অনুভবের প্রহর পর্ব_৩১

0
532

#অনুভবের_প্রহর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব____৩১

ছবির অ্যালবামটা উল্টেপাল্টে দেখছে প্রহর। মোটা এক অ্যালবাম জুড়ে শুধু অনুভবের ছবি। শেষের দিকে কিছু খালি ছিল। সেগুলো পূর্ণ করার জন্য ইতোমধ্যে বেশকিছু নতুন ছবি বের করেছে। এবারের ছবিগুলোতে অনুভব একা নয়। সাথে সে আছে! একটা ছবি সামনে মেলে ধরলো প্রহর৷ অনুভবের পাঁজাকোলে সে। দুজনের বিস্তৃত হাসি মাখা দৃষ্টি একে-অপরের পানে। ছবিটা সমুদ্রের পাড়ে তোলা। হাসলো প্রহর। দুজনের একত্রিত ছবিগুলো অ্যালবামের শেষ পাতা গুলোতে রাখলো।

রুমের বড় দেয়াল ঘড়িতে টিকটিক শব্দ হচ্ছে। সেকেন্ডের কাঁটা নিয়মমাফিক ঘুরছে। আস্তে আস্তে বুকের ভেতর কেমন চাপ অনুভব করছে প্রহর। গলার মধ্যে খুসখুস করছে৷ মনে হচ্ছে দীর্ঘদিনের কফ জমে আছে। ইদানীং হুটহাট কাশিও শুরু হয়৷ সেদিন মাঝরাতে হঠাৎ দু বার কেশে উঠলো। তাতে অনুভবের সে কি দুশ্চিন্তা। চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। যন্ত্রণার ছাপ! তার ছোটখাটো ব্যথায় অনুভব পাগলের মতো হয়ে যায়। এজন্য প্রহর নিজেকে আড়ালে রাখার চেষ্টা করে। অনুভব কাছে থাকলে সব সময় শরীরের অস্বস্তি বুঝতে দিতে চায় না। বুঝতে দিতে চায় না শারীরিক অসুস্থতাটুকু। তাকে নিয়ে মানুষটার ছটফটানি একদম সহ্য হয় না।

গলার কাছের খুসখুসানি বেড়ে চলেছে৷ এবার উঠতে হবে। প্রহর অ্যালবামটা বিছানায় রেখে দাঁড়িয়ে পড়লো। মুখে হাত চেপে কিছু মুহূর্ত স্থির রইলো। অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে দৌঁড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। বেসিনে মুখ রেখে ক্রমাগত কাশতে লাগলো। কাশতে কাশতে এক পর্যায়ে বমি করে ফেলল। ভেতরে ভয়ংকর কষ্ট হচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে বুকে। মাথাটা দপদপ করছে। শরীর কাঁপছে অনবরত। বাম হাতে কোনো রকমে পানির ট্যাপ ছাড়লো। এক সময় খেয়াল করলো কাশির সাথে রক্ত বের হয়েছে। কেমন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সে৷ তার কি বড় ধরনের অসুখ হয়েছে? যক্ষা টাইপ কিছু? ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো প্রহর।

একটানা কলিং বেল বাজছে। লতিফার মা ভীষণ বিরক্ত হলো। অসময়ে কলিং বেল বাজায় কে? বাজাবে ভালো কথা। একবার বাজালেও তো হয়! এমন বিরতিহীন বাজাতে হবে? রান্না ফেলে রেখে তো চট করে যাওয়া যায় না!

সে চুলার আঁচ কমিয়ে দিল। তরকারির কড়াইতে ঢাকনা দিল। তারপর বিরক্তি ভরা দৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে গেল। দরজা খোলার অপেক্ষা মাত্র! তাকে প্রায় ঢেলে ঝড়ের গতিতে কেউ একজন ঢুকলো। সে হাঁ করে তাকিয়ে দেখলো এ বাড়ির একমাত্র জামাই। লতিফার মা ভীষণ বিরক্ত হলো। বউ কি পালিয়ে যাচ্ছে নাকি? একেবারে ঘূর্ণির বেগে উড়ে গিয়ে বউয়ের কাছে যেতে হবে! এখনকার আধুনিক যুগের পোলাপান। লাজ-লজ্জা বলতে কিছু চিনে নাকি? বিড়বিড় করতে করতে আবার রান্নাঘরে ঢুকল।

