ময়ূখ পর্ব-১৩

0
1898

#ময়ূখ
#পর্ব-১৩
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৩৭.
‘রুহানি, আমি আর পারছিনা। আমার নিজের উপর আমার নিয়ন্ত্রণ নেই। আমি কেন এতো অদ্ভুত আচরণ করছি রুহানি?’
‘এই একটু জবাব দেওনা।’
‘আমার যে তোমাকে ভিষণ প্রয়োজন রুহানি।’

সাদা টাইলসে আবৃত কবরটার সামনে দাঁড়িয়ে অব্যক্ত কথাগুলো বলে যাচ্ছে নিভৃত। তবে কোনো জবাব আসেনা। পাশের স্বর্ণচাঁপা গাছটায় বসে কিচিরমিচির আওয়াজ তুলছে একটা ছোট চড়ুই। সেই পাখির আওয়াজ ভেসে আসে। কাঙ্খিত মানুষটার গলার সুর কেন আসেনা? একটু! কেবল একটু আওয়াজ, একটু সুর। মৃত্যুগুলো এতো নিষ্ঠুর কেন? প্রিয়জনদের ছিনিয়ে নিয়ে কি মজা পায় তারা?

নিভৃত চলে আসে তার ঘরে। রুহানির উপর রাগ হয়। কেন চলে গেলো তাকে ফেলে? এই অদ্ভুত পৃথিবীতে সে যে বড়ই একা।

____________________

মৌন ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে প্রবেশ করেছে। নিভৃত মাথা চেপে ধরে বসেছিল ডিভানে। মৌনকে দেখে কোনো প্রতিক্রিয়া করেনি। মৌনও অভিমানে চুপ।

রাতের আকাশে হাজারো তারার হাতছানি। বারান্দায় বসে একধ্যানে মৌন তাকিয়ে আছে তারাগুলোর দিকে। কুচকুচে কালো আকাশে ঝলমলে তারার মেলা। শুক্লপক্ষের চাঁদের হালকা আলোয় চারপাশ আবছা দেখা যায়। কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা পেরিয়ে আজ আবার এসেছে শুক্লপক্ষ। আচ্ছা, মৌনর জীবনটা কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যার মতো কেন? প্রকৃতির আকাশে তো কৃষ্ণপক্ষের ঘুটঘুটে আঁধার পেরিয়ে ঝলমলে শুক্লপক্ষ আসে। তার জীবনে আসেনা কেন? একটু বাঁকা চাঁদের ঝলমলে কিরণে অন্ধকার ছাপিয়ে আলোর দিশা কেন দেখা যায় না?

এসব কথা ভেবেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার। এক অদ্ভুত খেলায় বন্দী সে। এই খেলার পরিণতিটা কি!
আজ সারাদিন কোনো কথা হয়নি নিভৃতের সাথে। নিভৃত তাকে এড়িয়ে গেছে। সেও অভিমানে নিজের নামের মতোই মৌন থেকেছে।

__________________

ধরণীর অন্ধকার ছাপিয়ে আবার এসেছে নতুন ভোর। একটা নতুন উদ্যমে আবার শুরু হবে মানুষের জীবনযাত্রা। ফজরের নামাজ পড়ে লাল গোলাপের বাগানে এসেছে মৌন। গোলাপের সুভাসে মনটা আকস্মিক ভালো হয়ে গেলো তার। মন ভরে ঘ্রাণ নিলো সে। লাল রঙের স্নিগ্ধ গোলাপের নরম পাপড়ি ক্ষানিক সময়ের জন্য ; জাগতিক মায়া কাটিয়ে তাকে নিয়ে গেলো অভূতপূর্ব এক জগতে। সেই জগত থেকে মৌন বের হলো মিরার ডাকে।

‘মৌন চা খাবি?’
‘তোমার হাতের চা মিস দেওয়া যায় মা।’

বাগানে করা সিমেন্টের পাটাতনে বসে চা খেলো শাশুড়ী, বউ মিলে। গল্পে গল্পে অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে। হঠাৎ মিরা বললেন,
‘জানিস মৌন আমার ছেলেটা কিন্তু অনেক সাধনার পরে হয়েছে।’

