একজন রূপকথা পর্ব-২

0
3289

#একজন_রূপকথা
#পর্ব_২
#নুশরাত_জেরিন

শোভন একা একা বসে আছে ঘন্টা দুই হলো। বিয়ের পরপরই তার সাথের লোকজন খেয়েদেয়ে চলে গেছেন। শোভনের দুর সম্পর্কের আত্মীয় তারা। নিকটাত্মীয় বলতে মা ছাড়া তার আর কেউ নেই। যদিও এখন আরেকজন যুক্ত হবে, কথা।
শোভন উশখুশ করছে, কেউ এ ঘরটায় আসছে না কেনো? সেই যে তাকে একা ফেলে চলে গেলো… কবিতা নামক মেয়েটাকেও তো দেখা যাচ্ছে না। বিয়ের পর থেকে দুলাভাই দুলাভাই বলে মেয়েটা মাথা ব্যথা করে দিচ্ছিলো। বয়স তার কম না, তবে বুদ্ধির পরিপক্বতা হয়ত কম।
শোভন উঠে দাঁড়াতেই কথা এসে সামনে দাঁড়ালো। শোভন আবার বসলো। কথার গায়ে শাড়ি নেই, বাড়ি পরার সাধারণ থ্রী পিস, চুল টাও এলোমেলো। কনের এমন দশা হবার কথা না। শোভনের বুকটা ধক করে উঠলো।
কনে অন্য কেউ নয়তো? তাছাড়া সন্দেহ হবার আরেকটা কারণ আছে, বিয়ের পড়ানোর সময় কনের নাম কথা ছিল না, ছিল রূপকথা।
কথা বলল,
“বসে আছেন কেনো? বাড়ি ফিরবেন না? ”

শোভন বলল,
“আপনি কনের কে হন?”

কথা একবার তীক্ষ্ণ নজরে পর্যবেক্ষন করলো। লোকটার মুখ চোখ শুকিয়ে গেছে? কেনো? একটু আগেও তো খুশিতে মুখ উজ্জ্বল হয়ে ছিল।
সে বলল,
“কনেকে না দেখে বিয়ে করতে এসেছেন? ”

শোভন উত্তর দিতে পারলো না। উত্তর দেবার মতো অবস্থাও তার নেই। ভেতরে কোথাও ক্রমাগত রক্তক্ষরণ হচ্ছে। যে মেয়েটাকে একপলক দেখার জন্য দিনের পর দিন অফিস যাওয়ার আগে রাস্তায় হা করে দাড়িয়ে থাকতো, যাকে বিয়ের জন্য নিজের মায়ের কথার বিরুদ্ধে গিয়েছে। তার সাথেই কি না বিয়েটা হয়নি? অন্যকোনো মেয়েকে সে মেনে নিতে পারবে? সে চটজলদি উঠে দাড়ালো। চোখে পানি এসে যাচ্ছে।
কথা বলল,
“আরে বউ রেখে চলে যাবেন নাকি?”

শোভন মুখ খুলল,
“জ্বি না, মানে, তাকে ডাকুন!”

কথা বলল,
“একমিনিট অপেক্ষা করুন, আমি আসছি।”

কথা ভেতরে যেতেই শোভন ধপ করে সোফায় বসলো। দু’হাতে মুখ চেপে ধরলো। তার এই মুহূর্তে সব ছেড়ে ছুরে চলে যেতে ইচ্ছে করছে।

কথা প্রথমে গেলো মামির ঘরে। তিনি চুপচাপ মুখ ভার করে বিছানায় বসে ছিলেন। মামা বসেছেন পাশের চেয়ারে। তার মুখটাও গম্ভীর।
কথা বলল,
“আমি চলে যাচ্ছি। ”

রুবিনা বেগম উত্তর না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বসলেন। মামা উঠে এলেন। হুট করে কথাকে বুকে টেনে হুহু করে কেঁদে উঠলেন।
কথা কিছুটা অবাক হলো। তার মামা তাদের ভালবাসে, বা সহানুভূতি আছে এমন কখনও প্রকাশ করেননি৷ বরাবরই তিনি বউয়ের আচল ধরা মানুষ। কবিতা তাকে ডাকে গৃহপালিত স্বামী। তবে আজ তার ব্যবহার অন্যরকম, কথার মনে হচ্ছে লোকটা তার আপন মানুষ। অথচ আগে কখনও এমন ধারণা মনেও আসেনি।
মামা তাকে ছেড়ে বললেন,
“আমি চেষ্টা করেছিলাম কথা, খুব চেষ্টা করেছিলাম তোর ভালবাসার মানুষটার হাতে তোকে তুলে দিতে৷ কিন্তু সে যে নিজেই তোকে বিয়ে করতে রাজী হলো না রে মা।”

কথা চমকে উঠলো। আরিফ তাকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে? সত্যিই? অথচ কল করে কী অবুঝ সাজলো? এতটা ভালো অভিনয় করা সম্ভব?

বেরুনোর আগে একবার কবিতার ঘরে উকি মারলো কথা। কবিতার চোখ ফোলা, কেঁদেছে হয়তো। কথা বলল,
“কাঁদছিস কেনো কবিতা?”

মৃদু কান্নার সুর এবার জোরে শুরু হলো। কান্নার দাপটে তার শরীর কেঁপে উঠছে। কথার হঠাৎ মনে হলো সেও যদি এমনভাবে কাঁদতে পারতো! বুকটা তার ও ভার হয়ে আসে, কষ্ট হয়..একটু হালকা করতে ইচ্ছে হয়.
কবিতা বলল,
“তুই চলে গেলে আমি কী করে থাকবো আপা? তুই ছাড়া আমার যে আর কেউ নেই!”

