর জীবন টা যেহেতু তোমাদের তাই তোমরা যাদের জীবনসঙ্গী হিসেবে চাও তাদের নিয়েই থাকো। আমাদের দায়িত্ব তোমাদের দোআ করে দেওয়া, সেটা পূরণ করে দেবো।
– এভাবে বলছো কেনো বাবা!
নজরুল সাহেব কিছু না বলে চায়ের কাপে ঠোঁট ছুয়ালেন। নীল মাথা নিচু করে আগের ভঙ্গিতেই বসে আছে। কেনো যেনো বিয়ে করে ফেলার কথা টা আর বলতে পারলো না নীল। হয়তো সে ভয় পাচ্ছে তার বাবা কে আরেকটা মানসিক ধাক্কা দিতে।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
দেড় মাস পর,
সকাল সকাল ভীষণ চ্যাচামেচি শুরু হয়েছে খান বাড়িতে। যে কেউ বাইরে থেকে দেখলে বলবে মাছের বাজার আজ খান বাড়িতে বসেছে। মানুষে থৈ থৈ করছে পুরো বাড়ি। সেই মানুষের ভীর ঠেলে হলুদ একটা শাড়ি কোনোমতে গায়ে পেচিয়ে উঠোন দিয়ে ছুটে চলছে রাইসা। রাইসার পিছন পিছন তায়েবা আর তানিয়াও ছুটে চলছে। রাইসা সকাল থেকে না খেয়ে পুরো বাড়ি ছুটছে মামার বিয়ে খাবে বলে।
— রাইসা মা খাবার টা খেয়ে নে। কতো বেলা হয়েছে! (তায়েবা)
— না মামুনি আমি মামাল বিয়ে কাবো!
— বিয়ে খেলে বুঝি খাবার খাওয়া যায় না পাকনি বুড়ি! (তানিয়া)
— খালামুনি আমি যদি খাবাল খেয়ে নেই তাহলে বিয়ে কিবাবে কাবো!
রাইসার আধো বুলির কথা শুনে তায়েবা আর তানিয়া ফিক করে হেসে দেয়।
তাহেরা বেগম আর নয়নতারা বেগম অন্দরমহলের সব কাজ সামাল দিচ্ছে। নজরুল সাহেব ডেকোরেশনের লোকদের সাথে চ্যাচামেচি শুরু করে দিয়েছেন। হলুদের অনুষ্ঠান বিকেলে শুরু হবে কিন্তু এখনও অর্ধেক কাজও শেষ হয় নি। বাইরের সব কাজের তদারকিতে নীরব ছিল। নীরব কিছু কাজে বাড়ির বাইরে গেলে এদিকে ডেকোরেশনের লোকজন কাজে চরম ঢিলামি দিয়েছে।
.
তাহেরা বেগম নিতু কে ডেকে একটা সাদা পাঞ্জাবী হাতে ধরিয়ে দিলো নীল কে দেওয়ার জন্য। পাঞ্জাবী টা হাতে নিয়ে নিতু শাড়ি উচু করে দৌড় দিলো নীল এর ঘরের দিকে।
— নীল ভাইয়া হলুদের সময় এটা পরিস।
— তুই এভাবে দৌড়াচ্ছিস কেনো?
— আমার ননদের বিয়ে কালকে তুই জানিস আমার কতো কাজ!
— ওরেহ। তোর কথায় মনে হচ্ছে দুনিয়ার সব কাজ তুই করছিস।
— আর নয়তো কি। জানিস কথাকে বউ সাজানোর, হলুদের সাজে সাজানোর দায়িত্ব পরেছে আমার।
— হ্যাঁ বুঝলাম।
— তোর এতো ঠান্ডা রিয়েকশন! যাক যা ইচ্ছা কর আমি যাচ্ছি।
— এই নিতু। তোর পরীক্ষা কেমন হয়েছিল রে?
পরীক্ষার কথা শুনে নিতুর হাসি মুখ খানা খানিকটা মলিন হয়ে গেলো। তবুও দাঁত গুলো বের করে জোরপূর্বক একটু হেসে বললো,
— পরীক্ষা! অনেক ভালো হয়েছে!
— সেটা তো রেজাল্ট এলেই বোঝা যাবে!
চলবে..