#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব_২৩
একটা শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ হাত ছেলেটার হাতের বাঁধন থেকে তুলি কে ছাড়িয়ে নিল। দেহের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তুলি কে চেপে ধরল নিজের প্রশস্ত বুকে। মুখ তুলে তাকানোর সাহস হলো না তুলির। গভীর স্পর্শে মানুষ টা কে চিনতে একটুও বেগ পোহাতে হয় নি তার। বহু কষ্টে মানুষ টার পিঠে খামচে ধরল শক্ত করে। বুকে মুখ গুঁজে নিরব রইল কয়েক সেকেন্ড। ক্রন্দন মিশ্রিত স্বরে বললো,
” আদ্র, ওই,,,”
কান্নার জোরে গলায় আঁটকে আসতে লাগল একেকটা শব্দ। চেয়েও পারল না কিছু বলতে। হঠাৎ অপরিচিত এক ছেলের বাজে ছোঁয়া সহ্য করতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে স্পর্শ করা হাত টা বুঝি কলঙ্কিত হয়ে গেছে। চিরতরে কলঙ্কের দাগ লেগে গেছে শরীরে। ঘৃণায় রি রি করে উঠছে দেহের সর্বাঙ্গ। কষ্টে বুক চিরে আসতে চাইছে দীর্ঘ শ্বাস। তুলি পারল না নিজেকে ধরে রাখতে। তার কিশোরী মন কেঁদে উঠল। আদ্রর পিঠে খামচে ধরে ডুকরে কাঁদতে লাগল। কান্নার বেগ বাড়তে লাগল ক্রমশ। কাঁদতে কাঁদতে অস্পষ্ট ধরা গলায় আদ্রের দিকে এক পলকের চাউনি দিয়ে বললো,
” আমার কষ্ট হচ্ছে আদ্র। খুব কষ্ট হচ্ছে । ”
বুক টা ব্যাথায় চিন চিন করে উঠল আদ্রর। তুলির অস্পষ্ট বাক্য টা হৃদয়ের গহীনে সূচালো তীরের মতো গিয়ে গাঁথল। মুহূর্তেই রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল হৃদপিণ্ডের সারা অংশ। রক্ত বর্ণ ধারণ করা নেত্র যুগল ধপধপ করে জ্বলে উঠলো। ক্রুদ্ধ দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল সামনের ছেলেগুলোর দিকে। সেই দৃষ্টিতে কি ছিল তা বুঝা মুশকিল!ছেলে তিনটা ছিটকে গেলো। ঘাম ছুটে গেল সারা শরীরে। কিন্তু সামনের সেই ছেলেটা ভাবলেশহীন। মাতাল হয়ে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলছে তুলির উপর। তুলি কান্নার চোটে থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। কেঁপে উঠছে পুরো শরীর। আদ্রর বুকে হাত রেখে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলতে লাগলো,
” আমার হাত,,,আমার হাতে, গলায় ছেলেটা বাজে ভাবে ছুঁয়েছে আদ্,,আদ্র। আপনি স্পর্শ গুলো ধুয়ে দিন না। মুছে দেন। ”
এতোকাল ধরে আগলে রাখা তুলির আকুল কন্ঠে আদ্র দু’চোখ বুঁজে নিল। নিমিষেই চোখের কার্নিশ ছুঁয়ে কপোল বেয়ে এক ফোঁটা বিষাক্ত অশ্রু স্পর্শ করলো তুলির ঘাড়। নিবিড়ভাবে লেপ্টে রইল তুলি আদ্রের বুকে। কান্নার শব্দ টাও থমকে গেল আকস্মিক। পকেট থেকে ফোন বের করলো আদ্র। সাগর কে কল দিয়ে বললো,
