#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-২২
৬৪.
‘রথিরে, আল্লাহ!’
চিৎকার করে উঠলো মৌন। মিরা ভাত খাওয়া রেখে দৌঁড়ে এলেন তার কাছে। জুলেখা, শরীফাও কাজ ফেলে ছুটে এসেছে। মৌন চিৎকার করে কাঁদছে। মিরা মৌনকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
‘এই মৌন। এই। কি হয়েছে?’
মৌন কোনো কথা না বলে কাঁদছে। পিঠাপিঠি বোন রথি। ঝগড়া তার সাথে বেশি হয় আবার বোনদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সে রথিকেই ভালোবাসে। কোনো জবাব না পেয়ে পাশে থাকা ফোনটা হাতে নিলেন মিরা। ঐপাশেও কেউ একজন আপা আপারে করে কাঁদছে। মিরা নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কি হয়েছে?’
‘ছোটআপা আত্মহত্যা করছে।’
‘কোন হসপিটালে আছে এখন?’
‘আমাগো জেনারেল হাসপাতালে।’
‘আচ্ছা, আমরা আসছি।’
নিভৃত মাত্রই ঘুম থেকে উঠে নিচে নেমেছে। মৌনকে চিৎকার করে কাঁদতে দেখে সে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। মিরা মৌনকে শান্ত হতে বলছেন। তবে কোনোমতেই শান্ত করতে পারছেন না। নিভৃত সহ্য করতে পারছেনা এই চিৎকার। দৌড়ে গিয়ে মৌনকে জড়িয়ে ধরলো সে। পরিচিত, প্রিয় মানুষটার স্পর্শ পেয়ে আরো গুটিয়ে গেলো মৌন। বাচ্চাদের মতো কাঁদছে সে। যেনো তার অসহায় মুখটা বলতে চায়,
‘আমার রথির কিছু হবেনা তো নিভৃত!’
নিভৃতের হাতের একটু ছোঁয়া, পিঠে সান্ত্বনার একটু ছোঁয়াই মৌনের অশান্ত মনকে শান্ত করে তুলছে।
___________________
দীর্ঘ চারটা ঘন্টা ছটফট করেছে মৌন। গাড়িতে থাকাকালীন সময়টা সে শ্বাস নিতে পারছিলো কিনা সন্দেহ! বাড়ির কেউই ফোন ধরছিলোনা। নিভৃত একহাতে আগলে রাখে মৌনকে।
ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালের ঘি রঙা দালানের সামনে গাড়ি থামে। মৌন পাগলের ছুটে যায় ভিতরে। তার উড়না ঝুলছে মাটিতে। বোনগুলো তার প্রাণ। যাদের জন্য নিজেকে বিলিয়েছে তাদের কিছু হলে সে কিভাবে থাকবে? নিভৃত দৌড়ে এসে উড়নাটা ঠিক করে দেয়। বামহাতটা ধরে শক্ত করে। হাসপাতালে মানুষ গিজগিজ করছে। সবাই সবার প্রিয়জনের তাগিদে এসেছে। কেউবা নিজের তাগিদে। ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের সামনে লাইন। এতো এতো মানুষ এতো বড় হাসপাতাল নিভৃত কি করবে বুঝতে পারছেনা। এখানে সে পূর্বে আসেনি। মৌনও নিজের মাঝে নেই। মিরা, নাজমুলকে আনেনি নিভৃত। নাজমুল অসুস্থ বলে।
পাশের লাল বিল্ডিংয়ে ছুটে গেলো মৌন। অপারেশন ওয়ার্ড এদিকেই থাকার কথা। মৌনও ঠিক করে চিনেনা। হঠাৎ সামনে আলমকে দেখতে পেয়ে নিভৃতের হাত ছাড়িয়ে বাবাকে ঝাপটে ধরে মৌন। আলম আকস্মিক জড়িয়ে ধরায় খানিকটা পিছিয়ে যান। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। মৌন ভেজা গলায় জিজ্ঞেস করে,
‘রথি কই বাবা?’
‘দুতালায় মহিলা ওয়ার্ডে।’
‘আমাকে নিয়ে চলোনা বাবা।’
দুতালায় মহিলা ওয়ার্ডে প্রবেশ করে মৌন, নিভৃত। দুইপাশে হাসপাতালের বেড। রোগী, তাদের আত্মীয়স্বজনে ভরা চারপাশ। কারো হাতে ঔষধ, কেউবা এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছে। এককোনায় একটা বেডে শুয়ে আছে রথি। মুখটা পাণ্ডুর। হাতে স্যালাইন।
৬৫.
পাশে একটা টুলে বসে আছেন মর্জিনা। কেঁদে কেঁদে বিলাপ করছেন তিনি। আর কেউ নেই পাশে। মৌন দৌড়ে গিয়ে বোনের পাশে বসে। মুখটায় হাত বুলায়। ডাকে,
‘রথি, রথিরে। আমি তোর আপা।’
মর্জিনা পাশ থেকে বলেন,
‘ডাকিস না। ঘুমের ঔষধ দিসে। একটু ঘুমাক।’
মৌন উঠে এগিয়ে যায় মায়ের দিকে। সিক্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,
‘মা, কি হইছিলো?’
মর্জিনা বিলাপ করে করে বলেন,
‘জানিনারে মৌন মাইয়াটার হঠাৎ কি হইলো। দুইদিন ধইরা চুপ কইরা থাকে। ভাত খায়না। আজকা সকালে হঠাৎ কইরা কয় মা আমারে মাফ কইরা দিও। আমি কিছু বুঝিনাই। আমার ময়নার গালে দুইডা থাপ্পড় দিয়া কই এগুলা কিসব কথা কস। আমার ময়নায় রাগে, কান্দে। আমি ধান ঝারতাছি হঠাৎ কইরা পুষ্পে দৌড়ায় আইসা কয় ও মা ছোটআপা নদীতে ঝাঁপ দিসে। আমার ময়নায় তো সাঁতার পারেনা। দৌড়ায় গিয়া দেখি রিপ্তে তুলছে পানিরতে। পরে কেমনে কি হইলো জানিনা। হাসপাতালে ছুইটা আইছি।’
নিভৃত পাশে দাঁড়িয়ে সবটা শুনছে। আসলে তার কি বলা উচিত সে বুঝতে পারছেনা। প্রিয়জনের কিছু হলে কেমন লাগে সে ব্যথা হয়তো তার থেকে বেশি কেউ জানেনা। সে আলমকে জিজ্ঞেস করে,
‘আংকেল, পুলিশ কেস হয়েছে? আর ওতো নদীতে কোনোভাবে পড়েও যেতে পারে?’
‘না, আব্বা। রথি নদীতে ঝাঁপ দিসে। কয়েকজন দূর থেকে দেখছিলো। আর পুলিশ আসছিলো। মেম্বাররে বলে ব্যাপারটা মিটাইছি।’
সময় যায়। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চললো। হাসপাতালের কোলাহল এখনো কমেনি। নিভৃত বাইরে থেকে ফল, খাবার নিয়ে এসেছে। মৌন রথির পাশে মূর্তির মতো বসে। খাবারগুলো মর্জিনার হাতে দিলো সে। মর্জিনা আঁচল দিয়ে চোখের কোণা মুছে বললেন,
‘তুমি বাড়িতে যাওগা বাবা। তোমার কষ্ট হইতাছে। বাড়িতে গিয়া বিশ্রাম করো।’
নিভৃত লজ্জা পায়। বিপদের মুখেও তার কথা ভাবছে মর্জিনা। মৌন দুইপিস রুটি, একটা কলা আর একটা আপেল নিভৃতকে খেতে দেয়। নরম কন্ঠে বলে,
‘আমি আজকে এখানে থাকবো রাতে। আপনি ফরিদপুর বাড়িতে যান। গিয়ে রেস্ট নিন। অনেকটা ধকল গেলো আপনার উপরে। এখানে থাকতে আপনার কষ্ট হবে। সারারাত বাইরে বসে থাকতে পারবেন না। কালকে রথিকে ডিসচার্জ করবে। আপনি যান।’
নিভৃতের খারাপ লাগছে। মেয়েটা কি তাকে আপন ভাবেনা একটুও।
‘থাকি কিছুক্ষণ।’
‘আপনি ক্লান্ত। ড্রাইভ করেছেন অনেকটা পথ দয়াকরে চলে যান।’
নিভৃত চলে আসে। খানিকটা অভিমান হলো কি!
স্যালাইন শেষ হয়ে রক্ত উঠে যাচ্ছে হাতে। মৌন আশেপাশে খুঁজেও কোনো নার্স পেলোনা। দৌড়ে গেলো বাইরে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়া মানে একপ্রকার যুদ্ধ। পাশের ওয়ার্ড থেকে নার্স এনে স্যালাইন খুলায় মৌন। মর্জিনা পাশে টুলে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। আলম ওয়ার্ডের বাইরে রাখা চেয়ারে বসা। পুরুষের রাতে মহিলা ওয়ার্ডে থাকা নিষেধ। এখানে আসার পর একবারও রিপ্তকে দেখেনি মৌন। ব্যাপারটায় সে খুব অবাক। তাদের বিপদে রিপ্ত সবসময় প্রহরীর মতো পাশে থাকে। অথচ আজ নেই! তাছাড়া রথিকে নাকি রিপ্তই হাসপাতালে নিয়ে এসেছে!
৬৬.
মাকে জাগাতে ইচ্ছে করেনা মৌনর। পান খেয়ে লাল করা শ্যামবর্ণ মুখটা মেয়ের চিন্তায় বিবর্ণ হয়ে আছে। মৌন রথির পাশ থেকে উঠে বেডের সামনে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। তার মাথায় কেবল দুটো প্রশ্ন ঘুরছে রথি কেন পানিতে ঝাঁপ দিলো? আর রিপ্ত কই? দুইটার কি কোনো যোগসূত্র আছে?
হঠাৎ মৌনের চোখ যায় বাইরে। মানুষে ভরা নিচে। একটা রক্তাক্ত লাশ নিচে পলিথিনের উপর রাখা। পাশে দুইজন মহিলা চিৎকার করে কাঁদছেন। মৌনের কানে বারি খায় সেই চিৎকার।
‘ও ভাইরে। আমাগোরে থুইয়া তুই কেন গেলিরে। আমাগো কি হইবোরে। তোর নতুন বউটার কি হইবোরে। আল্লাহগো।’
কি আর্তনাদ! বেদনা সে চিৎকারে। চোখ ফিরিয়ে নেয় মৌন। হয়তো লোকটা এক্সিডেন্ট করেছে। কষ্ট হয় মৌনর। একটা এক্সিডেন্ট কত সহজে সব আশা কেড়ে নেয়। প্রিয়জনকে আকস্মিকভাবে হারিয়ে পরিবার স্তব্ধ, নিশ্চুপ হয়ে যায়। হাসপাতালে আসলেই কেবল বুঝা যায়, উপলব্ধি করা যায় মানুষ ঠিক কতটা অসহায়!
রথির পাশে গিয়ে বসে মৌন। চোখ লেগে যায় তার। নরম, মলিন কন্ঠস্বর।
‘আপা।’
হকচকিয়ে উঠে মৌন। রথি নিবুনিবু চোখে তাকিয়ে। মৌন রথির গাল স্পর্শ করে বলে,
‘কোথায় কষ্ট হচ্ছে। আপাকে বল।’
রথি আলতো করে মৌনর হাতটা নিয়ে তার হৃদপিণ্ডের পাশটায় রাখে। নরম স্বরে বলে,
‘এইখানটায় বড্ড কষ্টরে আপা।’
‘কি হইছে আপাকে বল।’
‘আমি রিপুভাইরে ভালোবাসি আপা।’
কথাটা শুনে থমকে যায় মৌন। অবাক চোখে রথির দিকে তাকায় সে। রথি থেমে থেমে বলে,
‘রিপু ভাই তোমারে ভালোবাসে আপা। তোমার তো এখন বিয়ে হয়ে গেছে আপা। আমি যে রিপুভাইরে ভালোবাসি আপা।ভাই কেনো বুঝেনা।’
রথি থামে। কথা বলতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার।
(চলবে)…..