মৌন জিঘাংসু দৃষ্টিতে তাকলো। মিরা হেসে বললেন,
‘সবার জীবনেই উত্থান-পতন থাকে। আমারো ছিলো। আমি ছিলাম রহমান পরিবারে সবচেয়ে শিক্ষিত বউ। ইডেন কলেজে শিক্ষকতা করছি। ক্যারিয়ারে আমি সফল। তবে আমার সাংসারিক জীবনে সফল ছিলাম না। তোর শ্বশুর সব সময়ই খামখেয়ালি। ব্যবসা নিয়ে সে ব্যস্ত। শাশুড়ী মা আমাদের সাথে ঢাকায় থাকতেন। তিনি আমার চাকুরি পছন্দ করতেন না। বারেবারে চাপ দিতেন বাচ্চার জন্য। বিয়ের দ্বিতীয় বছরে প্রথম গর্ভধারণ করলাম। একটা মেয়ে হলো। কত খুশি চারপাশে। আমাদের ফাঁকি দিয়ে মেয়েটা চলে গেলো ছয়বছর বয়সে। খুব ভেঙে পড়েছিলাম। আমার দ্বিতীয় মা যেন আমায় ফাঁকি দিয়েছেরে মৌন।’

৩৮.

নিজের চোখের কোণে পানিটা নীল রঙা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে মিরা আবার বললেন,
‘দ্বিতীয়বার মা হলাম। সেই মেয়েও দুইমাসে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। চারপাশে ছড়িয়ে পড়লো আমি অলক্ষী, অপয়া। মানুষ মুখের উপর কোনো অনুষ্ঠানে যেতে মানা করে দিতো। চাকুরি ছেড়ে নিজেকে ঘরবন্দী করলাম। শাশুড়ী মায়ের কটুকথায় একবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম। ভাগ্যের জুড়ে বেঁচে যাই। আমার খামখেয়ালি স্বামীটা আমাকে কখনো ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবেনি। মায়ের কথা শুনেও দ্বিতীয়বার বিয়ে করেনি। মুখে কিছু না বললেও বুঝতাম আমার একজন আছে। যে আমাকে কখনো ছেড়ে যাবেনা। একটা কাঁধ আছে যেখানে আমি মাথা রাখতে পারবো। বিয়ের দশবছরে কোনো সন্তান নেই। ডাক্তার, কবিরাজ ধরেও কাজ হচ্ছেনা। তখন ছুটে গেলাম সৌদি আরব। আল্লাহর কাছে হাত দুইটা মেলে কেঁদে একটা সন্তান চাইলাম। আল্লাহ আমার ডাক শুনলো। সৌদি থেকে ওমরাহ করে ফেরার তিনমাসের মাথায় জানতে পারি আমি মা হবো। অবশেষে আমার জীবনে এলো আমার মানিক রতন। পূর্ণ হলো আমার জীবন। ছেলেটাকে কখনো কোনো কষ্ট পেতে দেইনি। যা চেয়েছে তাই দিয়েছি।’

মৌনর চোখে জল। মাথা নিচু করে শুনছে কেবল। এই পৃথিবীতে প্রত্যেকটা মানুষেরই একটা গল্প থাকে। কষ্টের গল্প।

‘মিতু আমার মেয়ে না।’

কথাটা শুনে অবাক চোখে মিরার দিকে তাকালো মৌন। মিরা মলিন হেসে বললেন,
‘একদিন প্রচুর ঝড় বৃষ্টির রাতে গাড়ি নিয়ে মিরপুর থেকে ফিরছি আমি আর নাজমুল। হঠাৎ দেখি একটা জীর্ণ শীর্ণ পাগলি রাস্তার পাশে পড়ে আছে। আর তার বুকে হামাগুড়ি খাচ্ছে একটা ফুটফুটে শিশু। ল্যাম্পপোস্টের হালকা আলোয় এ এক করুণ দৃশ্য। আমি গাড়ি থামাতে বললাম। নেমে দেখি গাছের ডাল পড়ে পাগলীটার মুখ থেতলে গেছে। বৃষ্টির পানি ধুঁয়ে নিচ্ছে তার রক্ত। বাচ্চাটা কাঁদছে। আদো আদো বুলিতে মা মা করছে। মায়ের বুকে মুখ গুঁজে মায়ের দুধ খেতে চাচ্ছে। আমার সহ্য হলো সে কষ্ট। নিভৃত তখন দেড়বছরের। নিজের বুকের দুধ দিয়ে পেট ভরালাম বাচ্চাটার। পাগলিটাকে হসপিটালে নিয়ে গেলাম। তবে পাগলি অনেক আগেই মারা গেছে। তার জটপাকানো চুলগুলো রক্তে লাল হয়েছিল। সে দৃশ্য আজো ভুলিনি আমি। দত্তক নিলাম বাচ্চাটাকে। সেই থেকে আমার দুইসন্তান। মিতু আর নিভৃত।’

