আকাশে তারার মেলা সিজন 2 পর্ব-২৬

0
2754

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব_২৬

তুলি কে টেনে হল রুমে নিয়ে আসল আদ্র। সায়েরা বেগম আমরিন কে খাইয়ে দিচ্ছিলেন নিজ হাতে। যেই না এক লোকমা ভাত আমরিনের মুখে পুড়ে দিল দেখতে পেল আমরিনের মুখভঙ্গি হঠাৎ করেই পরিবর্তন হয়ে গেছে। বহু কষ্টে লোকমা টা গিলে নিল আমরিন। চোখের ইশারায় সামনে তাকাতে বললো সায়েরা বেগম কে। দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে চাইতেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ছেলের পিছনে নত মস্তকে থাকা তুলি কে দেখে হাত ধুয়ে উঠে আসলেন তড়িঘড়ি করে। মেয়েটার চেহারায় ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। আতঙ্কিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

” কি হয়েছে আদ্র?তুলি কে এভাবে ধরে এনেছিস কেন?”

” কিছু হয় নি। বউ কে নিয়ে এলাম একেবারে। আর দিচ্ছি না। তোমার বোন কে জানিয়ে দিও।”

নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিয়ে তুলির হাত টা ছেড়ে দিল আদ্র। টি টেবিলের উপর থেকে রিমোট নিয়ে এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিল। কয়েক সেকেন্ড ঠাঁই দাড়িয়ে থেকে সিঁড়ি বেয়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই সায়েরা বেগম পিছু ডাকলেন। হন্তদন্ত পায়ে এগিয়ে এসে বললেন,

” একেবারে নিয়ে এসেছিস মানে?”

“আমার বউ উড়তে শিখে গেছে,বুঝতে শিখে গেছে,অন্যের দুঃখ কষ্টের ভাগিদার হওয়া,সহানুভূতি দেওয়া শিখে গেছে। সব মিলিয়ে খুব বড় হয়ে গেছে। তাই আমি আমার বউ কে নিয়ে এসেছি। কোনো শর্ত সহ্য করতে রাজি নয় আমি।”

তাচ্ছিল্যের স্বরে তুলির দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে কথাগুলো বললো আদ্র। তুলির চোখে জল টলমল করছে। ভয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে ঝটপট। এতো ভয় কখনও পায় নি এর আগে আদ্র কে। হয়তো আগে আদ্রর এমন রূপের সম্মুখীন হতে হয় নি তাই। সায়েরা বেগম ইতস্তত কন্ঠে বলতে লাগলেন,

” কিন্তু,,। ”

” কিন্তু কি?শর্ত ছিল ইন্টার ফাইনাল দেওয়ার পর তুলি কে এই বাড়িতে, আমার হাতে তুলে দেওয়া হবে। কারণ খালা-খালু,বাবার দৃষ্টিতে তুলি এখনও ছোট। আমি যদি আমার বউ কে খাইয়ে পড়িয়ে,যত্ন দিয়ে বড় করতে পারি তাহলে কি এই শর্ত নিছক নয়?আমার পক্ষে আর এক মুহুর্তও কোনো শর্ত মানা সম্ভব না। বউ আমার। তাই আমি নিয়ে এসেছি। ”

একটু থামলো আদ্র। কন্ঠে এক রাশ গম্ভীরতা ঢেলে বাঁকা হেসে বলে উঠল,

” তোমার মনে আছে মা?নাও থাকতে পারে। স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। তোমার পিছনে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা কে চার বছর আগে নিজের ছেলের বউ করে আনার জন্য অন্য একটা মেয়ে কে আমার জীবন থেকে সরিয়েছিলে অন্যায়ভাবে। আজ যখন আমি তুলি কে চাইছি কেন দূরে সরিয়ে রাখছো?আমি ধৈর্যশীল তবে ততটাও নয় যতটা ধৈর্য্য ধরলে আমার নিজেরই নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হবে।”

আদ্রের কথায় আঁতকে উঠলেন সায়েরা বেগম। পিছন ফিরতেই চোখে পড়ল তুলির বিস্ময়কর দৃষ্টিপাত। তুলির চোখের জল শুকিয়ে গেছে। অন্য এক চিন্তা হানা দিয়েছে মনের মধ্যে। অন্য একটা মেয়ে মানে?সূক্ষ্ণ বিষাদ অনুভব করল তুলি। সায়েরা বেগম ফের ছেলের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। আদ্রর ঠোঁটের কোণের হাসি টা প্রগাঢ় হলো। শান্ত শোনালো কন্ঠস্বর।

” অন্যায়কারী তুমি একা নও,সেও ছিল। তবে আমি কৃতজ্ঞ তোমার প্রতি মা। তুমি আমাকে সুন্দর একটা পৃথিবী দেখিয়েছ, আমার অস্তিত্বের সন্ধ্যান দিয়েছ। তুলি কে যদি কেউ এই বাড়ি থেকে নিয়ে যায়, তাহলে আমার ছায়াও এই বাড়িতে দেখবে না তোমরা।”

আদ্রর শান্ত কন্ঠের হুমকি শুনে বুক টা হাহাকার করে উঠল সায়েরা বেগমের। তিনি আর কোনো ভুল করতে চান না। একটা ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে চার টা বছর ধরে। এক মুহুর্তও দাঁড়ালো না আদ্র। তুলির দিকে একবার চেয়ে সোজা চলে গেল সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করে। ছেলের যাওয়ার দিকে চেয়ে ভিতর থেকে একটা দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো সায়েরা বেগমের। তুলির কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

” আদ্রর রুমে যা মা। ”

তুলি বিস্ময়ে জড়ীভূত হয়ে গেল। চোখের পলকেই শ্যাম বরণ চেহারাটা কেমন রাঙা হয়ে উঠল। আলতো হাসলেন সায়েরা বেগম। আদুরে কন্ঠে বললেন,

” তুই এখন না গেলে আমার ছেলেটা ভীষণ রেগে যাবে। ”

লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পড়ল তুলি। মাথা নাড়িয়ে নত মস্তকেই সিড়ি বেয়ে উঠে গেল। আমরিন চিন্তাগ্রস্ত স্বরে আওড়ালো,

” ভাইয়া বোধ হয় কোনো বিষয় নিয়ে রেগে আছে আম্মু। তুমি রাতে আব্বু আসলে বিয়ের বিষয় টা নিয়ে কথা বলো। আমি চাই না ভাইয়া এই বাড়ি ছেড়ে আবারও চলে যাক। শূন্য শূন্য লাগে বাড়ি টা।”

মেয়ে কে বুকে জড়িয়ে নিলেন সায়েরা বেগম। হেসেই বলে উঠলেন,

” তোর ভাইয়া কে আঁটকে রাখার জন্য তুলিই যথেষ্ট। ”
_________

কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা ঠেলে আদ্রর রুমে ঢুকল তুলি। নিরবতার ছড়াছড়ি পুরো রুম জুড়ে। তুলির বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল। বেলকনি থেকে একটা শীতল হাওয়া ছুঁয়ে দিয়ে গেল। এলোমেলো করে দিয়ে গেল কয়েকটা চুল। চারদিকে নজর বুলিয়ে তুলি বেলকনির দিক পা বাড়াল। বাতাসের দাপটে সাদা পর্দা গুলো উড়ছে বাধাহীন। আকাশ টা হুট করেই কালো মেঘে ঢেকে গেছে। হয়তো বর্ষণ হবে। তুমুল বেগে বর্ষণ। শীতল হাওয়া তারই বার্তা বয়ে চলেছে। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিল তুলি। বেলকনির দরজা লাগিয়ে রুমে আসতেই চোখে পড়ল সদ্য শাওয়ার নিয়ে আসা আদ্র কে। সাদা একটা গেঞ্জি পরে আদ্র চুলের পানি ঝাড়ছে হাত দিয়ে। রুমে কারো উপস্থিতির আভাস পেয়েও ফিরে তাকাল না। বাধ্য হয়ে তুলি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এগোতেই আদ্র কতগুলো জরুরি ফাইল নিয়ে বসে পড়লো চেক করতে। গতকাল হসপিটাল থেকে ফাইল গুলো নিয়ে এসেছিল। ফাইলে নজর রেখেই দুর্বোধ্য হেসে বললো,

” আজ হসপিটাল থেকে লেকের পাশের রাস্তা দিয়ে ব্যাক না করলে কখনোই জানতে পারতাম না আমার তুলা আমাকে মিথ্যে বলে।”

যন্ত্রণা দায়ক পীড়ন ছড়িয়ে পড়ল তুলির সারা শরীরে। আদ্রর অভিমান মিশ্রিত দৈবাৎ বাক্য টা তার মন মেনে নিতে পারল না। হাউমাউ শব্দ করে প্রচন্ড জোরে কেঁদে উঠল। ছুটে এসে সবকটা ফাইল ফেলে দিল ফ্লোরে। বাচ্চাদের মতো গুটি শুটি মেরে জায়গা খুঁজতে লাগল আদ্রর প্রশস্ত বুকে। হতভম্ব হয়ে গেল আদ্র। কয়েক পলক স্তম্ভিত থেকে নিজেই তুলির কোমল দেহ টা কে বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। ভেজা অনুভব করল বুকের এক পাশে। তুলির মাথায় হাত রেখে কানের কাছে করুন স্বরে ফিসফিস করে বললো,

” হৃদপিণ্ড বরাবর মাথা রেখে কাঁদছো তুমি তুলি। আমার রক্তাক্ত হৃদপিণ্ডের আর্তনাদ কি শুনতে পাচ্ছো তুমি?যদি পারো তাহলে কাঁদবে না প্লিজ। ভীষণ কষ্ট হয় আমার। ”

কথাগুলো কর্ণগোচর হতেই তুলির কান্নার বেগ কমে এলো। থেমে গেল একটা সময়। অশ্রু সিক্ত কন্ঠে বুকে মুখ গুঁজে বলে উঠল,

” কোনোদিনও আর মিথ্যা বলবো না আদ্র। কোনোদিনও না। আপনি আমার সাথে রাগ করে থাকবেন না। ভালোবাসা বন্ধ করবেন না।”

তুলির অশ্রু ভেঁজা কন্ঠে বোকা বোকা কথা শুনে স্মিত হাসল আদ্র। ফ্লোরের দিকে নজর ঠেকতেই দৃষ্টি করুন হয়ে এলো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ফাইলগুলো। প্রত্যেক টা ফাইল খুবই জরুরি। আদ্র ফাইলগুলোর দিকে তাকিয়েই তুচ্ছ করে মনে মনে বললো,

” আমার বুকে থাকা মেয়েটা আমার কাছে তোদের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তোদের নাহয় কষ্ট করে আবার গুছিয়ে নিব কিন্তু আমার তুলা কে ছাড়া আমি অগোছালো হয়ে পড়ব।”

তুলি কে বুকে জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল আদ্র। আদ্রের হাতে মাথা রেখে লজ্জায় চোখ বুঁজে রইল তুলি। আবেগের বশে যেন হুঁশ হারিয়ে ফেলেছিল কিছুক্ষণের জন্য। এখন লজ্জায় বুকে হাতুড়ি পেটা শব্দ হচ্ছে। নিজ থেকে আদ্রর এতোটা কাছে এসেছে যা তুলির জন্য এভারেস্ট জয় করার সমান।নিজের হাতের মুঠোয় তুলির একটা হাত পুড়ে নিল আদ্র। পুরো রুমে শীতলতা। বৃষ্টি ইতিমধ্যে ধরনীর বুকে আছড়ে পড়ছে প্রবলভাবে। তুলির সারা শরীর শিউরে উঠল। ছোট্ট দেহে কিছুটা ভার অনুভব করল। ঠান্ডার মাঝেও ঘামতে লাগল দেহ। কলেজ ড্রেস টা পুনরায় ঘামে ভিজতে লাগল। এইবার টনক নড়ল তুলির। আদ্রর গা থেকে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ নাকে দোলা দিতেই লজ্জায় চুপসে গেল। এতোক্ষণ অব্দি ঘর্মার্ত ড্রেস নিয়ে আদ্রর সাথে মিশেছিল ব্যাপারটা কেমন জঘন্য। আদ্র বোধ হয় মনে মনে তাকে খাটাশ উপাধিও দিয়েছে। তুলি উঠে যাওয়ার প্রয়াস করতেই আদ্র হাত চেপে ধরল। কপালে সূক্ষ্ণ ভাজ পড়ল তার।

” কোথায় যাচ্ছো?”

তুলি আমতাআমতা করে জবাব দিল,

” ফ্রেশ হবো।”

” আরেকটু পরে যেও।”

” কলেজ ড্রেস টা ময়লা হয়ে আছে ঘ,,ঘামে ভিজে।”

“তো?”

কপট রাগ দেখিয়ে প্রশ্ন করল আদ্র। হাত টেনে তুলি কে নিজের কাছে নিয়ে আসল। গালে শুষ্ক ঠোঁট ছুয়ে দিতেই তুলি কম্পমান হাতে খামচে ধরল আদ্রের বুকের কিছু অংশ নিষ্পলক চেয়ে রইল আদ্র তুলির অস্থিরতা মাখা মুখশ্রী তে। ক্ষীণ স্বরে আওড়ালো,

” ঘামে চুপচুপে কালো ড্রেসে পড়ন্ত এক দুপুরে তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম তুলা। ”

অতিশয় বিস্মিত হলো তুলি। চোখ বুঁজে থেকেই বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে লাগল। নিঃশ্বাসের উত্তাপে কন্ঠনালি শুকিয়ে এলো আদ্রর। শিরদাঁড়া বেয়ে গড়িয়ে গেল শীতল স্রোত। তুলির কোমর আঁকড়ে ধরে একদম কাছে টেনে নিল। গম্ভীর স্বরে ডাকল,

” লুক এট মি তুলা।”

পলক ঝাপটিয়ে আঁখিদ্বয় মেলল তুলি। নিমিষেই আঁটকে পড়ল আদ্রর চোখের মাদকতায়। দু’চোখে অদ্ভুত মুগ্ধতা ফুটে আছে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। গভীর চাউনি আদ্রর। অন্তর টা কেমন ভয়ংকর অনুভূতিতে নড়ে উঠছে। চোখ সরাতেই আদ্র নেশা মিশ্রিত স্বরে বলে উঠল,

” যদি তোমাকে একটু গভীরভাবে ছুঁয়ে দিই তোমার মন কি কষ্ট পাবে তুলা?”

বাক্য হারা হয়ে গেল তুলি। বক্ষস্থল কেঁপে উঠল নিদারুণ ভাবে। এ কেমন হৃদয় নিংড়ানো প্রশ্ন করে বসল আদ্র!

#চলবে,,,

(ভুল -ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল।)

P.c: Fatiha Ali

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here