#আকাশে_তারার_মেলা
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -১৯
রাতের আঁধারে একজোড়া যুগল হাতে হাত রেখে বসে আছে। কারো ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি তো কারো ঠোঁটে লাজুকতার রেখা। আমরিন দের বাগানের দিকটায় বসে আছে নিবিড় ও আমরিন। আমরিনের হাত টা আলতো করে ধরে রেখেছে নিবিড়। খানিকক্ষণ আগেও সবকিছু এলোমেলো লাগলেও এখন আর বিচ্ছিন্ন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরিনের বেশ লজ্জা লাগছে। ইশ! এতো লজ্জাকর পরিস্থিতি কেন সৃষ্টি হল? নিবিড় টাও কেমন বেহায়া প্রকৃতির। তার চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে তার ভাই। কি অবলীলায় বোন কে সারাজীবনের জন্য বেঁধে দিল নিবিড় নামক ছেলেটার সাথে।
ফ্লাশব্যাক~
তুলির ছলছল নয়ন জোড়া দেখে মৃদু হাসল আদ্র। নিবিড়ের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,,
–” ফিরিয়ে কেন দিব জানিস?”
–” জানি। আমি অপরাধ করেছি আদ্র। বেস্ট ফ্রেন্ড হয়েও তোর কাছ থেকে লুকিয়েছি। কিন্তু আমি তোর বোনটা কে ভীষণ ভালোবাসি।”
–” আমার বোন ও তোকে ভালোবাসে তা আমরিনের চোখের জলেই প্রতীয়মান।”
আদ্রর কথা শুনে আমরিন মাথা নত করে ফেলল। এতোক্ষণ বিষাদ লাগলেও এখন বড় ভাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে লজ্জা তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। রাদিফ সাহেব, সায়েরা বেগম,ইনশিতা প্রচন্ড অবাক আদ্রর মুখের কথা শুনে। রাদিফ সাহেবের মনটা অসম্ভব ভালো লাগায় ভরে গেল। আদ্র শুধু সম্পর্কে ভাই হিসেবে থাকে নি ভাইয়ের দায়িত্ব টা ও যথাযথ পালন করে। দু মেয়ে মুখ ফুটে কখনও ওনার কাছে কিছু না বললেও আদ্র ঠিকি দুই বোনের মনের কথাগুলো, চাওয়া গুলো অনাসয়ে বুঝে নেয়। আবদার করার আগেই পূরণ করে দেয়। আচ্ছা আজও কি আদ্র সঠিল বুঝতে পেরেছে? আমরিন সত্যিই নিবিড় কে পছন্দ করে? নাকি ভুল! প্রশ্ন টা মনে উদয় হতেই রাদিফ সাহেব স্নেহার্দ্র স্বরে মেয়েকে প্রশ্ন করলেন,,
–” তোমার ভাইয়া কি সঠিক বুঝেছে আমরিন?”
বাবার আদর ভরা কন্ঠ কর্ণপাত হতেই আমরিন মাথা নেড়ে সঠিক বুঝাল। রাদিফ সাহেব চুপ করে রইলেন। আদ্রর উপরই সিদ্ধান্ত ছেড়ে দিলেন বিনাবাক্যে। তিনি ভালো করেই জানেন বোন কে কখনও কষ্টের দিকে ঠেলে দিবে না আদ্র। বরং বোনের জন্য যা সবচেয়ে ভালো হবে তাই করবে। তাছাড়াও নিবিড় কে ছোট থেকে বড় হতে দেখেছেন তিনি। নিবিড় নিঃসন্দেহে আমরিনের জন্য একজন যোগ্য পাত্র। তবুও মেয়েদের নিয়ে প্রচন্ড চিন্তা হয় ওনার। তাই নিজে সিদ্ধান্ত নিতেও হিমশিম খেয়ে যান। ছেলে যখন এতোটা বিচক্ষণ তখন তিনি নিজের মস্তিষ্কে আর চাপ দিতে চাইছেন না। সাময়িক নীরবতা কাটিয়ে আদ্র মোলায়েম কন্ঠে রাদিফ সাহেব কে জিজ্ঞেস করল,
–” আপনি কি চান বাবা?”
