ময়ূখ পর্ব-১১

0
1888

#ময়ূখ
#পর্ব-১১
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৩১.
‘কেমন আছিস মৌনি?’
‘ভালো রিপুভাই। তুমি কেমন আছো?’

প্রশ্নটা শুনে মলিন হাসে রিপ্ত। তার ভালো থাকার ঔষধটা যে দূরে চলে গেছে। সে ভালো থাকবে কিভাবে? রিপ্তর চাচার উপর রাগ লাগে। চাচা ওয়াদা করেও পালন করেনি! রিপ্ত মৌনর হাতটা ছেড়ে বললো,
‘আছি কোনোরকম। তোর জামাই কিন্তু অনেক সুন্দর। একেবারে রাজপুত্র। ছোটবেলায় বলতিনা রাজপুত্র আসবে তোকে নিতে। দেখ সত্যিই এসেছে।’

মৌন মাথা নিচু করে শুনছে। রিপু ভাইয়ের কন্ঠটা কি ভিজা ভিজা শুনালো?

‘কতদিন থাকবিরে মৌনি?’
‘রবিবারে চলে যাবো।’
‘মাত্র দুইদিন!’
‘হুম।’
‘আচ্ছা, শনিবার সকালে জংলা পুকুরের পাড়ে যাবি? শাপলা ফুটেছে অনেক। তোকে শালুক খাওয়াবো। আর কিছু কথাও বলার আছে।’
‘কি কথা রিপু ভাই?’

মর্জিনা মৌনকে দেখে হাঁক ছাড়েন। তাই রিপ্তের সাথে কথা বাড়ায়না মৌন।
‘আমি যাই রিপু ভাই।’

রিপ্ত নয়নভরে দেখে। আজ এতিম বলে ভালোবাসার মানুষটাকে চেয়েও সে পেলোনা!

মৌন রান্নাঘরে বসে হাতেহাতে কাজ করছে। গল্প করছে। ছনের রান্নাঘরের পিছনে বিস্তৃত বাঁশবাগান। আজ অম্যাবস্যা। তাই যেখানে লাইট আছে সেখানেই কেবল আলো। বাকী স্থানে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাঁশবাগান থেকে কুলা ব্যাঙের ডাক ভেসে আসছে। একটানা ভাঙা রেকর্ডারের মতো ভেজেই চলেছে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ। ঝিঁঝি পোকার ডাকও বাজছে ক্রমাগত। মৌনর খুবই ভালোলাগছে। সবার সাথে গল্প করতে। গ্রামীণ পরিবেশে নিজেকে ভাসাতে।
‘মৌন?’
‘হ্যাঁ, মা।’
‘চুলার পাশে দেখ গাছের মেন্দি বাইট্টা রাখছি। নিতুরে গিয়ে দিয়ে দে।’
‘আচ্ছা।’

সাউন্ডবক্স কিছুক্ষণ আগে বন্ধ করা হয়েছে। এশার আজান পড়েছে। তাই মুরুব্বিরা বকাবকি করে বক্স বন্ধ করিয়েছে। মৌন মাথায় আঁচলটাকে ঘুমটা করে দিয়ে সামনে উঠানে এলো। ঘরে ঢুকবে এমন সময় হঠাৎ নিভৃতের কথা মনে পড়েছে। লোকটাকে তো সে ঘরে একা রেখেই চলে এসেছিলো।
‘এই মেয়ে?’

নিভৃতের কন্ঠে পিছনে ফিরে মৌন। নিভৃত বিরক্তি কন্ঠে বলে,
‘যদি ঢাকা হতোনা একটা ঠাটিয়ে দিতাম তোমায়। কতক্ষণ ধরে তোমাকে খুঁজছি জানো! আমি বাসায় যাবো।’
‘তো যান। আমি কি মানা করেছি নাকি আপনার হাত বেঁধে রেখেছি।’

নিভৃত খানিকটা ভ্যাবাচেকা খায়। সত্যিই তো! সে তো চলে গেলেই পারতো!
‘দায়িত্ববোধ বলেও একটা কথা আছে! সেই থেকেই। তুমি বাড়ি যাবে?’
‘না, আমি কাল যাবো। আপনি যান।’

নিভৃত পিছনে ফিরে। মেয়েটা এতো অদ্ভুত কেন! হঠাৎ মৌন নিভৃতের কাছে এসে বলে,
‘শুনুন?’
‘কি?’
‘পারলে কালকে দুপুরে একটু বিয়েতে আসবেন। বাবা তো আজ বাড়ি নেই। আরো রাতে আসবে। গরু আনতে শহরে গেছেন। কালকে বাবা আপনাকে দেখলে খুশি হবে।’

নিভৃত কথা না বাড়িয়ে মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে সামনে এগোয়। যেন সে মৌনর কথাই শুনেনি। মৌন সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অতঃপর ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। বোনকে মেহেদী দিতে হবে।

৩২.

গ্রামের সকালগুলো হয় ভিন্ন। কুয়াশায় ছেয়ে থাকে চারপাশ। কানে ভেসে আসে মুরগের ডাক। টিনের চালে কুয়াশা পড়ে বৃষ্টির ফোঁটার মতো টপটপ আওয়াজ হয়।

মৌন ফজরের নামাজ পরে শুয়েছিলো একটু। তবে বাইরের আওয়াজে উঠে গেলো। পাশে রথি শুয়ে আছে। মৌন বোনকে দেখে হাসে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আবার কবে দেখা হবে কে জানে?

__________________

সকালবেলা হলুদের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। গ্রাম্য বিয়েগুলো এমনি সাদামাটা। নিতুকে একটা হলুদ শাড়ি পরানো হয়েছে। কলপাড়ের ধারে বসিয়ে একে একে সবাই হলুদ বাটা ছুঁইয়ে দিচ্ছে তাকে। নববধূর মুখে লাজুক রাঙা হাসি। ভালোবাসার মানুষটিকে আপন করে পাওয়ার চেয়ে মধুর আর কি আছে? শাড়ি দিয়ে চারদিক ঘিরে কলসি করে আনা নদীর পানি ঢালা হলো নিতুর মাথায়। মৌন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। ছোটবেলায় খুব শখ ছিল তার রাজপুত্রের সাথে খুব জমজমাট করে বিয়ে হবে। তবে কিছু স্বপ্ন থাকে মানুষের যা কখনো পূর্ণ হয়না। এটি হয়তো তেমনি।
নিতুকে ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বরপক্ষ আসবে কিছুক্ষণ পর।

বেতের সোফায় বসে আলম মুরব্বিদের সাথে কথা বলছিলেন। মৌনকে তার ঘরে যেতে দেখে তিনি এগিয়ে গিয়ে বললেন,
‘মা’

হঠাৎ বাবার মায়াভরা ডাকে পিছন ফিরে তাকায় মৌন। নরম কন্ঠে বলে,
‘কিছু বলবে বাবা?’
‘তুই কি এখনো আমার উপর রাগ করে আছিস?’
‘না, বাবা।’
‘আমাকে ক্ষমা করে দে মা।’
‘এভাবে বলোনা বাবা। আমার নিজেকে ছোট লাগে।’

আলম কথা না বাড়িয়ে আবার বসার ঘরে চলে আসেন। মেয়েকে বিক্রি করেছেন, একজন প্রেমিকের মন ভেঙেছেন তার পাশাপাশি ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। তিনি যে অপারগ ছিলেন!

বাইরে প্যান্ডেল টানানো হয়েছে। বড় বড় হাড়ি পাতিলের আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। গরুর মাংসের তীব্র ঘ্রাণ বেড়িয়েছে। বাঁশবাগানের পাশে দুয়েকটা শিয়াল ঘুরঘুর করছে। ভোরে এখানে গরু জবাই দেওয়া হয়েছিল। রক্তের ঘ্রাণে ছুটে এসেছে শিয়ালের দল।

বরযাত্রী এসেছে। গেট ধরা নিয়ে তুমুল ঝগড়া চেঁচামেচি। যদিও মৌন সেদিকে ভিড়েনি। পুষ্প, রথি আরো কয়েকজন টাকা নিয়ে ঝগড়া করছে। তাদের দাবি পাঁচহাজার। তাদের দেওয়া হচ্ছে পাঁচশো! সে নিয়ে কি কথা কাটাকাটি! লাল পাঞ্জাবি পরা একছেলে রথিকে বললো,
‘ও বেয়াইন মাথা ঠান্ডা করেন। সেভেন আপ আনি?’
‘আরে মিয়া রাখেন সেভেন আপ। টাকা দেন।’
‘তাতো পাবেন না বেয়াইন।’

রথি কিছু বলবে তার আগেই আলম, রিপ্ত এগিয়ে এসে মেয়েদের ধমকাধমকি করে গেট ছাড়ালো।

_________________

লাল টুকটুকে শাড়ি পরানো হয়েছে নিতুকে। শাড়িটা নিতুর শশুরবাড়ি থেকেই দেওয়া হয়েছে। কয়েকজন মেয়ে মিলে সাজাচ্ছে তাকে। নিতুর মুখে লাজুক হাসি। দীর্ঘ পাঁচবছর পর নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে আপন করে পাবে সে। এই মানুষটার জন্য কত পাগলামি করেছে সে।

মাঝে আবার তার শাশুড়ী এসে বাবার বাড়ি থেকে দেওয়া গলার, কানের স্বর্ণের জিনিসগুলো দেখে গেছেন। এছাড়াও ট্রাক রাখা বাইরে। একটা ফ্রিজ, টিভি, খাট তুলে রাখা। সাথে আরো প্রাসঙ্গিক জিনিসপত্র। বিছানার চাদর, বালিশ, তোশক, কাঁথা, হাঁড়ি পাতিল। এতকিছুর পরেও বায়না একটা মোটর সাইকেল দিতে হবে! আলম সেটার বদলে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েছেন।

বাইরে খাবারের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। দুইশজন বরযাত্রী এসেছে। দুই তিনবারে খাওয়ানো হলো। দুপুর গড়িয়ে যেতেই কাজী কনের ঘরে এলেন। নিতু লাজুক মুখে উচ্চারণ করলো তিনটে পবিত্র শব্দ। মৌন সেই কখন থেকে নিতুর ঘরে। বাইরে বের হওয়ার সুযোগ পায়নি। মনটা আনচান করছে। বদলোকটাকে দেখেনা কতঘন্টা! লোকটা আদোও এসেছে!

মৌন বসার ঘরে আসতেই শাশুড়ী মায়ের আওয়াজ পায়। এগিয়ে গিয়ে দেখে নাজমুল সাহেব, মিরা বসে আছেন সবার সাথে। মিরা মৌনকে দেখে বললেন,
‘এতক্ষণ কোথায় ছিলিস?’
‘এই তো মা বড়আপার কাছে ছিলাম। খেয়েছো তোমরা?’
‘হ্যাঁ, খেয়েছি। তুই খেয়েছিস?’
‘হ্যাঁ, মা।’

হঠাৎ চোখ যায় পাশের সোফায়। এতক্ষণ মিরার সাথে কথা বলায় মৌন সেদিকে তাকায়নি। খয়রী একটা পাঞ্জাবি পরনে নিভৃত বসে।দৃষ্টি নিজের হাতে থাকা মোবাইলে। মৌন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। এটা কি সত্যিই নিভৃত!

৩৩.

বিকালে বউ নিয়ে রওনা দেয় বরযাত্রী। বিদায়কালে নিতুর সে কি কান্না! বিল্লাল আগলে নেয় নিজের সহধর্মিণীকে। কষ্টে যেন বুকটা ফেটে যাচ্ছে নিতুর। মর্জিনা আঁচলে চোখ মুছেন। পুষ্প, রথি, মৌন কাঁদছে। চারবোন একপ্রাণ ছিল। আর আজ বোনেরা একেকজন থেকে বহুদূরে। একসাথে আর কানামাছি খেলা হবেনা, নুন দিয়ে করমচা মেখে নদীর তীরে বসে খাওয়া হবেনা, ঝগড়া করা হবেনা। মেয়েদের জীবনটা এমনি। বাবার বাড়ি প্রিয় মানুষদের রেখে চলে যেতে হয় একটা অচেনা জায়গায়। মানিয়ে নিতে হয় নতুন একটা পরিবেশের সাথে।

_________________

রাতে নিভৃতের সাথে ব্যারিষ্টার বাড়ি ফিরে এলো মৌন। মনটা ভিষণ খারাপ। বোনটা চলে গেছে, সেও ঢাকা চলে যাবে। বাড়িটা একেবারে খালি হয়ে যাবে তাদের। আর হয়তো কখনো কোনো বৃষ্টির দিনে বাবা,মা, চারবোন মিলে মুড়ি মাখানো খাওয়া হবেনা। গল্প করা হবেনা।

মৌনর শরীরটা বেজায় ক্লান্ত। ঘরে এসে যে বিছানায় শুয়েছে। নিভৃত ডেকেও উঠাতে পারেনি। অতঃপর উপায় না পেয়ে নিভৃতও পাশে শুয়ে পড়েছে। ঘুমের ঘোরে অভ্যাসবশত কখন যে মৌনর বুকে মাথা রেখেছে নিভৃত হয়তো নিজেও জানেনা।

ফজরের আজানে ঘুম ভাঙলো মৌনর। হঠাৎ নিভৃতকে এতো কাছে দেখে ভরকে গেলো সে। নিভৃতকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। কারণ ঘুম থেকে উঠলে এই অবস্থায় নিজেকে দেখলে হয়তো আবার মৌনর উপরই দোষ দিবে। সে সুবিধাবাদী, স্বার্থপর। মৌন নামাজ সেরে মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। ব্যারিষ্টার বাড়ির সামনেই জংলার পুকুর। গেট থেকে বেরিয়ে সামনেই। নিভৃতের ঘরের বারান্দার সামনে কোনো গাছ না থাকায় এবং এল সিস্টেম বাড়ির এই ঘরটি একদম কিনারে হওয়ায় জংলার পুকুর স্পষ্ট দেখা যায়। মৌন এগিয়ে গেলো পুকুরটার দিকে। শাপলাহাতে সামনে ফিরে উদাস ভঙ্গিতে বসে রিপ্ত। মৌন শুনতে চায় রিপ্তের অব্যক্ত কথা। তার অনেক কৌতূহল জাগছে।

(চলবে)……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here