#শ্রাবণের_মেঘ🌿
#পর্ব_২৭
#Tabassum_Kotha
” চুপ করো তোমরা! সত্যি টা না জেনে কেউ আর কোনো কথা বলবে না।”
কথার প্রতি সবার অপবাদ মানতে না পেরে এক প্রকার গর্জে উঠে কথাটা বললো নীল।
— তুই এই চরিত্রহীন মেয়ের জন্য আমাদের সাথে গর্জে কথা বলছিস নীল! এই দিন দেখার জন্য বুঝি তোকে পেটে ধরেছিলাম? (নয়নতারা বেগম)
— কথা চরিত্রহীন নয় মা। কথা ঠিক ততোটাই পবিত্র যতোটা তোমার কাছে নিতু পবিত্র।
— নিতুর সাথে এই কলঙ্কীনির তুলনা দিস না নীল। অন্তত আর যাই হোক নিতু বিয়ের আগেই পরপুরুষের সাথে,, ছিঃ!
পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মুনতাহা বলে উঠে,
— যেই মেয়ে তার গর্ভের সন্তানের পিতৃপরিচয় দিতে পারে না। সে কিভাবে পবিত্র হয় নীল!
— উইল ইউ জাষ্ট শাট আপ মুনতাহা? তোমাকে কিছুক্ষণ আগেই মানা করেছি আমার আর কথার থেকে দূরে থাকবা। তারপরেও বেহায়ার মতো এসে পরেছো নাক গলাতে। (নীল)
— মুনতাহাকে চুপ করাচ্ছিস কেনো? মুনতাহা তো ঠিকই বলেছে। কথার গর্ভের সন্তানের তো কোনো পিতৃপরিচয়ই নেই। (নয়নতারা বেগম)
— কথার গর্ভের সন্তানের পিতৃপরিচয় নেই কে বলেছে তোমাদের? সেই কখন থেকে আজেবাজে বকে যাচ্ছো! একটা বার আমাদের কথা শুনেছো নাকি শুনার চেষ্টা করেছো?
নজরুল সাহেব পাশে থেকে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন,
— কি বলতে চাও তুমি স্পষ্ট করে বলো।
— বাবা, কথার গর্ভের সন্তান কোনো পাপের ফসল নয়। এই সন্তান আমাদের ভালোবাসার প্রতীক। কথা আমার সন্তানের মা হতে চলেছে।
.
নীল এর বলা কথায় মুহূর্তের জন্য পুরো ঘর নিস্তব্ধ হয়ে যায়। যদিও এই মুহূর্তে ঘরে পরিবারের প্রায় অনেকে উপস্থিত তবুও বাইরে থেকে মনে হবে ঘর একদম খালি। কারো মুখে কোনো কথা নেই। মাঝে মধ্যে কথার ফুপিয়ে উঠার শব্দ ভেসে আসছে কানে।
নীরবতা ভেঙে নয়নতারা বেগম বাজখাই গলায় চেচিয়ে উঠলেন,
— এতো অধঃপতন হয়েছে তোর নীল! এই খারাপ মেয়েটার জন্য তুই সব দোষ নিজের ঘাড়ে নিচ্ছিস! কথাকে যেনো কোনো কথা শুনতে না হয় তাই ওর পাপ কে তুই নিজের পরিচয় দিচ্ছিস।
— মা কি সব উল্টা পাল্টা বলছো? আর আমার সন্তানকে বারবার পাপ বলছো কেনো? ওর কোনো দোষ নেই। ও তো এখনও এই পৃথিবীতে আসেও নি। ও নিষ্পাপ। ভুল যা করার আমরা করেছি। শাস্তি পেতে হলে আমরা পাবো। আমাদের সন্তানকে কিছু বলতে পারবে না।
— দেখছেন আপনি? আপনার ছেলের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এই নষ্টা মেয়েটাকে বাঁচানোর জন্য সব দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিচ্ছে।
— মা তুমি যদি আর একবারও কথাকে নষ্টা মেয়ে বলেছো তাহলে আমি ভুলে যাবো তুমি আমার মা!
— ছিঃ ছিঃ নীল। তুই আমার সাথে এই ব্যবহার করতে পারলি! এই দিন দেখার জন্য তোকে পেটে ধরেছিলাম আমি!
