অনুভবের প্রহর পর্ব_০৯

0
283

#অনুভবের_প্রহর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব____০৯

‘প্রহর, অনুভব এসেছে।’

বাইরে থেকে মায়ের কন্ঠ কানে এলো প্রহরের। অনুভব এসেছে? তৎক্ষনাৎ বুকের ধড়ফড়ানি বেড়ে গেল তার। গুছিয়ে রাখা কথাগুলোর সুতো ছিঁড়ে গেল। সে বাইরে বের না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। এই মুহূর্তে অনুভবের সামনে পড়তে চাচ্ছে না। কথার পিঠে কথা বলার মতো অবস্থায় সে নেই। এগিয়ে গিয়ে সে বিছানায় বসে পড়লো। এরপর কি হবে? তাকে এখানে দেখে অনুভব নিশ্চয়ই অনেক রেগে যাবে। কিন্তু এ ছাড়া তো মানুষটার কাছে যাওয়ার আর কোনো উপায় ছিল না।

এক বুক অস্থিরতা নিয়ে প্রহর সময় পার করলো। অনুভব ভেতরে এলো না। সে-ও বের হলো না। কিছু সময় পর উঠে দাঁড়ালো। এভাবে চুপচাপ বসে থাকা যাবে না। এতকিছু যখন করতে পেরেছে আর অনুভবের মুখোমুখি হতে পারবে না? এটাও পারবে সে। দ্রুত শাড়ির আঁচল গুছিয়ে নিল। আজ দিয়ে তৃতীয় বারের মতো শাড়ি পড়েছে সে। শাড়ি সামলানো মোটেই সহজ কাজ নয়। কিন্তু অনুভবকে দেখানোর জন্য সে অসাধ্য সাধন করছে৷ বিয়ের পর প্রথম সাক্ষাৎ তাদের। একটু অন্য রকম তো হতেই হবে!

শাড়ির কুচি ঠিক করতে করতে কয়েক পা এগোতে অনুভব সামনে এসে দাঁড়ালো। এতক্ষণে স্থির হয়ে যাওয়া হার্টবিট আবার তুমুল বেগে বেড়ে গেল প্রহরের। অনুভবের মুখটা শক্ত হয়ে আছে৷ সে একটু হাসার চেষ্টা করলো। কিন্তু তার হাসিতে অনুভবের মুখোভঙ্গির পরিবর্তন সাধিত হলো না। প্রহর এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলো। কি বলা যায়? অনুভবও তো কোনো প্রশ্ন করছে না৷ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য সে স্মিত হেসে বলল,

‘আপনি কখন এলেন?’

অনুভব সে প্রশ্নের উত্তর দিল না। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

‘এসব কি করছো তুমি?’

‘কই? কিছু করেছি নাকি?’

‘কিছু করোনি? ব্যাগপত্র নিয়ে আমার এখানে চলে এসেছ কেন?’

প্রহরের ঠোঁটের কোণে হাসির রেশ। মুখটা স্বাভাবিক করে বলল,

‘এটা কোনো প্রশ্ন হলো স্বামী? যেথায় বর সেথায় বউ। স্যরি, বর যেখানে থাকবে, বউও সেখানে থাকবে। এটাই তো স্বাভাবিক। প্রকৃতির নিয়ম। আপনি প্রকৃতির নিয়মকে অস্বীকার করতে চান? অবমাননা করতে চান?’

‘প্রহর!’

অনুভব চিৎকার করে বলে উঠলো। প্রহর সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ চেপে ধরলো। খোলা দরজার দিকে এক পলক চেয়ে ফের অনুভবের দিকে তাকালো। চোখ জোড়া ছোট ছোট করে বলল,

‘এত চিৎকার করছেন কেন আপনি? এখানেই তো আমি।’

অনুভব এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে দিল। সরে গিয়ে বিছানায় বসে পড়লো। কি থেকে কি হয়ে গেল! এই মেয়েটা সত্যি সত্যি তার ঘর অবধি পৌঁছে গেল। পার্মানেন্টলি থাকার ব্যবস্থাও করে এসেছে। কি করবে এখন সে? কিভাবে সামাল দিবে? গ্রামে থাকতে যে মেয়েটা তার জন্য দিওয়ানা ছিল, সে-ও তো এতটা পাগলামি করেনি। সে গ্রাম ছেড়ে চলে আসার পর ভুলে গেছে। বছর দুই হলো ভালো একটা ছেলেকে বিয়ে করে নিয়েছে। শুধুমাত্র প্রহরের কাছে হেরে গেল সে। এই মেয়ের পাগলামি কিছুতে কমাতে পারলো না। হেরে গেল সে। হেরে গেল!

অনুভব কেমন অসহায় বোধ করতে লাগলো। প্রহরের জীবনটা সে এভাবে নষ্ট হতে দিতে পারে না। ওর সম্পূর্ণ জীবনটা পরে রয়েছে। এখনো ভার্সিটি কমপ্লিট করেনি। একটা ব্রাইট ফিউচার অপেক্ষা করছে। তাকে কিছু একটা করতে হবে! তার ভাবনার মাঝে প্রহর এগিয়ে এলো। কাছাকাছি এসে হুট করে তার বুকের উপর পড়ে যেতে নিল। অনুভব সঙ্গে সঙ্গে দু হাতে তার কাঁধ চেপে ধরে ফেলল। তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,

‘একটু বেশি ফিল্মি হয়ে যাচ্ছে না?’

‘আপনার কি মনে হয় আমি ইচ্ছে করে আপনার গায়ের উপর পড়তে নিয়েছিলাম?’

‘তা, নয়তো কি?’

‘ও হ্যালো! শাড়ির কুচিতে বেঁধে পড়তে নিয়েছিলাম। নিজেকে কি ভাবেন? সবসময় আপনার গায়ের উপর পড়ার জন্য আমি মুখে থাকি?’

‘অলরেডি গায়ের উপর পড়ে আছো।’

প্রহর থতমত খেয়ে গেল। অনুভব কাঁধ ছেড়ে দিতে সে সরে এলো। অযথা শাড়ির আঁচল টেনেটুনে পেঁচালো। অনুভবের থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে বিছানায় বসতে নিল। তৎক্ষনাৎ অনুভব বাজখাঁই গলায় ধমকে বলল,

‘খবরদার ওখানে বসবে না। বসবে না কিন্তু! ‘

‘শুধু বসনো না, আজ রাত থেকে আমি এখানেই শুবো।’

‘প্রহর, আমি বসতে বারণ করেছি। বিছানায় বসলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না বলে রাখলাম।’

প্রহর ভ্রু কুঁচকে অনুভবের দিকে তাকালো। বসলো না। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অনুভবের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এই ছেলে তাকে এখনো সম্পূর্ণ চিনতে পারেনি। এতদিন তার উপর কোনো অধিকার ছিল না বলে চুপ থেকেছে। এখন আর চুপ থাকার মানে হয় না। সে অনুভবের রাগান্বিত চেহারা সম্পূর্ণ ইগনোর করে বিছানায় গিয়ে লম্বালম্বি হয়ে শুয়ে পড়লো। অনুভব ছিটকে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। তোতলানো সুরে বলল,

‘পাগল হয়ে গেছো তু-তুমি? শুয়ে পড়লে কেন?’

‘এত অবাক হচ্ছেন কেন? আপনি তো বিছানায় বসতে বারণ করেছেন। শুতে তো বারণ করেননি। সেজন্য শুয়ে পড়লাম।’

‘এক্ষুণি উঠে পড়ো।’

‘আমি অসুস্থ মানুষ। এত চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলছেন কেন স্বামী?’

অনুভব বরাবরের মতো হাল ছেড়ে দিল। সে সত্যি এই মেয়ের সাথে পেরে উঠবে না। কি হবে এখন? আঙুল উঁচু করে শাসিয়ে সে নিজেই রুম থেকে বের হয়ে গেল। অনুভব চলে যেতে প্রহর ফিক করে হেসে ফেলল। মাথার নিচের বালিশটা উঠিয়ে বুকে চেপে ধরলো।

_______________

ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটার কাছাকাছি। প্রহর রুমে পায়চারি করছে। অনুভব এখনো বাড়ি ফেরেনি। সন্ধ্যার পর বের হয়েছে। এত রাত হয়ে গেল। এখনো ফিরছে না! সে বুঝতে পারছে তার জন্যই অনুভব বাড়ি ফিরছে না। মুহূর্তে চোখ দুটো জলে ভরে উঠলো। ভেতরে অপরাধ বোধের পোকা কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে লাগলো। রুম অন্ধকার করে সে ফ্লোরে বসে পড়লো। হাঁটুতে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো।

সময়ের সাথে সাথে রাতের গভীরতা বেড়ে যাচ্ছে। সেই সাথে বেড়ে যাচ্ছে অন্ধকারের গভীরত্ব। চারপাশ নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে। বাইরে থেকে দু একটা নিশাচর পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ বাদুরের পাখা ঝাপটানির শব্দ। সেই সাথে প্রহরের মৃদু স্বরের কান্নার আওয়াজ! সবকিছু মিলিয়ে প্রকৃতি যেন অদ্ভুত এক সত্তা ধারণ করলো।

কত সময় কেটে গেছে তা প্রহরের অজানা। আচমকা রুমে লাইট জ্বলে উঠতে সে মাথা উঁচু করলো। ভেজা চোখের পাপড়ি মেলে তাকিয়ে দেখলো অনুভব অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার ডান হাতটা এখনো সুইচের উপর!

অনুভব হন্তদন্ত হয়ে তার সামনে বসে পড়লো। চিন্তিত কন্ঠে বলল,

‘প্রহর? ফ্লোরে বসে আছো কেন? কি হয়েছে?’

উত্তর দিল না প্রহর। কোথা থেকে যেন এক সমুদ্র অভিমান এসে জেঁকে ধরলো তাকে। অভিমানের প্রতিটি বিন্দু রক্তে রক্তে মিশে গেল। ছড়িয়ে পড়লো কোষ থেকে কোষাভ্যন্তরে। চোখের শুষ্ক নদী পুনরায় কানায় কানায় ভরে উঠলো। মাথা নিচু করে ফেলল সে। এত কষ্ট কেন হচ্ছে? বুকের ভেতর কোথায় যেন পুড়ে পুড়ে উঠছে। এত যন্ত্রণা কেন ভালোবাসায়? সে কি সঠিকভাবে ভালোবাসতে পারেনি? নাকি ভুল মানুষকে ভালোবেসেছে?

ডুকরে কেঁদে উঠলো প্রহর। অনুভব প্রচন্ড রকমের শকড হলো। প্রহরকে কান্নারত অবস্থায় খুব একটা দেখেনি সে৷ দু একবার চোখ ঝাপসা দেখেছে শুধু। কিন্তু আজ এতটা ভেঙে পড়লো কেন? সে কি করবে ভেবে পেল না। দ্বিধান্বিত হয়ে ডান হাতটা প্রহরের মাথায় রাখলো। মিনমিন স্বরে বলল,

‘কি হয়েছে? কান্না করছো কেন?’

প্রহর ঝটকা দিয়ে অনুভবের হাতটা সরিয়ে দিল। দ্রুত চোখ মুখ মুছে উঠে পড়লো। এত তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিল যে অনুভব বিস্মিত হলো। প্রহর তার তোয়াক্কা না করে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। অনুভব ফ্লোর থেকে উঠে পড়লো। প্রহর ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার আগেই সে বাইরের জামাকাপড় পরিবর্তন করে নিল। পাতলা টিশার্ট পরে নিল। মনটা খারাপ হয়ে গেছে তার। প্রহর হঠাৎ কান্না করছে কেন? ও তো যথেষ্ট স্ট্রং!

প্রহর ওয়াশরুম থেকে বের হলো। অনুভব আড়চোখে দেখলো শাড়ি পাল্টে থ্রি পিস পরে নিয়েছে। প্রহরকে উদ্দেশ্য করে সে বলল,

‘রাতের খাবার খেয়েছ?’

প্রহর উত্তর দিল না। নিঃশব্দে হাত মুখ মুছতে লাগলো। অনুভব এগিয়ে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে এলো। প্রহরের পিছনে দাঁড়িয়ে আবার বলল,

‘বলছিলাম যে, কাল সকাল থেকে পড়াশোনা নিয়মিত ভার্সিটি যাওয়া শুরু করো। বেশ কিছুদিন ক্লাস ব্লাংক দিয়েছ। আর গ্যাপ দেওয়া ঠিক হবে না।’

প্রহর কিছুই বলল না। এতটা নির্বিকার ভাবে চলাফেরা করতে লাগলো যেন রুমে সে ব্যতীত দ্বিতীয় কেউ নেই। অনুভব শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। প্রহর বিছানা ছেড়ে বালিশ আর কাঁথা হাতে উঠাতে কপাল কুঁচকে গেল তার। অসুস্থ শরীর নিয়ে নিচে শোয়ার প্লান করছে নাকি? বালিশ, কাঁথা নিয়ে প্রহর আলনার কাছে গেল। কাঁথাটা মেঝেতে বিছিয়ে নিল। আর চুপ থাকতে পারলো না অনুভব। প্রহর কাঁথার উপর বালিশ রাখতে অনুভব এগিয়ে গিয়ে তার হাত টেনে ধরলো।

(চলবে)

ভালোমতো রি-চেইক করা হয়নি। বানান ভুলগুলো ধরিয়ে দিবেন। এডিট করে দিবো পরে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here