অচেনা তুমি পর্বঃ০২

0
4284

#অচেনা_তুমি
#লেখিকাঃমহিমা_হাছনাত_মাহি
#পার্টঃ০২
সোহেলের এই সস্তামার্কা সত্যি কথা গুলো শুনে শুভ্রার চোখ গুলো ছলছল করে উঠল। তবে এটা দেখে সোহেলের মুখে ফুটে উঠল এক পৈশাচিক হাসি। কারন সে তো এটাই চেয়েছিল। কাল রাতে আমাকে সাপ বলা না?? আর কতো কি বলে বেচে যাবি আমার হাত থেকে। ধরা তো তোকে আমার হাতে দিতেই হবে। এই বলে সে আরো কাছে এগিয়ে যাবে তখনই সাদিয়া সোহেলের পাশের রুম থেকে শুভ্রাকে ডাক পাড়ে। মূহুর্তেই শুভ্রা চুখ মুখ খুলে দৌড়ে যেতে লাগে। কিন্তু তার মনে হলো হাজার শক্তি দিয়ে দৌড়াতে গিয়েও আটকে আছে তার হাত। হ্যা সোহেল এখনো ঠায় ওর হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্রা আবার ও কালকের মতো বুদ্ধি করে কিছু বলার জন্য চিতকার দিবে তখনই সোহেল বলল,
সোহেলঃ খবরদার কালকের মতো চালাকি করবি তো। নেহাত আজ আমার শুভ কাজ আছে বলে ছেড়ে দিচ্ছি তোকে। সক্কাল সক্কাল তোর ওই পোড়া মুখ দেখে আমার চাকরি টাই না ভেস্তে যায় আবার যাহ। বের হয়ে যা এক্ষনি।
শুভ্রার মাথায় একটাই কথা বাজছে যে তাকে এই প্রথম মুখপুড়ি বলা হলো । যেখানে তার বাবা বলতো সক্কাল সক্কাল তার মুখ দেখলে নাকি তার বাবার সারদিন ভালো যেতো।হাতের দিকে তাকিয়ে চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো । ফর্সা, দুধে আলতা গায়ে সোহেলের অই হাত যে জায়গায় ধরেছিল সেখানে লাল হয়ে আছে। এমনি তে মেয়েটার শরীর অন্যদের তুলনায় অনেক নরম। কারন নাকি সে যখন তার মায়ের পেটে ছিল তখন তার মায়ের বয়স ১৫ নাকি ১৬ বছর। তার উপর আর্থিক সমস্যার কারনে তার খাওয়া দাওয়া ও ছিল বিশেষ কম। শুভ্রা হওয়ার সময় পুরুপুরি সুস্থ হলেও, তার শরীর অনেক দূর্বল , তার উপর রক্ত স্বল্পতা । এসব হওয়া সত্ত্বেও টাকা রোজগার এর কথা ভেবে সে আজ অন্যের বাড়িত চাকর!!! নিজের এসব কথা ভাবতে ভাবতে শুভ্রা একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর পা বাড়ায় সাদিয়ার রুমে৷ সাদিয়া হলো সোহেলের আপন ছোট বোন। তবে সোহেলের বোন হলেও মোটেও সোহেল আর মিসেস লুতফা বেগমের মতো নয় সে। এক্কেবারে স্বভাব, চরিত্র তার বাবার মতো । রুমে গিয়ে দেখে সাদিয়া ঘুমে টুলুমুলু করছে বিছানায় উবু হয়ে। শুভ্রা বেশ বুঝতে পেরেছে তার কি লাগবে। দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে ফ্ল্যাক্স থেকে গরম গরম কফি নিয়ে গিয়ে সাদিয়ার সামনে ধরে। সাদিয়া উবু থেকে সুজা হয়ে ফিরতেই দেখে শুভ্রা কফি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর সে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে কফিটা নিয়ে বলল,
সাদিয়াঃ মানুষের মন পড়ে নেয়া কি তো জন্মগত ভাবে স্বভাব??