ছলছল চোখে ছেলের দিকে চাইলেন রাদিফ সাহেব। দীর্ঘ সময় পর ছেলের মুখ থেকে বাবা ডাক টা শুনে দু চোখ ভরে এল তার। ঠোঁটে হাসিয়ে ফুটিয়ে বললেন,,
–“তুমি যা চাইবে তাই হবে আদ্র। ”
–” ঠিক আছে বাবা।”
সবার মাঝে একটা ভয় কাজ করছে। আদ্র কি বলবে? সত্যিই কি ফিরিয়ে দিবে? তুলির অবস্থা তো দম আঁটকে যাওয়ার মতো। আদ্র আজ কেন এতো কঠোর হয়ে পড়েছে একদমই বুঝতে পারছে না সে। আচ্ছা ভাই গুলো কি বোনের বেলায় এমন কঠিন রূপ ধারণ করে? তুলির ইচ্ছে করছে আদ্র কে বলতে–” আপনি যদি আজ নিবিড় ভাইয়া কে ফিরিয়ে তবে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।” আদ্র নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসল। সাবলীল কন্ঠে বলল,,
–” তুই ফিরে যা নিবিড়। আর,,”
এটুকু বলে থামতেই অসহায় দৃষ্টিপাত করল নিবিড়। বুকে চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘ শ্বাস। পলকেই হৃদয় টা জ্বলে পুড়ে যেতে লাগল। ইচ্ছে জাগল আমরিন কে জোর করে নিজের করে নিতে। কিভাবে বাঁচবে এই মেয়েটা কে ছাড়া সে? আদ্রর কঠোরতা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে আদ্র অসমাপ্ত কথাটা শেষ করে দিল।
–” কাজী নিয়ে তাড়াতাড়ি আসিস। এখন না ফিরলে কাজী নিয়ে আসবি কিভাবে?”
চমকিত নয়নে সবাই আদ্রর দিকে তাকাল। সবার ঠোঁটে ফুটে উঠল আনন্দের হাসি। আমরিন তো পুরোই স্তব্ধ হয়ে গেছে। নিবিড় উঠে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আদ্র কে। বুকে ঘুষি বসিয়ে দিয়ে বলে উঠল,,
–” শালা তুই তো আমাকে মেরেই ফেলছিলি। জীবনে এতো কঠিন পরিস্থিতি তো মেডিক্যাল এক্সামে ও ফেইস করি নি।”
–” এতো সহজে বোন দিয়ে দিব নাকি? ভাই হয়েছি অথচ একটু কঠোর হব না তা কি হয়?”
–” আজকেই তোর বোন টা কে আমার হাতে তুলে দিবি? ওর তো আঠারো হয়ে গেছে। কখন আবার তোর মতামত পাল্টে যায় আমার তো ভয় হচ্ছে। তুই অনুমতি দিলে আমি এখনই কাজী সাহেব কে নিয়ে আসব।”
আমরিন লজ্জায় চুপসে গেল। নিবিড় কি বলল এটা? আজকেই বিয়ে মানে? আদ্র কি মানবে? মানবে না। বিয়ে কি হুট করে বললেই হয়ে যায় নাকি! কিন্তু আমরিন কে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আদ্র বলল,,
–” নিয়ে আয়।”
রাদিফ সাহেব ও সম্মতি জানালেন। তুলি তো খুশিতে আত্মহারা। সায়েরা বেগম আমরিন কে রুমে নিয়ে গিয়ে একটা শাড়ি পড়িয়ে দিলেন। আমারিন মূর্তির মতো দাড়িয়ে। কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে! কাজী সাহেব আসতেই বিয়ের কার্য সম্পন্ন হল। তবে আমরিন এখানেই থাকবে। ইনশিতা ও আমরিন দু জনের বিয়ের অনুষ্ঠান এক দিনেই হবে। তুলি যেন স্বপ্ন দেখছে। সেও আদ্রর বউ হতে চায় তবে এমন করে নয়। খুব ইচ্ছে খুব বড় করে ওদের বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। আদ্র বর সেজে আসবে। তুলি লাল বেনারসি পড়ে আদ্রর অপেক্ষার প্রহর গুণবে। আর তো কয়েক মাস। এতটা ধৈর্যহারা হতে চাই না তুলি। ভালোবাসার শুদ্ধতম প্রতীক তো অপেক্ষা। আর মাস তিনেক অপেক্ষার পর তো সুন্দর একটা মুহুর্ত পাবে দু’জন।
।
।
গালে ঠোঁটের উষ্ম স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠল আমরিন। উঠে যেতে নিলে নিবিড় হ্যাঁচকা টানে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল তাকে। পিঠ বুকে গিয়ে ঠেকতেই আমরিন অভিমানী কন্ঠে বলে উঠল,,
–” আপনার বুক তো আমার বাপের কেনা সম্পদ না তাহলে এভাবে বুকে টানছেন কেন?”
