অচেনা তুমি পর্বঃ১৭

0
2591

#অচেনা_তুমি
#লেখিকাঃমহিমা_হাছনাত_মাহি
#পর্বঃ১৭।
ঘর,রুম,রান্নাঘর,করিডোর,বেলকনি, বাগানে পাগলের মতো খুজেও সাদাফ শুভ্রাকে খুজে পায় নি। এবার সে নিজের মস্তিষ্কে চাপ দিয়ে ভাবতে থাকে যে সে কোথাও থাকতে পারে। তারপর দৃদৃষ্টি স্থির করে পা বাড়ায় এক জানা গন্তব্যে।

বিকেল হয় নি তবে দুপুর এ নই মাথার উপর তেরছাভাবে কিরন দিচ্ছে সূর্যের মিষ্টি আলো। সেই সাথে ছুটে চলছে সমুদ্রের ঢেউ৷ চারদিকে যখন পিনপতন নীরবতা বিরাজমান সেখানেও এক নিরব কিশোরী তার চঞ্চল মন নিয়ে চেয়ে আছে অসীম ওই দিগন্তের পানে।

ওওও তাহলে আপনি এখানে??

পেছন দিয়ে পুরুষ মানুষের ভেসে আসায় ও শুভ্রা মুখ ফিরিয়ে তাকায় না। কারন সে বুঝেছে কে এসেছে।

সাদাফঃ তা মেডামের আজ ঠিক কেন মন খারাপ বলতে পারবে কেউ? ( থুতনিতে হাত দিয়ে চিন্তার ভঙ্গিতে)

শুভ্রাঃ কে বলেছে আমার মন খারাপ। ( সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে)

সাদাফঃ কেউ যেন আমায় বলেছিলো যে তার যখন খুব মন খারাপ থাকে তখন তার মন খারাপের নিরবতাকে সঙ্গ দেয় এই নীরব সাগর।

শুভ্রাঃ আপনার এটা মনে আছে? ( এবার সাদাফের দিকে তাকিয়ে)

সাদাফঃ ইউ নো শুভ্রা। কিছু মানুষের সাথে কাটানো কিছু মূহুর্ত কখনোই ভুলা যায় না। আর ইচ্ছে করে তো কখনোই নয়। আর যদি মানুষটা হয় সবচেয়ে স্পেশাল। (শুভ্রার চোখের দিকে তাকিয়ে)

শুভ্রা মাথায় সাদাফের কথার আগামাথা কিছুই ঢুকছে না। স্পেশাল মানে?? আর কেমন স্পেশাল??

শুভ্রাকে চুপ থাকতে দেখে সাদাফ আবার বললোঃ আজ সারাদিন আমায় ইগনোর কেন করছো বলোতো? কফি দিতে গিয়ে দাড়াওনি, খাওয়ার সময় ও চুপচাপ ছিলে, তারপর তো উধাও ই হয়ে গেলে। তুমি জানো কোথায় কোথায় খুজেছি আমি?

শুভ্রাঃ এতো খুজার দরকার ই বা কিসের। আমি কি বলেছি আমাকে খুজুন আমি লুকিয়ে পড়ি।

সাদাফঃ শুভ্রা আজ কি হয়েছে তোমার? এমন অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলছো?? তোমাকে আজ আমার বড্ড অচেনা লাগছে। বিশেষ করে ইলিয়ানা আসার পর থেকে।

শুভ্রাঃ মি.চৌধুরী আমি বরাবরই এমন ছিলাম। শুধু পরিস্থিতির গুনে আমি আমাকে চেপে রেখে শান্ত প্রলেপ দিয়ে রাখতাম। আমি তো আর কচি খুকি নয় যে ছোট বাচ্চাদের মতো ন্যকা ন্যকা করে স্যাডি বেইবি বলে বলে কারো গায়ে দুলে বার বার জড়িয়ে ধরে দুনিয়া জড়ো করে ফেলবো। আম টু মাচ ম্যাচিউর দেন ইউর ফিয়েন্স। (বুকে হাত দিয়ে বেশ ভাব দেখিয়ে)

শুভ্রার চেহারার আর অঙ্গভঙ্গির অবস্থা দেখে সাদাফের ইচ্ছে করছে পেট ফেটে হাসতে। নিজেতো বাচ্চাদের মতো বিহেব করছে এখানে তিনি বলছেন আম ম্যাচিউরড।

