#গাংচিল
#৬ষ্ঠ_পর্ব
গেস্ট রুম থেকে বের হয়েই রান্নাঘর। সীমান্তের ইচ্ছে হলো এক গ্লাস ঠান্ডা লেবুর শরবত খেতে। যদি এতে মাথা ব্যাথা কমে। নীলুকে বললে হয়তো করে দিবে। কিন্তু রান্নাঘরে যেতেই সীমান্তের পা আটকে গেলো। তার চোখের সামনে যেনো কোনো মায়াপুরীর রাজকন্যা দাঁড়িয়ে আছে। স্রষ্টা বেশ সময় করে যেনো এই শিল্পকর্মের রচনা করেছেন। কোনো নারী কি এতোটা মায়া পরিপূর্ণ হতে পারে! সূর্যের স্নিগ্ধ আলো শ্যামমুখুখানার উপর আছড়ে পড়ছে। মুখশ্রীর মায়া যেনো আরোও দ্বিগুন লাগছে এই প্রভাতে। পাতলা ঠোঁটজোড়ার কোনেতে যে এক চিলতে স্নিগ্ধতা লেপ্টে আছে তা বুকে আঘাত হানতে সীমান্তের। চুলগুলো উঁচু করে মাথায় খোপা করে রাখা। ঘামের রেখা গড়িয়ে পড়ছে চুলের গোড়া থেকে। নেমে আসছে মোলায়েম ঘাড়ে। কাধের কালো তিলটা যেনো তার নজর টিকা। নীলশাড়িতে মায়াবতীকে মনে হচ্ছে কোনো নীলকন্ঠী ফুল। মৌপ্রিয়া কাজে ব্যাস্ত, ক্ষণে ক্ষণে কপালের চুল গুলো কানের পাশে ঘুজছে সে। ফাঁকে কোমড়ের কাপড়টি খানিকটা সরে গেলো, সেদিকে খেয়াল নেই মৌপ্রিয়ার। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিলো সীমান্ত। তার মনে হলো শিরদাঁড়া বেয়ে গরম রক্তের স্রোত বয়ে গেলো। অজান্তেই বুকে হাত চলে গেলো সীমান্তের। এই প্রথম কোনো নারীর প্রতি অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। এই অনুভূতিকে প্রকাশ করার সাধ্য তার নেই। এই অনুভূতির নাম কি সেটাই যে তার অজানা। এক পা আগানোর সাধ্য নেই তার। সেখানেই দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো সীমান্ত।
পরোটা ভাজা শেষে হটপট হাতে পেছনে ঘুরতেই চমকে উঠলো মৌপ্রিয়া। সীমান্ত বুকে হাত দিয়ে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাটাকে দেখেই গতরাতের দুঃস্বপ্নটা চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। শ্যামগাল জোড়া রক্তিম হয়ে উঠলো। কিন্তু ভয় পেলে তো চলবে না। তাকে এই ব্যাক্তির মুখোমুখি হতে হবে প্রতিদিন। মৌপ্রিয়া নিজেকে সামলালো। ঝাঁঝিয়ে বললো,
“এখানে কি করছেন আপনি?”
