অচেনা তুমি পর্বঃ২৫

0
1805

#অচেনা_তুমি
#লেখিকাঃমহিমা_হাছনাত_মাহি।
#পর্বঃ২৫

দেখতে দেখতে ঘনিয়ে আসে সেই আকাঙ্ক্ষিত দিনটি। সারা বাড়িময় মেহমান ভর্তি হৈ-হুল্লোড়। বাড়িময় ছোট ছোট বাচ্চাদের দৌড়া দৌড়ি আর খিলখিল হাসিমায় পরিবেশ। আত্মীয় স্বজন সকলেই এতো বছর পর শুভ্রার মা কে দেখে এবং ফিরে পেয়ে তাদের আনন্দ আর উৎসাহের ভার ধরছে না। তার চেয়ে বড় অবাক করা বিষয় হলো এতো বছর পর তাদের মনোবাসনা ঠিকই পূর্ণ হচ্ছে।

আজ সাদাফ আর শুভ্রার গায়ে হলুদ আর মেহেন্দি। এর দু-তিন দিন আগে থেকেই বাড়িতে সকল মেহমান ভরতি। সাদাফ দের বাড়ি এবং ছাদ যথেষ্ট বড়। তবুও তার বাবা মায়ের ইচ্ছে ছেলের বিয়ে যেন গোটা ঢাকা শহরে টনক নাড়িয়ে দেওয়া।

ঢাকার সবচেয়ে বড় কমিউনিটি সেন্টার টা বুক করা হয়েছে তাদের জন্য। প্রায় তিন দিনআগে থেকে সাজাতে লেগে গিয়েছে লোকেরা। দেশের টপ বিজনেস টাইকুন দের মধ্যে সাদাফের মতো একজন এর বিয়ে বলে কথা!!

দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর মেয়েরা সকলে একে রেডি হয়ে নেয় সাজতে বসার জন্য। কারন এখন সাজতে বসতে দেরী হয়ে গেলে সন্ধ্যা পার হয়ে যাবে কম্পলিট হতে হতে। প্রথমেই সাজতে বসবে বাড়ির মেইন তিন সদস্য সুভ্রা,কুবরা আর ইলিয়ানা।

আজকাল ইলিয়ানা খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। ঐদিনের ঘটনার পর থেকে নিজেকে যথাসম্ভব রুমে গুটিয়ে রাখার চেষ্টা করে। সবসময় দরজা বন্ধ রেখে নিজেকে বন্দী করে রাখে। কারো সাথে কোনো কথা বলে না। তার রুমে গিয়ে তার মা বাবা ভাই কথা বলে। বার বার চলে যেতে চাইলে জিজ্ঞেস করলে আর কারন বলে না। বিশেষ করে তো সাদাফ আর শুভ্রার সাথে সেদিনের পর থেকে দেখা ও করে নি কথা ও বলে নি। ইলিয়ানার এই বদলে যাওয়া শুভ্রাকে খুব ভাবাচ্ছে দিন কে দিন। তবে কি ইলিয়ানা মনে মনে অনুতপ্ত বোধ করছে? নিজের মনে অনু সুচনা হচ্ছে বলেই কি সকলকে এভাবে এড়িয়ে চলছে?

সাজার সময় শুভ্রা আর কুবরা ভেবেছিলো সাজের ব্যাপার হলে ইলিয়ানা দৌড়ে দৌড়ে চলে আসবে। তবে ডাকতে যাওয়ায় সে নাকি তার মাকে মানা করে দিয়েছে।

শুভ্রা এবার আগে যা হয়েছে সব ভুলে বাদ দিয়ে ইলিয়ানাকে ডাকতে যায়। যতোই হোক বড় বোন তো হয় তার। বড় বোনের উপর রাগারাগি কিসের? ঝুকের বসে না হয় ভুল করেই ফেলেছে।

ডাকতে গিয়ে দেখে ইলিয়ানার বাবা ইলিয়ানার রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন। দরজা তখন খোলা ই ছিলো। শুভ্রা আজ দরজায় নক না করেই দরজা ঠেলে মুখ ঢুকিয়ে ইলিয়ানাকে দেখে একদন্ধ পুরাই অবাক।

এই প্রথম ইলিয়ানাকে সেলওয়ার কামিজ পড়া মাথায় কাপড় দেওয়া দেখছে সে। আগে যেমন সুন্দর লাগতো তার চেয়ে ডাবল সুন্দরী লাগছে তাকে।

শুভ্রাঃ আপু…..

