হৃদয়ের শুভ্রতা🌸পর্ব-২৬

0
2009

#হৃদয়ের_শুভ্রতা🌸🌸

পর্ব~২৬

#ফাবিহা_নওশীন

🍀🍀
অরিত্র গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে দেখছে।পরিচিত শহর,রাস্তাঘাট ছেড়ে গাড়ি চলছে এয়ারপোর্টের দিকে।
হয়তো আর কখনো দেখতে পাবেনা এই শহর,এই শহরের পরিচিত মুখগুলোকে।ওর রোজকে।অরিত্র জানালার কাচ খোলে দিলো।শু শু করে বাতাস বইছে।এলোমেলো করে দিচ্ছে ওর চুলগুলো।

রোজ ফ্যামিলির সাথে বসে নাস্তা করছে।নাস্তা করছে বললে ভুল হবে নাস্তা করার অভিনয় করছে।প্লেটের খাবার নাড়াচাড়া করছে।বারবার ওর চোখজোড়া পানিতে ভরে যাচ্ছে।রোজ সবার আড়ালে চোখের পানি মুছে নিচ্ছে।
তখনই ডোর বেল বেজে উঠে।একজন সার্ভেন্ট গিয়ে দরজা খোলে দিলো।
একজন মহিলা একজন পুরুষ ভিতরে ঢুকলো।সবাই সেদিকে চেয়ে আছে।কারণ তারা কারোই পরিচিত কেউনা।রোজের মাম্মা উঠে তাদের সামনে গিয়ে বললো,
—–আপনাদের তো চিনলাম না।

ভদ্রমহিলার চেহারায় আতংক স্পষ্ট।মনে হচ্ছে কোনো বিপদে পড়েছে।ভদ্রমহিলা কিছু বলার আগেই ভদ্রলোক বললো,
—–আমরা অরিত্রের পেরেন্স।

রোজ প্লেট থেকে চোখ সরিয়ে তাদের দিকে তাকালো।হ্যা অরিত্রের বাবা-মা এরা।
অরিত্রের বাবা-মাকে দেখে সবাই বেশ অবাক হয়েছে।

রোজের মাম্মা অস্বস্তিবোধ করলেও তাদেরকে বসতে বললো।
অরিত্রের মম রোজের মাম্মার হাত ধরে বললো,
——বসার সময় নেই বোন।আমাদের পাপের শাস্তি আমার ছেলেকে দিবেন না প্লিজ।
ওকে ফিরান।

রোজ উনাদের কথা শুনে বুঝতে পারছে অরিত্র চলে যাচ্ছে।একটা চাপা আর্তনাদ ওর বুক চিরে বের হতে চাইছে।গলায় কিছু একটা দলা পাকিয়ে যাচ্ছে।

রোজের মাম্মা বললো,
—–অরিত্র!! কি হয়েছে ওর?

সবাই একে একে টেবিল ত্যাগ করে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে।

——অরিত্র আমাদের উপর রাগ করে আজীবনের জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছে।কিছুক্ষণ আগে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে।হাজার চেষ্টা করেও আটকাতে পারিনি।রোজকে….
বলেই রোজের দিকে এগিয়ে গেলো।রোজ নীরবে চোখের পানি ফেলছে।

অরিত্রের মম রোজের কাছে গিয়ে বললো,
—–তুমি কি রোজ?

রোজ মাথা নিচু করে বললো,
—–হ্যা।

তিনি রোজের কাছে মিনতি করতে লাগলো যেনো অরিত্রকে ক্ষমা করে ফিরিয়ে আনে।রোজ মাথা তুলছেনা।চুপচাপ চোখের পানি ফেলছে।এতদিন ফ্যামিলির সবাই যেভাবে ওকে সাপোর্ট দিয়েছে এখন ও কিছুতেই পারবেনা ফ্যামিলির বিরুদ্ধে যেতে।রোজ মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলায় ব্যস্ত।সবার দৃষ্টি রোজের দিকে।

রোজের দাদি রোজের পাপাকে বললো,
—–রোদ্দুর কিছু কর।রোজ অনেক কষ্ট পাচ্ছে।

রোজের মাম্মা রোজের সামনে গিয়ে ওর মুখ উপরে তুললো।মেয়ের চোখমুখ স্পষ্ট বলছে ও অরিত্রকে ফেরাতে চায়।রোজ মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়লো।রোজের মাম্মা রোজের পাপার দিকে তাকালো।

রোজের পাপা বললো,
—–হৃদ রোজকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যা।

রোজের মাম্মা মেয়ের চোখের পানি মুছে বললো,
—–যা।শুভ্রাকে সাথে নিয়ে যা।তাড়াতাড়ি যা নয়তো দেরি হয়ে যাবে।
বলতে দেরি রোজের যেতে দেরি হয়নি।

রোজের মাম্মা অরিত্রের বাবা-মাকে যেতে দেয়নি।তাদেরকে বলছে যাতে এখানে থাকে।তারা তাদের বুঝাপড়া করে নিবে।

হৃদ ফুলস্পিডে গাড়ি চালাচ্ছে।রোজ অরিত্রকে ফোনের উপর ফোন করেই যাচ্ছে কিন্তু ওর ফোন অফ।রোজ কেদে চলেছে অপরদিকে শুভ্রা ওকে বারবার শান্তনা দিচ্ছে।

অবশেষে ওরা এয়ারপোর্টে পৌছে গেলো।এখনো লন্ডনের প্লেন ছাড়েনি।ওরা খোজ নিয়ে জানতে পারে এখনো এনাউন্সমেন্ট করে নি।এখনো অনেক সময় আছে।ওরা পুরো এয়ারপোর্ট জুড়ে অরিত্রকে খোজছে কিন্তু খোজে পাচ্ছেনা।রোজ এয়ারপোর্ট জুড়ে পাগলের মতো করছে কিন্তু অরিত্রের দেখা মিলেনি।
রোজকে হৃদ শান্তনা দিচ্ছে।ওরা অনেকক্ষন যাবত অরিত্রকে খোজে টায়ার্ড।

রোজ ভাইয়ের বুকে পড়ে কাদছে।হটাৎ শুভ্রার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুললো।
—–রোজ পেয়ে গেছি তোর রাজাকে।

রোজ শুভ্রার দিকে তাকালো।শুভ্রা চোখ দিয়ে ইশারা করলো।অরিত্র কিসব কাগজপত্র দেখছে।রোজ অরিত্রকে দেখে কাদতে কাদতে হেসে ফেললো।অরিত্র তখনও রোজকে দেখেনি।
রোজ দৌড়ে অরিত্রের কাছে গিয়ে অরিত্রকে আচমকা জড়িয়ে ধরলো।অরিত্রকে হটাৎ কেউ এভাবে জড়িয়ে ধরায় অরিত্র চমকে যায়।

অরিত্র দুহাত উচু করে বললো,
—–আরে কে আপ…

এটুকু বলেই থেমে গেলো।কারণ ওর অনুভূতিরা বলছে এ কাছের কেউ,খুব কাছের।

রোজ মাথা তুলে বললো,
—–কি ভেবেছিলে তুমি অন্য কোনো সুন্দরী মেয়ে পাগল হয়ে তোমাকে জড়িয়ে ধরেছে?

অরিত্র কথা বলবে কি ও তো রোজকে দেখে রীতিমতো শকড।রোজ এখন এভাবে এখানে আসবে সেটা ও কল্পনাও করেনি।

—–কথা বলছো না কেন?

—–তুমি!!

—–ভূত দেখলে নাকি?

—–হ্যা তেমনই।

—–কিহ!!

—–না মানে তুমি এখানে যে?

রোজ মুখ বাকিয়ে বললো,
—–তোমাকে গুডবাই জানাতে এসেছি।আবার কখনো দেখা হয় কিনা তাই।

রোজের কথা শুনে অরিত্রের মুখ কালো হয়ে গেলো।রোজ ওকে বিদায় জানাতে এসেছে।
অরিত্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
—–ওওও।

রোজ আবারো কেদে দিলো।
—–ওওও??? তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিলে আর এখন বলছো ওওও?তোমার মতো স্বার্থপর ছেলে আমি দুটো দেখিনি।
কেন আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিলে? আমার কত কষ্ট হচ্ছিলো জানো?

—–তুমি তো আমাকে আর চাওনা।কি করে আমি এখানে থাকতে পারি তুমিহীন।

রোজ অরিত্রকে আবারো জড়িয়ে ধরলো।তারপর বললো,
—-তুমি কোথাও যাবেনা।আমার সাথে চলো আমাদের বাড়িতে।ভয় পেওনা।তারাই আমাকে এখানে আসতে বলেছে।তোমার মম,পাপাও আমাদের বাড়িতে।মাম্মার কাছে তোমার মম ক্ষমা চেয়েছে।আর আমার মাম্মা ক্ষমা করেও দিয়েছে আই নো মাই মাম্মা।

অরিত্রের এসব শুনে অনেক খুশি লাগছে যেনো মরুভূমিতে হটাৎ করে এক পশলা বৃষ্টির দেখা পেয়েছে।

—–এহেম!এহেম!
রোজ শরম কর।বড় ভাই ভাবি এখানে আছে।
হৃদ মজা করে বললো।

রোজ মাথা তুলে বললো,
—–তোমাকে কে বলেছে কাবাবের হাড্ডি হতে?তোমার লজ্জা লাগলে দূরে সরো আমাকে ডিসটার্ব করোনা।

—–হায়রে মেরি বেহেনা!!

অরিত্র আর শুভ্রা ওদের কথা শুনে হেসে দিলো।

বাড়িতে সবাই একসাথে বসে আছে।নিজেদের মধ্যে সবটা মিটমাট করে নিয়েছে।অরিত্রের ফ্যামিলি ক্ষমা চেয়েছে।রোজ আর অরিত্র একে অপরকে ভালোবাসে তাই আর দুই ফ্যামিলির মধ্যে দূরত্ব রাখতে চায়না।
রোজ আর অরিত্রের এনগেজমেন্ট করে রাখবে।অরিত্রের পোস্ট গ্রাজুয়েশন শেষ করে বিজনেসে জয়েন করার পর ওদের বিয়ে দিবে।
২-৩বছর পরে বিয়ে হবে সেটাই ফাইনাল করে অরিত্রের বাবা-মা বাড়িতে ফিরে গেলেন।
সবাই রোজের কথা ভেবেই সব দূরত্ব মিটিয়ে নিয়েছে।তাছাড়া অকারণে এহেন দূরত্ব রাখার মানেই হয়না।

রোজ আর অরিত্র একসাথে বেরিয়েছে।
রোজ অরিত্রকে বললো,
—–তোমাকে কিন্তু পুরোপুরি ক্ষমা করিনি।

—–মানে অর্ধেক করেছো?বাকি অর্ধেকের জন্য কি শাস্তি দিবেন মাই কুইন?

—–আমাকে আজ সারাদিন ঘুরাতে হবে।

—–এরকম শাস্তি আমি হাজার বার পেতে রাজী জান।

অরিত্র ড্রাইভ করছে।হটাৎ জ্যামে গাড়ি আটকে যায়।ওরা ওখানেই বসে থাকে।অরিত্র গাড়ির গ্লাস খোলে দেয়।ওর মন অনেক ফুরফুরা।
পাশের শপিংমল থেকে দুটো মেয়ে বের হচ্ছে।ওরা আড়চোখে বারবার অরিত্রকে দেখছে।বিষয়টি অরিত্র খেয়াল না করলেও রোজ করেছে।
রোজ হটাৎ ক্ষেপে যায়।

রোজ জোরে চিতকার করে মেয়ে দুটোকে বলে,
—–ওই লুচ্চি মাইয়ারা জীবনে ছেলে দেখিস নি?এভাবে ঢেপঢেপ করে চেয়ে আছিস কেন?আমার জিনিসে চোখ দিয়েছিস কেন?চিনিস আমাকে আমি রোজ একদম চোখ গেলে দেবো।

রোজের এমন অদ্ভুত কথাবার্তা শুনে অরিত্র ভরকে গেলো।পাশের মেয়েগুলোকে দেখে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে রোজের মুখ চেপে ধরে বললো,
—–আপুরা দুঃখীত।প্লিজ কিছু মনে করবেনা।

রোজ অরিত্রের হাত ছাড়িয়ে নিলো।তারপর বললো,
—–তুমি আমার মুখ চেপে ধরেছো কেন?
শ্বাস আটকে যাচ্ছিলো।

—–কি ভাষা এগুলো?

—–তাহলে কি করতাম?তুমি দেখোনি মেয়ে গুলো কি লুচু?
ছিহ!!ছেলেরা এভাবে তাকায় জানতাম কিন্তু ওই মেয়েগুলো?একেকটা লুচ্চি।ইমরান হাসমির গার্লফ্রেন্ড।
আমি ওদের মিক্সিং মেশিনে দিয়ে জুস বানাতাম।তুমি আমার মুখ চেপে ধরলে কেন?

অরিত্র চোখ বড়বড় করে বললো,
—–হায় আল্লাহ তুমি এত ঝগড়াটে কেন?

রোজ ভ্রু কুচকে বললো,
—-আমি ঝগড়াটে?ওহহহ বুঝেছি মেয়েরা তোমার দিকে লুচ্চির মতো চেয়ে ছিলো তোমার খুব মজা লাগছিলো তাইনা?

অরিত্র ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো,
—–আরে আমি তো ওদের দেখিইনি।তোমার কথায় দেখেছি।

—–মিথ্যা বলছো কেন?তাহলে কি দেখছিলে?

অরিত্র মেকি হাসি দিয়ে বললো,
—–আরে আমি তো আমার রোজ কুইনকে দেখছিলাম।

রোজ অরিত্রের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,
—–সত্যি?

অরিত্র সিরিয়াস ভংগীতে বললো,
—-হুম সত্যি।কতদিন পর তোমাকে এতো কাছে থেকে দেখছি।ভাবিনি কখনো আর দেখতে পারবো তোমাকে, ছুতে পারবো।

—–আমিও।ভেবেছিলাম সব শেষ।আর কখনো আমাদের পথ এক হবেনা।কিন্তু ওই যে আমাদের ভালোবাসা।আমাদের ভালোবাসার শক্তি আমাদের এক করেছে।সব ঠিক করে দিয়েছে।দেড়মাস পর আমাদের এনগেজমেন্ট।আমার ভার্সিটিতে এক্সাম পড়ে গেছে নয়তো এ মাসেই হয়ে যেতো।আমার যে কি খুশি লাগছে।

অরিত্র মুগ্ধ হয়ে রোজকে দেখছে।
—–তুমি কি সত্যিই আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছো?

—–উহু এখনো পুরোপুরি না।সারাদিন ঘুরাবে তারপর সিদ্ধান্ত নিবো।

—–যো হুকুম মহারাণী।আজ আপনার থেকে ক্ষমা নিয়েই ছাড়ব।দেখি আপনি কত ঘুরতে পারেন।

রোজ মুচকি হেসে বললো,
—–জ্বি চলুন।

.
.

হৃদ শুভ্রাকে ওর ড্রান্স স্কুলে ছাড়তে যাচ্ছে।তারপর অফিসে যাবে।
হৃদ ওর ড্রান্স স্কুলের সামনে গাড়ি থামালো।
হৃদ বললো,
—–সাবধানে নামো আর হ্যা মিস মি।

শুভ্রা মুচকি হেসে জবাব দিলো।
—–ইউ ঠু..

শুভ্রা গাড়ি থেকে নামতেই ওর দুইটা ফ্রেন্ড এসে হাজির।
এক ফ্রেন্ড বললো,
—–জিজুর সাথে মিট করাবি না?

শুভ্রা না চাইতেও হৃদকে বললো,
—-এই যে জিজু আপনার শালিকারা এসেছে মিট করতে নামুন।

হৃদ নেমে ওদের সাথে কুশল বিনিময় করছে।ওরা গল্প জুড়ে দিয়েছে।
শুভ্রার গা জ্বলে যাচ্ছে।আর না পেরে হৃদকে টেনে সরিয়ে ওদের সামনে দাড়িয়ে বললো,
—–এটা আমার বর তোদের বর না যে দিনভর গল্প করবি।যা ক্লাসে যা।বিদেয় হ।

ওর বান্ধবীরা ওর এমন কথায় অভস্ত্য তাই কিছুই মনে করে নি।কিন্তু হৃদ অস্বস্তিতে পড়লো।শুভ্রাকে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
—–কি বলছো এসব?মাথা গেছে?কি মনে করবে ওরা?

শুভ্রা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
—–জানু তোমার অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে।যাও যাও তাড়াতাড়ি যাও।

হৃদ হাসবে না কাদবে।মনে মনে হাসছে।গাড়িতে উঠে বসে হাসছে।গাড়ি স্টার্ট দিয়ে শুভ্রাকে একটা হাসি উপহার দিয়ে চলে গেলো।।
হৃদ ভাবছে,
—–শুভ্রার ছোটবেলার পাগলামিগুলো আবারো দেখতে পারছি।শুভ্রা তুই এমনই থাকিস।আমার ছোবড়া হয়ে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here