ময়ূখ পর্ব-৫

0
2033

#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-৫

১৩.
ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনিতে ঘুম ভাঙে মৌনর। চোখমেলে নিজেকে একটা শক্ত বাঁধনে আবিষ্কার করে সে। পাশে তাকাতেই দেখে নিশ্চিত মনে ঘুমিয়ে আছে নিভৃত। মৌনকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রেখে গভীর ঘুমে সে।
মৌন নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে বসে।

বাথরুম থেকে অজু করে নামাজে বসে যায়। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে। কারণ নিভৃত নেশার ঘোরে থাকলেও তার উপর কোনো অধিকার ফলায়নি। আর মৌনও চায়না তাদের সম্পর্কের শুরুটা ভুল দিয়ে হোক।

নামাজ শেষে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে মৌন। নির্মল বাতাস মনকে পরিশুদ্ধ করে দিচ্ছে যেন। ফজরের নামাজের পরের সময়টা অসম্ভব ভালোলাগে মৌনর কাছে। চারপাশে যেন কেবল বিশুদ্ধতা আর বিশুদ্ধতা।

হঠাৎ মৌনের চোখ যায় দূরে রুহানির কবরটাতে। সামনে লালগোলাপ বাগান। প্রায় শতখানেক গোলাপ গাছ। সবুজের মাঝে ফুটে উঠা লাল গোলাপগুলোকে মনোমুগ্ধকর লাগছে। নাকে হালকা ভেসে আসছে কচি গোলাপের সুঘ্রাণ। মৌন শুনেছে রুহানি লাল গোলাপ অনেক পছন্দ করতো। বিয়ের পর নিজের হাতে এই গোলাপ বাগান করেছিলো সে। তাই নিভৃতের জেদের কাছে হার মেনে রুহানির কবর দেওয়া হয়েছে তার প্রিয় গোলাপ বাগানের কাছে। মৌন একমনে তাকিয়ে আছে কবরটার দিকে। মনে মনে বলছে,
‘আপু তুমি আমাকে ভুল বুঝোনা। আমি তোমার স্বামী,ঘর,পরিবার দখল করতে আসিনি৷ তোমার জায়গাটাও আমার চাইনা। আমি কেবল তোমার জায়গার পাশে ছোট করে একটু জায়গা চাই। বেশি না। একটু। তুমি কি রাগ করবে আপু?’

কোনো জবাব আসেনা। মৌন একধ্যানে কেবল তাকিয়ে থাকে।

______________

ঘুম থেকে উঠে রাতের কোনো কথাই মনে নেই নিভৃতের। অ্যাবসিনতের সবুজ পানির কড়া ডোজে সব ভুলে বসে আছে সে। ঘুম থেকে উঠে মাথা চেপে বসে রইলো খানিকটা সময়। আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে ঐ মেয়েটাকে খুঁজে পেলোনা সে। রুহানির হাসোজ্জল ছবিটার সামনে গিয়ে খানিকটা সময় তাকিয়ে রইলো। কথা বললো।

সোফায় বসে চা-বিস্কিট খাচ্ছে আর গল্প করছে সবাই। নাজমুল, মিরা, মিতু, রাতুল, দিলারা আর মৌন। আগামীকাল মিতু, রাতুল সিঙ্গাপুর চলে যাবে। তাই এই আয়োজন। যদিও ‘একগুচ্ছ সুখ’ নামক বাড়িটিতে প্রতিদিন সবাই মিলে সকালবেলা এভাবেই ব্রেকফাস্ট করতো। বিগত মাসগুলোতে সব কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিলো। রুহানির মৃত্যুতে সবাই অনেক কষ্ট পেয়েছে। তবে মৃত্যু হলো চরম সত্য। সবাইকেই একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। সময়ের স্রোতে একসময় ভুলে যেতে হবে সেই আপনজন হারানোর ব্যথা। পুরানো মানুষের স্থানে জায়গা করে নিবে নতুন মানুষ। হয়তো আগেরজনের মতো পারবেনা তবে আস্তে আস্তে গাঢ় করবে নিজের উপস্থিতি। মুক্ত অণু প্রাথমিক অবস্থায় ছুটাছুটি করলেও একসময় সেও স্থির হয়ে যায়। বন্ধনটা সমযোজী হোক কিংবা আয়নিক। একটা বন্ধনে বাঁধা পরে তারা। মানুষের বেলায়ও অনেকটা তাই। তারাও পরিবার চায়। স্থির হতে চায়। তাদের মনের দগ্ধ অনুভূতি কাটিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায়।

নিভৃত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসেছে। সবাইকে আবার আগের মতো ব্রেকফাস্ট করতে দেখে কিঞ্চিৎ ভালো এবং খারাপ মিলিয়ে একটা অনুভূতি হলো তার।

১৪.
তবে সবার মাঝে মৌনকে দেখে সহ্য হলোনা নিভৃতের। এই মেয়েটাকে তার স্বার্থপর ঠেকছে। বারবার মনে হচ্ছে এই মেয়েটা স্থান দখল করতে এসেছে। রুহানি নামক মানুষটাকে সবাই ভুলে যাচ্ছে। নিভৃতকে দেখে মিরা উঠে দাঁড়ালেন। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন,
‘বাবুই কফি খাবি?’

নিভৃত তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
‘কফি আমার গলা দিয়ে নামবেনা। ঐ মেয়েটাকে গেলাও।’

অতঃপর বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। উপস্থিত সবাই এতক্ষণ হাসিখুশি থাকলেও হঠাৎ করে যেনো একটা তিক্ততা এসে ভিড় করলো তাদের মাঝে।

______________

পেরিয়ে গেছে একটা মাস। মিতু, রাতুল চলে গিয়েছে সিঙ্গাপুর। মৌনের দিনগুলো একাই কাটে। মাঝেমধ্যে নিভৃতের সাথে ঝগড়া হয়। মৌন যে ছেড়ে কথা বলে তা কিন্তু নয়। মৌন নিভৃতের প্রত্যেকটা কথার জবাব খুবই পারদর্শিতার সাথে দেয়। সে তো কোনো ভুল করেনি। তাহলে নিভৃতের অহেতুক কথা কেন শুনবে। নিভৃতের মাঝে একটা জিনিসের উন্নতি হয়েছে সে আবার অফিস যাওয়া শুরু করেছে। এটা অবশ্য নিজের কষ্ট ভুলতে। নিজের মনের শান্তি জুগাতে সারাদিন কাজে ডুবে থাকে। আর রাতে মদ খেয়ে সেই মৌনের বুকে মাথা রেখেই ঘুমায়।

‘মৌন মা।’
‘জ্বি, বাবা।’
‘আজ বিকালে রেডি থাকিস। তোকে একটা কোচিংয়ে ভর্তি করিয়ে দিবো।’
‘আচ্ছা।’
‘তুই আর্টসে না?’
‘হ্যাঁ।’
‘পড়াশোনা কেমন লাগে তোর? জানিস আমি ছিলাম প্রচুর বাউণ্ডুলে। বাবা মেরে পড়াতেন। তারউপর আমার বাবা ছিলেন ব্যারিস্টার। বুঝতেই তো পারছিস কি কড়া!’
‘আমার পড়াশোনা খুবই ভালোলাগে। জানো বাবা আমার ইচ্ছে ছিলো সাইন্স নিয়ে পড়বো। তারপর বড় ডাক্তার হবো। ঢাকা মেডিকেল নিয়ে কত স্বপ্ন দেখতাম। তখন বাবার আর্থিক অবস্থা খারাপ। ছোটবোনদের খরচ। সবমিলিয়ে আর সাইন্সে পড়া হয়ে উঠেনি।’

মৌনের মনটা হঠাৎই খারাপ হয়ে গেলো। মানুষের কিছু কিছু চাওয়া মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অপূর্ণ থেকে যায়।

‘মন খারাপ করিসনা। ঢাকা মেডিকেলে পড়তে পারবিনা তো কি হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বি।’
‘হ্যাঁ। তুমি দোয়া করো বাবা।’
‘আমার দোয়া সবসময় থাকবে।’

মিরা ট্রেতে করে চা নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন। নাজমুল চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,
‘তোর শাশুড়ীমা কিন্তু এককালে ইডেন কলেজের শিক্ষিকা ছিলো। তুই কোচিংয়ের পাশাপাশি পড়াগুলো না বুঝলে তোর মাকে দেখাতে পারবি।’
‘আচ্ছা।’
‘এখনও সেই শিক্ষিকা ভাবটা যায়নি। সুযোগ বুঝে ফলিয়ে দেয়।’

কথাটা বলে আড়চোখে সহধর্মিণীর দিকে তাকালেন নাজমুল। যিনি চোখ লাল করে তাকিয়ে আছেন। মৌন হেসে কুটিকুটি। শশুড়-শাশুড়ীর দুষ্টু মিষ্টি সম্পর্কটা তার অনেক ভালোলাগে। মানুষগুলো বড্ড ভালো।

১৫.
‘এই মেয়ে তুমি আমার আলমারিতে নিজের জামা-কাপড় রেখেছো কেন?’
‘তাছাড়া কোথায় রাখবো?’

আলমারি থেকে মৌনর শাড়িগুলো নিচে ফেলে দিতে দিতে নিভৃত বললো,
‘প্রথম দিনই বলেছি। এইঘর কিংবা এই ঘরের কোনো জিনিসের উপর অধিকার দেখাবেনা।’
‘দেখুন আমার অধিকার দেখানোর কোনো ইচ্ছে নেই। আমি কাপড় কোথায় রাখবো? আপনিই বলেন?’

নিভৃতের প্রচুর রাগ লাগছে মেয়েটার উপর। মেয়েটা এতো বেহায়া! মৌন কাপড়গুলো তুলে আবার আলমারিতে রেখে দিলো।
‘আপনি যদি আবার আমার শাড়িগুলো ফেলে দেন। তাহলে আমি বাবাকে বিচার দিবো।’
‘হাহ্৷ আমি খুব ভয় পেয়েছি।’
‘আপনি ভয় পেয়েছেন। তা মুখে স্বীকার করছেন। যাক বুদ্ধিটা কাজে লাগলো।’
‘অদ্ভুত! মেয়ে তো তুমি।’
‘শুধু অদ্ভুত না গ্রামের লোকে আমাকে পাগলও বলতো। কারণ আমি বেশি রাগলে কামড়ে দেই।’
‘আজব!’

নিভৃত এই মেয়েটার কর্মকাণ্ডে একই সাথে বিরক্ত, বিস্মিত এবং স্তব্ধ! এই মেয়ে এসেছে রুহানির জায়গা নিতে! বাঁচাল একটা।

_________________

‘আফা, আফনে রান্নাঘরে কেল্লাই?’
‘রান্না করবো।’
‘ওমা, বড় আফা সব রান্না করছে তো।’
‘আমি মায়ের পারমিশন নিয়ে এসেছি। তোমাদের ছোট সাহেবের জন্য পোলাও আর বড়ই দিয়ে টক ডাল রান্না করবো।’

জুলেখা হাসি মুখে তাকিয়ে। ও এবাড়িতে ছুটা বুয়ার কাজ করে। বয়স বিশেক হবে। রোগা, পাতলা, ছিপছিপে গড়ন।

‘জানেন আফা ছোট সাহেব ডাল দিয়া পোলা খাইতে হেব্বি পছন্দ করেন। রুহানি আফা তো প্রতিদিন বানাইতো। আর সাহের চেটেপুটে খাইতেন।’

কথাটা বলেই জুলেখার মন খারাপ হয়ে গেছে। রুহানি আফাকে অনেক পছন্দ ছিলো তার। তবে এই নতুন আফাটাকেও তার ভালোলাগে। অনেক মিষ্টি দেখতে।

দুপুরে খাবার খেতে বসেছে সবাই। শুক্রবার বিধায় নিভৃত, নাজমুল সাহেব বাড়িতেই আছেন। নিভৃত পোলাও আর ডাল মেখে গাপুসগুপুস করে খাচ্ছে। পাশেই মিরা বসে খাচ্ছিলেন।
‘আম্মু, আজ খাবারটা অনেক মজা হয়েছে।’
‘আমি না আজকে মৌন রেঁধেছে।’

মৌন মাথা নিচু করে খাচ্ছিলো।নিভৃতের প্রশংসা শুনে লাজুক হাসলো সে। তবে কথাটা শুনে গলায় খাবার আটকে গেলো নিভৃতের। খাবার রেখে উঠে দাঁড়ালো সে। খাবারের প্লেটটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে বললো,
‘জঘন্য হয়েছে।’

মৌনের এই অপমানটা খুবই গাঁয়ে লেগেছে। এতো কষ্ট করে রান্না করে এই প্রতিদান! চোখের কোণা বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে তার। এ কোন সম্পর্কে জড়িয়েছে তার জীবন! এর পরিণতি কি!

(চলবে)….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here