#নাটাই_ঘুড়ি
।।৩১।।
প্রায় তিন সপ্তাহ পরের ঘটনা। দাদার শরীর অনেকটা ভালো এখন।
পাটোয়ারি ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের ডাক্তার এসে নিয়মিত দেখে যায়, শেখানো নিয়মে ফিজিওথেরাপি চলছে। শরীরের অবশ দিকটায় একটু একটু করে জোর ফিরে আসছে।
সকালে লাঠি হাতে মীরার সাথে কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়ান আলিমুল হাসান। সবকিছু অনেকটাই ঠিক হয়ে আসছে, শুধু ছোট চাচার অনুপস্থিতির ব্যাপারটা ছাড়া।
আজকে ঘরোয়া আয়োজনে “আমেনা মঞ্জিল” এ নাইমা আর শাহীনের আংটি বদল হচ্ছে। বিয়ের দিনক্ষণ, ভেন্যু এইসবও আজকেই ঠিক করার কথা।
শিহাবদের বাসার সবার দাওয়াত ছিল, শিহাবের আম্মু এসে জানিয়েছে সে আসবে না।
শিহাব কেন আসবে না, সেটা মীরা জানে। সে ঠিক করেই রেখেছিল শিহাব আসলে আজকে শিহাবকে সব কিছু খুলে বলবে।
শিহাব যখন আসবেই না, মীরাকেই যেতে হবে তাহলে। পাশাপাশি বাসা, আম্মুর অনুমতি নিয়ে ফুলি রওনা হলো শিহাবের জন্য বক্সে করে এনগেজমেন্ট উপলক্ষ্যে রান্না করা কাচ্চি বিরিয়ানি নিয়ে।
মীরাও গেল সাথে।
শিহাবের ঘরে গিয়ে অবাক হয়ে গেল মীরা। বেশিরভাগ জিনিসপত্রই প্যাক করা।
“কোথাও যাচ্ছেন শিহাব ভাই?”
শিহাব কী যেন গোছগাছ করছিল। মীরার কথা শুনে মুখ তুলে পরিচিত ভঙ্গিতে হাসল।
যেন সে মীরার অপেক্ষাতেই বসে ছিল এতক্ষণ।
“এসো এসো মীরু। ভালো আছ?”
“কোথায় বেড়াতে যাচ্ছেন?”
“বেড়াতে যাচ্ছি না, আমি ঢাকায় চলে যাচ্ছি।“
“কোথায়?”
“আম্মুকে এখানে রেখে পুরো বাসাটাই ভাড়া দিয়ে আমি ঢাকায় চলে যাব। চাকরির চেষ্টা করব।“
“কেন শিহাব ভাই? আপনার দোকান?”
“দোকান বিক্রি করে দিয়েছি!”
“সে কী!”
ধাক্কাটা হজম করতে কিছুক্ষণ সময় লাগল মীরার। বজ্রাহতের মত তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।
“কেন শিহাব ভাই?”
শিহাব মীরার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলল, “এমনি। টাকার জরুরি দরকার ছিল।“
“কী এমন জরুরি দরকার ছিল যে দোকান বিক্রি করে দিতে হলো?’
“ছিল একটা দরকার। তুমি তোমাদের বাসায় কাউকে বলো না কিন্তু!”
শিহাব ভাইয়ের আম্মু এসে ঢুকলেন এই সময়। মীরা তার দিকে তাকিয়ে প্রায় হাহাকার করে বলল, “আন্টি, ভাইয়া চলে যাচ্ছে?”
শিহাব ভাইয়ের আম্মু শুষ্ক হেসে বললেন, “হ্যাঁ, কী আর করা। শেষ বয়সে এত দুঃখও ছিল কপালে। পাওনাদারদের পাওনা মেটাতে নাকি এত কষ্টের দোকান বিক্রি করে দিয়েছে। আমি বললাম, আমাকে একবার বলতি, আমি কোনো জায়গা থেকে ব্যবস্থা করতাম, ধার আনতাম, নাহয় পাওনাদারদের হাতে পায়ে পড়তাম দুইদিন সময় বাড়ানোর জন্য! এত তাড়াহুড়ো করে দোকান বিক্রি করে দেওয়ার কী প্রয়োজন ছিল? চুপ করে থাকে, কথা বলে না। এত লস হলো কী করে, বায়ান্ন লাখ টাকা দেনা হলো কীভাবে সেটাই বুঝলাম না। “
শিহাব আচমকা ঝাঁঝিয়ে উঠল, “আম্মু তুমি একটু চুপ করবা? মীরার সামনে দুঃখের গীত না গাইলে চলছিল না?”
আন্টিও পালটা রেগে উঠলেন, “তুই বল তুই কী করছিস এত টাকা? এত টাকা দেনা হলো কীভাবে? তুই কি নেশা ভাঙ করিস? ইয়াবা খাস?”
“হ্যাঁ আমি নেশা করি, হইছে? খুশি হইছ শুনে? এখন যাও সামনে থেকে, বের হও এই ঘর থেকে! আমার মাথা ব্যথা করছে, আমি এখন লাইট নিভিয়ে শুয়ে থাকব!”
আন্টি মীরার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এলেন, পাংশু মুখে বেরিয়ে এলো মীরাও। বিয়েটা যে আসলে নীরার না, নাইমার, সেই কথাটা আর বলার সুযোগ পেল না সে।
আজকে মীরার মুড ভালো ছিল না। তাই নীরা আর নাইমা পার্লারে গিয়েছিল সাজতে, মীরা যায়নি আজকে।
গোলাপি জামদানি পরেছে নাইমা, সাথে হাত ভরা চুড়ি আর চুলে গোঁজা সাদা ফুলে তাকে লাগছে সদ্য প্রেমে পড়া কোনো তরুণীর মত। তার কথাবার্তায় সেই তিক্ততা আর নেই, সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে মিষ্টি মিষ্টি লাজনম্র হাসি।
নাইমা তার নিজের মেক আপ নিয়ে এত উত্তেজিত ছিল যে, বাসায় এসে নীরা দেখল কপালে টিপ পরা হয়নি। এদিকে নীরার খুব প্রিয় সাজ হলো কপালে টিপ পরা। তার নিজের স্টকে ম্যাচিং টিপ নেই, মীরার বক্সে থাকতে পারে।
মীরা গেছে শিহাব ভাইয়াদের বাসায়, এদিকে গেস্টরাও চলে আসবে যে কোনো সময়। আসলে আবার তাদেরকে হাতে হাতে আপ্যায়ন করা লাগতে পারে।
নীরা তাই মীরার জন্য অপেক্ষা না করে নিজেই টেনে নিল মীরার চুড়ির বক্সটা। এখানে চুড়ির নিচে মীরার টিপের পাতা থাকে, জানে নীরা।
গেস্ট চলে আসতে পারে যে কোনো সময়, নীরা তাই তাড়াহুড়ো করে বক্সের সব চুড়ি বিছানায় ঢেলে ফেলল। সব চুড়ির নিচে টিপের পাতা রাখা, টান দিয়ে তুলতে গিয়ে বক্সের নিচে পেতে রাখা পুরনো খবরের কাগজটাও উঠে এল সেই সাথে।
রেখেই দিত নীরা, লক্ষ্যও করত না হয়ত। কিন্তু আচমকাই চোখে পড়ল চিরকুটে নিজের নাম।
টিপ পরা মাথায় উঠল, কাঁপা কাঁপা হাতে চিরকুট তুলে নিয়ে পড়ল নীরা। লেখা আছে,
“নীরা
তুমি কি কিছুই বোঝো না?
শিহাব”
চিরকুট হাতে নিয়ে বিছানায় স্থানুর মত বসে রইল নীরা। এখন অনেক অমীমাংসিত রহস্যের জট খুলছে।
অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাচ্ছে। সেই “দিকভ্রান্ত নাবিক” আইডির অন্তরালের মানুষটি আসলে কে তাও বোঝা যাচ্ছে।
গত রাতেও বিছানায় শুয়ে শুয়ে মেসেজ পাঠিয়েছিল নীরা, “তুমি আসলে কে?”
উত্তর এসেছিল, “আমি তো তোমার খুব কাছেই আছি! হাত বাড়ালেই খুঁজে পাবে আমাকে। তুমি কেন বোঝো না নীরা!”
নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবার মেসেজ পাঠাল নীরা, “কী করছ?”
প্রায় সাথে সাথেই উত্তর এলো, “তোমার কথাই ভাবছিলাম! আজ খুব সেজেছ তাই না নীরা!”
“হ্যাঁ, কিন্তু তুমি জানলে কীভাবে বল তো?”
“আমি তো তোমার সবই জানি!”
“কচু জানো।“
উত্তর এলো, “তোমার খোঁপার মালার একটা বেলি
ওমনি খসে যাক,
তোমার গালের পাশে অবাধ্য চুল
আলতো পড়ে থাক।
আড়াল থেকে তোমায় দেখি
মনটা ভরে যাক,
আমার মেঘলা দিনের একটা চুমু
তোমার কপাল জুড়ে থাক।
শ্রাবণ দিনের প্লাবন ধারায়
বৃষ্টি ভেজা কাক,
একলা বসে আঁকছি তোমায়
মন কেমনের ডাক
তপ্ত দিনের প্রবল খরায়
বুকটা পুড়ে খাক
তুমি আছ কোন সুদূরে
এমন দুর্বিপাক…”
“এসব শুনব না আমি, তুমি সামনে আসো।“
“সামনে আসলে যে তুমি আমার কাছ থেকে দূরে চলে যাবে নীরা। তার চেয়ে এই ভালো!”
“তুমি কি ভাবছ আমি তোমাকে খুঁজে বের করতে পারব না? খুব পারব!”
“কী দরকার, নীরা? যে হারিয়ে যেতে চায় তাকে হারিয়ে যেতে দেওয়াই তো ভালো!”
“তোমাকে আমি হারাতে দিলে তো!”
“তুমি আমার দূরের চাঁদ, তোমাকে আমি রাখব কোথায়? এই মনের সরোবরে তুমি ছায়া ফেলে গেছ, সেই ছায়া নিয়ে আমি একটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারব!”
“আহাহা!”
“একটু পরে আংটি পরাবে তোমাকে, তুমি এখন অনলাইনে কী কর?’
“আমাকে? আমাকে আংটি পরাবে কেন!”
“কেন আজকে তোমার এনগেজমেন্ট না?”
“আমার এনগেজমেন্ট হতে যাবে কেন! আজকে আমার ফুপুর এনগেজমেন্ট!“
অফলাইনে চলে গেল “দিকভ্রান্ত নাবিক”। নীরা বিষয়টার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারল না।
তার এনগেজমেন্টের কথা আসছে কেন?
ঠিক এই মুহূর্তে দরজা খুলে ঢুকল মীরা। চিরকুট হাতে নীরাকে থমথমে মুখে বসে থাকতে দেখে যা বোঝার বুঝে গেল।
কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, “আমাকে বেশি বকা দিস না আপু! আমি আসলে বুঝি নাই এরকম হবে?”
“কী গণ্ডগোল বাধাইছিস তুই? আর আমার চিঠি তোর চুড়ির বক্সে কেন?”
মীরা এবার সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলে বলল, “একটু মজা করতে গিয়ে আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি আপু! আমিই ভুল করেছি, আমাকেই সব ঠিক করতে হবে।“
(পরের পর্ব পরশু দিন সকালে ইন শা আল্লাহ্)