সাদাফঃ ওও আচ্ছা৷ ম্যাডাম তাহলে এই কারনে রেগে আছে। তা ম্যাডাম আমাকে জড়িয়ে ধরলে তোমার কি। আর ইউ ফিলিং জেলাস? ( শুভ্রার দিকে ঝুকে)

শুভ্রাঃআ.. আমি কেন জেলাস হতে যাবো খামকা! আজব তো। আমার বয়েই গেছে ওই মেয়ের সাথে জেলাস করতে। আর আপনি এখানে কেন। যান সে না ফিয়েন্স আপনার। উনার সাথে টাইম স্পেন্ড করুন।

সাদাফঃ ইলিয়ানা আমার ফিয়েন্স এটা তোমায় কে বললো? ( ভ্রু কুচকে) ।

শুভ্রাঃবিয়ে তো আমি তোমার ছেলেকেই করবো। বাই হুক অর বাই ক্রুক। ( ইলিয়ানার ভঙ্গিতে)

সাদাফ এবার পারলো না নিজের হাসি চেপে রাখতে। হু হা করে হাসতে লাগলো একদমে।

সাদাফঃ তুমি যে জেলাস ও কর‍তে পারো তা আমার ধারনার ও বাইরে৷ তাও এভাবে?

শুভ্রাঃ কে বলেছে আমার জেলাস হচ্ছে। আর আমার জেলাস হবেই বা কেন। আমি কি আপনার বউ না গার্লফ্রেন্ড?

সাদাফঃ যদি বলি তার চেয়ে বেশি কিছু।

শুভ্রাঃ মানে??

সাদাফঃ মানে তুমি বুঝবে না কিছু। চল হাটি। বসে বসে কোমড় ব্যাথা করছে।

এদিকে নাদিম শুভ্রাকে খুজার জন্য ছাদে উঠে এদিক ওদিক খুজে কোথাও পায় না। অবশেষে ছাদের একদম টপ ফ্লোরে উঠে দেখে রেলিঙে ভর করে এক হ্রদয় জলন্ত পরী একদৃষ্টিতে সাগর পানে চেয়ে আছে। পড়নে জিন্স আর সুন্দর একটা কূর্তি। চুলগুলো হাটু পর্যন্ত খোলা। ঠান্ডা বাতাসে চুলগুলো এলোমেলো ভাবে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছে।

আজ মনে হয় কারো সাথে সাথে আকাশটারও মন খারাপ। দেখো কেমন গুম্পড়ো করে আছে। মনে হচ্ছে এখুনি ভ্যা ভ্যা করে কেদে দিবে।

নাদিমের এমন কথা তেও আজ কুবরা একটুও টু করে উত্তর দেয় নি। নাদিম যে কথাটা কুবরাকে ইমডিকেট করে বলেছে তা ভালো করেই বুঝা যাচ্ছে। তবে কুবরার চুপ করে থাকাটা নাদিমের কেমন খারাপ লাগছে।

নাদিমঃ তোমায় তো দেখি এই লুকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।

কুবরাঃ কেউ যদি মনে করে আমি তাকে দেখানোর জন্য এইভাবে সেজেছি তাহলে সেটা তার অনেক বড় বোকামি হবে। আর এখানে সুন্দরের কি হলো? সকালে তো আমায় কেউ বলেছিলো লো ক্লাস ড্রেসাপ নাকি তার পছন্দই না তবে এখানে এসে কেন সে এই সস্তা সাজকে সুন্দর বলছে?

নাদিমঃ মিস কুইন কুবরা আমি তো সেটা মজা করেই বলেছিলাম । আর আমি মোটেও আপনাকে ইন্ডিকেট করে বলিনি কথাটা।

নাদিমের কথা শুনেই কুবরা একজন মেকি হাসি দিলো।

কুবরাঃ কোনো কিছু কাউকে উদ্দেশ্য করে বলতে হয় না। যখন সেটা কারো সাথে সামঞ্জস্য ভাবে মিলে যায় তখন সে পরিস্থিতি টা সেই বুঝতে পারে৷
নাদিমের এখন ইচ্ছে করছে নিজের মাথার চুল নিজেরই টেনে ছিড়ে ফেলতে। বলেছিলো কি জন্য আর হচ্ছে কি সব।
কুবরা আর কথা না বাড়িয়ে চলে যেতে নিলেই নাদিম কুবরার হাতটা ধরে ফেলে।