বিস্মিত হল নিবিড়। চাপা অভিমান টুকু বুঝতে পেরে আমরিনের শাড়ি ভেদ করে পেটে হাত রেখে নিজের আরও কাছে টেনে নিল। তৎক্ষনাৎ আমরিনের হৃদপিন্ডে তীব্র বেগে কিছু একটা ছুটে চলতে শুরু করল। শরীরের প্রত্যেক টা ভাজে ভাজে শুরু হল কম্পন। নিবিড়ের হাতটা ক্রমশই বিচরণ করতে লাগল পুরো পেট জুড়ে। দু চোখ বুঁজে ফেলল আমরিন। এই অনুভূতি গুলো তার জীবনে প্রথম। নিশ্বাস টাও আটকে আসছে। নিবিড়ের হাতটা চেপে ধরতেই ধীর কন্ঠ ভেসে এল।
–” তোমার বাপের কেনা সম্পদ না হলেও বুকটা এখন তোমার কেনা সম্পদ। চিরকাল এটা তোমারই থাকবে।”
কথাটা বলেই আমরিনের ঘাড়ে ঠোঁট ছোঁয়াল । এক অজানা ঘোরে ডুবে যেতে লাগল দু’জন। আমরিন কে একটানে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিল। দু চোখ এখনও বন্ধ। ফর্সা চেহারায় লজ্জার ছাপ যা নিবিড় কে টানতে লাগল অনবরত। দোষের তো কিছু নেই। আমরিন তো তার বউ। কপালে ঠোঁট ছোঁয়াতেই আমরিন খামচে ধরল নিবিড়ের হাত টা। প্রস্ফুটিত হাসি নিবিড়ের ঠোঁটে। আমরিনের তিরতির করে কাঁপতে থাকা গোলাপি ঠোঁট দুটো মুহুর্তেই বিক্ষিপ্ত করে দিল তার হৃদয় টা কে। নিজের ঠোঁট দুটো দিয়ে চেপে ধরল আমরিনের দু ঠোঁট। সাথে সাথেই ধপ করে চোখ মেলে তাকালো আমরিন। তীব্রভাবে আকড়ে ধরল নিবিড়ের ঘাড়ে। নিবিড় হালকা কামড় দিতেই ছিটকে সরে এল। লজ্জায় সেখানে আর এক মুহূর্ত না দাড়িয়ে দৌড়ে চলে গেল। ভাগ্যিস কেউ দেখে নি। নিবিড় ও ঘোর থেকে বেড়িয়ে ভিতরে চলে এল। একটু পরই চলে যাবে। সায়েরা বেগম ডিনার করা ছাড়া যেতে দিচ্ছিলেন না। হুট করে বিয়ে হলেও তিনি মেয়ের জামাই আদরে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
_________
রোদের প্রখরতায় ঘেমে একাকার তুলির কলেজ ড্রেস টা। কাঠফাটা রোদের তাপে আজকাল তুলি প্রচন্ড বিরক্ত। তার চেয়ে ও বেশি বিরক্ত পরীক্ষা নামক প্যারায়। কিছুই ভালো লাগছে না তার। আজ শেষ পরীক্ষা। আমরিনের সাথে দাঁড়িয়ে আছে কলেজ গেইটে। আমরিন আজ পরীক্ষা শেষে বাসায় যাবে নিবিড় কে বলেই এসেছে। তিন তিনটা মাস কেটে গেছে বিয়ের। আর সংসারের পুরো দুইটা মাস। আজ ইনশিতা ও আসবে বাসায়। গাড়ি তে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে তাই ড্রাইভার ঠিক করতে নিয়ে গিয়েছেন। তপ্ত দুপুরে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে আমরিনের ও ভালো লাগছে না। তুলির দিকে তাকাতেই দেখল মেয়েটা গরমে কেমন হাসফাস করছে। কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। কলেজে মোবাইল আনা নিষেধ হওয়ায় মোবাইল টা ও আনা হয় নি নয়তো নিবিড় কে বলত গাড়ি পাঠাতে। টিস্যু বের করে তুলির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল–” আজকাল তুই অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছিস না তুলি?”
কপালের ঘামটুকু মুছে তুলি নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে উঠল-” আমার ক্লান্তির কারণ কি বুঝতে পারছিস আমরিন? তোর ভাই টা এতো খারাপ কেন? আমায় এক রাশ ক্লান্ত মাখা অনুভূতি দিয়ে উদাসীন হয়ে আছেন। আমি হাফিয়ে উঠেছি। অবিশ্রান্ত হয়ে উঠেছে মনটা।”
তুলির অভিমানে ভরপুর কথা শুনে আমরিন ম্লান হাসল। মুখ খুলে কিছু বলতে নিবে তখনি একটা গাড়ি এসে থামল। দু’জন চোখ ছোট করে চাইতেই গাড়ি থেকে হাসি মুখে বেরিয়ে এল সামিরা। দু’জনেই এক গাল হাসল সামিরা কে দেখে। ইনশিতার বিয়ের পর থেকে সামিরার সাথে বেশ ভাব হয়েছে তুলির। সামিরা কে ভীষণ পছন্দ তার। নিজের বড় বোনের আসনে বসিয়ে ফেলেছে। সত্যি বলতে সামিরা মেয়েটাই এমন যার তার সাথে মিশে যেতে পারে অনাসয়ে। আদ্র মিশতে বারণ করলেও তুলির কাছে সামিরা কে ভালো লাগে। তুলির ধারণা সামিরা আদ্র কে ভালোবাসত বলেই হয়তো খারাপ কিছু করতে পারে তাই আদ্র বারণ করে। কিন্তু তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না তুলির কাছে। সামিরা এগিয়ে এসে বলল—দু’জন রৌদ্দুরে দাড়িয়ে আছো কেন? বাসায় যাবে না?”
আমরিন হেসে জবাব দিল–” আসলে আপু আমাদের গাড়ি টা নষ্ট হয়ে গেছে। ঠিক করে আনলে তারপর যাব।”
–“আমার সাথে চলো। আমি দিয়ে আসছি। এতো সময় ধরে রোদে দাড়িয়ে থাকলে শরীর খারাপ করবে। তুলিও কেমন দুর্বল হয়ে পড়েছে রোদে দাড়িয়ে থেকে।”
দু’জনেই সায় জানিয়ে সামিরার সাথে গাড়িতে উঠল। পুরো রাস্তা কোনো কথা বলল না তুলি। বুকটা বড্ড হাহাকার করছে আজকে। হৃদপিণ্ডের প্রতিটা স্পন্দন যেন আদ্র কেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। যেই মানুষ টা প্রতিটা নিশ্বাসে মিশে আছে তাকে ছাড়া নিশ্বাস নিতেও অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে তুলির। গাড়ি বাড়ির গেইটে আসতেই আমরিন ও তুলি নেমে পড়ল। সামিরা কে অনেকবার সাধলো ভিতরে আসার জন্য কিন্তু জরুরি কাজ থাকায় সামিরা আসে নি। তুলি বাড়িতে ঢুকেই চারদিকে চোখ বুলাল। হতাশার নিশ্বাস ছেড়ে সোফায় বসে পড়ল। সায়েরা বেগম আমরিন ও তুলির জন্য লেবুর শরবত নিয়ে আসতেই তুলি অভিমানী কন্ঠে বলে উঠল,,
–” তোমার ছেলে আজও আসে নি আম্মু তাই না? ”
–“নারে।তবে চলে আসবে। কিন্তু তুই যে গত কাল থেকে আমার ছেলেটার ফোনটা ধরছিস না ও কিন্তু ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে।”
–“কেন ধরব? তোমার ছেলে তো বিখ্যাত হার্ট সার্জন হয়ে গেছে। অন্যের হার্টের চিকিৎসা করে কি হবে? ওনি তো আমার হার্ট টা কেই অসুস্থ বানিয়ে দিয়েছে।”
আমরিন ও সায়েরা বেগম হাসলেন। ওনি তুলির পাশে গিয়ে বসে তুলি কে জড়িয়ে ধরলেন। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন–” ছোট্ট তুলি টা আমার ছেলেটা কে এতো ভালোবেসে ফেলেছে। আদ্র আসলে বকে দিব আমি৷ কত বড় সাহস ওর আমার মা টা কে কাঁদিয়ে অন্যের সেবা করতে লেগে পড়েছে।”
তুলি কাঁদতে কাঁদতে হালকা হেসে বলল–” অন্যের সেবা করা তো জরুরি আম্মু তবুও তোমার ছেলে দূরে গেলে আমার অসম্ভব কষ্ট হয়। মনে হয় কেউ ওনাকে আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নিয়ে যাবেন।”
–” কেউ কেঁড়ে নিবে না। আর তো পাঁচ দিন। আল্লাহ ব্যতীত তোকে আমার ছেলের কাছ থেকে কারো কেড়ে নেওয়ার সাহস নেই মা। আর না তোর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার। ”
তুলি আর আওয়াজ না করে চুপ করে রইল।পাঁচ দিন পর ওদের বিয়ে। সময় কত তাড়াতাড়ি গড়িয়ে যায়। পিছনে ফেলে যায় কিছু বিষাদময় স্মৃতি আবার কিছু মুগ্ধময় প্রহর। তুলির জীবনে বিষাদ ছিল যা সময়ের স্রোতে কাটিয়ে দিয়েছে আদ্র। গড়েছে তুলির মনে নিজের জন্য জায়গা। ধীরে ধীরে মিশে গেছে তুলির অস্তিত্বে। একটা দিনও না দেখে থাকতে পারে না তুলি। গতকাল ভোরে আদ্র চট্টগ্রাম গিয়েছে তখন থেকেই মুখ ভার তুলির। আদ্র কে দেখতে না পেরে ঝেকে বসেছে অজস্র অভিমান।
_____________
রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। তুলি ঘড়ির কাটার দিকে তাকাতেই চোখের কার্ণিশ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। ভেবেছিল আদ্র হয়তো আজ আসবে কিন্তু তার ভাবনা ভুল ছিল। মনের গহীনে থাকা অভিমান দ্বিগুণ হয়ে গেল। চাপা কষ্ট গুলো জলে পরিণত হয়ে বালিশ ভেজাতে লাগল। তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘড়ির কাটায় যখন এগারোটা পঞ্চান্ন তখনই চোখ লেগে এল তুলির। চোখের জল গুলো শুকিয়ে ছাপ পড়ে আছে। হঠাৎ মুখের উপর গরম উত্তাপ অনুভব করতেই সদ্য লেগে আসা চোখ মেলে তাকাল। চোখের মণি তে দৃশ্যমান হল আদ্রর হাসিমাখা উজ্জ্বল মুখটা। নিমিষেই বুক টা প্রচন্ড গতিতে কেঁপে উঠল। কল্পনা ভেবে মুখ ফিরিয়ে নিল তুলি। তখনই নিজেকে শূন্যে অনুভূত করতেই পিলে চমকে উঠল। ভয়ে আদ্র কে আঁকড়ে ধরল শক্ত করে। চোখ মুখ কাচুমাচু করে রইল। নিজের রুমে এনে তুলি কে বিছানায় বসিয়ে দিল আদ্র। একটা কাগজ হাতে নিয়ে এসে তুলির সামনে বসল চেয়ার টেনে। দু চোখ লাল হয়ে আছে। চুলগুলো এলোমেলো। মুখ জুড়ে ক্লান্তির ছাপ। দেখেই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে মাত্র এসেছে। মোলায়েম কন্ঠে আদ্র উচ্চারণ করল,,
–” শুভ জন্মদিন আমার তুলা।”
নিমিষেই জেগে উঠা অভিমান চাপা পড়ে গেল তুলির। কেঁদে দিল শব্দ করে। কাঁদবেই না কেন? আদ্রর ক্লান্তি মাখা চেহারা, রক্তিম চোখ দুটোই বলে দিচ্ছে শুধু মাত্র তার জন্যই এতো পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে আদ্র। তুলি নিজের শরীরের সবটুকু ভর ছেড়ে দিল আদ্রর উপর। ভেজা স্বরে বলে উঠল-
“শুধুমাত্র সামান্য একটা মুহুর্তের জন্য এভাবে ছুটে এলেন কেন ডাক্তার সাহেব? আমার অভিমান করা নিছক ছিল। নিজেকে এতো কষ্ট দিয়ে কেন আসতে গেলেন?”
