অচেনা তুমি পর্বঃ৪০

0
1970

#অচেনা_তুমি
#লেখিকাঃমহিমা_হাছনাত_মাহি
#পর্বঃ৫০

“মেয়েটা যাওয়ার পর থেকে বাড়িটাই নিঝুম হয়ে গেলো। ”

সবাই চুপচাপ। ডাইনিং এ বসে আছে সাদাফের মা বাবা, ইলিয়ানা, তার মা, আবির, শুভ্রার মা, পারভেজ তার মা আর সাদাফ – শুভ্রা। কুবরা চলে যাওয়ার পর পুরো চৌধুরী পরিবারেই নিরবতার ছায়া এসে বসেছে। সকলে চুপচাপ আর শুভ্রার মা তো কাল রাতে মেয়েকে মিস করতে করতে ঘুমুতেই পারে নি। এক মেয়েকে শশুর বাড়ি দিয়ে ও কাছাকাছি আছে। তবে আরেক কলিজার টুকরা তো অনেক দূরে চলে গেলো। যদিও কিছুক্ষন আগে ফোন দিয়ে কুবরা সবার সাথে কথা বলে। কিন্তু তার মা নিজের ভেতরের অব্যাক্ত অনুভুতি লুকিয়ে রেখে হাসিমুখে কথা বলেছেন।

কথা শেষে নিঝুম হয়ে যাওয়ার কথাটা সাদাফের মা বলে উঠে।

ইলিয়ানার মাঃ ঠিকি বলেছিস। মেয়েটা সারাক্ষন কতো হৈ-হুল্লোড় করতো। একদম মাতিয়ে রাখতো।

পারভেজের মাঃ তা যা বলেছেন। ছোটবেলা থেকেই মেয়েটা এমন ছটফটে ছিলো। যেখানেই যাবে সেখানেই মাতিয়ে তুলবে ছোট বড় সকলের সাথে।

সাদাফের মাঃ এমনিতে মেয়েটা চলে গেলো তার উপর কোনো দরকার আছে আজই আপনাদের চলে যাওয়ার? আর এই ছোট তুই ও চলে যাচ্ছিস কেন বল তো এতো তারাতাড়ি?

পারভেজের মাঃ না না সে কি করে হয়। এর আগের বারেও শুভ্রার বিয়েতে যখন এসেছিলান তখন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আপনাদের বিরক্ত করেছি। এবার নাহয় আর জোর করবে।

ইলিয়ানার মাঃ হ্যা ঠিকি। তাছাড়া আবিরের আব্বু তো ওখানে। আমরা যদি আজ থেকে যাই উনি তো ওখানে একা হয়ে যাবেন।

সাদাফের মাঃ এরকম কেন করছিস। সবে তো বিয়েটা শেষ হলো। এই মালিহা কিছু বল না।

শুভ্রার মাঃ আর দু এক দিন বেরিয়ে গেলে হয় না আপা? ওখানে তো একাই থাকেন। আমাদের সাথে সময় কাটালে তো ভলোই হবে৷

পারভেজঃ না না আন্টি প্লিজ জোর করবেন না। তাছাড়া আমি আজকের ফ্লাইটের টিকিট ও বুক করে রেখেছি। দেখুন এই মাসের পর আগামী মাসের শুরুর দিকে আমার চলে যেতে হবে। আর তো মাত্র ১৯/২০ দিন আছে। আমরা এখানে থেকে গেলে কি করে হবে। তাছাড়া শুধু আমরা বেড়ালেই কি হবে? সেই কবে নিজেদের পুরোনো ভিটে ছেড়ে চলে এসেছেন আমি চলে যাওয়ার আগে একবার কি ঘুরে আসবেন না?

পারভেজের চলে যাওয়ার কথা শুনেই সামনে উপস্থিত ইলিয়ানার ভেতরে কেমন মুচড়ে উঠে। মনের মধ্যে কেমন এক ভয় কাজ করা শুরু করে দেয়। তবে এই ভীতি কি জন্য তার নিজেরও অজানা। কিন্তু যতোবার পারভেজ চলে যাওয়ার কথা বলে ভেবে উঠলেই মনের ভেতরে কেমন হু হু করে উঠে।

সাদাফের মাঃ ঠিক আছে। যখন এভাবে বলছো আর জোরাজোরি করছিনা। তবে এটা শিউর থাকো যে এই বছর শীতকালের পিকনিক শুভ্রাদের আগের বাড়ি মানে পারভেজদের ওখানেই হবে। কি বলেন আপা?

পারভেজের মাঃ বেশ তো এই বছর ছেলে মেয়ে সকল কে নিয়ে এক সাথে বড় করে চড়ুইভাতির আয়োজন করবো। এই যে ইলিয়ানার আম্মু আপনাদের ও আসা চাই ই চাই তখন।

ইলিয়ানার মাঃ এসবের মাঝে আমরা কেন আবার আপা… আপনারা পরিবার স্বজন মিলে….