” এখুনি গাড়ির কাছে আয় সবাই। ”
আদ্রের ফোন পেয়ে সবাই বিনা সময় ব্যতীত ছুটে এলো। তুলি কে বিধস্ত অবস্থায় দেখে আঁতকে উঠল সবাই। আদ্রর ঝাঁঝালো, অগ্নি রূপ দেখে হতবাক সকলে। আমরিন ছেলেগুলো কে দেখে বুঝার বাকি রইল না এখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে। মেয়েটার নেতিয়ে পড়া চেহারা দেখে হাহাকার করে উঠল বুক টা। নিজেকে দোষারোপ করতে লাগল মনে মনে। হয়তো তখন ভাই কে জানানো হলে এতোটা খারাপ পরিণাম দেখতে হতো না। কাঁপা কাঁপা হাতে তুলি কে আদ্রের বুক থেকে সরিয়ে আনতে হাত বাড়ালে আদ্র নিজেই কোলে তুলে তুলি কে গাড়িতে বসিয়ে দিল। আমরিন তড়িঘড়ি করে বসে তুলির মাথা টা আগলে ধরলো হাত দিয়ে। তীব্র ভয়ের ফলে মেয়েটা জ্ঞান হারিয়েছে। ভেঙে পড়েছে মানসিকভাবে।
পায়েল,রিমি ও গাড়িতে উঠে বসল। অন্তুর দিকে চেয়ে আদ্র ভারী গলায় বললো,
” তুলি কে বাসায় নিয়ে যা। ”
অন্তু নির্বিকার ভঙ্গিতে গাড়ি স্টার্ট দিল। নিষ্পলক তাকিয়ে রইল আদ্র গাড়িটির যাওয়ার দিকে। গাড়ির জানালা দিয়ে যতক্ষণ তুলির অচেতন মুখটা দেখা গিয়েছে ততক্ষণ অব্দি অস্থির চক্ষুদ্বয় নিষ্পাপ চেহারায় স্থির ছিল।সেই সাথে স্থির ছিল হৃদয়ের যন্ত্রণা। না চাইতেও দ্বিগুণ বেড়ে গেল হৃদয়ের সৃষ্ট হওয়া যন্ত্রণা টা। তীক্ষ্ণ একটা বাক্য কর্ণে প্রবেশ করলো দ্রুত বেগে। ছেলেটা মাতাল কন্ঠে বললো,
” কি ব্রো মেয়েটা বেহুঁশ হয়ে গেল?এতো নাজুক! নাজুক তো হবেই,হাত টা তো অনেক কোমল ছিল। ধরতে না ধরতেই আমার নেশা লেগে গেল। পাঠিয়ে দিলে কেন?দু’জন মিলে নাহয় একসাথে ইনজয় করতাম।”
ছেলেটা দুর্বোধ্য হাসল। নিবিড়, সাগরের মস্তিষ্ক রাগে দাউদাউ করে জ্বলতে লাগল। কিন্তু ওরা কিছু করবে না। দাঁড়িয়ে শুধু দেখবে। আদ্রর কপালের ফুলে উঠা একেকটা রগ জানান দিচ্ছে রাগের তীব্রতা। উজ্জ্বল ফর্সা মুখশ্রী লাল আভায় ছেয়ে গেছে। হাতের রগ গুলোও ফুলেফেঁপে উঠছে। শিরা-উপশিরায় রাগের প্রদাহ,উত্তাপ বয়ে চলেছে দ্রুত গতিতে। ছেলেটার হাত টা ধরে প্রচন্ড জোরে বাঁকিয়ে ধরলো সে। একটা কটমট ভাঙনের শব্দ সবার কর্ণ ছিদ্র ভেদ করে সুর সুর করে ঢুকে পড়ল। ভয়ে সেঁটে গেল পিছনের ছেলে তিনটা। নিবিড়, সাগরের ঠোঁটের কোণে প্রস্ফুটিত হলো বাঁকা হাসি। ছেলেটা আর্তনাদ করে উঠল ব্যাথার চোটে। মুখের ভাবভঙ্গি বদলে গেল তার। ব্যাথায় বদলে গেল মুখের আভা। হাত ভাঙাতেই থেমে থাকল না আদ্র। ছেলেটা কে মাটিতে ফেলে বেধরম মারতে লাগল। ঠিক কতক্ষণ মারল তার হিসেব নেই। ক্ষণে ক্ষণে রাগ টা বাড়ছে,সেই সাথে বাড়ছে ছেলেটা কে ভস্ম করে দেয়ার ইচ্ছে। ছোট্ট একটা নাইফ বের করে ছেলেটার হাতের রগ কাটতে নিলে নিবিড় আঁটকে দিল। অস্থির কন্ঠে আওড়ালো,