শুভ্রাঃ না গো আপ্পি। তবে কবে কার কি লাগবে কবে কার মন খারাপ আর ভালো তা আমি দেখেই বুঝে নিতে পারি।
সাদিয়াঃ তোর না আমাদের বাড়িতে কাজ না করে সাইকোলজিস্ট হওয়া উচিত ছিল রে।
সাথে সাথে শুভ্রার মুখটা মলিন হয়ে গেল। তখনই মিসেস লুতফা দরজায় দাড়িয়ে বললেন
ঃদুজনে মিলে সারাদিন গল্প করবে নাকি বাড়ির কাজ তাজ ও করা হবে শুভ্রা।
শুভ্রা মিসেস লুতফার সামনে এসে বলেঃ আমি ঘুম থেকে উঠে ঘর দোর সব গুছিয়ে পরিষ্কার করে ফেলেছি। আর নাস্তা ও তৈরি করে রেখেছি, ছাদ থেকে পানি ও এনেছি। আর কি করতে হবে বলুন।
মিসেস লুতফাঃ বাব্বাহ এতো দেখছি মুখে কই ফুটেছে মতো বিবরণ দিচ্ছিস। এতো কথা বলতে বলেছি তোকে?? যা গিয়ে বেসিনের এটো থালাবাসন গুলো ধুয়ে ফেল, আর এই নে টাকা আর বাজারের ব্যাগ। লিস্ট করে দিয়েছি সব আনবি। খবরদার যদি টাকার হিসাব এদিক থেকে এদিক হয় তাহলে আজকে তোর মাইনে থেকে টাকা কেটে নিব।
শুভ্রা ব্যাগ নিয়ে রান্না ঘরে গিয়ে থালাবাসন ধুয়ে বাইরে রওনা হলো । আর মনে মনে ভাবতে লাগলো, ( এমন ভাবে আমাকে বলছে যে আমি কোনদিন তাদের জিনিস বা টাকা চুরি করেছি। )
তারপর বাজারে গিয়ে লিস্টে যা যা লিখা আছে সব একে একে গিয়ে কিনে ব্যাগে রাখলো। লাস্ট মূহুর্তে এসে শুভ্রার মনে হলো ব্যাগ নিয়ে হেটে যাওয়ার সাধ্য তার নেই। তার ওপর হঠাৎ করে পেটে মোচড় দিয়ে উঠলেই তার মনে পড়লো সকাল থেকে তার এখনো কিছু খাওয়া হয় নি। মাথাটা কেমন ঘুরছে। তবুও ধুনিয়া দারি খেয়াল না করে একমনে ব্যাগটা নিয়ে আসতে আসতে বাম সাইড দিয়ে হঠাৎ একটি লোকের সাথে ধাক্কা খেল শুভ্রা। তারপর লোকটা আর শুভ্রা দুজনে মিলে একসাথেই সরি সরি, খেয়াল করিনি এরকম বলে একপ্রকার ছোট চিতকার দিয়ে উঠলো৷
শুভ্রা লোকটিকে দেখে রীতিমতো থতমত খেয়ে গেল। লম্বা গড়ন এক ফর্সা লোক। মোটামুটি ৬ ফিটের মতো হবে কিনবা তার চেয়েও দুই এক ইঞ্চি লম্বা। ফর্সা বলতে গেলে শুভ্রার মতোই দুধে আলতা। সাথে চাপ দাড়ি আর চেহারাটা কেমন জানি বেশ একটু চেনা চেনা মতো লাগছে। হঠাৎ কোন এক অপরিচিত মানুষ যাকে সে কোনো দিন দেখে ও নি অথচ তার মনে হচ্ছে তার চেহারাটা খুব চেনা মতো । অথচ শুভ্রার স্পষ্ট মনে আছে গত ৫ বছরেও এরকম চেহারার মানুষ সে আগে দেখেনি।
শুভ্রা যমন লোকটিকে দেখে চমকে গিয়েছে, তেমনি লোকটিও শুভ্রাকে দেখে চমকে গিয়েছে। তবে শুভ্রার মতো চেনাঘটিত কারনে নয় বরং শুভ্রার ব্যবহার ও শুভ্রার মায়াময় ওই মুখটি দেখে। সে খেয়াল করলো ব্যাগটা কোনমতে টেনে টুনে সে যাচ্ছিল। ব্যাগটি বয়ে নিয়ে যাওয়ার যে তার যথেষ্ট শক্তি নেই তা সে বুঝতেই পারছে। তারচিন্তার মাঝে শুভ্রা বলে উঠল