নাদিমঃ মিস. কুইন কুবরা আমি লাস্ট টাইম বলছি কথা টা আমি আপনাকে ইনডিকেট করে বলিনি।

কুবরাঃ আর আমিও বলিনি যে আপনার কথাতেই আমার কিছু হয়েছে মি.পচা বাদাম। আর এভাবে হাত কেন ধরেছেন। ছাড়ুন আমার হাত। আমি কোনো বড়লোকের গায়ে পড়া মেয়ে নয় যে, কেউ আমার হাত ধরবে আর আমি ন্যাকামি করে ঢলে পড়বো৷ মিডেল ক্লাস মেয়েরা কোনো দিন এসবের ধারে কাছে ও যায় না।

এই বলে কুবরা হাত টা ঝাড়ি দিয়ে ছাড়িয়ে চলে এলো। নাদিম এখনো চুপচাপ সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে, কুবরার কথা গুলোই তার মাথায় বাজছে। সামান্য এই টুকুনি একটা মেয়ের তার কথায় কি হয়েছে না হয়েছে তাতে কি এসে যায়। এরকম তো সে এর আগে এর চেয়ে বেশি কথা শুনিয়েছে অনেক মানুষকে। তবে যে কথা কুবরাকে বলাই হয় নি তবে কেন কুবরার কষ্টে তার কষ্ট হচ্ছে।

একপাশে বিশাল ঝাউবন আরেক পাশে অসীম সমুদ্র। মাঝখানে নিরবে হেটে চলেছে দুটি চঞ্চল মনের নীরব দুটি মানব।

সাদাফঃ আসলে জানো আমার ছোট বেলা থেকে কোনো মেয়ে বন্ধু ছিলো না। ছেলে বন্ধু ও যা আছে তারা গুটিকয়েক। নাদিম ই আমার একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড একমাত্র ভাইয়ের মতো। কলেজে উঠার পরেও আমার বান্ধবী বলতে কেউ ছিলো না। সবাই বন্ধুত্বের চেয়ে প্রেম করতে বেশি চাইতো। বরাবরই আমার মেয়েলি বিষয় একদম ভালো লাগতো না। তবে যেদিন আমি এক অদ্ভুত কোমল মায়াপরীর সাথে ধাক্কা খেয়েছিলাম সেই ধাক্কাটাই আমার জীবনের মোড় অন্যদিকে করে দেয়। সময়ের সাথে আমার তার সাথে দেখা হয়, বন্ধুত্ব হয়, পরে আবার ভালো আলাপ ও হয়। আর সেটা কে জানো শুভি??
সাদাফ এবার শুভ্রার সামনে এসে হাটু গেড়ে বসে বলে,
“” তুমিই আমার সেই মায়াপরীর রাজকন্যা। তুমি আমার জীবনের প্রথম বান্ধবী, প্রথম আকর্ষণ, প্রথম অনুভূতি, প্রথম আবেগ আর প্রথম ভালোবাসা। শুভি আমি তোমায় সারাজীবন আমার পাশে আমার করে নিতে চাই। তোমার সুখ দুঃখ সব কিছু ভাগ করে নিতে চাই। উইল ইউ ম্যারি মি, শুভি ?? “””

সাদাফের হঠাৎ এমন কথায়, কি উত্তর দিবে শুভ্রা নিজেও ভেবে কুল পাচ্ছে না। ভেতর দিয়ে সব অচল হয়ে আসছে। এটা সে ঠিক শুনছে তো? কোনো মতে নিজেকে সামলে বসে শুভ্রা।

শুভ্রাঃ মি.চৌধুরী আমি মোটেও আপনার উপর রেগে কিংবা কারো সাথে জেলাস করছি না। আপনি এসব কি উলটা পালটা কথা বলছেন? মাথা ঠিক আছে আপনার।

সাদাফঃ শুভি আমি মোটেও মজা করছি না। আমি জানি তুমি যথেষ্ট একজন ধার্মিক মেয়ে। যার কারনে আমাকে তুমি এভয়েড করেই চলো৷ যথারীতি খুব কম ই কথা হয় দেখা হয় আমাদের। আমি এও জানি তুমিও আমায় ভালোবাসো শুভ্রা।আমি চাই আমাদের সম্পর্কটাকে হালালে পরিণত করতে। এভাবে তোমার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতে আমার আর মোটেও মন চাইছে না শুভি।

