নাটাই ঘুড়ি পর্ব-৩৫

0
1306

#নাটাই_ঘুড়ি
।।৩৫।।
পরদিন সকালে মীরাদের বাসায় বড় একটা পার্সেল এল। বাসায় বড়রা কেউই ছিল না।
শুধু দাদা, দাদি, মাশুক, ফুলি আর মীরা। বাকি সবাই ঢাকায় গিয়েছে নাইমার বরের জন্য আর বাকি সবার শপিং করতে।
নাইমা শুধু যায়নি, সে তার নিজের শাড়ি গয়না কিনতে পরে আরেকদিন যাবে। পরে এমনিতেই ছুটি নিতে হবে, তাই এখন আর ছুটি নষ্ট করতে রাজি নয় সে।
ফুলি পার্সেলটা রিসিভ করে রেখে দিয়েছিল। মীরা স্কুল থেকে ফিরে এসে ফ্রেশ হওয়ার পর ফুলি এসে দিয়ে গেল মীরার হাতে।
জরুরি কিছু ভেবে মীরাই খুলে ফেলল পার্সেলটা। কিন্তু খুলে কিছুই বুঝতে পারছিল না সে।
ভেতরে সুন্দর একটা ডায়েরি আর শুভেচ্ছা বার্তা লিখে একটা চিঠি। চিঠিটা বড় চাচার নামে।
নাইমা ফুপির ইদানিং মুড ভালো থাকে, ফুপি অফিস থেকে ফিরে এসে মীরা তাকেই চিঠিটা দেখিয়ে বলল, “ফুপি দেখ তো এটা কীসের কংগ্র্যাচুলেশনস লেটার?”
নাইমা চিঠিটা খুলে দেখে বলল, “এটা তো বড় ভাইয়ার চিঠি! কীসের কংগ্র্যাচুলেশনস?”
চিঠি পড়তে পড়তে নাইমার মুখের ভাব ক্রমেই বদলে যেতে লাগল। মীরা ভয়ে ভয়ে বলল, “কী হয়েছে ফুপি?”
নাইমা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “কী হয়েছে ফুপি? ভাজা মাছটা উলটে খেতেও জানো না, তাই না?”
মীরা আতঙ্কে অস্থির হয়ে বলল, “আমি কী করেছি ফুপি?”
“তুই কী করেছিস তুই জানিস না?”
নাইমা শীতল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “ইমরুলের সাথে তোর নিয়মিত যোগাযোগ হয় না বলতে চাস? অস্বীকার করতে পারবি?”
মীরা কাঁপা গলায় বলল,”চিঠিতে কী লেখা আছে ফুপি?”
নাইমা ঝাঁঝালো গলায় বলল, “তোর বড় চাচা একটা চোর, চিঠিতে সেটাই লেখা আছে! আর ইমরুলের কোনো দোষ নেই, এটা জেনেও তুই কাউকে কিছুই জানাস নাই, আমরা দিনের পর দিন ইমরুলকে চোর ভেবে গিয়েছি, এটাই লেখা আছে!”
মীরা কী বলবে বুঝতে পারল না। নাইমা উঠে গেল আলিমুল হাসানের ঘরে।
“আপনার বড় ছেলে র‌্যাংগস প্রোপার্টিজ লিমিটেড থেকে মাসিক ৩৫০০০ টাকা কিস্তির ফ্ল্যাট কিনেছে ঢাকায়! ছয় কিস্তি শেষ হওয়ার পর আজকে কংগ্র্যাচুলেশনস লেটার পাঠিয়েছে!”
আলিমুল হাসান তাকিয়ে রইলেন শূন্য দৃষ্টিতে।
“আর আমরা দিনের পর দিন ইমরুলকে দোষী ভেবেছি আব্বা!”
“এখন? এখন কী করব?”
মীরা এসে দাঁড়িয়েছে দরজার কাছে। নাইমা মীরার দিকে ফিরে কড়া গলায় বলল, “এখন আর ঢং না করে ইমরুলের নাম্বার দে!”
নাইমার সাথে কথা শেষ করে ফোন রেখে সুপার শপের কাঁচের ভেতর দিয়ে বাইরে তাকাল ইমরুল। আর কিছুক্ষণ পরেই ডিউটি শেষ।
এই শহর রাতে ঘুমায় না, বরং যেন আরো বেশি করে জেগে ওঠে। বাইরে রাস্তায় দেখা যাচ্ছে সারি সারি গাড়ি আর বাসের থেমে থাকা অদ্ভুত ছন্দময় ব্যস্ততা।
সবাই বাসায় ফিরছে। একটা ছেলে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে খুব উত্তেজিত ভঙ্গিতে কী যেন বোঝাতে চেষ্টা করছে।
মেয়েটি মিটিমিটি হাসছে। কাঁচ ভেদ করে বাইরের কলরোল, ছেলেটার কথা কিছুই শোনা যাচ্ছে না।
ইমরুল ছেলেটার ঠোঁটের নাড়াচাড়া দেখে সে কী বলছে সেটা অনুমান করার ছেলেমানুষি চেষ্টা করতে থাকে।
আচমকা ইমরুলের মনে হলো মানুষের জীবনটাও কি আসলে তাই নয়? প্রত্যেকেই যার যার কাঁচের ঘেরা টোপের ভেতরে বাস করে।
তারা তাদের মত করে নিজেদের কথাগুলো বলে যেতে থাকে। আমরা কাঁচের বাইরে থেকে তাদের কথা বলার ভঙ্গি দেখে কথাগুলো অনুমান করে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকি।
একজনের মনের কথা কি অন্য একজন কখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে? মনে প্রাণে এক সাথে মিশে গিয়েও, নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস মিলিয়ে দিয়েও থেকে যায় কত না বলা কথা, কত কত গোপনীয়তা!
যেমন তিথি কখনোই রুম্পার কথা সবটুকু জানবে না। জানতে পারবে না।
কাস্টোমার দেখে দার্শনিক ভাবনা ভুলে বাস্তবে ফিরে এল ইমরুল। গতকাল ফুচকা নিয়ে গিয়েছিল।
আজকে হালিম নিয়ে যেতে হবে। বাসায় যাওয়ার পথে ফুটপাথ থেকে ডিম, লাল শাক কিনে নিয়ে উঠল।
বাসায় ঢোকার পর ইমরুলের হাত থেকে হালিমের বাটি নিয়ে নিল তিথি।
“প্রতিদিন কি এইসব আনতেই হবে!”
তিথির পিছু পিছু ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেই ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ইমরুল।
‘ওমা, ওমা কী হলো? আমি কতদিন বলেছি বাইরের কাপড় চোপড় না ছেড়ে এইসব আমার একদম পছন্দ না!”
ইমরুল তিথি জড়িয়ে ধরে রেখেই বলল, “সব ঠিক হয়ে যাবে তিথিমণি।“
“মানে?”
“বাসায় কথা বলেছি আজকে। তোমার কথাও জানিয়ে দিয়েছি।“
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। আব্বা বলেছে বিয়ে যেহেতু করেই ফেলেছি, তাহলে বৌভাতই হোক। সামনে নাইমার বিয়ে, নাইমার বিয়ের পর পরই হবে হয়ত। তোমাদের বাসায় প্রোগ্রামের তারিখ নিয়ে কথা বলতে যাবে আব্বা আম্মা খুব শিগগির। নাইমার গায়ে হলুদে যেতে বলল আমাদের।“
“আমরা কি তাহলে ফিরে যাব? ওখানেই থাকব?”
“তুমি চাও ফিরে যেতে?”
“না চাই না।“
“তুমি থাকতে চাও আমাদের বাসায়? আমার ঘরে? তোমার ছোট লাগে এই ঘরটা?”
তিথি ইমরুলের বুকে মাথা রেখে বলল, “না ছোট লাগে না।“
“তাহলে আমিও চাই না যেতে।“
সে রাতে দুজনেই জেগে রইল অনেক রাত পর্যন্ত। কত স্বপ্ন, কত কল্পনা।
হলুদে পরবার মত তিথির কিছুই নেই, সেগুলো কিনতে হবে। তিথি প্রথম যাচ্ছে ওদের বাসায়, তাই একদম সাদা মাটা যাওয়া যাবে না।
একটু ফিটফাট হয়ে যেতে হবে। সে জন্যও কিছু কেনাকাটা করতে হবে।
অনেক দিন পর বাসায় ফিরছে, মাশুক, মীরার জন্যও চকোলেট নিয়ে যেতে হবে। অনেক কাজ।
জানালার গ্রিল ভেদ করে এক চিলতে চাঁদের আলো এসে পড়ছে, সেই আলোতে হাত রাখলে ছায়া পড়ে। হাতের বুড়ো আঙুলের সাথে তর্জনি এক সাথে করে বাকি আঙুলগুলো খাড়া করে দেয়ালের সামনে রাখলে দিব্যি একটা হরিণের ছায়া দেখা যায়।
তিথি আঙুল দিয়ে একটা হরিণ বানিয়ে ছায়া ফেলল দেয়ালের গায়ে। “এত শপিং করতে চাচ্ছ যে, টাকা পাবে কোথায়?”
ফ্যাকাসে হাসল ইমরুল। সে নিজেও একটা হরিণ বানিয়ে দেয়ালের গায়ে ছায়া ফেলল।
“ও হয়ে যাবে। ম্যানেজ করব কোনো না কোনো ভাবে।“
“ধার করবে?” তিথি নিজের হরিণটার মুখ ইমরুলের হরিণের মুখে স্পর্শ করল।
চুম্বনরত দুই হরিণের ছায়া দেখতে দেখতে ইমরুল বলল, ‘তাই করতে হবে। অসুবিধা নেই, এসে তো ফেরত দিয়েই দেব।“
“কামরান ভাইয়ের কাছ থেকে?”
“হু। দেখি পরশুদিন যাব ওর অফিসে।“
“অফিসে কেন? বাসায় চল না?”
“কেন, বাসায় কেন?”
“রূম্পা আপুকে একটা থ্যাংক্স দিয়ে আসি! এত সুন্দর শাড়িটা যে দিল বিয়ের জন্য!”
রুম্পার সামনে পড়তে চায় না বলেই ইমরুল আসলে যেতে চাচ্ছিল না কামরানের বাসায়। সেটা এখন সে তিথিকে বলে কী করে!
ইমরুল শুষ্ক স্বরে বলল, “না, আমি তো রুম্পার কাছ থেকেও টাকা ধার নিয়েছি এর আগে। রূম্পা এমনিতেই আমার কাছে টাকা পায়। ও তো আর এত আপন কেউ না। বন্ধুর শালী। ওর সামনে কামরানের কাছে আরো লোন করতে পারব না। খারাপ ভাববে। ভাববে ওর লোন শোধ না করেই আরো লোন করছি। নাইমার বিয়ে শেষ করে এসে যখন টাকা ফেরত দিতে যাব তখন একবারে যাব ওদের বাসায়।“
“আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যা বলবে তাই হবে।“
আচমকা রুম্পার জন্য এত মন কেমন করে উঠল ইমরুলের যে সে তাড়াতাড়ি হাতের হরিণ ভেঙে দিয়ে বুকের ভেতরে জড়িয়ে নিল তিথিকে। এক সহস্র চুমুতে ধুয়ে মুছে ফেলতে চাইল মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা গোপন অপরাধ বোধ।
(দেরির জন্য অনেক বেশি দুঃখিত। এই কয়দিন খুব চাপে ছিলাম। ভেবেছিলাম আজকে সকালে উঠে লিখব। কিন্তু সকালে মেয়ের অনলাইন ক্লাস শেষ করিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অপেক্ষা করে থাকার জন্য অশেষ কৃতজ্ঞতা রেখে গেলাম।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here