শুভ্রাঃ সরি, আসলে আমি আপনাকে খেয়াল করতে পারিনি। আসলে ব্যাগটি খুব ভারী তো তাই আমি এদিক ওদিক খেয়াল না করে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি বাড়ি যাচ্ছিলাম। আম এক্সট্রেমলি সরি।
লোকটার গেটাপ দেখে মনে হচ্ছে সে অফিসে যাচ্ছে। নিশ্চয় আবার তার জন্য লোকটার সময় নষ্ট হচ্ছে।
শুভ্রার কথা শুনে লোকটা রীতিমতো টাস্কি খেয়ে গেল। কারন সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে যে মেয়েটার পোশাক আশাক আর বাজারের ব্যাগ বয়ে নিয়ে যাওয়া তাকে কোনো বাড়ির কাজের লোকের পরিচয় দিচ্ছে। কিন্তু তার কথাবার্তা মোটেও সে পরিচয় বিহন করে নাহ। যেন মনে হচ্ছে যথেষ্ট শিক্ষিত একটা মেয়ে। কই তার বাড়িতেও তো কাজের লোক আছে। তারা তো এভাবে কথা বলেনি কোনো দিন ! নিজেকে সামলে লোকটি বলল
ঃ ইটস ওকে আম ফাইন। আর ইউ অকে? আরে..
শুভ্রাঃ হ্যা আমি ঠিক আছি।
লোকটি নিজের মনে হলো তার ইংরেজি বলাতে মেয়েটির বুঝতে কষ্ট হবে তাই সে আবার বাংলা বলতে যাচ্ছিল। কিন্ত তাকে আবারো অবাক করে দিয়ে মেয়েটি তার প্রশ্নের অবলিলায় উত্তর দিয়ে দিলো।
আর কিছু বলতে না দিয়ে মেয়েটি আবার তার ব্যাগ নিয়ে টানাটানি করতে করতে চলে যায়। লোকটা চাইলেও এদিক ওদিক তাকিয়ে তাকে আর পেল নাহ। কেন জানি মেয়েটাকে তার কেমন অদ্ভুত মনে হলো । তারপর ড্রাইভার তাকে গাড়ি থেকে ডাক দিলো যে গাড়ি ঠিক হয়েছে। তারপর সে আবার তার গন্তব্যে পাড়ি দেওয়ায় শামিল হলো।
অফিসের একটা নির্দিষ্ট রুমে বসে আছে সোহেল সহ আরো ২৬ জন। আজ তাদের সবার ইন্টারভিউ হবে। এই ২৬ জন থেকে ৭ জন সিলেক্ট করা হবে। কিন্তু বসে সবার একসঙ্গে বসে থাকার একটাই কারন তাদের যে ইন্টারভিউ নিবে স্বয়ং বস নিজেই এখনো লেপাত্তা। তবে অফিসের মেনেজার এর কাছ থেকে শুনেছে তিনি নাকি ভিষণ পানচুয়েল, আর সময়জ্ঞানী একজন ব্যাক্তি। তবে তিনি মেনেজার কে ফোন করে বললেন আর মিনিট দশেকের মধ্যে তিনি হাজির হবে। সকলে গভীর চিন্তায় মগ্ন হতে হতে অফিসে প্রবেশ করেন গ্রুপ অফ চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রিজ এর একমাত্র সিইও সাদাফ মাহমুদ চৌধুরী। গটগট পা ফেলে মেনেজার সহ নিয়ে সে তার অফিস রুমে প্রবেশ করে। তার ১০ মিনিট পর শুরু হয় ইন্টারভিউ । একে একে সবার ইন্টারভিউ নেওয়া হলে অবশেষে ৭ জনকে সিলেক্ট করা হলো। অবশ্য এর মধ্যে সোহেল ও ছিল। তাকে রিজেক্ট করার অবশ্য কোনো কারন ছিল না বরং সে তো এখানকার মেনেজার পদে নিযুক্ত হয়েছে। বর্তমান মেনেজার এর বয়স অনেক বেশি ৪৫ এর ও কাছাকাছি । সে নিজেই চেয়েছিল রিজাইন করতে। কিন্তু এখানকার দেখা শুনার জন্য মেনেজার এর পর উপযুক্ত লোকের অভাবে নতুন মেনেজার নিতে সমস্যা হচ্ছিল। তাই ঢাকা থেকে সাদাফ নিজেই এখানে এসেছে ইন্টারভিউ নিতে। আজ মেনেজার রিজাইন করেছে। কাল থেকেই সোহেল অফিস আসতে পারবে।