— আমাকে ক্ষমা করে দাও মা। কিন্তু তুমিই বলো, আমার সন্তানের জন্ম পরিচয় নিয়ে যেখানে প্রশ্ন উঠছে সেখানে আমি কিভাবে চুপ করে থাকি!
নজরুল সাহেব পাশের সোফায় বসে ছিলেন। নীল আর নয়নতারা বেগমের কথা কাটাকাটি ক্রমশ বাড়তে থাকলে তিনি উঠে দাড়ায়। নজরুল সাহেবের চোখ রাঙানিতে নয়নতারা বেগম চুপ হয়ে যায়।
— কি বলতে চাইছো সবটা স্পষ্ট করে বলো নীল! কথার সন্তানের বাবা কি সত্যি তুমি?
— জি বাবা। এই সন্তান আমার। আমিই ওর বাবা।
— তার মানে তোমাদের বিয়ের আগে থেকেই অবৈধ সম্পর্ক ছিল?
— না বাবা। কথা আর আমার সম্পর্ক অবৈধ ছিল না। আমাদের সম্পর্ক শতভাগ ধৈধ এবং হালাল ছিল।
— তুই আবার মিথ্যে বলছিস নীল এই মেয়েকে বাঁচানোর জন্য! (নয়নতারা বেগম)
— আম্মা ঠিক বলছে নীল। তুই কেনো কথার কুর্কমের ভার নিজের কাঁধে নিচ্ছিস? (কাব্য)
— কাব্য, আমার ভাবতেই অবাক লাগছে তুই কথার ভাই হয়ে কথাকে এভাবে বলতে পারলি কিভাবে? তোর নিজের বোনকে বিশ্বাস করতে পারলি না? তোর দ্বারা এটা আশা করি নি কাব্য। বাকি সবার কথা বাদ দিলেও তোর তো অন্তত কথা কে বিশ্বাস করা উচিত ছিল। (নীল)
— এতো কিছু হয়ে যাওয়ার পর বিশ্বাস কি করে করি? (কাব্য)
— ভাইয়া, আমি কোনো অন্যায় করি নি। আপনারা সবাই আমাকে যা ইচ্ছে তাই বলছেন বলুন। কিন্তু আমার অনাগত সন্তানের কোনো দোষ নেই। (কথা)
— চোরের মায়ের বড় গলা! একেতো কার না কার পাপ পেটে নিয়ে ঘুরছিস তার উপর বড় বড় কথা! (নয়নতারা বেগম)
— মা তুমি থামবে? কি বারবার পাপ পাপ বলছো? আমি যে বারবার বলছি এটা আমার সন্তান কানে যাচ্ছে না তোমার? আমি কথাকে আরো দুই মাস আগে বিয়ে করেছি। সেটা তোমাদের কাউকে না জানিয়ে। আর এই সন্তান আমার।
নীল এর মুখ থেকে বিয়ের কথা শুনে আরেক দফা বজ্রপাত হলো খান বাড়িতে। সবাই বাকরুদ্ধ দৃষ্টিতে কথা আর নীল এর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। নীল এর মুখ থেকে বিয়ের কথা শুনে নয়নতারা বেগম নিশ্চিত হয়ে গেছেন যে কথার বাচ্চার বাবা নীল ই। কারণ নীল আর কথার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক অনেক আগে থেকেই দেখেছে সে।
বাড়ির সবাই হতবাক হয়ে আছেন কিন্তু সবচেয়ে খারাপ অবস্থা নজরুল সাহেবের। কিছুদিন আগেই মেয়ে নিতুর কাছে থেকে এমনই একটা ঝটকা পেয়েছিলেন তিনি। পালিয়ে বিয়ে করে তার মান সম্মাণ ডুবিয়েছিল সে। বহুকষ্টে নিজেকে সামলে পুনরায় তার সম্মাণ আগের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। কিন্তু সেই একই কাজ এখন আর ছেলেও করে ফেললো! আর অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই নির্বাচন। নীল এর এই বোকামির কথা বাইরে জানাজানি হলে দ্বিতীয়বার চেয়ারম্যান পদে তাকে কেউ মেনে নেবে না।
.