মৌপ্রিয়ার কন্ঠ কানে আসতেই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরে সীমান্ত। আমতা আমতা করে বলে,
“মাথা ব্যাথা করছে, লেবু পানি খেতে পারলে ভালো হতো। তাই”
“উহহহ, আগে গোসল করে আসুন। গা থেকে শুকোরের মতো গন্ধ বের হচ্ছে। সকাল সকাল আমার পেট মুড়িয়ে উঠেছে। ছি ছি এই নাকি আপনি টিচার।“
নাকে আঁচল চেপে সুতীক্ষ্ণ স্বরে কথাটা বলে মৌপ্রিয়া। মৌপ্রিয়ার কথায় খানিকটা বিব্রতবোধ হয় সীমান্তের। গতকালের কাজটা মোটেই ভালো হয় নি তার। মৌপ্রিয়ার জায়গায় অন্য কেউ হলে তো তাকে ঘাড় ঘরে বের করে দিতো। মাথা চুলকে খানিকটা লজ্জিত কন্ঠে সীমান্ত বলে,
“ সরি, আমার কাছে তো এক্সট্রা পাঞ্জাবী নেই।গতরাতের জন্য ও সরি।“
“আমি নীলাঞ্জনাকে দিয়ে সাবান, শ্যাম্পু, কাপড় পাঠিয়ে দিচ্ছে। আপাত্ত বাবার পাঞ্জাবী ই পড়তে হবে। আর পরণের পাঞ্জাবীটা আমার হাতে দিবেন। ধুয়ে শুকানোর পর ফেরত দেবো। গোসল করে ডাইনিং টেবিলে আসুন।“
“জ্বী”
সীমান্ত শুধু ঘাড় কাত করে ছোট করে জ্বী বলে। ক্ষনিকের জন্য মনে হলো মৌপ্রিয়াই তার শিক্ষক। আর সে তার বাধ্য ছাত্র। সীমান্ত যেতে ধরলে মৌপ্রিয়া হিনহিনে কন্ঠে বললো,
“শুনুন”
“জ্বী”
“কাল হয়েছে, কিছু বলছি না। কিন্তু আর যেনো এমনটা না হয়। তাহলে আমার রুদ্ররুপ দেখতে হবে, বলে দিলাম।“
“কথা দিচ্ছি, আর হবে না।“
সীমান্ত এক মূহুর্ত দেরি না করে নিজের রুমে প্রস্থান করলো। মৌপ্রিয়ার সাথে কথা বলাটা যেনো বিশ্বের সব থেকে দুর্বিষহ কাজে পরিণত হয়েছে। তার দিকে তাকালেই হৃদয়ের কোনায় চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে। এই ব্যাথার উৎসটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। তাড়াতাড়ি প্রস্থান করাটাই যথার্থ। সীমান্তের কাচুমাচু মুখখানা দেখে হেসে উঠলো মৌপ্রিয়া। লোকটাকে এবার বাগে পেয়েছে সে। গতকাল রাতে লোকটির জন্য কম ধকল যায় নি তার। সারারাত লোকের নেশাগ্রস্থ কন্ঠের কবিতাটি তার মাথায় ঘুরেছে। নির্ঘুম রাত পার করেছে সে। অবশ্য ঘুমের ব্যাপারে সে বেশ দূর্ভাগা, ঘুমের ঔষধ ও তাকে দু থেকে তিনঘন্টার বেশি ঘুম দিতে পারে না। এই সমস্যা টা আজ থেকে না। যেদিন সে মাকে হারিয়েছিলো সেই দিন থেকেই এই সমস্যা। ছোটবেলায় মায়ের মিহি কন্ঠের গল্প না শুনলে তার ঘুম আসতো না। এই অভ্যাসটা তার কাল হয়ে উঠেছে। তাইতো এখনো নির্ঘুম রাত কাটাতে হয় তাকে। তার সাথে যোগ হয়েছে এখন সীমান্তফোবিয়া। এই রোগটা কতদিন তাকে জ্বালাবে সেটাই দেখার পালা।
ডাইনিং টেবিলে পিনপতন নীরবতা। কাচুমাচু মুখে মাথা নিচু করে বসে আছে ইফতেকার সাহেব। গতকালে একটু বেশি ই হয়ে গিয়েছিল। তার ঠিক অপোজিটে বসে আছে সীমান্ত। ইফতেকার সাহেবের পাঞ্জাবী বেশ আটসাট হয়েছে তার। ফুল হাতা হয়ে গিয়েছে থ্রি কোয়ার্টার। হাটু অবধি উঠে এসেছে, হাটু থেকে পাচ ইঞ্চি উপরে। বুকের বোতাম আটকালে শ্বাস আটকে আসবে তার। বুকের কালো লোমগুলো ফলে দৃশ্যমান। তবুও উপায় নেই। মৌপ্রিয়ার আদেশ না মানার সাধ্য নেই তার। ইফতেকার সাহেবের কাচুমাচু মুখ দেখে মৌপ্রিয়া হিনহিনে কন্ঠে বলে উঠলো,
“খাবার তো দেখার জন্য দেই নি, খাওয়ার জন্য দিয়েছি। তা সেটাকে কি দেখেই যাবে নাকি?”