ইলিয়ানা কাপড় ভাজ করছিলো। কারো কন্ঠ শুনে মুখ তুলে দেখে শুভ্রা দরজায় দাড়িয়ে আছে। শুভ্রাকে দেখে ইলিয়ানা নিজেই ইতস্তত বোধ করছে।

শুভ্রাঃ সাজগোজ শুরু হয়ে যাবে আপু। তুমি সাজবে না?
ইলিয়ানাঃ না আমি সাজবো না। তুমি যাও। তোমার তো লেট হয়ে যাচ্ছে।

খুবই নরম স্বরে শুভ্রাকে ইলিয়ানা কথাটা বললো। ইলিয়ানার এমন অস্বাভাবিক আচরনে শুভ্রা হা হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

ইলিয়ানাঃ শুভ্রা একটা কথা বলবা? তুমি কি এখনো ঐদিনের ঘটনার উপর রেগে আছো? অবশ্য রেগে থাকারই কথা। কতো বড় জঘন্য কাজ ই বা আমি করতে যাচ্ছিলাম সেদিন। এছাড়াও এর আগেও তুমি আমাকে খারাপ কাজ করতে দেখেছিলে ( মাথা নিচু করে)

শুভ্রা একের পর এক শুধু ইলিয়ানা থেকে আগত ধাক্কা খাচ্ছে। এ কোন ইলিয়ানাকে দেখছে সে? কদিন আগেও যার সাথে তুমুল পরিমানে ঝামেলা হয়েছিলো, এই কে সে??

ইলিয়ানাঃ আমি জানি আমি আমার পাপের জন্য ক্ষমার অযোগ্য। আমি জানি আমি তোমার সাথে বড় অন্যায় করে ফেলেছি। আমি নিজেও নিজের জীবনে আরো বড় বড় অন্যায় করেছি। আমি এখন বুঝতে পারছি যে পার্থিব জীবনে কতো বড় বড় পাপ করেছি। শুভ্রা তুমি প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দাও। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আমি তোমার সাথে অনেক খারাপ কাজ করে ফেলেছি।

শুভ্রার বিশ্বাসই হচ্ছে না যে এসব ইলিয়ানা বলছে। সে এখনো ঠায় ইলিয়ানার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। কথা বলার সময় ইলিয়ানার চোখ দিয়ে গড় গড় করে পানি পড়ছে। তার চোখের ভাষাই বলে দিচ্ছে যে সে কোনো মিথ্যা অভিনয় করছে না। তবে কি সে সত্যিই অনুতপ্ত?

ইলিয়ানাঃ শুভ্রা চুপ করে থেকো না। কিছু তো বলো আমায়।

শুভ্রাঃ আপু তুমি ঠিক আছো? সত্যিই তুমি মন থেকে বলছো তো?

ইলিয়ানাঃ আমি জানি আমার কথা তোমার কিংবা অন্যকারো বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে আমি যতোদূর সম্ভব নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছি। আমি আর তোমাদের দুজনের মাঝে সমস্যা সৃষ্টি করবো না। এই দেখো আমি আমার কাপড় চোপড় সব গুছিয়ে ফেলেছি। আজই আমি চলে যাবো। আমি আর আমার মুখ কাউকেই দেখাবো না। তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো শুভ্রা। ( শুভ্রা হাত দুটি ধরে)

শুভ্রাঃ আপু তুমি যে নিজের ভুল টা বুঝতে পেরেছো এটাই অনেক। আর আমি তোমায় ক্ষমা করার কে? হ্যা ঝুকের বশে তুমি অনেক অনেক অন্যায় আর খারাপ কাজ করেছো। কিন্তু তুমি তো এখন সেটা রিয়েলাইজ করতে পারছো? তুমি যদি সাফ মনে রবের সামনে হাজির হউ, নিজের অনুতপ্ততা পেশ করো, এবং ক্ষমা প্রার্থনা করো নিশ্চয় তোমায় মাফ করে দিবেন। আর চলে যাবার কথা আসছে কোথা হতে? আমরা সবাই জানি তুমি কেমন, না হয় ভুল করেই ফেলেছো আর কি। তাই বলে নিজেকে চারদিক থেকে এভাবে গুটিয়ে নিবে? একবার যখন ভুল করে ফেলেছো তখন ঠিকি যদি শুধরে যেতে চাও তাহলে ভয়ের কিংবা পালানোর কোনো দরকার নেই।

ইলিয়ানাঃ কিন্তু শুভ্রা আমি চাই না……

শুভ্রাঃ আর কোনো কিন্তু না। চলো সাজবে চলো। আজ সবাই নতুন ইলিয়ানাকে দেখবে। নতুন রুপে।