নীরবতা কাটিয়ে নীল আবার বলতে শুরু করে,
— কথা আর আমি একে অপরকে আগে থেকেই ভালোবাসতাম। কিন্তু যখন কিশোর চাচা কথা আর আদনানের বিয়ে ঠিক করে দেন, তখন কথাকে হারানোর ভয় আমার মনে জেকে বসে। বেকার ছিলাম, কিশোর চাচা আমাকে পছন্দ করতেন না, সব মিলিয়ে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিতে ভয় পাচ্ছিলাম। তখন হুট করে মাথায় আসে পালিয়ে বিয়ে করবো। যেই ভাবা সেই কাজ, পালিয়ে বিয়ে করে নিলাম কথাকে। কিন্তু সেখানেও আমি দুর্বল পরে গেলাম, বিয়ে করা সত্ত্বেও কথাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে বাড়ি আনতে পারি নি।
নিতু আর কাব্য এর বিয়ের পর যখন বাবাকে আমার আর কথার বিয়ের কথা বলতে গিয়েছিলাম, সেদিনও সাহস করে উঠতে পারি নি। আমার দুর্বলতার কারণেই আজ আমাদের এই পরিণতি। আমাদের ভুলের শাস্তিই আমাদের অনাগত সন্তানকে পেতে হচ্ছে। এই পৃথিবীতে আসার আগেই ওকে সবাই পাপের ফসল বলছে! কিন্তু ওর কোনো দোষ নেই। ভুলটা আমার। আমিই ভয় পেয়েছিলাম যে আমাদের বিয়ের কথা জানতে পারলে বাবা অনেক কষ্ট পাবেন।
.
হঠাত ঠাস্ করে শব্দ হলে সবাই ধড়ফরিয়ে সামনের দিকে তাকাতেই দেখে নীল গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। আর নজরুল সাহেব অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন নীল এর দিকে। এইমাত্র তিনি নীল কে চড় মেরেছেন। নীল অন্যায় করেছে, এটা তার প্রাপ্য শাস্তি সে জানে,, তবুও তার দুচোখ টলমল করছে।
নজরুল সাহেব ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললেন,
— সন্তানদের সুশিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে মা বাবা হিসেবে আমরা ব্যর্থ। প্রথমে নিতু আর তুমি। দুজনেই এক কাজ করেছো। একইভাবে দুজনে আমার মান সম্মাণ ডুবিয়েছো। নয়নতারা! এই সব দোষ তোমার। তুমি তোমার সন্তানদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারো নি।
— বাবা প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও। (নীল)
— ক্ষমা! তুমি আমার অহংকার ছিলে নীল। আর সেই তুমি কি না,, ছিঃ! আর এক মুহূর্তও আমি তোমাকে সহ্য করতে পারছি না। বেরিয়ে যাও তোমরা আমার বাড়ি থেকে!
.
নজরুল সাহেবের কথার উপর কথা বলার সাহস খান বাড়িতে কারো নেই। বউভাতের অনুষ্ঠান মাটি হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে। কাব্য আর নিতু কথাকে তাদের সাথে না নিয়েই বাড়ি চলে গেছে। মেহমানদের খাইয়ে বুঝিয়ে শুঝিয়ে বিদায় করে দিয়েছেন নজরুল সাহেব। নয়নতারা বেগম ছেলেকে হারানোর কষ্টে বিল্লাপ করছেন আর কথাকে যা মুখে আসছে বলে যাচ্ছেন। তার ভাষ্যমতে নীল কে নজরুল সাহেব কথার জন্য বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। যা কিছু হয়েছে সবকিছুর জন্য কথা দায়ী।
.
কাব্য আর নিতু একা বাড়ি ফিরলে কলি বেগম আর কিশোর সাহবে উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চায় তারা কোথায়! উত্তরে কাব্য খান বাড়িতে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটা ঘটনা কিশোর সাহেবকে খুলে বলে।
.
.
.
তাহেরা বেগম নজরুল সাহেবকে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন অনবরত। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। তিনি তার স্বীদ্ধান্তে অটল। যতো যাই হয়ে যাক না কেনো নীল আর কথাকে আজ খান বাড়ি ছেড়ে যেতেই হবে।
চলবে..
[দুদিন ধরে জ্বর, এজন্য কালকে গল্প দিতে পারি নি। আগামীকালও হয়তো দিতে পারবো না জ্বর থাকলে। ইনশাল্লাহ পরশু গল্পের শেষ পর্ব দেওয়া হবে। ভুল-ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। ধন্যবাদ।]