শুভ্রা সাদাফের কথার প্রতিউত্তরে কি বলবে সেটারই কুল পাচ্ছে না। তবে মনে মনে খুব খুশি লাগছে যে সাদাফ তাকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চায়। সম্পর্ককে সম্মান করে বলেই তো সে বিয়ে করতে চায়। আর কজনে তা পারে। শুভ্রা শুধু নিরবে মিটিমিটি হাসে।

🌃🌃🌃

সন্ধ্যায় সাদাফ আর শুভ্রা বাড়ি ফিরে দেখে ইলিয়ানা, ইলিয়ানার মা আর ভাই এসেছে। সাদাফকে দেখা মাত্রই এলিয়ানা যখন জড়িয়ে ধরতে আসে তখনই সাদাফ শুভ্রাকে সামনে এনে দাড় করিতে দেয়। যার কারনে ইলিয়ানা শুভ্রাকে জড়িয়ে ধরে।

ইলিয়ানাঃ উহহহ স্যাডি। এতো গেম কি করে খেলতে পারো তুমি? সবসময় এমন কেন করো বলতো?

সাদাফঃ কারন আমার এসব ভালো লাগে না। আর যেখানে আমার ফিয়েন্স আছে সেখানে আমি কি করে অন্য মেয়েদের সাথে হাগ করতে পারি বলোতো?

ইলিয়ানাঃ হুয়াট রাবিশ স্যাডি? ফিয়েন্স মানে? আমিই তো তোমার উড বি।তুমি এসব কি বলছো।

সাদাফঃ দেখো ইলিয়ানা আমি তুমায় ছোট বেলা থেকেই বোনের নজরে দেখেছি। আর আমি কিংবা আম্মু কোনো দিন তো বলিনি তোমার আর আমার বিয়ে সম্পর্কে কোনো কথা। তাহলে এসব বলো কেন? আর আমার ফিয়েন্স হলো আমার পাশের এই মেয়েটি। যাকে আমি মন প্রান দিয়ে ভালোবাসি। ( শুভ্রাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে) ।

এদিকে ড্রইংরুমে বসা বাড়ির সকলেই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে শুভ্রা-সাদাফের দিকে আর তাকিয়ে তাকিয়ে শুনছে তাদের কথা।

ইলিয়ানাঃ মম, মামনি দেখো স্যাডি কি সব বলছে। (ন্যাকা কান্না করে)

সাদাফঃ আম্মু আর কি বলবে। আম্মু আব্বু নিজেই তো আমার আর শুভ্রার বিয়ে ঠিক করেছে।

সাদাফের কথা শুনে সাদাফের মায়ের চোখ গুলো বের হয়ে আসার উপক্রম। ছেলে তার কি বলছে এসব। মি.মঞ্জুর সাহেদ শান্তই আছেন।

ইলিয়ানাঃ মামনি, বাবাই এটা একদম ঠিক না। তোমরা জানো আমি স্যাডি কে কত্তো ভালোবাসি।

ইলিয়ানার মাঃ কি রে মালিহা কি বলছে সাদাফ এসব। তুই ওর বিয়ের কথাবার্তা সেরে ফেললি আর আমাদের ও একটু বললি না।
মিসেস মালিহা বোনের প্রশ্নের প্রতিউত্তরে কি বলবে তার কিছুই ভেবে পাচ্ছেন না। তবে তিনি মনে মনে বেশ নিশ্চিন্ত যে সাদাফ শুভ্রাকে বিয়ে করতে চাইছে। আর তিনি এও বুঝেছেন যে ইলিয়ানার হাত থেকে বাচার জন্যই সাদাফ এখন সব খুলামেলা ভাবে বলে দিচ্ছে।

শুভ্রার তো ইচ্ছে করছে ফ্লোর ফাক করে সেখানে ঢুকে পড়তে। তার মা আর বোন উৎসুক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। লজ্জায় তাদের দিকে তাকাতেও পারছে না।

ইলিয়ানাঃ এই মেয়েটাও তো তোমার কাজিন হয়। তার মানে সেও নিশ্চয় তোমার বোনের মতো। তাহলে তাকে কেন বিয়ে করছো স্যাডি।

সাদাফঃ শুভ্রা আর তোমার অনেক পার্থক্য। শুভ্রা আমার কাজিন হওয়ার আগে সে আমার ভালো বন্ধু ছিলো। আর একজন ভালো বন্ধু অবশ্যই একজন ভালো লাইফ পার্টনার হতে পারে।
#চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here