বাইজি কন্যা পর্ব-২৯

0
1071

#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_২৯ ( প্রথমাংশ )
পরিহাস্যের সুরে বলা প্রণয়ের বক্তব্য’টি কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই চোখ তুলে তাকালো শাহিনুর৷ প্রণয়ের দৃষ্টি গাঢ়,নির্নিমেষ, দুর্বোধ্য। আর শাহিনুরের দৃষ্টিদ্বয় আসক্তিহীন। একজোড়া প্রগাঢ় দৃষ্টি’তে কতো সুনিপুণ ভাবে মিলিত হলো একজোড়া নির্লিপ্ত দৃষ্টিদ্বয়ের। ছাব্বিশ বছর বয়সী একজন কাঠিন্য,রাশভারী যুবকের পানে কতো অবলীলায়, অবহেলায় মাত্র পনেরো বছর বয়সী কিশোরী’টি দৃষ্টিপাত করলো। সে দৃষ্টিজোড়ায় না আছে লজ্জা, না আছে জড়তা। প্রণয়নের অন্তঃকোণে জেগে ওঠলো সেই রাতের অনুভূতি। যে রাতে প্রথম দেখেছিলো শাহিনুর’কে। সে’রাতে এই দৃষ্টিতে ভয় ছিলো,জড়তা ছিলো, কতশত সংকোচে আচ্ছন্ন ছিলো এ’দৃষ্টিজোড়া, হয়তো হিসেবনিকেশ করে বের করা যাবে না। অথচ আজ কতো পরিবর্তন! সময়ের ব্যবধান’টা একজন পরিবর্তনশীল মানুষ’কে দেখেই স্পষ্ট বোঝা যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের পরিবর্তন না ঘটলে,মানুষের জীবন না বদলালে হয়তো সময় কতো সুন্দর, কতো নির্মম তা বোঝা কঠিন হয়ে যেতো। গত সময়,আজকের সময় এবং পরবর্তী সময় যাইহোক না কেন আপন অনুভূতিটুকু যে একই রয়েছে তা সুক্ষ্ম ভাবেই টের পেলো প্রণয়৷ সেদিনের দৃষ্টিজোড়া তার হৃদয়ে যে অনুভূতি দান করেছিলো আজকের এ মূহুর্তের এই দৃষ্টিও একই অনুভূতির সঞ্চার করছে। তবে পার্থক্য তো আছেই। তা হলো সেদিনের থেকেও আজকের অনুভূতি অনেক বেশীই দৃঢ়, অনেক বেশীই গাঢ়। এ পৃথিবীতে বহু পুরুষ বিভিন্ন কারণে বহু নারী’র প্রেমে পড়েছে। কত-শত নারী কত-শত পুরুষের বুকে প্রেমের জোয়ার এনেছে হিসেবের বাইরে। এক্ষেত্রে পুরুষ’রাও থেমে নেই। তারাও নারীদের বুকে প্রেমের জোয়ার আনে। কিন্তু বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তা সুপ্ত রয়ে যায়। প্রণয়ের হৃদ সিন্ধু পারে ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ খেলা তো সেই কবেই শুরু হয়েছে। এই যে তার সম্মুখে সদ্য প্রস্ফুটিত হওয়া ফুলের ন্যায় নিষ্পাপ, শুভ্র মুখশ্রী, একজোড়া স্বচ্ছ,হরিণাক্ষী দৃষ্টি, প্রেমে পড়ার জন্য এই এটুকুই যথেষ্ট। আজ প্রণয় তীব্রভাবে অনুভব করছে দায়িত্ব আর ভালোবাসার ফারাক কতোটা হয়৷ দায়িত্ব’তে শুধু দায়িত্ব পালনই গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে ভালোবাসা নাও থাকতে পারে। কিন্তু ভালোবাসলে ভালোবাসার পাশাপাশি দায়িত্ব পালনও গুরুত্বপূর্ণ। দায়িত্বে ভালোবাসা নাও জন্মাতে পারে,কিন্তু ভালোবাসায় দায়িত্ব আপনাআপনিই জন্মায়। প্রণয় খেয়াল করলো শাহিনুরের চোখমুখ ভীষণ রুক্ষ হয়ে আছে। অজস্র ক্লান্তি এসে ভর করেছে দৃষ্টিদ্বয়ে। ঈষৎ লাল বর্ণীয় নীরস ঠোঁটজোড়ায় দৃষ্টি পড়তেই বুকের ভিতর মুচড়ে ওঠলো। মনের ভিতর চনমনে হয়ে কেউ যেনো বলে ওঠলো,
-‘ মেয়েটা ভীষণ ক্ষুধার্ত, মেয়েটা ভীষণ তৃষ্ণার্ত। ওর খাবার প্রয়োজন, পানি প্রয়োজন, ঘুম প্রয়োজন, ভালোবাসা, আদর, স্নেহ সবটা প্রয়োজন। এসবের অভাবে মেয়েটা নুয়ে পড়ছে, ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে মেয়েটার দেহ,মন সবটা, সবটা! ‘
হৃৎস্পন্দন থমকে গেলো প্রণয়ের। রুদ্ধশ্বাসে একহাত বাড়িয়ে শাহিনুরের গালে স্পর্শ করলো। কঠিন,গুরুগম্ভীর ব্যক্তিত্বের পুরুষ’টি আচমকাই নম্র হয়ে ওঠলো। কিঞ্চিৎ আদুরে কন্ঠে বললো,
-‘ এই মেয়ে, তোমার মুখটা শুঁকিয়ে গেছে, কখন থেকে না খেয়ে আছো তুমি? খেতে হবে তো, ঘুমহীন চোখে ঘুম প্রয়োজন তো, এভাবে চেয়ে থেকো না নুর, তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো? ‘
উদ্বিগ্ন হয়ে গেলো প্রণয়। গালে ছুঁয়ে থাকা হাতটি আলতো চেপে আবারো বললো,
-‘ আই নো নুর তুমি ভীষণ কষ্ট পাচ্ছো, আমি তোমার এই কষ্ট দূর করতে চাই, তোমার পাশে থাকতে চাই। ‘
আর কিছু বলতে পারলো না প্রণয় তার পূর্বেই শাহিনুরের ছোট্ট, কোমল হাতটি তার পুরুষালী হাতের ওপর রাখলো। সে হাত কিঞ্চিৎ দৃঢ়তার সঙ্গে চেপে ধরে ঠাশ করে নামিয়ে দিলো। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে মলিন কন্ঠে বললো,
-‘ আমি গোসলে যাব। আপনার শার্ট’টাও ফেরত দেবো। ‘
বিস্মিত হলো প্রণয় এতো সহজেই যে শাহিনুর মেনে যাবে ভাবতেও পারেনি৷ শার্ট ফেরত দেবে ভাবতেই হাসি পেলো, কিন্তু কথা মেনেছে তা ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে ব্রিফকেস এগিয়ে দিলো। শাহিনুর তখনো প্রণয়ের দিকে চেয়ে আছে। আর ভাবছে তার আম্মা শারমিনের কথা। সে বলেছিলো একজন মানুষ’কে চিনতে হলে, জানতে হলে সর্বপ্রথম তার চোখের ভাষা’কে বুঝতে, তারপর মানুষটা’কে পড়ার চেষ্টা করতে। তাই সে দেখছে প্রণয়’কে অতি সুক্ষ্ম নজরে৷ প্রণয় ব্রিফকেস খুলে দিয়ে পুনরায় তাকালো শাহিনুরের দিকে। আবারো দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলন ঘটলো। কিন্তু শাহিনুর প্রণয়’কে কিছু ভাবার সুযোগ দিলো না, সহজ গলায়, নরম সুরে বলে ওঠলো,
-‘ গোসল থেকে এসে খাবার পাবোতো? আমার খুব খিদে পেয়েছে! ‘
বুকের ভিতরটা ধক করে ওঠলো প্রণয়ের। কি নিষ্পাপ, কি সরল স্বীকারোক্তি। একটুও সময় নিলোনা প্রণয় ত্বরিতগতিতে মাথা উপর নিচ করলো। শাহিনুরও আর বসে থাকলো না। নিঃশব্দে ওঠে দাঁড়ালো। খাওয়া,ঘুম কোনটাই ঠিকমতো না হওয়াতে শরীরটা প্রচুর দুর্বল অনুভব করলো। মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠলো। সহসা দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ক্ষণকাল চুপ রইলো সে। তা দেখে প্রণয় সটান হয়ে দাঁড়িয়ে শাহিনুরের কাঁধ স্পর্শ করলো,উদবিগ্ন কন্ঠে বললো,
-‘ শরীর খারাপ লাগছে? ‘
শরীরে থাকা শেষ শক্তিটুকু দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো শাহিনুর। কাঁধে থাকা প্রণয়ের হাতটি সরিয়ে দিয়ে ছোট্ট হাতের পাঁচ আঙুলের তালু উঁচিয়ে বললো,
-‘ কথার ছলে বার বার ছুঁয়ে দিচ্ছেন কেন? আমি কি আমাকে ছুঁতে অনুমতি দিয়েছি? ‘
রাগ এবং বিরক্তি মিশিয়ে কথাটা বলে ব্রিফকেস থেকে দ্রুত একটা শাড়ি, মখমলের কাপড়ের ব্লাউজ,আর পেটিকোট নিয়ে বাথরুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো শাহিনুর।
রুদ্ধ শ্বাস ছাড়লো প্রণয়। শাহিনুরের যাওয়ার পানে ভ্রুদ্বয় কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। কেন জানি রাগ হলো না, খারাপ লাগলো না। হৃদয়ে বাস করা নারী’র করা ভুলে রাগতে নেই, শুধরে দিতে হয়৷ সব পুরুষ শুধরে দেয় কিনা সে জানেনা। কিন্তু সে দেবে। পুরো কক্ষ জুড়ে পায়চারি করতে করতে আরেকটি দৃশ্য মনে পড়ে গেলো তার রঙ্গনের হাতে রাখা শাহিনুরের হাতের সেই দৃশ্যটি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাই বিরবির করে বললো,
-‘ অপাত্রে ঘি ঢালতে আপনি বড়ো ওস্তাদ মনোহারিণী। ‘

চলবে….
(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ)
[ রিচেক করিনি। কেউ একজন রোমানাকে বলা প্রণয়ের একটি বাক্য কমেন্টে দিয়েছে। তার মন্তব্য পুরোটাই পড়েছি। তাই একটু বলে দেই দায়িত্ব আর ভালোবাসা এক নয়। রোমানা যে প্রণয়ের দায়িত্ব ছিলো এটা প্রমাণিতই। রোমানার প্রতি সব অনুভূতি ছিলো প্রণয়ের শুধু ভালোবাসা ছাড়া৷ উপন্যাস পড়তে পড়তে আরো অনেক প্রশ্নের উত্তরও মিলবে ইনশাআল্লাহ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here