#গাংচিল
#১০ম_পর্ব
ধীর স্বরে কথাটা বলে তিয়াশা। এবার যেনো অন্তুর রাগটা সপ্তম আকাশ ছোঁয়। নিজেকে কোনো মতেই সংযমে রাখতে পারে না সে। শক্ত করে চেপে ধরে তিয়াশার বাহু। ব্যাথায় কুকড়ে উঠ তিয়াশা। আরোও খানিকটা ঝুকে তীব্র স্বরে বলে অন্তু,
“কেনো আমার সাহায্য নিলে কি তোমার মান সম্মান খুয়ে যাবে?”
“কথাটা মান সম্মানের নয়, কথাটা সম্পর্কের। কোন সম্পর্কে আমাকে সাহায্য করবেন আপনি?”
“কোনো সম্পর্ক নেই আমাদের?”
“নাহ, নেই।“
তিয়াশা অটল কন্ঠে কথাটা বলে। তিয়াশার স্বাভাবিক কন্ঠ বুকে ছুরিঘাত করে অন্তু। হাতের চাপটা আরোও বাড়ায়। দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
“আমার মুখ খুলিও না তিয়াশা, ক্ষতিটা কিন্তু তোমার হবে। আমাদের কি সম্পর্ক জানা নেই তোমার? বিয়ে করা বউ তুমি আমার।“
অন্তুর মুখে “বিয়ে করা বউ” কথাটা শুনে থমকে যায় তিয়াশা, অন্তু এতো বছর বাদে এই কথাতা বলবে জানা ছিলো না তার। অহেতুক কারণে মনটায় এক শান্ত দোলা খেয়ে যায়। চোখটা তার অটল রাখতে পারে না। কন্ঠে কেঁপে উঠে তার। ধরা গলায় বলে,
“সেই সম্পর্কের মূল্য কি আছে? তা কেবলই আবেগের জোয়ার ছিলো?”
“তোমার কাছে তো সব কিছুই আবেগ, সব কিছুই মূল্যহীন। আমার ভালবাসাটাও মূল্যহীন। তাইতো নিষ্ঠুর ভাবে সেটার গলা টিপতে দুবার ভাবো নি। আমার হৃদয়ে আঘাত করতেও দুবার ভাবো নি। এতোটা নিষ্ঠুর কেনো তুমি তিয়াশা? আমি ই ভুল, এখনো সেই স্মৃতি আকড়ে বসে রয়েছি। এখন ভ্রান্ত ধারণায় বাঁচি, এখনো মরীচিকার পেছনে ছুটি। আসলে আমি তো তোমার মতো নিষ্ঠুর নই। তোমার কাছে আমাদের বিয়েটা মূল্যহীন, কিন্তু আমার কাছে সেটা বিয়ে। নিজের জমানো ছয়শত একটাকা দেনমোহরে আমি তোমাকে বিয়ে করেছিলাম। সেই পাঁচটা মাস আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিলো। আমার কাছে আমার ভালোবাসাটা আবেগ নয়, মায়া নয়। সেটা আমার অনুভূতি। আমার অস্তিত্ব”
গড়গড় করে কথাগুলো বলেই ছুটে বেড়িয়ে গেলো অন্তু। তার তিয়াশার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হচ্ছে। থাকলে হয়তো দেখতে পেতো একটা নোনাজলের রেখা গড়িয়ে পড়ছে তিয়াশার চোখ থেকে। ভিজিয়ে দিচ্ছে নরম গালজোড়া। নাকটা ক্রমশ লাল হয়ে আসছে। দৃষ্টি ঝাপসা। বুকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কিন্তু তা দেখার চোখ আজ হয়তো অন্তুর নেই______________________
সীমান্ত একটা ঘরে বসে রয়েছে। ঘরটি বেশ সাজানো গোছানো। দেয়াল জোড়া বিভিন্ন বইয়ের পোস্টার। ঘরের কোনায় তিনটি বড় বড় বুকশেলফ। হাজারো হাজারো বই সাজানো তাতে। একটা থাক জুড়ে শুধু সাজানো “সীমান্ত ইসলাম” এর বই। ল্যাপটপে কি যেনো টাইপ করে যাচ্ছে সে। টেবিলে বেশ কটা বই সাজান। কিছু সাদা কাগজের মোটা মোটা নোট স্ট্যাপলার করেও গোছানো তার সামনে। এর মাঝেই উপস্থিত হলো একজন মধ্যবয়স্ক যুবক। বয়স হয়তো সীমান্তের সমান, চুলগুলো ছোট ছোট, লম্বা সীমান্তের ঘাড় পর্যন্ত, ছোট মুখ। এসেই ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“ছাপা খানা থেকে আগামীকাল বই গুলো ফিরবে, ব্যাটাকে কতকরে বলেছি। কিন্তু শুনলোই না। এজন্য বলি তোকে যেতে। তুই থাকলে ব্যাটা সিধা হয়ে থাকে।“
“সব কাজ আমি করলে আমার কাজ কে করবে শুনি? তুই আর মোহনা তো বলেই খালাস। কতোগুলো প্রচ্ছদ বানাতে হবে সেদিকে খেয়াল আছে? হাতে সময় নেই, বই মেলা এলো বলে। প্রমোশন ছাড়া চলবে কি করে?”
“তা হুদা কাজে এই কলেজের চাকরি নিতে গেলি কেন শুনি?”
“বই ছাপানোর টাকা তো আমার বাপ এসে দিবে না টগর। আমার টাকা আমাকেই ম্যানেজ করতে হবে।“
টগর মুখ বাকিয়ে বললো,
“তা তোমার সেই লেখিকার কতদূর হলো লেখা?”
“চলছে। তাড়া নেই। গড়াতে সময় লাগবে।“
“তুমি একটু বেশি ই তার প্রতি দূর্বল হচ্ছো না?”
“তাই বুঝি? কে জানে? আমার তো মনে হচ্ছে না।“
বলেই হেসে দেয় সীমান্ত। টগর তার হাসির সাথে তাল মেলায়। একনিষ্ঠ বন্ধু বলতে এই একটি মানুষ ই রয়েছে সীমান্তের। একটা প্রকাশনী চালানো তো চারটে খানিক কথা নয়। এর মধ্যে টগর বলে উঠে,
“তোমার বই কি তবে এবার বের হচ্ছে না?”
কথাটায় মুখ তুলে তাকায় সীমান্ত। মুখের হাসিটা মিলিয়ে যায়, কোনো তীব্র বিষাদের মেলা ভর করে শ্যাম মুখখানায়। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে সে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। শীতল কন্ঠে বলে,
“না, এবার আমি আর বই লিখবো না। লিখালিখি তো হলো অনেক। আর নয়।“
“তোমার পাঠকের অপেক্ষারত থাকবে। তাদের কি বলবে?”
“ওই তো সব ছাইপাশ লিখি, তার আবার পাঠক। শোনো বন্ধু, এখন সময় এসেছে প্রকাশনীটাকে বড় করার। কতদিন আর নিজের লেখাই লিখবো আর ছাপাবো?”
“আমি বুঝি না বাবা, তোমার এই কথা আমার মাথার উপর দিয়ে যায়। বেশ তো তোমার লেখা চলছিলো। এখন বসে বসে লেখক খুজো।“
“খুজতে তো হবেই, সময় যে বহু কম”
বলেই লেখায় মনোযোগ দেয় সে। এবার আর কথা বাড়ায় না টগর। সীমান্তের সাথে তর্কে অহেতুক শক্তি খরচ করতে চায় না সে। কিন্তু পান্ডুলিপি ঘাটাও ঢের ভালো। পান্ডুলিপিতে মনোনিবেশ করবে তখনই সীমান্ত বলে উঠে,
“তোমার একটা কাজ বাকি, এখনো অবধি করো নি।“
“কি?”
“মৌপ্রিয়াকে ম্যাসেজ করা। পান্ডুলিপিটা তো আমি চাইতে পারি নি। আমি তো তার প্রকাশক নই, কেবল একজন শিক্ষক।“
বলেই হেসে উঠে সীমান্ত। সীমান্তের এই হাসির মানে বেশ ভালো করে বোঝে টগর। বিদ্রুপের স্বরে বলে,
“তা তুমি কবে নিজের পরিচয় খোলশা করবে শুনি?”
টগরের প্রশ্নে ……………………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি