#নাটাই_ঘুড়ি
।।৩৩।।
তিথি ওদের বাসায় ফোন করে জানিয়েছিল যে সে ভালো আছে। উত্তরে তিথির আম্মু বলে দিয়েছেন তিথি যেন আর কোনো দিন তাদেরকে ফোন না করে, কখনো ওই মুখ নিয়ে তাদের সামনে না দাঁড়ায়।
সেদিন খুব কেঁদেছিল তিথি, ইমরুল ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল সে একটা ভালো চাকরি পেলেই উনাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে, তখন আর কোনো দুঃখ থাকবে না তিথির।
ইমরুলের একার রোজগারে চলে না, চলার কথাও নয়। বাসার কাছেই একটা কিণ্ডারগার্টেন স্কুল দেখে সেখানে কথা বলে এসেছে তিথি।
তাড়াহুড়ো করে বাসা থেকে বের হয়ে এসেছে বলে আগের স্কুল থেকে এক্সপেরিয়েন্স সার্টিফিকেট আনতে পারেনি। তাই এই স্কুলে উঁচু ক্লাসে সুযোগ পাওয়া যায়নি, প্লে গ্রুপে কো টিচার হিসেবে ওকে নিতে রাজি হয়েছে ওরা।
এই মুহূর্তে কোনো পোস্ট খালি নেই, সামনের মাস থেকে একজন টিচার ম্যাটার্নিটি লীভে যাবে, সেই জায়গায় বদলি হিসেবে নেওয়া হবে তিথিকে। এক্সপেরিয়েন্স সার্টিফিকেট দেখাতে পারেনি বলে ওকে একদম এমেচার হিসেবেই বেতন অফার করা হয়েছে।
মাত্র আট হাজার টাকা। পাংশু মুখে ঢোক গিলে এতেই রাজি হয়ে গেছে তিথি।
হেঁটে যাওয়া যায়, আসা যাওয়ার খরচ তো নেই। ইমরুল বেতন পায় উনিশ হাজার পাঁচশো, তার মধ্যে দশ হাজার যায় সাবলেট ভাড়া দিতে।
বাড়ী থেকে আরো দশ হাজার আসে। দুজন মানুষের বাজার খরচ, চলে যাওয়ার কথা।
চাকরিতে জয়েন করাটা তিথির নিজের জন্যও প্রয়োজন, এইসব একলা দুপুর আর কাটে না। দুজন মানুষের রান্না করতে আর কতটুকু সময়ই বা লাগে।
রান্না বান্না ঘর পরিষ্কার শেষ করে কিছুক্ষণ চাকরির পড়া পড়ে। বিকেল থেকে শুরু হয় অস্থির প্রতীক্ষা।
সন্ধ্যার আলো মিলিয়ে যাওয়ার পর থেকেই জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে তিথি। একটা দুটো করে ল্যাম্প পোস্টের জ্বলে ওঠা দেখে।
এক সময় নিচে মুসলিম মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনে দেখা যায় ইমরুলের অবয়ব। আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তিথির মুখ।
কলিং বেল বাজলে দরজা খুলে কপট রাগে বলে, “এতক্ষণে আসার সময় হলো?”
ইমরুল সে কথার উত্তর না দিয়ে বলে, “এই দেখো তোমার জন্য কী এনেছি!”
কোনো দিন ফুচকা, কোনো দিন চটপটি, কোনো দিন হালিম, কোনো দিন দশ টাকার জিলাপি। পরিমাণে অল্পই, খুব বেশি কিছু নিয়ে আসার সামর্থ্য ইমরুলের নেই।
তবু ওইটুকু জিনিসের দানায় দানায় কণায় কণায় যেন নিঃশব্দে উচ্চকিত ঘোষণা হতে থাকে, “ভালোবাসি! তোমাকে ভালোবাসি!”
রাতে এক সাথে বসে শুধু লাল শাক আর ডাল দিয়ে মাখা ভাত খাওয়া যেন অমৃতের স্বাদ নিয়ে আসে। খাট নেই, মাটিতে জাজিম পেতে শুয়ে ইমরুলের বুকে মাথা রেখে যেন স্বর্গের দেখা পায় তিথি।
যেদিন বিকাল শিফটের ডিউটি থাকে, সেদিন সকালে ডিউটি না থাকলে আগের দিন গভীর রাত পর্যন্ত দুজনের কথাই ফুরোয় না। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলেও ইমরুল বিছানা থেকে নামতে দেয় না তিথিকে।
ওর এলোমেলো চুলে বিলি কাটতে কাটতে মনে প্রাণে অনুভব করে এই মেয়েটি এখন তার। শুধুই তার।
কোনো কোনো ছুটির দিনে এলোমেলো ঘুরে বেড়ায় দুজনে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষ দেখে।
রাস্তার পাশের ভ্যান থেকে বড়ইয়ের আচার কিনে খায়, দু ডজন কাঁচের চুড়ি, দুটো প্লেট গ্লাস কিনে হিসেবের বাইরে খরচ করে ফেলার অপরাধবোধে ভোগে তিথি।
একদিন হয়ত আর সবার মত জীবনের জটিলতা গ্রাস করে ফেলবে এই যুগলকেও। চাল ডাল তেল নুন আর ফিডার ডায়াপারের নিত্যকার হিসেবের নির্মম আঁচে জমাট বেঁধে কঠিন হয়ে যাবে এই কুসুম কুসুম প্রেম।
সেই সব দিনে এই মায়ামাখা দিনগুলো স্বপ্নের মতই অবিশ্বাস্য বলে মনে হবে ওদের কাছে। আপাতত ভালোবাসার যে ময়ূরপঙ্খী নৌকায় যাত্রী হয়েছে এই দুজন, সুখের ঢেউয়ে সেই নৌকা একবার ডোবে আর একবার ভাসে।
তিথির কালো চোখের তারায় টলটল করে দুলতে থাকে মায়াবী স্বপ্নেরা। স্বর্গ কি এর চেয়েও বেশি সুন্দর? এর চেয়েও বেশি সুখের?
(পরের পর্ব পরশু দিন সকালে ইন শা আল্লাহ্)