“তুমি কি জানো এই মুহুর্তটার জন্য আমি কতগুলো সময় অপেক্ষা করেছি?”
“জানিনা। জন্মদিনে আপনার থেকে আগে উইশ পাওয়া টা আমার কাছে জরুরি ছিল না। জরুরি তো আপনি এবং আপনার ভালো থাকা।”
তুলির মুখটা বুক থেকে তুলে এক হাত নিয়ে গালে রাখল আদ্র। নিজের ওষ্ঠদ্বয় দিয়ে শুষে নিল তুলির চোখের জল। মুগ্ধময় স্বরে বলল–” আজ তোমার জন্মদিন তাই আমার কাছ থেকে উপহার পাওনা তুমি। কিন্তু উপহার টা তুমি আজই গ্রহণ করতে পারবে না।”
তুলি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আদ্রর দিকে। পাশ থেকে কাগজ টা আদ্র বাড়িয়ে দিল তুলির কাছে। তুলির মস্তিষ্ক কিছুই ধারণ করতে পারছে না। কি করতে চাইছে আদ্র? উপহার কি এই কাগজ টা? আবার গ্রহণ করতে পারবে না এটা কেমন কথা? কলম এগিয়ে দিতেই তুলি না পড়েই সাইন করে দিল কাগজ টা তে। তারপর আদ্রর হাতে ধরিয়ে দিল। একটু ঝুঁকে তুলির কপালে কপাল ঠেকাল আদ্র। দু’জনের ঠোঁটের কিঞ্চিত মাত্র দূরত্ব। নিজের মাদকতাময় চোখ গুলো আদ্র স্থাপন করল তুলির ডাগরডাগর আঁখি তে। কোনোভাবেই চোখ সরিয়ে নিতে পারছে না তুলি। তড়িৎ বেগে ছুটে চলেছে হৃদপিণ্ডের হৃৎস্পন্দন। কেন সে পারে না আদ্রর মোহ উপেক্ষা করতে? আবার কেন এতো ঝড় উঠে আদ্র কাছে আসলে? এই ঝড় কি সারাজীবন বয়ে যাবে অন্তর জুড়ে? প্রশান্তির আবেশিত বাতাসে তুলির মনে প্রবলভাবে ভেসে বেড়াতে লাগল একটু একটু করে জড়ো হওয়া অনুভূতি গুলো। আদ্রর কন্ঠস্বর শুনে ঠোঁটের কার্ণিশে হাসি ফুটল।
–” না পড়েই সাইন করে দিলে?”
–” আপনার প্রতি অগাধ বিশ্বাস আছে তো আদ্র। সবকিছু ধোকা দিলেও আমার অস্তিত্ব আমাকে ধোঁকা দিবে না।”
স্নিগ্ধ সুবাসিত হাওয়ায় ছেয়ে গেল আদ্রর হৃদপিণ্ড। ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি। তুলির কৃষ্ণবর্ণী চোখের মায়ায় ডুব দিতে ইচ্ছে করছে তার। কারো সাধ্য নেই আঁটকে রাখার তবুও কোনো তাড়াহুড়ো চায় না সে। গুছিয়ে শুরু করতে চায় সবকিছু। তুলির ঘাড়ের পিছনে হাত রেখে নিজের আরেকটু কাছে টেনে নিল। ঠোঁটে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে বলল–” তুমি নিজের উপহার টা না দেখেই আমায় রিটার্ন গিফট দিয়ে দিলে তুলা।”
আদ্রর কথাটা তুলির কর্ণধার হয় নি। তুলি তো আদ্রর নীলাভ চোখের মাদকতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলছে। আলতো সেই স্পর্শ টা শরীরে শিহরণ জাগিয়ে তুলছে। মনটা ক্রমাগত চাইছে আরো গভীরভাবে হারিয়ে যেতে। চোখ বুঁজতেই প্রচন্ড বেগে কিছু আওয়াজ এসে ধাক্কা খেল তুলির কানে। হকচকিয়ে উঠল তুলি। চোখ মেলতেই সামনে আর আদ্র কে আবিষ্কার করল না।
#চলবে,,,
(ভুল-ত্রুটি গুলো ক্ষমার চোখে দেখবেন।)