রুমে ঢুকে হাঁফাতে লাগলো অনুভব। আজ সারাদিন রোদের তেজ ভারী ছিল। যার দরুন শহরে ভ্যাপসা গরম পড়েছে। সে গরমের মধ্যে ছুটে আসতে আসতে অনুভবের শরীর ঘেমে একাকার। গলা শুকিয়ে মরুভূমি! নিজের দিকে খেয়াল নেই তার। রুমের এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো প্রহর নেই। অস্থির হয়ে ডাকলো,

‘প্রহর? প্রহর!’

পাগলের মতো রুমে খুঁজে বেলকনির পর্দা সরালো। বেলকনিতেও নেই! অস্থিরতা বেড়ে চলল। বেলকনি থেকে বের হতে ওয়াশরুমের দরজা খুলে গেল। তীব্র আগ্রহ নিয়ে তাকালো অনুভব। প্রহর বের হয়েছে। চোখ-মুখ ভেজা। কানের দু পাশের কিছু অবাধ্য চুল দিয়ে পানি পড়ছে। অনুভব অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো প্রহরের পানে। যেন বহুদিন পর দেখছে৷ চোখের তৃপ্তি মেটাচ্ছে।

মূর্তেমান অনুভবকে দেখে প্রহরের চোখ ছোট ছোট হয়ে এলো। স্থানচ্যুত হয়ে রুমের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে পড়লো সে। অনুভবের এলোমেলো চেহারা অনেক কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছে। কিছু একটা তো হয়েছে। সে চিন্তিত স্বরে বললো,

‘এত অস্থির হয়ে আছেন কেন আপনি? এমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে কেন? দেখি এদিকে আসুন তো।’

অনুভবের টনক নড়লো। একদৌঁড়ে গিয়ে প্রহরকে ঝাপটে ধরলো। সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল যেন ছেড়ে দিলে পালিয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে। অদৃশ্য হয়ে যাবে! প্রহর চমকালো। অনুভবের অদ্ভুত আচরণের অর্থ উদ্ধার করতে পারলো না। এতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে যে দম যায় যায় অবস্থা। সে অনুভবের পিঠে হাত বুলিয়ে দিল। নরম গলায় জিগ্যেস করলো,

‘কিছু হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে?’

একবার চোখ খুলে আবার বন্ধ করলো অনুভব। উত্তর দিল না। গলা ধরে আসছে তার। এত কান্না পাচ্ছে! প্রহর দ্বিতীয় বার প্রশ্ন করলো,

‘আপনার শরীর কাঁপছে অনুভব। এমন করছেন কেন? অসুস্থ লাগছে?’

প্রহর নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। অনুভব ছাড়লো না। হাতের বাঁধন শক্ত করলো। কম্পিত সুরে শুধু বললো,

‘আমি ঠিক আছি।’

________

দিনগুলো কেমন দ্রুত কাটছে। চোখের পলক ফেলার আগে যেন দিন গড়িয়ে রাত হচ্ছে। আবার চোখ বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে রাতের অন্ধকার কেটে ভোর হচ্ছে। মনে হচ্ছে সময়ের চেয়ে দ্রুততর পৃথিবীতে কিছু নেই। এইতো সেদিন মাত্র অনুভব সাদা গোলাপের চারা টা এনে দিল প্রহরকে। অথচ এর মধ্যে অনেক দিন কেটে গেছে। গাছের মরা পাতা ঝরে গিয়েছে৷ কিছু নতুন পাতা গজিয়েছে। এর মধ্যে গাছে কুঁড়িও জন্মেছে। প্রহর হাত দিয়ে টবের মাটি পরিষ্কার করলো। গাছের অবাঞ্ছিত পাতাগুলো কেটে ফেলল। গোড়ায় পানি দিয়ে সে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে রইলো।

‘পূর্বি মা?’