” এমনটা করিস না আদ্র,মরে যাবে।”
নিবিড়ের কথাটা সম্পূর্ণ রুপে অগ্রাহ্য করে ছেলেটার বুকে ছুরির আঁচড় কেটে দিল। ছ্যাৎ করে উঠল ছেলেটার পুরো দেহ। ব্যাথায় বিষিয়ে গেল সারা অঙ্গ। মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল শুধু ফোঁপানোর শব্দ। বাকি তিন টা ছেলে এমন অবস্থা দেখে পালাতেও ভুলে গেল। লড়বড়াতে লাগল পা। সাগর থেমে থাকলো না, বাকি তিনটা কে বেধরম পিটালো। মাটিতে মুখ থুবড়ে কুঁকড়াতে লাগল ছেলে গুলো। আদ্র মাটি থেকে তখন আনা পানির বোতল টা তুলে ছেলেটার মুখের উপর ঢালতে লাগল অনবরত। গাল গড়িয়ে গলা বেয়ে জল ধারা ছেলে টার বুকের কাটা অংশ স্পর্শ করলো। জ্বলন্ত শিখার ন্যায় জ্বলে উঠল জায়গাটা। মনে হচ্ছে যেনো কেউ মরিচ লাগিয়ে দিয়েছে। পানির জন্য দৃশ্যমান না হলেও ছেলেটার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে যন্ত্রণা মিশ্রিত অশ্রুর বেগে। চোয়াল শক্ত রেখে আদ্র শ্লেষাত্মক স্বরে বলে উঠল,
” আমার তুলা কে কখনও আমি ওর অনুমতি ব্যতীত স্পর্শ করার চেষ্টা করি নি। বছরের পর বছর দূর থেকে দেখে চোখের তৃষ্ণা মিটিয়েছি। স্পর্শ করতে বারবার চিন্তা করি আমার তুলার কোমল দেহে আবার ব্যাথা না লেগে যায়। আর তুই তাকেই কষ্ট দিলি?তুই ওর হাত টা দেখেছিলি? আমার তুলার হাতে তোর কলুষিত ছোঁয়ায় লাল ছাপ পড়ে গেছে। তুই ওকে শুধু বাহ্যিক ভাবে নয় মানসিক ভাবে আঘাত করেছিস। ব্লাডি বাস্টার্ড। তুই আমার তুলা কে হার্ট করেছিস। আমার তুলা কে!”
লাস্টের কথাগুলো অস্থির কন্ঠে চিৎকার করে বললো আদ্র। ইতিমধ্যে এখানে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। কারো তোয়াক্কা না করে কঠোর ভাবে আঘাত করতে লাগল ছেলেটা কে। যেনো ছেলেটা মরে গেলেও তার কোনো ভয় নেই।
____________
পিটপিট করে নেত্র যুগল মেলে তুলি নিজের অবস্থান বুঝার চেষ্টা করলো। রুমের পর্দা দেখে বুঝতে বাকি থাকল না এটা আদ্রর রুম। জানালার পর্দা হালকা হাওয়ায় মৃদু মৃদু নড়ছে। তুলি সময়টা আন্দাজ করার চেষ্টা করলো। বাহিরে হালকা অন্ধকারের সমারোহ। দুপুরের কথা মনে পড়তেই চট করে উঠে বসলো তুলি। হাতে টান অনুভব করতেই পাশে তাকাল। চোখের পাতায় ভেসে উঠল কপালে হাত ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় থাকা আদ্র। বাজে সেই মুহুর্ত টা মনে করে তুলির কান্না পেলো। ফুপিয়ে কান্না আটকানোর শব্দ কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হতেই আদ্র উদগ্রীব হয়ে গেল। হাতে টান পড়ায় তাল সামলাতে না পেরে তুলি আদ্রর বুকে গিয়ে পড়লো। আহ্লাদী স্বরে বলে উঠল আদ্র,
” কাঁদছো কেন তুলা?”
প্রতুত্তর করলো না তুলি। মিশে রইল আদ্রর বুকের মধ্যে। কান্নার কারণ টা তো আদ্রর অজানা নয়। সূক্ষ্ণ একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল আদ্র। তুলি কে বুক থেকে টেনে বিছানায় শুয়ে দিল। নিজেও শুয়ে পড়ল পাশে। বাম হাত টা হাতের মুঠোয় বন্দী করে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিল গভীর ভাবে। তুলির শরীরের লোমশ খাড়া হয়ে গেল আকস্মিক স্পর্শে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ে গেল লজ্জার শিহরণ। হাতে পরপর ঠোঁটের পরশ বুলিয়ে দিল আদ্র। মুখ এগিয়ে গলার কাছে আনতেই তুলির ভিতরটা কাঁপতে লাগল। অস্বাভাবিক হয়ে পড়ল হৃৎস্পন্দন। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল লজ্জায়। আলতো ভাবে ঠোঁট ছুঁয়ে সরে এলো আদ্র। ম্লান হেসে বললো,
” তুমি প্রত্যেক টা মুহুর্তে আমার স্পর্শ অনুভব করবে তুলি। ”
কথাটায় কি ছিল তুলি জানে না। তবে নতুন এক মিষ্টি অনুভূতির সাথে পরিচয় হলো তার। চোখ বুঁজে কীয়ৎক্ষণ অনুভব করল সদ্য জন্ম নেওয়া অনুভূতিটা কে। আঁখি পল্লব মেলতেই নজর ঠেকল আদ্রর হাতের দিকে। নিমিষেই লজ্জিত চোখে ফুটে উঠল সূক্ষ্ণ ব্যাথার ছাপ। আদ্রর হাত টা ধরে বিচলিত কন্ঠে বলে উঠল,
” আপনার হাতে তো রক্ত।”
” ব্যান্ডেজ করে নিব।”–আদ্রর নিষ্প্রভ স্বর।
তুলি মলিন মুখে তাকিয়ে রইল নিষ্পলক। আদ্র ক্ষীণ হেসে পুনরায় বললো,
” বাহিরে সবাই তোমার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় বসে আছে তুলি। তাদের আসতে বলি?”
প্রচন্ড অবাক হলো তুলি। সবাই বসে আছে মানে?আনমনেই মাথা নাড়াল। আদ্র উঠে গিয়ে দরজা খুলতে না খুলতেই সবাই একসাথে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করল। এর মধ্যে রাদিফ সাহেব, তৌফিক সাহেব কেউই বাদ যায় নি। রিমি,আমরিন,পায়েল এসে ঝাপটে ধরল তুলি কে। ভালো লাগায় ভরে গেল তুলির আবেগি মন টা। সবার চেহারা বলে দিচ্ছে মানুষ গুলো কতটা ব্যাকুল হয়ে তার অপেক্ষায় ছিল। রক্তের সম্পর্ক না হয়েও জীবনে আপনজনের খাতায় নাম লেখাল। মনে মনে হাজারো ধন্যবাদ জানালো তুলি আদ্র কে। এই মানুষ টা জীবনে না আসলে এতো আপনজন পেতো না কখনও। দূরে দাড়িয়ে আছে আদ্র। ঠোঁটে তার অমায়িক হাসি। তুলি আজকের বিষাক্ত মুহুর্ত টা ভুলে গেল, চিরতরে মুছে গেল মন থেকে। তৃপ্ত হেসে মনে মনে বললো,
” আমার যেনো এই মানুষ গুলোর সাথে দীর্ঘ একটা জীবন কাটানোর সুযোগ হয়। মানুষ গুলোর ভালোবাসায় সিক্ত থাকতে পারি দীর্ঘক্ষণ।”
#চলবে,,,,
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)
Pic.credit:Ananya 💜