মৌনের খুবই অবাক লাগছে। একটা বাড়ির দেয়ালের আড়ালে কত গল্প লুকিয়ে থাকে। সে বাড়ির মানুষগুলো সে কাহিনী না বললে তা গোপনই থেকে যায়।

‘তোকে কথাগুলো কেন বললাম জানিস মৌন?’
‘কেন মা?’
‘আমার মানিক রতন। আমার বাবুই রুহানিকে হারিয়ে পাগলপ্রায়। এভাবে ছেলেটার নিঃশেষ হয়ে যাওয়া আমি মা হয়ে কোনোমতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। বিশ্বাস কর মৌন তোকে সেই ছোটবেলা থেকে দেখছি। কি যেন ছিল! কেন যেন আমার মনে হলো আমার ছেলেটাকে সুখে রাখতে এই পুতুলটাকে যে আমার বড্ড প্রয়োজন। তুই কি এখনো অভিমান চেপে রেখেছিস?’
‘না, মা।’

মিথ্যা বললো মৌন। যে ছেলেকে খেলনার পুতুল এনে দেওয়া হয়েছে। সে তো পুতুলটাকে দূরে ছুঁড়ে মেরেছে।

৩৯.
দুপুর পেরিয়ে বিকেল। মৌন ফুলকপির বড়া তৈরি করছে রান্নাঘরে। জুলেখা তাকে সাহায্য করছে। শরিফা ছাদে কাপড় আনতে গেছে।

কলিংবেল বাজতেই দরজা খুললেন মিরা।তিনি ড্রয়িংরুমে বসে বই পড়ছিলেন। রুনা, মহিন আর জিল্লুর সাহেব দাঁড়িয়ে। মিরার হঠাৎ মনে পড়লো রবিবারে বিকেলে তো তাদের আসার কথা ছিলো।
‘আসেন ভাবি।’

সোফায় বসে রুনা দুনিয়ার গল্প জুড়ে দিলেন।মিরা যারপরনাই বিরক্ত। মহিন শুধু চোখ দিয়ে কি যেন খুঁজছে আর জিল্লুর সাহেব নিরীহভাবে বসে আছেন। তার ভাবখানা এমন যেন বেচারাকে ধরে বেঁধে এখানে আনা হয়েছে। আহারে! শ্যামলা মুখটা এমন যেন দুধের উপর অপাংক্তেয় মাছিটা। মিরার খুবই মায়া হলো। তিনি নিজেই রুনার ক্ষণিকের বকবকে বিরক্ত। বেচারা তো রোজ শুনে।

‘ভাবি এই হলো কাহিনী। দিলরুবা অবশেষে ভেগে বিয়ে করলো কামরুলকে।’

আরে কে কামরুল, কে দিলরুবা। এদের কাহিনী শুনে মিরা কি করবেন! অদ্ভুদ! মিরা একটু বিরতি নেওয়ার তাগিদে হাঁক ছেড়ে বললেন,
‘জুলেখা চা, নাস্তা নিয়ে আয়।’

মহিন বুঝলো নতুন মেয়েটার নাম বুঝি জুলেখা। তবে নামটা বেমানান লাগলো তার। এতো সুন্দর মেয়ের নাম জুলেখা! ইতিমধ্যে নিভৃত ঘুম থেকে উঠে নিচে নামছে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় বেচারা ভরকে গেলো। মুখে হাই তুলতে যাচ্ছিল তবে সেটা মুখেই আটকে গেলো। রুনা নামক মহিলাটাকে সে সর্বদা এড়িয়ে চলে। কিন্তু এরা গোষ্ঠীশুদ্ধ তাদের বাড়ি এলো কেন?

এদিকে মহিন লাজুক হেসে রুনাকে কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
‘ওমা জুলেখাকে আমার চাই। ওই তোমার বউমা হবে কিন্তু!’

মিরা আরো অবাক হচ্ছেন! এঁরা ফিসফিসিয়ে বলে কি! কি শুরু হলো এসব!

(চলবে)…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here