নাটাই ঘুড়ি পর্ব-৭

0
1087

#নাটাই_ঘুড়ি
।।৭।।
সকালবেলা প্রচণ্ড দৌড়াদৌড়ি বেঁধে যায় মুশফিকের। নিকেতন খালার বাসা থেকে প্রতিদিন ভার্সিটি যাওয়া সহজ কর্ম নয়।
হলে এখনো সিট পায়নি ও, গণরুমে উঠতে চেয়েছিল, মা খালার সম্মিলিত প্রতিবাদের মুখে পেরে ওঠেনি। এখন প্রতিদিন এই ভোর ছয়টায় উঠে ছোটাছুটি করে রেডি হতে হয়।
খালার বাসায় থাকার ঝক্কিও কম নয়, খালুর সামনে পারতপক্ষে পড়তে চায় না ও। খালু যে ওর এই বাসায় থাকা নিয়ে খুব একটা খুশি নয় সেটা সরাসরি মুখে না বললেও প্রকারান্তরে আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয়।
সপ্তাহে চারদিন খালার ছেলে মেয়ে আহসান আর আনিকার পড়া দেখিয়ে দিতে হয়। সে আসার আগে এই চারদিন টিচার আসত পড়া দেখিয়ে দিতে।
সেটা নিয়েও খুশি নয় মুশফিক। এর চেয়ে বাইরে দুটো টিউশ্যনি করলে পকেটে দুটো পয়সা আসত।
এখন এ তো বেকার খাটনি, জায়গির মাস্টার থাকা। তাও যদি খালু কটমট করে না তাকাত।
তার ওপরে বোঝার ওপরে শাকের আঁটির মত আছে খালার ফাই ফরমায়েশ। প্রায় দিনই রাত দশটার পর বাইরে যেতে হয় তাকে।
কখনো খালার ওষুধ ফুরিয়ে গেছে, আবার কখনো খালুর সিগারেট। সেই নিকেতন বাজার গেটে দোকানে যেতে যেতে খালুর মুণ্ডুপাত করে মুশফিক।
তাও লোকটা এমনই চামার, একদম গুণে গুণে টাকা দেয় তাকে। রিকশাভাড়াটা পর্যন্ত দিতে চায় না।
বলে, “এখান থেকে ওখানে যেতে আবার রিকশা লাগবে কেন? আমাদের বয়সে আমরা কত দূর হেঁটে যেতাম জানো?”
মুশফিক হেঁটে যেতে যেতে মনে মনে বলে, “মর, তুই মর!”
আজকে রাতে এন্টাসিড কিনতে বেরোনোর সময় মুশফিক দেখল ছয়তলা থেকে লিফটে এপ্রন পরা একটা মেয়েও নামছে তার সাথে। খালারা থাকে পাঁচতলায়।
মুশফিক লিফটে ওঠার পর মেয়েটা এক পাশে সরে জায়গা করে দিল তাকে।
লিফট নিচে নামতেই তাড়াহুড়ো করে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল মেয়েটা। দারোয়ান সালাম দিল, উত্তর দিল না।
জোরে পা চালিয়ে হেঁটে হেঁটে নিকেতন বাজার গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল মেয়েটা। মুশফিকও হাঁটছিল পিছু পিছু, কিছুটা দূরত্ব রেখে।
হঠাৎ মেয়েটা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনি আমাকে ফলো করছেন?”
মুশফিক থতমত খেয়ে বলল, “কই, না তো! আমি তো বাজার গেটে যাচ্ছিলাম!”
মেয়েটা কিছুক্ষণ সন্দেহের দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আবার রওনা হলো। মুশফিকের বিরক্তির সীমা রইল না।
আজব তো! কী মনে করে নিজেকে?
বিশ্বসুন্দরী?
