#অনুভবের_প্রহর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___১৮
প্রথমবারের মতো ট্রেনে ভ্রমণ প্রহরের। উচ্ছ্বাসের সাথে সাথে আতংক শব্দটাও সমানহারে ছিল। তাছাড়া অনুভবের সাথে কখনো একা কোথাও যাওয়া হয়নি। মানুষটার অবহেলা সম্পর্কে তার পাকাপোক্ত ধারণা আছে। তার প্রতি যে মানুষটার অগাধ অনাগ্রহ, সেটা ভালোমতো জানা আছে বলে কিছুটা ভীত ছিল সে। কিন্তু স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছাতে অনুভব অভিভাবক ভূমিকা পালন করেছে। ট্রেনে উঠার সময় যখন ভিড় ঠেলে তার দু পাশে দু হাত রেখে অন্যদের ছিঁটেফোঁটা স্পর্শ থেকে তাকে বাঁচিয়ে রাখলো তখন সে অবাক না হয়ে পারেনি। আড়চোখে তাকিয়ে ছিল অনুভবের দিকে। তাকে আগলে রাখার আলাদা এক প্রতিক্রিয়া মানুষটার চোখে মুখে স্পষ্ট ছিল।
ট্রেন ছাড়তে ভাবনার জগত থেকে ছিটকে পড়লো প্রহর। আশপাশে এক নজর তাকিয়ে অনুভবের দিকে তাকালো। অনুভবের সম্পূর্ণ মনোযোগ ফোনের স্ক্রিণে নিবদ্ধ। চেহারায় কঠোরতার ছাপ। কুঁচকানো কপালের রেখা! অথচ প্রহর জানে এ-সব অভিনয়। এই কঠোর মূর্তির আড়ালে, ঠিক বুকের একটু গভীরে লুকিয়ে আছে অনুভবের আলাদা সত্তা। সম্পূর্ণ ভিন্ন, নরম এক অন্য সত্তা। যে সত্তা তাকে সর্বদা রক্ষার চিন্তায় থাকে। যে সত্তা তাকে সব বিপদ থেকে, সব বদ নজর থেকে আগলে রাখার প্রতীজ্ঞায় প্রতীজ্ঞা বদ্ধ।
আবছা আলোতে প্রহরের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। খুব কাছে আলাদা এক অনুভবকে আবিষ্কারের আনন্দে মন নেচে উঠলো। রাতের আলো আঁধারিতে অনুভূতিরা একের পর এক জড়ো হতে লাগলো। সবাই একত্রে ঘোষণা করলো, সে ভুল মানুষকে ভালোবাসেনি। ভুল ঠিকানায় জীবন সঁপে দেয়নি। কেমন ঘোরের মধ্যে চলে গেল সে। অনুভবের পানে চেয়ে থাকা দৃষ্টিতে ভর করলো মুগ্ধতা!
আচমকা অনুভব মাথা উঁচু করলো। ফোন থেকে চোখ সরিয়ে প্রহরের দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে কুঁচকানো কপাল আরো কুঁচকে গেল। ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় জিগ্যেস করলো, কোনো সমস্যা কি না! প্রহর দ্রুত ডানে-বামে মাথা নাড়লো। চেহারায় লজ্জার আভাস দেখা দিল। এক ঝটকায় মাথা ঘুরিয়ে জানালায় হেলান দিল। দৃষ্টি নত করলো উদ্দাম বেগে পেছনে ফেলে আসা প্রকৃতি পানে।
ট্রেনের লাইট বন্ধ। অনেকটা পথ যেতে হবে। বগির সবাই ঘুমাতে ব্যস্ত। অনুভব সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজলো। নিচু স্বরে একবার বললো,
‘পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় ভোর হবে। ঘুমিয়ে পড়ো প্রহর।’
প্রহর চমকে তাকালো অনুভবের দিকে। সে খেয়াল করেছে, অনুভব যতটা সম্ভব চেষ্টা করে তার নাম উচ্চারণ না করার। সেজন্য হুটহাট তার মুখে নাম শুনলে সে চমকে যায়। প্রহর একটু কাছ ঘেঁষে এলো অনুভবের। জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস আসছে। বাতাসে মাড়ি আটকে যাওয়ার উপক্রম। প্রচন্ড শীত! কিন্তু তার চোখে ঘুমেরা অধরা। সে শীতল স্বরে বললো,
‘ঘুম আসছে না আমার।’
অনুভব জবাব দিল না। বুকে হাত গুঁজে সটান হয়ে আছে সে। ফর্সা মুখোশ্রী অাবছা অন্ধকারে চকচক করছে। উন্মুক্ত ললাটে অল্প কিছু চুল লুটোপুটি খাচ্ছে। প্রহর হঠাৎ সুর পাল্টে বললো,
‘আমার সাথে সর্বদা শব্দ গুণে, অক্ষর গুণে কথা বলেন কেন বলুন তো? দু চারটে বাক্য বেশি বললে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে? বোবা হয়ে যাবেন আপনি? অদ্ভুত!’