পারভেজের মাঃ ওমা আপনারা কি পরিবার নই নাকি? চাইলে কিন্তু আমরা সহজেই আত্মীয়তার বন্ধন দৃদৃঢ় করতে পারি। দেখা যখন হয়েছে তখন ইনশাআল্লাহ বার বার হবে। আর হ্যা মনে পড়েছে আপনার নাম্বার টাও আমাকে একটু দিবেন। যতোই হোক অন্তত আমরা হলে একই জেলাতে থাকি।

পারভেজের মা কথার ছলে ইলিয়ানার মাকে একটা অন্যরকম ইঙ্গিত দিয়েছে। কিন্তু কথাটা যেন সহজ সরল ইলিয়ানার মায়ের মাথার উপর দিয়ে চলে যায়। কিছু ভেবে উঠার আগেই আগে নাম্বারটা পারভেজের মা কে সেইভ করে দেয়।

পারভেজঃ ১১ টা বাজলো বলে ( ঘড়ি দেখে) নিয়ম মোতাবেক ফ্লাইট তো ১২ টায়। আমাদের এক্ষুনি রওনা না দিলে দেরি হয়ে যাবে অনেক।

সাদাফঃ আচ্ছা তাহলে চলো আমি অফিসে যেতে যেতে তোমাদের এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে আসি।

এরপর সকলেই তোরজোর করে রেডি হয়ে নেয় চলে যাওয়ার উদ্যেশ্যে। যাওয়ার সময় সকলেই সকলের সাথে কোশল বিনিময় করে আর বেড়াতে যাওয়ার কথায় বলে বিদায় জানায়।

গাড়িতে চলছে আপন গতিতে। এমন শীতের সময় গাড়ির ভেতরে ভ্যাপসা গরম। তার উপর ঢাকা শহরে নিত্য দিনের যানজট ত রয়েছেই। সাদাফ ড্রাইভিং সিটে, পাশে পারভেজ। আর তার পেছনের সিটে এক পাশে পারভেজের মা, মাঝখানে ইলিয়ানা আর অপর পাশে তার বসেছে। পেছনের সিটে আবির একা বসে গান শুনছে। মিনিট দশেকের মতো গাড়ি জ্যামে আটকে রয়েছে।

পারভেজ বসে থাকতে থাকতে বোর হয়ে উঠেছে প্রায়। এখানে সে যতোবারই বেড়াতে আসে ততোবারই অর্ধেক সময় এই জ্যামে পার হয়ে যায়। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হঠাৎ লুকিং গ্লাসে চোখ পড়তে দেখে ইলিয়ানা বিষন্ন চেহারায় লুকিং গ্লাসের মাধ্যমে তার দিকে তাকিয়ে আছে। পারভেজের চোখে চোখ পড়া মাত্রই অন্যদিকে তাকিয়ে ফেলে সে। বিষয়টা সে আসার সময় থেকে লক্ষ্য করেছে। যবে থেকে চলে আসার কথা উঠেছে তবে থেকেই ইলিয়ানার মুখটা কেমন ফেকাশে হয়ে গিয়েছে আর পারভেজের দিকেও কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকাচ্ছে বারবার।

এরপর গাড়ির জ্যাম ঠিক হয়ে গেলে দ্রুত শর্টকাট রাস্তা দিয়ে এয়ারপোর্টে চলে আসে সাদাফ।

এখনো ২০ মিনিট বাকি আছে। লাগেজ ব্যাগ প্যাক নিয়ে রেডি হয়ে তারা এয়ারপোর্টের ভেতর ঢুকে যায় আর সাদাফ ও তাদের বিদায় জানিয়ে অফিসের দিকে রওনা দেয়।

” আগামী মাসে তাহলে চলে যাবেন আপনি? ”

চেয়ারে বসে মোবাইল দেখছিলো পারভেজ। হাঠাৎ চেনা কন্ঠ কানে আসতে চোখ তুলে দেখে সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তি টি।

নিজেকে আর কোনো ভাবে আটকে রাখতে না পেরে অবশেষে মুখ ফুটে কথা বলে ইলিয়ানা। এতোদিনে পারভেজের সাথে তেমন একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে না উঠলেও অজান্তে দুজন দুজনের প্রতি মায়া বেড়ে উঠে। আজ যখন পারভেজের চলে যাওয়ার কথা শুনে, তখন অজান্তেই মনটা আনচান হতে শুরু করে।

পারভেজঃ হুম। এসেছিলাম তো মাত্র ৩ মাসের ছুটি নিয়ে অলরেডি ২ মাস ক্রস হয়ে গিয়েছে। চলে তো যেতেই হবে। আর তাছাড়া অনেক কাজ ও রয়েছে। এই বারে চলে গেলে সাথে আম্মুকেও নিয়ে যাবো।

ইলিয়ানাঃ আচ্ছা। আরো তো ১ মাস মতো বাকি আছে। এতো তাড়াহুড়ো না করলেও তো পারতেন। আরো কয়েকদিন বেড়াতে পারতেন।