কথা পরম মমতায় তার মাথায় হাত রাখলো।
তার বোকা সহজ সরল বোনটার জন্য তার যে চিন্তা হয় না তা কিন্তু না। মামির কাছে ফেলে যেতে বুক কাঁপছে বৈকি। সকাল সন্ধ্যা কটু বাক্য শুনতে শুনতে দিননিপাত করতে হবে তাকে।
কথা বলল,
“কিছুদিন পর তোকে আমি নিয়ে যাবো কবিতা, তুই চিন্তা করিস না।”

একটু চুপ থেকে আবার বলল,
“মামা আরিফের কাছে আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল, আরিফ সরাসরি না করে দিয়েছে। তুই জানতি এসব?”

কবিতা মাথা নাড়লো।
“তবে বলিসনি কেনো আমায়?”

“তুই কষ্ট পেতি যে!”

“এইজন্য বুঝি এই বিয়ের ব্যপারে তুই আগ্রহ দেখিয়েছিলি?”

কবিতা আরও একবার মাথা নাড়লো।
“দুলাভাই আরিফ ভাইয়ের মতো নয় আপা, সে তোকে খুব ভালো রাখবে। তুই খুব ভালো থাকবি আপা, ভালো মানুষেরা খারাপ থাকে না।”

“আমি ভালো মানুষ?”

কবিতা এবার কথাকে জাপটে ধরলো।
“তোর মতো ভালো মানুষ আমি কোনদিনও দেখিনি।

কথা এবার লাল বেনারসি গায়ে জরিয়েছে, তাকে দেখাচ্ছে কিছুটা রাজকন্যার মতো। কোমড় সমান লম্বা চুলটা খোলা রেখে সে চোখে কাজল আকছে। কথার বাবা বেচে থাকতে তাদের দুইবোনকে বড় রাজকন্যা এবং ছোট রাজকন্যা বলে ডাকতেন। কথা খুব উপভোগ করতো এ ডাক। তবে এখন সেসব মনে পড়লে নিজের ভাগ্যের উপর হাসি পায়। বাবা বেচে থাকলে দেখতে পেতেন তার দুই রাজকন্যা এখন ভোল পাল্টে ঘুটে কুড়ানির রূপ নিয়েছে।
শোভন কথাকে দেখে লাফিয়ে উঠলো। এখন কথাকে দেখতে নতুন বউদের মত লাগছে। ডাগর ডাগর চোখ জোড়ায় কাজল দেওয়ায় আরও মোহনীয় হয়ে উঠেছে। মুলত তার চোখ দেখেই শোভন প্রেমে পড়েছিল। এত মায়াবী চোখ… একদিন ভেবেছিল কথাকে ডেকে বলে,
” তুমি চোখে কাজল দাও না কেনো?”

কিন্তু সাহস করে উঠতে পারেনি। কথার সামনে এলেই কেন জানি তার হাটুতে কাঁপন ধরে৷ এই যে এখনও কাঁপছে।
কথা সামনে দাড়িয়ে বলল,
“এখন কী আমায় কনের মতো দেখাচ্ছে? ”

শোভন লজ্জায় মাথা নোয়ালো। মাত্র বিয়ে করা নিজের বউকে সে চিনতে পারেনি। তবে তার আনন্দটাও আবার ফিরে এসেছে। অন্য মেয়েকে বিয়ের কথা সে চিন্তাও করতে পারে না। এতটুকু সময়ে উল্টো পালটা ভেবে অসুস্থ হয়ে পরেছিল প্রায়।

শোভনদের ফ্লাটটা খুব বেশি বড় নয়। দু’রুমের ছোট্ট ছোট্ট শোবার ঘরের সামনে ড্রয়িং রুমের মতো মাঝারি সাইজের একটা ঘর। কয়েকটা সোফার সামনে একটা মিডিয়াম সাইজের টিভি। রান্নাঘরটা দেখা যাচ্ছে না, হয়তো ভেতরে কোথাও। মধ্যবিত্তের ছোট্ট সংসার। তবুও কথার খুব পছন্দ হলো। আরিফের সাথে সম্পর্ক থাকাকালীন সে প্রায়ই এমন ছোট্ট সংসারের স্বপ্ন দেখতো। আরিফ নিজেও কম স্বপ্ন দেখায়নি। কিশোর বয়সের প্রেম তাদের। কথা প্রথমে তাকে পাত্তা দিতে না চাওলেও পরে নিজেও আরিফের পাগলামির কাছে হার মেনেছিলো।
শোভনের মা রোজিনা বেগমকে দেখেই কথার মনে হলো তিনি এ বিয়েতে রাজি ছিলেন না।
কথাকে দেখে তার মুখে কোনো হাসি ফুটলো না, বরং কপালে আরও দু’একখানা ভাজ যুক্ত হলো।
কথা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার জিবনে কখনই পুরোপুরি শান্তির দেখা পাওয়া যায় না।
আরিফকে ভুলে যেখানে নতুন জীবনে সুখের সন্ধান চালানোর সিদ্ধান্ত নিলো সেখানেও ঝামেলা তার পিছু ছাড়লো না।
রোজিনা বেগম দায়সারা ভাবে কথার মাথায় হাত রেখে কড়া চোখে ছেলেকে দেখে নিজের রুমের দরজা আটকালো। এত জোরে দরজা আটকানোর শব্দে কথা কিছুটা কেঁপে উঠলো।
শোভন ঠিক তক্ষুনি কথার হাত আঁকড়ে ধরে বলল,
“সব ঠিক হয়ে যাবে কথা, চিন্তা করো না।”

কথা নিজেও হাতটাকে আকড়ে ধরলো। এমন ভরসার হাতই তো চেয়েছিল সে এতদিন। এতগুলো বছর পরে বুঝি ভাগ্যে সুখের দেখা মিললো!

,

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here