অনুভব তবুও উত্তর দিল না। প্রহর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হঠাৎ দৃষ্টি গভীর করে বললো,
‘আমার শীত লাগছে!’
‘পায়ের নিচের আমার ছোট ব্যাগটাতে দেখো চাদর আছে। গায়ে জড়িয়ে নাও!’
অনুভবের জড়ানো কন্ঠ। কেমন ক্লান্ত শোনাচ্ছে। হয়তো আধো ঘুমে, আধো জাগরণে আছে মানুষটা। প্রহর আর ঘাটালো না। ফোনের আলো জ্বালিয়ে ব্যাগ থেকে চাদর বের করলো। কাজটা সে নিঃশব্দে করলো যাতে অনুভবের ঘুম ছুটে না যায়।
ট্রেন ছুটে চলেছে বাতাসের বেগে। দুপাশের বন-জঙ্গল, গাছপালা, লোকালয় দুপাশে ঠেলে ছুটে চলেছে নিজ গন্তব্যে। আকাশের ম্লান চাঁদটা আস্তে আস্তে কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে। প্রহর গায়ে চাদর পেঁচিয়ে অনুভবের আরো কাছ ঘেঁষে এলো৷ বাহুতে বাহু হালকা স্পর্শ হতে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো সে। মনে মনে অনুভবের ধমক শোনার জন্য প্রস্তুতিও নিল। কিন্তু কয়েক মিনিটের মাথায় ধমকের পরিবর্তে অনুভবের মাথাটা তার কাঁধে এলিয়ে পড়লো। ভূত দেখার মতো শিউরে উঠলো প্রহর। হিতাহিত বোধশূন্য হয়ে সরে যেতে নিতে অনুভব তার বাহু চেপে ধরলো। ঘুমজড়ানো কন্ঠে ফিস ফিস করে বলে উঠলো,
‘আমি ভীষণ ক্লান্ত প্রহর। কয়েক রাত হলো ঘুমাতে পারি না। একটু শান্তির ঘুম প্রয়োজন। কিছুক্ষণের জন্য তোমার কাঁধটা ধার দিবে? লেট মি স্লিপ অন ইয়্যুর শোল্ডার। প্লিজ!’