পারভেজঃ তা অবশ্য ঠিকি বলেছেন। তবে এবার আম্মুর ইচ্ছে যেন একেবারে বিয়েটা করে নিই। প্রতেকবছর তো আমার আর দেশে আসা সম্ভব নই। আর আম্মুর ইচ্ছা ও দেশি মেয়ে বউ করে আনার। আর আমারও তো যথেষ্ট বিয়ের বয়স হয়েছে। যদিও আমার বিয়ে করতে তেমন ইচ্ছে নেই। তবু আম্মুর ইচ্ছে পূরণ করার জন্য চেষ্টা করবো।

পারভেজের বিয়ের কথা শুনে ইলিয়ানার মনে আরেকদফা ধাক্কা খায়। মনে মনে তাকে নিয়ে কেন এতো আশা সে নিজেও বুঝতে পারছে না। মায়ের মুখে একবার পারভেজ কে নিয়ে বিয়েভিত্তিক কথা শুনে মন যেন বার বার চাইছে যেন সেরকমই হোক। পারভেজের মত সচ্চরিত্রবান, স্মার্ট, ভদ্র, বড় কথা তার মা যথেষ্ট মিশুক আর পরহেজগার। কোনো না কোনো দিক দিয়ে বার বার তোর মনোযোগ আর চিন্তাভাবনা পারভেজের দিকে গিয়েই ঠেকে।

ইলিয়ানাঃ ও.. আচ্ছা.. তো পছন্দ…আছে কেউ..?( কাপা কাপা কন্ঠে)

ইলিয়ানার আহত সিক্ত কথা শুনে তার চোখে চোখ রেখে দেখে ইলিয়ানার চোখ যেন এয়ারপোর্টের জ্বলজ্বলে লাইটের আলোতে চিকচিক করছে। কন্ঠ শুনে আর চেহারার ভাব দেখে মনে হচ্ছে খুব উদাসীন। তবে কি বিয়ের কথা শুনে কোনো ভাবে সে কষ্ট পেয়েছে? কিন্তু ঠিক কোন কারণে কষ্ট পেতে পারে সে?

পারভেজঃ হুহ.. আমার আবার পছন্দ… ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে সারাজীবন পড়াশুনাই করে গেলাম। এদিক ওদিক বিষয়ে তেমন মন দিই ই নি বলতে গেলে। বিশেষত এসব মেয়েলি ব্যাপার স্যাপার। আর বেসিকেলি সে সব চিন্তাধারা আমার পছন্দসই নয়। আম্মু যা করবে তাতেই আল বি সো হ্যাপি।

পছন্দ নেই সেই কথা টা শুনে মনে যেন একটা স্বস্তির ঝলকা বাতাস বয়ে যায় ইলিয়ানার। তবে বিয়ের ব্যাপার নিয়ে মাথায় যেন তার নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।

ইলিয়ানাঃ তো কেমন মেয়ে আপনার পছন্দ। মানে কি রকম টাইপের… যেমন হলে আপনার ও সুবিধে হয়।

পারভেজ আজ যেন ইলিয়ানার আচার আচরণ, হাবভাব দেখে অবাক না হয়ে পারছে না। যে মেয়ে নিজ থেকে খুজে টু টি ও কথা বলতো না আজ সে কথা বলতে এতো উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। এতোদিন পারভেজ নিজ থেকে কথা বলতো। ইলিয়ানার কথাবার্তা চলাচল তাকেও যে আকর্ষিত করেনি এমন নয়। বারবার মন চাইতো তার সাথে দুদন্ড কথা বলতে। অথচ এতো বছরের জীবনে কোন নারীর সাথে কথা বলার জন্য এতো চেষ্টা করতো বলে তার মনে হয় না। তাও মুখ ফুটে পারভেজ কথা বললেই তবে ইলিয়ানা বলতো। আজ সে ইলিয়ানা কেমন আহত দৃষ্টিতে উদাসীন ভাবে কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে !!

পারভেজঃ এই ধরুন, ধার্মিক, ভদ্র, মিশুক, আমার আম্মুর খেয়াল যত্ন করবে, সংসারী না হলেও গোছানো সম্পন্ন, স্মার্ট হতে হবে অবশ্য গেয়ো নই, শান্ত । বলতে পারেন একদম আপনার মতোনই।

পারভেজের বলা প্রতিটা কথা যেন সে ইলিয়ানাকে উদ্যেশ্য করে বলছিলো মতোন। সব কিছুই তার সাথে মিলে যাচ্ছে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। শেষের কথায় যখন ইলিয়ানার মতোনই বলেছে তখন যেন তার মনে এক আনন্দের হাওয়া বয়ে যায়। তবে পারভেজের কথা মাথায় টনক নড়তেই খানিকটা ইতস্ততবোধ করে উঠে সে। পারভেজ ও তাই, কি বলতে কি বলে ফেলছে। এই মূহুর্তে দুজনেই পরম লজ্জার সম্মুখীন। কিছুক্ষণ পর এয়ারপোর্টে তাদের ফ্লাইটে এনাউন্সমেন্ট হতেই সবাই চলে যায় কক্সবাজারের উদ্যেশ্যে। ✈️✈️✈️

#চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here