বাজার গেটে পৌঁছে এন্টাসিড কিনে নিয়ে মুশফিক আড়চোখে তাকিয়ে দেখল মেয়েটা রিকশা নিয়েছে মহাখালীর উদ্দেশ্যে। মুশফিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাসার দিকে রওনা হলো।
ইচ্ছা করেই শামুকের গতিতে হাঁটতে লাগল মুশফিক। যতক্ষণ সম্ভব দেরি করে ফেরা যায়।
খালু ভুগছে এসিডিটিতে। ভুগুক শালা।
এটা হলো শাস্তি। পাঁচ মিনিট দেরি করে গেলেও পাঁচ মিনিট বেশি সময় শাস্তি পাবে।
সমস্যা হলো মুশফিকের সাহস খুব একটা বেশি না। খুব বেশি দেরি করে ফেরার মত সাহসও তার নেই।
অনেক চেষ্টা করেও পাঁচ মিনিটের বেশি দেরি করতে পারল না সে। বাসার গেটে এসে জিজ্ঞেস করবে না করবে না ভেবেও দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে ফেলল, “মেয়েটা কে?”
দারোয়ান বলল, “ছয়তলার ভাড়াটিয়া। ডাক্তার।“
মুশফিক আর কথা না বাড়িয়ে লিফটে ওপরে উঠে গেল। কলিং বেল বাজাতেই গজগজ করতে করতে এসে গেট খুলে দিল খালা।
“বাজার গেট এখান থেকে এখানে, এইটুকু যেতে আসতে এতক্ষণ সময় লাগে?”
কথা না বাড়িয়ে ঘরে ঢুকে গেল মুশফিক। হাত মুখ ধুয়ে খেতে আসতে মেজাজ খিঁচড়ে গেল দ্বিতীয় দফায়।
আজকে রান্না হয়েছে করল্লা ভাজা, ডাল আর তেলাপিয়া মাছ। ঠিকমত ভেজে মজা করে রান্না না করলে এই মাছটা একটুও মজা হয় না খেতে।
এই বাসায় খালা নিজে রান্না করে না, রান্নার বুয়া আছে আলাদা। বুয়ার তেলাপিয়া রান্না একেবারে অখাদ্য হয়।
মুশফিক গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “খালা একটা ডিম ভেজে দাও না, একদম খেতে পারছি না!”
খালা আড়চোখে খালুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ডিম নেই বাসায়!”
মুশফিকের ইচ্ছে হলো না খেয়ে উঠে চলে যায়। কিন্তু তার খুব খিদেও পেয়েছে।
কোনোমতে শুধু ডাল দিয়ে খেয়ে উঠে গেল সে। শালার, এগুলো আম্মুকে বলাও যায় না।
আম্মু তো ভাবে হলে গণরুমে থাকতে হচ্ছে না দেখে হাতে স্বর্গ পেয়ে গেছে ছেলে। আসলে যে তার কী অবস্থা এখানে…
একবার যদি এসে দেখত!
এই বাসায় রাত এগারোটায় ওয়াইফাই কানেকশন বন্ধ করে দেওয়া হয়, রাউটার খালা খালুর রুমে। মুশফিক বলল, “খালা, আজকে আমার একটু ওয়াইফাইটা লাগত, বন্ধ করো না।“
খালু বলল, “কেন?”
“কালকে একটা এসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে, রাতে গ্রুপে কাজ করব একসাথে।“
“সম্ভব না। সবকিছুর একটা নিয়মকানুন আছে। নিয়মের বাইরে যাওয়া যাবে না।“
মুশফিকের গা জ্বলে গেল। খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘরে গেলে আহসান বলল, “ভাইয়া তুমি আমার নেট ইউজ করতে পারো, আমার মডেম আছে।“
“থ্যাঙ্ক ইউ।“
ছেলেটা অন্তত বাপের মত চামার হয়নি, মনে মনে ভাবল সে।
‘ডাটা শেষ হয়ে গেলে রিচার্জ করে দিও, এই আর কী!”
দাঁত বের করে হাসল আহসান।
“আচ্ছা দেব।“
মুশফিকের ল্যাপটপটা পুরনো, সেকেণ্ড হ্যাণ্ড। তাদের ভার্সিটির গ্রুপে একজন সিনিয়র ভাই নতুন ল্যাপটপ কেনার পর পুরনোটা বিক্রি করে দেবে বলে পোস্ট দিয়েছিল, সেটাই কিনে নিয়েছে সে।
পুরনো মডেলের ডেল, ভালোই চলে কিন্তু বড্ড স্লো। মাঝে মাঝে হ্যাং করে আর চার্জে না দিয়ে রাখলে চলতে চায় না।
মেসেঞ্জার গ্রুপে এসাইনমেন্টের প্রোফর্মা শেয়ার করে দিয়েছে কেউ একজন, ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র কারো থেকে জোগাড় করা খুব সম্ভব। এখন এটা ডাউনলোড করে প্রোফর্মা ঠিক রেখে নিজের মত করে লিখতে হবে।
মুশফিকের ল্যাপটপ এত বিরক্ত করা শুরু করল যে বলার নয়। কাণ্ড দেখে আহসান বলল, “ভাইয়া তুমি আমার ল্যাপটপ ইউজ কর। কোনো সমস্যা নেই।“
রাত বারোটায় দড়াম করে খুলে গেল রুমের দরজা। খালু দরজা দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে বলল, “এই বাসার নিয়ম বারোটায় শুয়ে পড়তে হবে।“
এই কথা বলার পর টেবিলে চোখ পড়তেই বলল, “নতুন ল্যাপটপ কিনেছ?”
নিঃশব্দে মাথা নাড়ল মুশফিক। “আহসানের ল্যাপটপ।“
“ওর ল্যাপটপ চালানোর দরকার কী? সব জিনিসের একটা লাইফ আছে! জিনিস চালালে সেই লাইফ কমে যায়। তুমি চালালে ল্যাপটপের লাইফ কমে যাচ্ছে না? ওকেও তো অনেকদিন ইউজ করতে হবে জিনিসটা!”
মুশফিকের মন চাচ্ছে ল্যাপটপটা তুলে নিজের মাথায় নিজেই একটা বাড়ি দিতে। কিন্তু তা না করে সে তাকিয়ে রইল চুপচাপ।
“শুয়ে পড়। আর ল্যাপটপ চালানোর দরকার নাই।“
যেভাবে এসেছিল সেভাবেই বেরিয়ে গেল লোকটা।
বিছানা থেকে আহসান ক্ষীণ স্বরে বলল, “ভাইয়া, তোমার বলার কী দরকার ছিল যে এটা আমার ল্যাপটপ?”
জবাব দিল না মুশফিক। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে তার।
‘এসাইনমেন্ট শেষ করে শোও। আব্বু বলেছে বলেই শোয়ার দরকার নেই।“
লাভের মাঝে লাভ হলো, যে কাজটা আধা ঘন্টার মধ্যেই শেষ হয়ে যেত, মাথা গরম হয়ে যাওয়ার কারণে সেই একই কাজ করতে সময় লাগল দেড় ঘন্টা। সব কাজ শেষ করে মুশফিক শুতে যেতে পারল রাত দেড়টায়।
ভোরে এলার্ম মিস করল। ছোটাছুটি করে বেরিয়ে যেতে হলো নাস্তা না খেয়েই।
বেরিয়ে যাওয়ার সময় গেটে আবার দেখা হয়ে গেল সেই এপ্রন পরা মেয়েটার সাথে। চেহারা মোটামুটি ঝড়ো কাকের মত হয়ে আছে।
গেটের সামনে রিকশা ভাড়া দিচ্ছিল সে। মুশফিক লাফ দিয়ে রিকশায় উঠে পড়ে বলল, “মামা চলেন, বাজার গেট!”
মেয়েটি ভাংতি টাকা ফেরত নিতে নিতে একবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল মুশফিকের দিকে। তারপর ভেতরে ঢুকে গেল।
(পরের পর্ব পরশু দিন সন্ধ্যায় ইন শা আল্লাহ্‌)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here