ময়ূখ পর্ব-২৩

0
1945

#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-২৩

৬৭.
‘ও আপা বলোনা। তুমি রিপু ভাইরে বুঝাইবা। আমি যে তাকে ভালোবাসি। তুমি তারে বুঝাও আপা।’

রথি হাঁপিয়ে যায়। মৌন বোনের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলে,
‘তোর আপা আছেনা। সব হবে। তুই চিন্তা করিসনা।’

রথি থামে। নিশ্চল চোখে তাকিয়ে থাকে বোনের মুখপানে। তার মৃগনয়না চোখে কৃতজ্ঞতা। ফজরের আজান ভেসে আসছে পাশের মসজিদ থেকে। বাইরে কিছু পাখির কলরব শুনা যাচ্ছে। মৌন মাথায় উড়না টেনে দেয়। শীত পড়েছে চারপাশে। শীতল আবহাওয়ায় শরীরও হিম ধরে আছে।

_________________

সকাল দশটা বাজে। কিছুক্ষণ পর ডিসচার্জ করা হবে রথিকে। নিভৃত এখনো আসেনি হাসপাতালে। মৌন অপেক্ষায় ছিলো। ভেবেছিলো হয়তো আসবে। আলম গিয়েছেন বাইরে নাস্তা আনতে। মৌন মহিলা ওয়ার্ড থেকে বাইরে বের হয় ডাক্তারের সাথে কথা বলার জন্য। হঠাৎই চোখ যায় দূরে। এককোনায় চেয়ারে বসে আছে একজন। মাথানিচু করে আছে লোকটা। চুলগুলো উসকোখুসকো। মৌন ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে পাশে বসে। লোকটা স্থির, ভাবলেশহীন। মৌন নরম কন্ঠে ডাকে,
‘রিপু ভাই।’

রিপ্ত হকচকিয়ে তাকায়। মৌন তার পাশে এলো কখন? রিপ্ত মাথা নিচু করে আবার। মাথাটা চেপে ধরে বসে থাকে কেবল। মৌনও চুপ করে আছে। রিপ্তকে সে কিছু বলতে চায় তবে সময় নিয়ে। রিপ্ত ডুবে যায় আজ থেকে পাঁচদিন আগের ঘটনায়।

______________

শাপলাবিলের কিনারে বসে আছে রিপ্ত। দৃষ্টি তার দূরে। বহুদূরে। যদি দেখা মিলে কাঙ্খিত মুখটার! হায়! কোথায় সেই মুখ।
‘রিপু ভাই।’

রথি নিজের দুইটা বেণী ঝুলিয়ে চোখে গাঢ় কাজল দিয়ে এসেছে। ছটফটে, চঞ্চল রথি পাশে বসলো রিপ্তের।

‘আমাকে রিপু ভাই ডাকতে মানা করছিনা।’
‘আপা তো ডাকে।’
‘আপা আর তুই এক না।’
‘কেন রিপু ভাই?’
‘জানিনা রথি। মাথা খাইস না। নিজের কাজ কর গিয়া।’
‘আমার ধ্যান, জ্ঞান সব যে আপনে রিপু ভাই।’

একটা থাপ্পড় পড়লো রথির গালে। রিপ্ত ক্লান্ত এসব শুনে। আজ দুইটা মাস ধরে রথির ব্যবহারে অবাক হচ্ছে রিপ্ত। এগুলো বয়সের দোষ। রিপ্ত জানে। তাই ঠান্ডা মাথায় বুঝাতো কখনো মারতোও। তবে রথি নাছোড়বান্দা। এই মেয়েটা ছোট থেকেই জেদি।
রথি গালে হাত দিয়ে কাঁদে। ভেজা গলায় বলে,
‘আপার তো বিয়ে হয়ে গেছে। আমারে একটু ভালোবাসলে কি হয়?’
‘চুপ। একদম চুপ। যা এখানতে। আমার হাত উঠবো রথি।’
‘বাবা তোমারে ঠকাইছে আমি জানি। আমি তোমাদের ঝগড়া শুনছি। ও রিপুভাই সব ভুইলা আমারে ভালোবাসলে কি হয়?’

রিপ্ত রথির গাল চেপে ধরলো। রাগ উঠলে তার মাথা ঠিক থাকেনা।

‘এই কথা যদি আর কেউ জানসেরে রথি তোরে আমি জ্যান্ত পুঁতে ফেলমু।’

রথি ভেজা চোখে দৌড়ে চলে যায়। রিপ্ত ধপাস করে পাশে বসে পড়ে। একোন পরীক্ষার মুখোমুখি সে। ভেবেছিলো বাকিটা জীবন একা কাটাবে।

হঠাৎ করে বদলে গেলো রথি। চুপ করে থাকে। কোনো চঞ্চলতা নেই, লাফালাফি নেই একেবারে চুপ। গতকাল সকালে নদীর পাড় থেকে গরুর জন্য ঘাস কাটছিলো রিপ্ত। হঠাৎ পিছন থেকে রথি চিৎকার করে বলে,
‘রিপু ভাই আমারে ভালোবাসবেন?’

রিপ্ত না ফিরেই বলে,
‘পাগলামি করিস না। মাইর খাবি।’
‘শেষবারের মতো বলতেছি রিপুভাই।’
‘পাগলামি করিসনা।’
‘ঠিক আছে।’

ধপাস করে একটা শব্দ হলো।

‘রিপু ভাই?’

মৌনর ডাকে স্তম্ভিত ফিরে রিপ্তর। নিচে তাকিয়ে বলে,
‘কিছু বলবি মৌনি?’

৬৮.
‘আমি যদি তোমার কাছে কিছু চাই। দিবা আমাকে?’

রিপ্ত নিচে তাকিয়ে মলিন হাসে। মনে মনে বলে,
‘আমার ছটফটে পিচ্চিটা জান চাইলে জান দিতেও রাজিরে মৌনি। জান দিতেও রাজি।’

‘কি চাই তোর?’
‘তুমি রথিকে বিয়ে করো রিপুভাই।’
‘মৌন!’

রিপ্ত অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ভালোবাসার মানুষটা আজ বলছে তুমি অন্যকারো হয়ে যাও! যদিও ভালোবাসাটা একতরফা। মৌন বুঝে একতরফা ভালোবাসার কষ্ট। তবে সে নিরুপায়।

‘রথি তোমাকে ভালোবাসে রিপুভাই। একটা মরিচীকার পিছনে আর কত দৌড়াঁবে তুমি? এবার নিজের জীবনটা গুছিয়ে নাও।’
‘এটাই তোর ইচ্ছা।’
‘তুমি কি রাগ করলে রিপুভাই?’
‘না।’
‘দয়াকরে আমায় ভুল বুঝোনা রিপুভাই। আমার বোনটা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসছে। ওঁরে তুমি বাঁচাও।’

রিপ্ত বিরবির করে,
‘বোনের কষ্টটা দেখলি আর আমার জ্বলনটা দেখলিনা তুই।’

‘তাই হবে।’
‘সত্যি রিপুভাই।’
‘হুম।’

নিভৃত আসতে চেয়েছিলো। তবে মৌন তাকে মানা করে দিয়েছে। কিছুক্ষণ পর রথিকে ডিসচার্জই করা হবে।

বাড়িতে আনা হয়েছে রথিকে। খাটে শুয়ে আছে। শরীরটা বড্ড দুর্বল তার। সোফায় বসে আছেন আলম। পাশে নিভৃত বসা। মৌন দাঁড়িয়ে আছে। কোথ থেকে ছুটে এলো রিপ্ত। তার সাথে দেওয়ান কাজী।
‘চাচা?’
‘রিপ্ত। তুই দেওয়ান কাজীরে আনছোত কেন?’
‘চাচা। আপনে অনেক কিছু করছেন। আমি কিছু বলিনাই। আজ আমি বলমু আপনি শুনবেন। আমি এই মুহূর্তে রথিরে বিয়া করবার চাই।’
‘বিয়া!’
‘হ, চাচা।’