“তুই আমাকে বকশিস কেনো? আমি না তোর বাবা?”
“ওহ তাই নাকি? জানাই ছিলো না। তা গতরাতে কটা বোতল ফাঁকা করা হয়েছে সেটা কি কবি মহাশয়ের মনে আছে?
এবার চুপ করে গেলেন ইফতেকার সাহেব। মৌপ্রিয়া এবার শক্ত কন্ঠে বললো,
“আজ থেকে তোমার ড্রিংক করা বন্ধ। আমার ঘরে কোনো মদের বোতল খুলবে না। যদি সেটা না হয়, তবে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।“
“সীমান্তের সামনে এই কথাগুলো না বললেই তো নয়?”
“না, কাল যখন উনার সামনে সরি উনাকে নিয়ে মদ গিলেছো তখন মনে ছিলো না উনি বাহিরের কেউ। এখন বকা খাবার সময় মানে লাগছে? আমার কথা স্পষ্ট আমার ঘরে হয় মদ থাকবে নয় আমি। অনেক হয়েছে আর না।“
ইফতেকার সাহেব মাথানিচু করে বসে রইলেন। তখন সীমান্ত ধীর স্বরে বলে উঠলো,
“মৌপ্রিয়া ঠিক বলছে, মদটা খুব বাজে জিনিস। কাল টের পাই নি, আজ মনে হচ্ছে নাড়িতে যেনো পেঁচ লেগে আছে। আপনি তো বয়স্ক, আপনার জন্য তো আরো খাওয়া উচিত না। মাসে এক আধবার ঠিক আছে কিন্তু প্রতিদিন না।“
“মাসে এক আধবার ও না।“
“এতোটাও কঠোর হবেন না, আসলে এতোদিনের অভ্যাস তো।“
“ঠিক আছে, মাসে দুবার। ঠিক আছে বাবা?”
ইফতেকার সাহেব শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানান। মেয়ের রাগ সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণাই রয়েছে তার। তাই সে যে মাত্র দুবার খেতে পারছে এইতো অনেক। তাই রাজী হয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। সীমান্ত খাওয়া শুরু করলে মৌপ্রিয়া বলে,
“আজ কোনো লেখা পড়তে হবে না আপনার। আবার গতবার লেখা বইটা নিয়ে যাবেন। কাল এসে আমাকে পয়েন্ট করে বলবেন কোথায় কোথায় ভুল ছিলো।“
“জ্বী”
“আমি ড্রাইভার কাকুকে বলে বলে দিবো আপনাকে পৌছে দিবেন। পাঞ্জাবী আর পায়জামাটাও কালকেই পাবেন।“
“জ্বী”
“জ্বী, জ্বী ছাড়া দেখি আজ কোনো কথা মুখ থেকে বের হচ্ছে না। কাল তো খুব কবিতা বের হচ্ছিলো”
মৌপ্রিয়ার কথা শুনেই বিষম খেলো সীমান্ত। গতরাতের মূহুর্তটা চোখের সামনে ভাসছে। ইফতেকার সাহেব পানি এগিয়ে দিলেন। তারপর মৌপ্রিয়াকে নরম গলায় বললেন,
“থাক না কাল রাতের কথা, রাত শেষ রাতের কাহিনীও শেষ।“
মৌপ্রিয়া কোনো কথা বলে না, শুধু আড়চোখে সীমান্তকে দেখে যায়। তার ঠোঁটের কোনায় একটা দুষ্টু হাসি লেগেই রয়েছে। সীমান্তকে এভাবে দেখতে বেশ উপভোগ করছে সে। যাক আবালচন্দ্র মাস্টরমশাই কিছু পারুক না পারুক, মৌপ্রিয়ার হাসির কারণ তো হতে পেরেছে______________
দুপুর১টা
হাসপাতালের বেশ জট লেগেছে। একজন রোগীর অভিভাবক রীতিমতো চেঁচামেচি করছে। গতকাল সন্ধ্যায় রোগীকে ভর্তি করিয়েছিলো সে। কিন্তু মিনিট বিশেক পূর্বে সে ইন্তেকাল করেছেন। লাশ নিয়ে যাবে নিজ বাসায়। লোকটি পুরুষ, তার মেয়ে বাবাকে জড়িয়ে কান্না করছে। তার স্বামীকে বলা হয়েছে সব অফিসিয়াল কাগজের কাজগুলো মিটানোর জন্য। ঝামেলাটা বাধলো যখন বিল দেবার সময় এলো। সব মিলিয়ে ত্রিশ হাজার টাকা বিল এসেছে তাদের। কিন্তু সেই লোক এই টাকাটা দিতে নারাজ। তার কথা চব্বিশ ঘন্টা তো হয় নি, তাহলে সে কেনো কেবিনের টাকা সম্পূর্ণ দিবে। তিয়াশা তাকে বারংবার বুঝাতে চাইছে,
“স্যার এটা আমাদের হসপিটালের নিয়ম। সকাল বারোটার পর একদিন কাউন্ট করা হয়। এখন একতা বাজে। সুতরাং আপনাকে আই.সি.উ রুমের ভাড়াটা সম্পূর্ণ দিতে হবে। এটাই রুল।“
“আপনারা কি রাহাজানি শুরু করেছেন হ্যা? কি ভেবেছেন মানুষের গলা চেপে টাকা নিবেন কিছু বুঝবো না। আমার শ্বশুর এক দিন পুরোও হাঁসপাতালে থাকে নি। আমি কেনো চব্বিশ ঘন্টার টাকা দেবো?”
“স্যার, ভর্তির সময় বলা হয়েছিলো। বারোটার পর ডিসচার্জ করলে একদিনের টাকা যুক্ত হবে। প্লিজ স্যার ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।“
“চুপ, একদম চুপ। তোর উপরে কে আছে তাকে ডাক। আমি তোর সাথে কথা বলবো না।“
“স্যার বিলিং সেকশনে আমি ই আছি।“
এবার লোকটি যেনো নিজের সংযম হারিয়ে ফেললো। উগ্রতার মাত্রা ছাড়িয়ে তুই তুকারি করা শুরু করলো। লোকটির সাথে জড়ো হয় আরোও কিছু মানুষ। অপমান জনক কথার মাত্রা বাড়তে তিয়াশা বাধ্য হয় সিক্যুরিটি ডাকতে। তিয়াশার কলিগেরা এসে লোকটিকে বোঝানোর চেষ্টা করে। সিক্যুরিটি ডাকতে দেখে লোকটি যেনো আরোও চেতে যায়। তার শ্বশুর মারা গিয়েছে তাতে তার কোনো আক্ষেপ নেই, সে পড়ে রয়েছে বিলের পেছনে। হায় রে মানুষ! তিয়াশা তাকে শেষবারের মতো নবলে,
“স্যার, অথোরিটির বাহিরে কাজ আমি করতে পারবো না। আপনাকে টাকাটা দিতে হবে। নয়তো আমরা লাশ ছাড়তে পারবো না।“
“তবে রে”
বলেই লোকটা ডেস্কে থাকা পেপার ওয়েটটি হাতে নেয়। ছুড়ে মারে তিয়াশার দিকে। পেপারওয়েটটা ঠিক কপালে যেয়ে লাগে তিয়াশার। টপটপ করে রক্ত পড়তে থাকে। লোকটি আরো কিছু করতে গেলে সিক্যুরিটি তাকে আটকায়। হাসপাতালের এমন পরিস্থিতি দেখে মেইন এডমিনিস্ট্রেশন নেমে যায়। লোকের ভিড় জমে যায়। তিয়াশা মাটিতে বসে পড়ে। চিনচিনে ব্যাথা তাকে গ্রাস করছে, এ যেনো অসহনীয়। মাথাটা ঘুরছে। এই বুঝি জ্ঞান হারাবে সে। তখনই এক জোড়া হাত তাকে আগলে ধরে। রুমালটা মাথায় চেপে ধরে তার কপালে। তিয়াশা মাথা তুললেই দেখে……………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি