অনুভবের প্রহর পর্ব_১৫

0
284

#অনুভবের_প্রহর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_____১৫

শার্টের উপরের দুটো বাটন খুলে দরজায় নক করলো অনুভব। দরজা খুললো না। দমফাঁস লাগা গরমের ভেতর আবার টোকা দিল। দেড়-দুই মিনিট অপেক্ষা করে দরজায় টোকার পরিমাণ বাড়িয়ে দিল। ক্রমেই তা ধাক্কায় রূপান্তরিত হলো। কিন্তু প্রহরের দরজা খোলার নাম গন্ধ পাওয়া গেল না। আস্তে আস্তে রাগের মাত্রাটা বাড়তে লাগলো। অল্প সময়ের মধ্যে সেটা হিমালয় স্পর্শ করলো। ক্ষয়ে যাওয়া কাঠের দরজাটায় এমন জোরে আঘাত করলো যে মড়মড় শব্দ হলো। এতে অবশ্য একটা সুবিধা হলো। দরজা ভাঙার বদলে খুলে গেল।অনুভব ভেতরে ঢুকে পায়ের জুতা খুলতে প্রহর বলল,

‘দরজা ভেঙে ফেলার ইচ্ছে ছিল নাকি? এটা যে ভাড়া বাসা সেটা কি মানুষ জন ভুলে গেছে?’

এমনিতে প্রচন্ড ক্লান্ত ছিল অনুভব। তার উপর অপ্রশম্য রেগে ছিল। প্রহরের অনাদর মাখানো তাচ্ছিল্যের সুর সইতে পারলো না। মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল। এক ধাক্কায় প্রহরকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। কর্কশ গলায় বলল,

‘কি করছিলে এতক্ষণ? কার সাথে ব্যস্ত ছিলে? এত সময় লাগলো কেন দরজা খুলতে?’

অনুভবের একের পর এক প্রশ্নে প্রহরের হিমশিম অবস্থা। মাথার পেছন সাইডে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলো। দেয়ালের সাথে একটু জোরে লেগেছিল। হাতটা উঁচু করে একটু ব্যথার জায়গাটা স্পর্শ করতে চাইলো। নড়চড় করতে অনুভব আরো শক্ত করে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। হুট করে অনুভবের এত এগ্রেসিভ আচরণ সে নিতে পারলো না। শরীরের হাড়গোড় ভেঙে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে ফেলার পায়তারা করেছে নাকি এই ছেলে? সে অনুভবকে সরানোর চেষ্টা করলো। যন্ত্রণা ক্লিষ্ট মুখে বলল,

‘ব্যথা পাচ্ছি। ছাড়ুন!’

অনুভবের হাতের বাঁধন আরো শক্ত হয়ে এলো। প্রহরের চোখ দুটো না চাইতেও ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো। ঠোঁট চেপে সে কান্না থামানোর চেষ্টা চালিয়ে গেল। সে বেশ বুঝতে পারছে অনুভব তার চোখের জল দেখে ছাড়বে। কিন্তু সে কান্না করবে না। কিছুতেই না! সে অনুভবের দেহটা নিজের উপর থেকে সরানোর চেষ্টা করলো। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

‘ব্যথা পাচ্ছি আমি। কথা কানে যায় না?’

‘এত সময় লাগলো কেন দরজা খুলতে?’

‘শাওয়ার নিচ্ছিলাম আমি। শুনতে পাইনি। ছাড়ুন।’

ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে প্রহরের মাথার টাওয়ালটা খুলে গেল। একগুচ্ছ ভেজা চুল গলা, ঘাড়জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো। হাল ছেড়ে দিল প্রহর। চেহারায় ফুটে উঠলো এক অন্তহীন নিঃশর্ত অভিব্যক্তি। ভেজা চুল বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানির কয়েক ফোঁটা অনুভবের বাহুতে পড়তে চমকে গেল। হাতের বাঁধন শিথিল হয়ে এলো তার। দ্রুত প্রহরকে ছেড়ে সরে দাঁড়ালো। তারপর উন্মত্ত হৃদয়টা বাক্সবন্দি করে হেঁটে রুমে ঢুকে গেল।

দেয়ালে ভর দিয়ে মূর্তির মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো প্রহর। আস্তে আস্তে ব্যথাগুলো সহনীয় পর্যায়ে চলে এলো। দূরুহতম পরিস্থিতিতে অনুভবের সাথে কি করে টিকে থাকতে হবে তা শিখে গেছে সে। সেজন্য প্রতিবাদ করে রাগিয়ে দেয়নি মানুষটাকে। অনুভবের ছোটবড়, মাঝারি সব ধরনের রাগের মাত্রার সাথে ইতোমধ্যে পরিচয় ঘটে গেছে। কখনো কখনো তার দেওয়া কষ্ট গুলো অসহ্যকর মনে হয়েছে। পূঞ্জীভূত তিক্ততা মাঝে মাঝে বিরূপ করে তুলেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এটা মনে হয়নি কেন তার অনুভবের সাথে দেখা হলো? অনুভবের জায়গা জীবনে অন্য কেউ কেন আসলো না? বরঞ্চ অনুভব তার কাছে আশীর্বাদস্বরূপ। যাকে সে প্রথম দেখায় আমরণ সহযোগিতার এক নীরব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অনুভব তার অদমিত কিশোরী মনের প্রথম ভালোবাসা। প্রথম অনুভূতি! প্রথম স্পর্শ। তার প্রেমহীনতার শুষ্ক মরুভূমির এক ফোঁটা জল। এই ছেলেটার জন্য তার দম বন্ধ করা এক আলাদা অনুভূতির সাথে পরিচয় ঘটেছে। তার হৃদয়ের কাঠিন্যতা দূর করেছে এই মানুষটা। তার জীবনের প্রথম আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা, পাগলামি, স্থিরবিশ্বাস সব এই মানুষটাকে ঘিরে।

বসার ঘরে চুল ছেড়ে দীর্ঘক্ষণ বসে রইলো প্রহর। অনুভবের বাইরে বের হওয়ার প্রতীক্ষায় দরজার পানে চেয়ে রইলো। কিন্তু অনুভব রুম থেকে বের হচ্ছে না। অনুভবের দিকে এক নজর তাকিয়ে সে বুঝতে পেরেছে সকাল থেকে ছেলেটার পেটে কিছু পড়েনি। প্রচন্ড ক্লান্ত আর ঘর্মাক্ত ছিল। না খেয়ে রয়েছে বলে হুট করে এত রেগে গেছে।

আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করলো সে। অনুভবের দর্শন পাওয়া গেল না। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিল। বুঝতে পারলো ভেতর থেকে লক করা। ফোঁস করে শ্বাস ফেলল সে। এই বেয়াদব, অনুভূতিহীন, অন্তপ্রাণ মানুষটা তাকে এক দন্ড শান্তি দিবে না। দরজায় মৃদু ধাক্কা দিয়ে সে বলল,

‘অনুভব, দরজা খুলুন।’

ভেতর থেকে কোনো প্রতিত্তর এলো না। প্রহর হাল ছাড়ার পাত্র নয়। একের পর এক দরজায় আঘাত করে চলল। চেঁচিয়ে বলল,

‘দরজা খুলুন। আমার দুপুরের মেডিসিন খেতে হবে।’

তার এত তর্জনগর্জন ভরা ডাকে অনুভবের পাথরসম মন গলল না। দুঃখ বোধ নিয়ে সে সরে যেতে চাইলো। তৎক্ষনাৎ দরজা খোলার শব্দ কানে এলো। খুশিমনে ভেতরে ঢুকলো সে। আড়চোখে তাকিয়ে অনুভবের মেজাজ মাপার চেষ্টা করলো। বেশ স্বাভাবিক মনে হচ্ছে এখন। সুস্থদের মতো আলনার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল ঝারছে। অথচ এতক্ষণ কি উচ্ছৃঙ্খল রূপটাই না দেখাল। প্রহর আর কাছ ঘেঁষার সাহস পেল না। দূর থেকে বলল,

‘রান্নাঘরে খাবার ঢাকা রয়েছে। মানুষজনের রাগ কমলে খেয়ে নেয় যেন।’

এটুকু বলে প্রহর বিছানায় গিয়ে বসলো। অনুভব কোনো উত্তর না দিয়ে রুমের বাইরে বের হলো। প্রহর পিছু পিছু দরজা পর্যন্ত এলো। দরজার আড়াল থেকে অনুভবকে লক্ষ্য করলো। অনুভবকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখে প্রচন্ড খুশি হলো। সেই সাথে মনে ভয় ঢুকে গেল। টুকটাক রান্না শিখেছিল সে। কিন্তু তা খাওয়ার উপযুক্ত ছিল না। তবে আজ সারা সকাল ব্যয় করে সে ভাত আর ছোট মাছ রান্না করেছে। সমস্ত শ্রম আর মনোযোগ ঢেলে দিয়েছিল। তবুও অনুভব খেতে পারবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

এক দৌঁড়ে সে বিছানায় গিয়ে বসলো। কান খাঁড়া করে রইলো বসার ঘরের দিকে। অনুভবের কন্ঠস্বর শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে রইলো।

অনুভব রুমে ঢুকলো অনেক সময় পর। প্রহর তখন বসে বসে ঝিমাচ্ছিল। হালকা পদধ্বনির শব্দ কানে যেতে গা ঝাড়া দিয়ে বসলো। অনুভব রুমে কিছু খোঁজাখুঁজি করছে। প্রহর কিছুক্ষণ সময় দিল তাকে। রান্না নিয়ে কোনো কমপ্লিমেন্ট করে কি না দেখলো। কিন্তু অনুভবকে নিশ্চুপ দেখে বলে উঠলো,

‘আমার বাবা-মা আসতে চাচ্ছে এখানে। কি বলবো তাদের?’

অনুভবের পায়চারি থেমে গেল। টেনে টেনে পা ফেলে সে প্রহরের সামনে এলো। টেবিলের সাথের চেয়ারটা টেনে নিয়ে তাতে বসে পড়লো। অন্য দিকে তাকিয়ে ডাক দিল,

‘প্রহর!’

অনুভবের কন্ঠের শীতলতা প্রহরের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিল। নড়েচড়ে বসে বলল,

‘হুঁ!’

‘কেন করলে এসব? কন্টিনিউয়াসলি কেন করছো? কবে থামবে?’

‘কি করেছি বা করছি?’

‘তুমি খুব ভালো করে জানো কি করেছ বা করছো! এখনো সময় আছে নিজের পথ দেখো। আমাদের বিয়ের ঘটনাটা বেশি মানুষ জানে না। দু চারজন যারা জানে, দ্রুত ভুলে যাবে। এখনো সময় আছে নিজের জন্য আলাদা পৃথিবী তৈরি করো। একটা অকল্পনীয় সুন্দর পৃথিবী তোমায় হাতছানি দিচ্ছে। সুযোগ হাতছাড়া করো না।’

‘যে পৃথিবীতে আপনি নেই সে পৃথিবী আমার চাই না।’

চট করে চোখ তুলে তাকালো অনুভব। এক পলক প্রহরের মুখ দর্শন করে আবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। গম্ভীর স্বরে বলল,

‘অনেক আগে থেকে জীবনের প্রতি ভীষণ উদাসীন আমি। বুদ্ধিহীন, নিষ্কর্মা, বাউন্ডুলে, যাচ্ছে তাই একটা ছেলে। আমার বেঁচে থাকার কোনো আশা নেই, আকাঙ্খা নেই। নেই কোনো উচ্চাশা। জীবন নামক পথের উদ্দেশ্যহীন, গন্তব্যহীন এক পথিক বলতে পারো। আমার এই পথযাত্রায় কাউকে সঙ্গী করতে চাই না। বুঝতে পেরেছ তুমি?’

‘পেরেছি। আপনি নিজেকে যত নিচু করে দেখুন না কেন, যত নীতিবাক্য বলুন না কেন আপনাকে আমি ছাড়ছি না।’

‘কিছু জিনিস ছাড়তে হয় না, নিজে থেকে ছেড়ে চলে যায়।’

মনে মনে বলে অনুভব উঠে দাঁড়ালো। রাগারাগির মধ্যে গেল না। কিছুটা সময় নিয়ে শান্ত গলায় বলল,

‘ভবিষ্যতে তুমি আমাকে দোষারোপ করতে পারবে না প্রহর। গভীর রাতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে পারবে না যে আমি আগে থেকে কেন সতর্ক করিনি তোমায়। মাঝরাতে বালিশ ভেজানোর আগে আমায় অভিশাপ দিতে পারবে না তুমি। শেষকথা, তোমায় আমি কখনো মেনে নেইনি। আর ভবিষ্যতেও নিবো না।’

প্রহরের জবারের অপেক্ষা না করে অনুভব রুমের বাইরে বের হলো।

____________

‘আপনার হাতে কি? কিসের মেডিসিন খেলেন? অসুস্থ লাগছে আপনার? মাথা ব্যথা করে?’

চমকে দরজার দিকে তাকালো অনুভব। হাতে থাকা পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে এক নিঃশ্বাসে শেষ করলো। স্বাভাবিক হয়ে বলল,

‘হালকা জ্বর জ্বর লাগছে। প্যারাসিটামল খেলাম।’

চিন্তিত হয়ে রুমের ভেতর ঢুকলো প্রহর। হাতটা উঁচু করে অনুভবের কপাল স্পর্শ করতে অনুভব মাথা সরিয়ে ফেলল। পিছিয়ে গিয়ে বলল,

‘ঠিক আছি আমি।’

‘মাথায় পানি নিবেন? অনেক জ্বর নাকি?’

‘নাহ! বললাম তো ঠিক আছি।’

প্রহর তবুও চিন্তামুক্ত হলো না। দ্বিধান্বিত স্বরে বলল,

‘আপনি সত্যি সত্যি এখানে ঘুমাবেন?’

‘হ্যাঁ।’

অনুভব সিদ্ধান্ত নিয়েছে মায়ের রুমে ঘুমাবে। এটা মানতে প্রহরের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। শ্বাশুড়ি মায়ের রুম ফাঁকা পেয়ে অনুভব যে এমন সিদ্ধান্ত নিবে তা কল্পনার বাইরে ছিল। সে এক নজরে রুমের তুচ্ছাতিতুচ্ছ সবকিছু পরখ করলো। মাথা নিচু করে বলল,

‘আমিও তাহলে এ রুমে ঘুমাই।’

‘কি! কেন? তোমার জন্য আমি নিজের রুম ছেড়ে এখানে আসলাম। এখন তুমি বলছো এখানে ঘুমাতে চাও?’

‘আসলে আমি একা থাকতে চাই না। ভূতের ভয় পাই! আপনাদের বাসা তো আমার একদম অপরিচিত। একা থাকতে পারবো না আমি!’

প্রহরের ভীত কন্ঠস্বর অনুভবের মন নরম করে দিল। অভেদ্য নিঃসঙ্গতার তল স্পর্শ করলো। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইলো। তারপর করুণা ঝেড়ে কপাল কুঁচকে বলল,

‘ঠিক আছে। ওই রুমে চলো।’

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here