রুম থেকে বাবার কন্ঠ ভেসে আসছে। প্রহর বেলকনি থেকে উত্তর দিল।

‘আসছি বাবা।’

আসছি বলার পরো প্রহর আসছে না। ইরতাজ উদ্দিন রুমের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে রইলেন। আগে যখন তখন মেয়ের রুমে আসতেন৷ কোনো দ্বিধা ছিল না। কিন্তু নিয়ম পাল্টেছে৷ মেয়ে এখন বিবাহিত। রুমে আসতে আড়ষ্টতা কাজ করে। আরো কিছুক্ষণ ঠায় স্থির হয়ে রইলেন তিনি। কিন্তু বেলকনিতে মাটি ঝুরঝুরে করার শব্দ ছাড়া কিছু শোনা যাচ্ছে না। তিনি শ্বাস ফেললেন। মেয়েটা সারাজীবন একই রকম রয়ে গেল। প্রহরের বেড টেবিলে গিয়ে বসলেন তিনি৷ টেবিলে একটা ছবির ফ্রেম। ফ্রেমে তিনি আর প্রহর। ছবিটা অনেক আগের। প্রহরের জেএসসি তে গোল্ডেন এ+ পাওয়ার পর তোলা হয়েছিল। তার কিছুদিন পর প্রহর ছবিটা বাঁধিয়ে এনেছে। বিয়ের পর অনুভবের বাড়িতে যাওয়ার পর দেখেছেন রুমে ফ্রেমটা নেই। এখন বুঝতে পারলেন, ফ্রেমটা সবসময় মেয়ের সাথে থাকে। বড় বিষণ্ণতা অনুভব করলেন তিনি৷ বুকের ভেতর হু হু করে উঠলো৷ ফ্রেমটা হাতে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

‘বাবা, কি করছো? জানো, গোলাপ গাছে কুঁড়ি এসেছে!’

নিজেকে সামলে নিলেন ইরতাজ উদ্দিন। ফ্রেমটা যথাস্থানে রেখে উঠে দাঁড়ালেন৷ মেয়ের মুখ দুপুর রোদের মতো ঝলমল করছে। দেখে মনে হচ্ছে, গোলাপে কুঁড়ি আসার চেয়ে আনন্দের কিছু পৃথিবীতে নেই। তিনি ভেতরে ভেতরে পুলকিত হলেন। যাক! মেয়েটা অন্তত প্রশান্তিতে আছে। আর মানসিক প্রশান্তির চেয়ে বড় সুখ পৃথিবীতে নেই।

‘পূর্বি মা, অনুভব কোথায়?’

‘দুপুরের দিকে একটু বের হয়েছে বাবা।’

‘তোমাকে তো একবার ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। ছোটখাটো চেক-আপ হবে একটা। আমি নিয়ে যেতে চাচ্ছি। কি বলো?’

‘আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি বাবা।’

_______

রাতের খাওয়া শেষ হয়েছে অনেক আগে। অনুভব দাঁড়িয়ে আছে বেলকনিতে। অন্ধকার বেলকনি৷ হাত বাড়ালে পাশের দেয়াল স্পর্শ করা যায়। দেয়ালে সুইচ আছে। সুইচে চাপ দিলে মোহময়ী এক আলোয় বেলকনি ভরে উঠবে। কিন্তু সে আলো জ্বালালো না। মস্তিষ্ক জুড়ে কত রকমের চিন্তা ঘুরছে। আপাতত সব রেখে সে রুমে ঢুকলো। প্রহর রুমে নেই। মায়ের রুমে গিয়েছে অনেকক্ষণ হলো। এখনো ফেরেনি। অনুভব দরজার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। প্রহরের শরীরের অবস্থা বিবেচনা করে ডাক্তার অনেক নিয়ম করে দিয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো রাতের বেলা দ্রুত ঘুমিয়ে পড়া। এখনো ফিরছে না কেন?

একবার ঘড়ির দিকে একবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে অনুভব। অস্থিরতা নিয়ে পায়চারি করছে রুমে। সময় কাটছে না। টান টান করে রাখা বেডশিট সে এলোমেলো করে ফের টান টান করলো। বইয়ের তাকে কিছু বই নাড়াচাড়া করলো৷ তবুও স্থির হতে পারলো না।

অস্থিরতা যখন তুমুল পর্যায়ে তখন প্রহর ফিরলো। অনুভব হাতের বইটা রেখে দ্রুত এগিয়ে এলো। ফস করে কিছু বলতে গিয়ে সামলে নিল নিজেকে। বেশি সিলি হয়ে যাবে। তবুও মিনমিন করে বললো,

‘অপেক্ষা করছিলাম তো।’

‘হুঁ? কিছু বললেন?’

দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে প্রহর ঘুরে তাকালো।

‘না! বলছিলাম ঘুমাতে হবে না? ডাক্তার দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে বলেছে।’

প্রহর বাধ্য মেয়ের মতো বিছানায় গিয়ে বসলো। অনুভব বাহু বাড়িয়ে দিতে সেখানে মাথা রাখলো। গায়ে ব্লাঙ্কেট টেনে দিয়ে টেবিল ল্যাম্প বন্ধ করলো অনুভব। প্রহরের শরীর শুকিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে। তার পাসপোর্টের কাজ শেষ দিকে প্রায়। কাগজাদি রেডি হয়ে গেলে মাদ্রাজ যাওয়া যাবে।

‘শুনছেন?’

আলো আঁধারির খেলায় প্রহরের গভীর কন্ঠস্বর বুকে তোলপাড় করে তুলল অনুভবের। হালকা স্বরে উত্তর দিল,

‘বলো, শুনছি।’

‘আমি আরেকবার গ্রামে যেতে চাই। একবারও তো মায়ের কবর ঘুরে আসা হলো না।’

শহরে ফেরার পর অনুভব একবার গিয়েছিল। প্রহর যাওয়ার জন্য বায়না ধরবে বলে তাকে জানানো হয়নি। কিন্তু গিয়ে দেরি করেনি। নাজমুলের সাথে এক গাড়িতে গিয়ে সে-ই গাড়িতে ফেরত এসেছে। হঠাৎ প্রহরের আবদার শুনে চমকালো সে।

‘তোমার শরীর তো সুস্থ না। আরেকটু সুস্থ হও৷ তারপর যাব।’

‘আমি সুস্থ আছি তো। চলুন না যাই। মামা-মামীকে কতদিন হলো দেখি না।’

‘ফোনে তো কথা হয়। দেখে কি করবে? তাছাড়া তোমার বাবা রাজি হবে না। অসুস্থ তুমি। এরকম অবস্থায় এতটা পথ জার্নি করার প্রশ্নই উঠে না।’

‘জার্নিতে কোনো সমস্যা হবে না আমার। গ্রামের সবুজ পরিবেশ ভালো লাগবে অনেক। বাবাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না। বাবা মত দিয়েছে৷ চলুন না! আচ্ছা যান! বেশি দেরি করবো না। যেদিন যাব সেদিনই চলে আসবো। বাবার গাড়ি নিয়ে যাব। কোনো সমস্যা হবে না। কি বলেন?’

অনুভব প্রহরকে থামানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু প্রহর তার সিদ্ধান্তে অটল। বাচ্চাদের মতো ঘুরেফিরে একই জিনিস বলতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত হার মানলো অনুভব। রাজি হয়ে গেল। প্রহর বাচ্চাদের মতো খুশি হয়ে উঠলো। অনুভব দীর্ঘশ্বাস লুকালো। প্রহরের কপালে অধর স্পর্শ করে বললো,

‘ঘুমিয়ে পড়ো এবার। দেখি চোখ বন্ধ করো তো!’

প্রহর চোখ বন্ধ করলো না। উল্টো চোখ বড় বড় করে তাকালো। সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,

‘বরসাহেব! সবসময় আপনার হুকুম মেনে চলতে হবে কেন? হুঁ? ঘুমাব না আমি। কি করবেন? ভয় পাই আপনাকে? একটুও না!’

প্রহর খিলখিল করে হেসে ফেলল। তার হাসির তরঙ্গ কানে মৃদু ঝংকার তুলে যাচ্ছে। হৃৎস্পন্দনের গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফোঁস করে শ্বাস ফেলল অনুভব। এই মেয়েটা নিশ্চিত তাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বে!

(চলবে)

পাঠকমহল–
https://www.facebook.com/groups/552626552415182/?ref=share

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here