ইলিয়ানার নিজ চোক্ষে বিশ্বাস হচ্ছে না যে এই মেয়েটার সাথেই কদিন আগে সে কতো খারাপ ব্যবহার করেছিলো। তার জায়গায় সে হলে তো হয়তো কখনোই ক্ষমা করতো না। অথচ আজ সে তার বিয়েতে নেই বলে নিজে এসেছে ডাকতে। তার উপর কতো সুন্দর বিনয়ের সাথে কথা বলছে, যেন আগে তাদের মধ্যে কোনো ঝামেলাই হয় নি।

ইলিয়ানাঃ শুভ্রা সবাই সত্যিই কথাই বলে জানো? তুমি আসলেই খুব ভালো মেয়ে। আজ বুঝতে পারছি স্যা.. না সাদাফ ভায়া তোমায় কেন এতো ভালোবাসে।

শুভ্রাঃ তুমি নিজেও জানো না তুমি নিজেই কতো ভালো মানুষ। আজ তোমার মন ভালো বলেই তো তোমার মনে তোমার পুর্ববর্তী কর্মের জন্য অনুসুচনা হচ্ছে। তুমি যদি এখন থেকে সঠিক রাস্তায় চলতে পারো তাহলে আমার চেয়েও ভালো মানুষ হতে পারবে। আমার চেয়েও বেশি মানুষ তোমায় ভালোবাসবে। দেখে নিও।

ইলিয়ানাঃ আচ্ছা আচ্ছা পাকা বুড়ি একদম। তোমার কিন্তু আমায় ট্রেনিং দিতে হবে বুঝেছ? আমি তো আর তোমার মতো ইসলামিক বিষয়ে জানি না। আমি না হয় সব তোমার কাছ থেকেই শিখবো সব।

শুভ্রাঃ সে না হয় সময় আছে। কিন্তু এখন চলো। রেডি হবে।

ইলিয়ানাঃ বলছি শুভ্রা তুমি চলে যাও। আমার না তেমন সাজতে ইচ্ছে করছে না। আর আমি তো সাজতে পারি। আলাদা পার্লারের লোকেদের কাছ থেকে সাজার দরকার নেই। এখন তুমি যাও তো লেট হয়ে যাচ্ছে তোমার। দেখো বিকের পেরিয়ে গেলো কথা বলতে বলতে।

শুভ্রা আর কোনো রকম ভাবেই ইলিয়ানাকে সাজাতে নিয়ে আসতে পারলো না। অগত্যা তাকে খালি হাতেই ফিরে যেতে হলো। তবে মনে মনে সে খুব খুশি ইলিয়ানার এমন পালটে যাওয়া দেখে। অবশেষে আল্লাহ তাকে হেদায়েত দিলেন।

শুভ্রা, কুবরা আর বাকি কজন কাজিন বাড়িতে সাজবে আর বাকি সবাই পার্লারে চলে গিয়েছে সাজতে। যেহেতু বাড়িতে মেহমান ও ভরতি, তার উপর বাড়িতে এতো লোক সাজানোর জায়গা ও কম।

সন্ধ্যা ৭ টা বাজে প্রায়। ছেলেদের সকলেই অলরেডি কমিউনিটি সেন্টারে চলে এসেছে। তবু এখনো মেয়েরা কেউ আসে নি। এদিকে সাদাফ আর নাদিম মনে মনে হাসফাস করছে কবে তাদের প্রিয়তমাদের আগমন হবে।

নাদিমঃ ধুর মিয়া। এতোক্ষন লাগে নাকি হ্যা?? সেই কবে দুপুর থেকে রেডি হতে বসেছে এতোক্ষন লাগে সাজতে?

সাদাফঃ ঠিকি ভাই। এতোক্ষন লাগে নাকি একটু সাজার জন্য!!!

তারপর নাদিম একটা “চ” বোধক আওয়াজ করে।

সাদাফঃ এই দাড়া দাড়া। আমি নাহয় আমার বউকে দেখার জন্য ছটফট করছি। তা তোর এতো ছটফটানি কিসের হ্যারে?? ( ভ্রু কুচকে)

নাদিমঃ ম.. ম্মা. মানে??? কি বলছিস তুই? আমি ছটফট কই করছি আজব তো? আমি বললাম যে,, ,, এ,,

সাদাফঃ এ…. যে… হ্যা….. তার… পর…. কি……??

নাদিমঃ ধুর বাল। সাদাইপ্পা বিয়ের দিন ও গালি শুনা থেকে বাদ যাবি না তুই? উলটা পালটা কোনো কথা মিন করবি না কিন্তু তোর বউ আসতে দেরি কেন হচ্ছে তাই জন্যি বললাম যাস্ট।

সাদাফঃ শুধু কি আমার বউ নাকি তোর ও কেউ? ( এক ভ্রু তুলে)

নাদিমঃ মানে?? এই বাইক্কা কথা বলিস না কিন্তু বলে দিচ্ছি।

সাদাফঃ নাদিম্মা তুই কত্তোবড় বাটপার একবারও ভেবে দেখেছিস? ভাই আমি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড। তোকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। আর ইদানিং যে আমি তোকে লক্ষ্য করিনি এটা মোটেও বলবো না। এতো ব্যস্ততার মধ্যেও প্রতিদিন কি শুধু আমার জন্যই তুই বাড়ি আসিস। আর কিছুর জন্যেও না?

নাদিমঃ ভাই এ..এসব তুই কি বলছিস?? বিয়ের চক্করে মাথার স্ক্রু কি ঢিলা হয়ে গেলো নাকি রে তোর? আর আবার কি হবে?

সাদাফঃ ওরে নাদু…… তুমি যে আমার বনু কুবরাকে ভালোবাসো…. সেটা আমি বুঝে গিয়েছি বুঝছিস বেডা??? আমি কিন্তু শপিং মলে ভালো করেই অবিরের প্রতি তোর জেলাস দেখেছি। ব্যাপার টা সামলানোর জন্যেই আমি মাঝখানে গিয়েছিলাম। আর তুই যে আবির কে জেলাস করিস তাই তো অফিসে না থেকে দৌড়ে আমার বাড়ি চলে আসিস। আমি বুঝি না মনে করেছিস নাকি??

নাদিমঃ ভাই তুই কি রে?? তোর কাছ থেকে কি আমি কোনো দিনও কিছু লুকিয়ে রাখতে পারবো না? ভাই আমার ভয় পেয়েছিলাম। আমি নিজেও জানি কবে আমি ওই ঝগরুটে মেয়েটার প্রেমে পড়ে গিয়েছি। কবে এতো মারাত্মক মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছি। তবে আমি জানি আমি ওকে ছাড়া সত্যি সত্যিই বাচবো না। আমি ভেবেছিলাম আমার মতো সে ও আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু আবির আসার পর থেকে কেমন জানি পালটে গেছে। আমার খুব ভয় হয়। তার উপর তুই তো শুরু থেকেই আমাকে কোনো দিন প্রেম ভালোবাসা তে সাপোর্ট করিস নি। টাইম পাস যা করতা। তার জন্য তো ২৪ ঘন্টা প্লে বয়, প্লে বয় করতি। আর এখন তো এটা তোর বোন রে। তোকে বললে নিশ্চয় তুই আমার সাথে আর সম্পর্কই রাখতি না। তাই আমি আর কিছু বলি নি।

সাদাফঃ ওরে তোর আর আমার সম্পর্ক কি এতোই ঠুনকো যে সামান্য কারনে নষ্ট হয়ে যাবে? তুই আর আমি তো আজীবন এরকম বেস্ট ফ্রেন্ড থাকবো। তবে একটা কথা আমার বলতেই হবে আমার বোনটা এই প্লে বয় কে কি করে নিজের বশে আনলো বল তো। তুই তো পুরা সাধু হই গিয়েছিস। মানতে হবে আমার বোনের দম আছে বইকি।

নাদিমঃ মাথা আছে। আমি নিজেই কনফিউজড যে তোর ওই বইন আসলে আমাকে ভালোবাসে কি না? মাঝে মাঝে তো কিছু কথা আর ব্যবহারে আমি তো অন্য জগতে হারিয়ে যায়। আর বাকি সময় তো শুধু ঝগড়া করে।

সাদাফঃ আরে এটাই তো কেমেস্ট্রি রে
ভালোবাসা যে কতো প্রকার ও কি কি তা তো প্রত্যেকের জীবনে একেক রকম।

নাদিমঃ এহহহ আইছে মিয়া 😏😏। দুদিন আগেও যে প্রেম নিয়া কিছু বুঝতো আজ সে আমারে জ্ঞান দিচ্ছে।

এরপর দুজনেই একসাথে দমফাটা হাসিতে মেতে উঠে।

#চলবে

( সবাই দেখছি নাদিম আর কুবরার কেমেস্ট্রি নিয়ে ডেস্পারেট বেশি। শুভ্রা আর সাদাফের থেকে তো দেখি তারাই বেশি প্রিয় আপনাদের। তবে অপেক্ষা করুন পরবর্তী পার্টে তাদের নিয়েই আসছে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here