ক্ষণিকের জন্য প্রহরের হার্টবিট থেমে গেল। ঠোঁট জোড়া কেঁপে উঠলো। কোনো কথা বলতে পারলো না। আস্তে আস্তে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। অনুভবের হাতটা চেপে ধরে আরো একটু কাছে ঘেঁষে বসলো। চাদরের এক অংশ জড়িয়ে দিল গায়ে। অনুভব হালকা নড়েচড়ে নিজের অনেকখানি ভর প্রহরের কাঁধে ছেড়ে দিল। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রহরের উন্মুক্ত গলায় ঘুমন্ত অনুভবের নিঃশ্বাস আছড়ে পড়লো।
_________
অনুভবের যখন ঘুম ভাঙলো তখন প্রায় সকাল হয়ে গেছে। এক হাতের আঙুল দিয়ে চোখ মুছে বগির ভেতরটা পরখ করলো। সবাই এখনো গভীর ঘুমে। অতঃপর জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। চারিদিক ফর্সা হয়ে গেছে। তবে কুয়াশায় ঢাকা। প্রকৃতি থেকে চোখ সরিয়ে প্রথম বার তাকালো নিজের উপর। প্রহর গুটিশুটি মেরে তার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। অনুভব ঘুম ভাঙতেই বিষয়টা টের পেয়েছে। তার একটা হাত প্রহরকে সারা রাত নিজের সাথে পেঁচিয়ে রেখেছিল। অসাবধানবশত! অনেকটা অসতর্কতার জন্যই প্রহর তার এত কাছে৷ এর বেশি অসাবধান আর হওয়া যাবে না। তাকে আরো বেশি কঠিন হতে হবে। সতর্ক হতে হবে। প্রহরের অনুভূতির চারাগাছে জল ঢেলে তরতাজা করা যাবে না।
তবুও দ্বিতীয় বারের মতো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সে প্রহরের ঘুমন্ত মুখপানে তাকালো৷ তাকাবে না তাকাবে না করেও সুগভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। এতটা গভীরতা সে দৃষ্টির যে চট করে ভেতরটা পড়ে ফেলা যায়। ঠান্ডা হাতটা উঁচু করে সে কয়েক সেকেন্ডের জন্য প্রহরের গাল স্পর্শ করলো। মনে মনে আওড়াল,
‘প্রহেলিকা, তুমি মৃত্যু হও!
আমি সাদরে গ্রহণ করবো।
তুমি জীবন হইও না কিন্তু,
সেখানে আমি বহু আগেই পরাজিত।’
ঠান্ডা হাতের স্পর্শে প্রহরের দেহটা হালকা নড়ে উঠলো। অনুভব দ্রুত হাত সরিয়ে নিল। কিছুক্ষণ পর প্রহরের মাথাটা সিটে হেলানো অবস্থায় রাখলো৷ চাদরটা ভালো মতো জড়িয়ে দিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো। ফ্রেশ হতে হবে।
ট্রেনের বাথরুমের আশপাশে অনেক গুলো মধ্য বয়স্ক লোক বসে আছে। এই শীতের মধ্যে অনেকের গায়ে পর্যাপ্ত কাপড় নেই। অনুভব থমকে দাঁড়ালো কিছু সময়ের জন্য। ঘুমন্ত মুখ গুলোর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে নিজের ভেতর মায়ার উদ্রেক হলো। এই মায়া কার জন্য সে জানে না। নিজের জন্য নাকি এই মানুষ গুলোর জন্য? এই মানুষ গুলোর কিছু না থাকলেও অন্তত একটা অনিশ্চিত জীবন আছে। আর তার আছে নিশ্চিত মৃত্যু। তাহলে কে বেশি অভাগা? কে বেশি দরিদ্র? সে নাকি এই মানুষ গুলো? এই মলিন মুখের মানুষ গুলো তবু নিশ্চিন্তে স্বপ্ন দেখতে পারে। সেই স্বপ্নের পিছু ছুটতে পারে৷ অথচ সে কতগুলো বছর হলো স্বপ্ন দেখতে পারে না। স্বপ্ন দেখা ছাড়া একটা মানুষের বেঁচে থাকা কতটা কষ্টের তা এই মানুষ গুলো জানবে না। কখনো বুঝবে না! দিনশেষে হয়তো এই মানুষ গুলোই সুখী।
স্বপ্নের পেছনে ছুটে চলা এই সুখী মানুষ গুলোকে পিছু ফেলে অনুভব বাথরুমে ঢুকে গেল।
চোখে মুখে পানি দিয়ে সে সিটের কাছে এসে দেখলো প্রহর উঠে পড়েছে। মুখটা কেমন শুকনো শুকনো লাগছে মেয়েটার। সে ভালোমতো জানে প্রহরের এভাবে ট্রেনে ভ্রমণ করে অভ্যাস নেই। যদি কখনো শখের বসে করে থাকে, তবে প্রথম শ্রেণীর স্লিপিং বার্থ টিকেট সংগ্রহ করে। এভাবে নয়!