নিভৃত হতবিহ্বল হয়ে রিপ্তকে দেখছে। ছেলেটা রেগে আছে খুব। আলম কোনো প্রত্যুত্তর করলেন না। কেবল মাথা নুইয়ে রাখলেন। যার অর্থ তিনি রাজি। তিন কবুল বলে বিয়ে সম্পন্ন হলো তাদের। মৌনর দিকে ফিরে কৃতজ্ঞতায় ভরা হাসি দিলো রথি। কতটা প্রাণবন্ত সে হাসি! মৌনর আগামীকাল পরীক্ষা। তাই আজই রওনা দিতে হবে তাদের। নিভৃত বাইরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। রাত আটটা প্রায়। বাঁশবাগানের পাশে বসে সিগারেট টানছে রিপ্ত। মাথাটা বড্ড ধরেছে তার।
‘রিপু ভাই’
‘চলে যাবি শুনলাম?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওহ্।’
‘রথি এখন তোমার স্ত্রী রিপুভাই। ওঁরে কষ্ট দিয়োনা। জীবনটাকে সুন্দরভাবে গুছিয়ে নাও। ও তোমাকে ভালোবাসে। পবিত্র বন্ধনের জোরে তুমিও একদিন ভালোবাসতে শুরু করবা। দেখে নিও। আমাকে না হয় মরিচীকা ভেবে ভুলে যেও। আমাকে ভুল বুঝোনা। তোমাদের ভালোর জন্যই এমনটা করেছি আমি। তোমাদের জন্য দোয়া করি। সুখে থেকো।’

চলে আসে মৌন। পিছনে রেখে আসে ছলছল করা দুটো আঁখির মালিককে।

৬৯.

আজ প্রায় দেড় মাস হয় তারা গ্রাম থেকে ফিরেছে । মৌনর শরীরটা প্রতিনিয়ত খারাপ লাগে। কাউকে বলতেও পারেনা আবার সইতেও পারেনা। মৌনকে খাইয়ে দিচ্ছেন মিরা। মেয়েটা একদম নিজের যত্ন নেয়না। হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠায় জুলেখাকে ডেকে বললেন খুলে দিতে।

অহনা আর রিজভীকে দেখে জুলেখা সালাম দিয়ে ভিতরে ঢুকতে বলে। অহনা, রিজভী ড্রয়িং রুমে এসে সোফায় বসেন। জুলেখা ডাইনিং টেবিলে ছুটে গিয়ে হাঁপিয়ে বলে,
‘বড়আফা। অহনা ম্যাডাম আইছে।’

রুহানির মা, বাবা এসেছে শুনে থমকে যান মিরা। তারা তো অস্ট্রেলিয়া চলে গিয়েছিলো।
‘ভাবি। কেমন আছেন?’

কথাটা বলে মৌনকে দেখে থমকে যান অহনা। পরখ করেন আগে দেখেছেন কিনা। তবে মনে পড়েনা তার। মিরা দাঁড়িয়ে হাসি মুখে বলেন,
‘ভালো আছি ভাবি। আপনি কেমন আছেন? অস্ট্রেলিয়া থেকে কবে ফিরলেন? শুনলাম না যে।’
‘গতকাল রাতেই ফিরেছি। আবার চলে যাবো। মেয়েটার কবর একটা নজর দেখতে আসলাম। তিনদিন পরে তো মেয়েটার মৃত্যুবার্ষিকী।’

মৌন দুজনের কথা শুনছে দাঁড়িয়ে। মহিলাটাকে সে চিনেনা। তবে যতদূর বুঝতে পারছে তিনি রুহানির মা।
‘ভাবি, ও কে?’
‘ও নিভৃতের বউ।’

অহনা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। নিভৃত এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নিলো? এই নিভৃতের ভালোবাসা?
‘নিভৃতের বউ মানে? নিভৃত বিয়ে করেছে?’
‘হ্যাঁ।’

অহনা আর দাঁড়ালেন না। ড্রয়িংরুমে চলে এলেন। নিভৃত বাবার ঘরে ছিল। ড্রয়িং রুমে এসে অহনা, রিজভীকে দেখে থমকে দাঁড়ালো সে। পিছন থেকে ডাকলো,
‘আম্মু।’

অহনা শুনলেন না। রিজভী সাহেবও কিছু বুঝতে পারছেন না। রিজভী সাহেবকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন অহনা। নিভৃত নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো সেদিকে। মৌন সবটাই দেখছে। তবে তার দোষটা কোথায়?

টিএসসিতে বসে আছে মৌন, লুবনা আর ঝিনিয়া। মৌনর সাথে ভালো সখ্যতা তাদের। মৌন চুপচাপ বসে আছে। আজ নিভৃত তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। অনেকটা এড়িয়ে চলেছে। মৌন ভেবে পায়না তার দোষটা কোথায়! সে তো কিছু করেনি। সবাই কেনো তার প্রতি রাগ দেখায়। সবার রাগের কেন্দ্রবিন্দু কেন সেই হয়!

(চলবে)…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here