ইন্টারভিউ শেষে সাদাফ তার অফিস কেবিনে চলে যায়। তারপর পিয়ন কে বলে কফির অর্ডার দেয়। এসেই নিজের কেবিনে সুইভেলচেয়ারে গা এলিয়ে দেয়। চেয়ারটাতে বসে সে ঘুরছিল হঠাৎ পেছনে ফিরতেই চোখ যায় একটা বাড়ির জানালাতে। সেখানে একটি মেয়ে রান্নাঘরের বেসিনে সবজি ধুচ্ছে। আরে এটা তো সকালেরই সেই মেয়েটা যার সাথে আমার ধাক্কা লেগেছিল। তাহলে কি মেয়েটা এই বিল্ডিংয়েই থাকে? তাকে দেখেই নিজের অজানায় সাদাফ মুচকি হাসে। তারপর পিয়ন এসে তাকে কফি দিয়ে যায়। হাতে কফির মগটা নিয়ে শুভ্রার দিকে তাকিয়েই পুরো কফিটা শেষ করলো সে।
হ্যা শুভ্রার সাথে ধাক্কা লাগা ব্যাক্তিটাই সাদাফ। সকালে ঢাকা থেকে কক্সবাজার আসার পথে অফিসের কিছু দূরে এসেই তার গাড়িটা খারাপ হয়। গাড়িটা ঠিক হতে হতে দেরি হচ্ছে বিধায় সে একটু বাইরে এসে হাটছিল। তারপর একটু এদিক থেকে ওদিক হতেই চোখের অগোচরে শুভ্রা সাথে ধাক্কা লেগে যায়। তবে শুভ্রার ব্যাপারটা যে তাকে ভাবাচ্ছে না তা নয়। সে যখন শুভ্রার সাথে কথা বলছিল তখন তার গালের বা পাশে স্পষ্ট হাতের ছাপ দেখেছে। তার ওপর যখন ধাক্কায় সবজি কিছু পড়ে গিয়েছিল তখন সবজি নেওয়ার সময় ও তার হাত যথেষ্ট লাল হয়ে ছিল। তবে কি অন্যান্য কিছু শ্রেণির লোকের মতো তাকেও তার মালিকপক্ষ অত্যাচার করে? ভাবতেই সাদাফের মুঠো শক্ত হয়ে উঠে। এসব অন্যায় সে কোনো দিন ই না মেনে নিয়েছিল না আর ভবিষ্যতে মানবে! তবে শুভ্রার সাথে কথা বলে মনে হলো সে যথেষ্ট পড়াশোনা জানা মেয়ে। খুব ভদ্রতার সাথেই তার সাথে কথা বলেছিল সে। এতোকিছু ভাবতে ভাবতে সাদাফ নিজেই অবাক হয়ে যায় অচেনা অজানা মেয়েকে নিয়ে তার নিজেরই এতো ভাবনা দেখে। ভাবতে ভাবতে দেখে শুভ্রা অনেক আগেই তার সবজি গুলো ধুয়ে রান্নাঘর থেকে চলে গিয়েছে। সাদাফ ১৫ দিন এর জন্য কক্সবাজার এসেছে এবারে। সারা বাংলাদেশে তার ৭ টি ব্রাঞ্চ আছে। সবগুলো সে আর তার বাবা দেখে।তবে ইন্টারভিউ নেওয়া আর মানুষের মন, মানসিকতা চেকে দেখা সাদাফ এর মেইন কাজ। এসব বিষয়ে ঘাটাঘাটি করতে সাদাফ বেশ সুক্ষ্ম । অফিসের ই ৫ তলায় তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অবশ্য সেখান থেকেও শুভ্রার বাসার দিকটা সম্পুর্ন ভালোভাবে দেখা যায়। সাদাফ এর অফিস এবং শুভ্রাদের বাড়ি প্রায় পাশাপাশি তবে মাঝখানে একটা রাস্তা আছে। সাথে অনেক মুদির দোকান।
#চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here