‘আর কতক্ষণ লাগবে পৌঁছাতে?’
প্রহরের ক্লান্তি আর ঘুমজড়ানো কন্ঠ কানে এলো অনুভবের। পাশে বসে বললো,
‘আধ ঘন্টার মতো। তৈরি হয়ে নাও।’
অনুভব কিছুক্ষণ উসখুস করে বলে ফেলল,
‘ওয়াশরুমে যাবে?’
প্রহর এদিক ওদিক মাথা দুলিয়ে বললো,
‘না!’
‘তাহলে এটা দিয়ে মুখ মুছে নাও।’
এতক্ষণ ডান হাতে লুকিয়ে রাখা ভেজা রুমাল টা বাড়িয়ে দিল অনুভব। প্রহরের জন্যই ভিজিয়ে নিয়ে এসেছিল। ট্রেনের এই নোংরা বাথরুম গুলোর প্রত্যক্ষ সাক্ষী প্রহরের না হওয়াই ভালো। সে ফের বললো,
‘কি হলো? দ্রুত মুখ মুছে নাও। ক্ষুধা লেগেছে? ট্রেন থেকে নেমে কিছু খেয়ে নিব।’
বাড়িয়ে রাখা রুমালের দিকে কিয়ৎক্ষণ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো প্রহর। পরমুহূর্তে দ্বিধান্বিত হয়ে রুমালটা হাতে নিল। ভেজা রুমালটা গালে স্পর্শ করে মুখে লুকিয়ে হেসে ফেলল।
__________
বেলা বয়ে চলেছে৷ কিন্তু সূর্যের মুখ এখনো দেখা যায় নি৷ চারিদিক এখনো কুয়াশাজড়ানো। গাছের সবুজ পাতা, গ্রাম্য ঝাউবন, আর রাস্তার দু ধারের সবুজ ঘাস শিশির বিন্দুতে একাকার। মাটির রাস্তায় সারা রাত শিশির জমে ভিজে আছে। অনুভবের কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো। হাতে প্রহরের ট্রলিটা উঁচু করে ধরে এগিয়ে চলে এসেছে। এক পলক পেছন ফিরে বললো,
‘সাবধানে হাঁটো। রাস্তা পিচ্চিল।’
অনুভবের কন্ঠ শুনতে পেলেও প্রহর কোনো প্রতিত্তর করলো না। সে চারপাশের প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত। গ্রাম্য শীতের সকাল অপরূপ সৌন্দর্য্য ধারণ করেছে। স্নিগ্ধ শীতল বাতাস নাসারন্ধ্র দিয়ে ঢুকে ভেতরটা নাড়িয়ে দিচ্ছে। ভেতরের সমস্ত ক্লান্তি, সব দুশ্চিন্তা, পাওয়া না পাওয়ার হাহাকার এক নিমিষে দূর করে দিচ্ছে যেন। প্রহরের এখন নিজেকে অনেক হালকা লাগছে। ফুরফুরে লাগছে। ভোরবেলার মাথা ব্যথাটাও একদম নেই। সে হাসি হাসি মুখে অনুভবের সামনে গেলো। অনুভবের দিকে তাকিয়ে উল্টো হয়ে হাঁটা শুরু করলো। হাঁটতে হাঁটতে বললো,
‘গ্রামে কতদিন থাকবেন অনুভব? আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে।’
‘সোজা হয়ে হাঁটতে থাকো। পড়ে যাবে কিন্তু। রাস্তা…….. ‘
অনুভবের বাক্য শেষ হওয়ার তর সইলো না। তার আগেই প্রহর ধাড়াম করে পড়ে গেল।
(চলবে)