স্মৃতির দেয়াল🍁 পর্ব-৮

0
875

স্মৃতির দেয়াল🍁
#পর্ব_৮
Writer -Afnan Lara
.
.
মুনের চাইতে আমি বরং তোমাকে তাহা ডাকবো,মুনতাহা আবার বেশি বড় নাম হয়ে যায়
কথাটা বলে চলে গেলো সে,আর দাঁড়ালো না,কিসের একটা টান তাকে টেনে নিয়ে গেলো রুমে
হিয়ার টান,এসময়টা হিয়াকে নিয়ে ভাবে নীল,আর তাই সময় নষ্ট করলো না সে
মুন এক দৃষ্টিতে নীলের চলে যাওয়া দেখলো,এতটাদিন পর তার কেয়ার করার একটা মানুষ সে নিজের চোখে দেখলো
.
মুনের সাথে এখন মা আর নিপা কথা বলছে,,ওর বাসার সব জিজ্ঞেস করছে এক এক করে
.
কথা বলা শেষ করে মা ও চলে গেলেন ডিনার রেডি করতে,নীল খায়নি,আর তিনিও না,নিপা খেয়েছে তাই সে মুনের পাশেই বসে থাকলো
নীল তার রুমে ফেরত এসে টেবিলের উপর থেকে বিয়ারের বোতল নিতে যেতেই ওপাশ থেকে মায়ের ডাক শোনা গেলো
মা ওকে খেতে ডাকছে
নীল দরজাটা একটু ফাঁক করে বললো”মা সরি,আজ খাব না,খিধে নেই”
.
আসলে নীলের পেটে অনেক খিধে তবে সে খাবে না কারণ তার মনের খিধে নেই,আপাতত ঢক ঢক করে মদ খাওয়া জরুরি

মুনকে নীলের আম্মু জোর করে ভাত খাইয়ে দিলেন
এখন মুনের ঘুম আসছে না,ঘুম না আসারই কথা
আজকে ওর উপর দিয়ে কত কি যে বয়ে গেলো,ওর পাশেই নিপা বেঘোর ঘুমোচ্ছে
তা দেখেও মুনের ঘুম আসছে না,বাসার সবাই ঘুমে
আরেকজনের বাসায় এত রাতে পায়চারি করাটা কি ঠিক হবে??
তাও নিজের মনের ডাকে সাঁই দিয়ে মুন বিছানা থেকে নামলো
নিপার একটা কমলা রঙের চুড়িদার পরেছে মুন,,সে আগে চুড়িদার পরেনি,নরমাল থ্রি পিস পরতো সে
এটাও চলে,পিঠের ব্যাথাটা কিছুক্ষণ পরে পরে ঘা দিচ্ছে
মুন ওড়নাটা গলায় দিয়ে দরজা খুলে বের হলো
ভেবেছিলো করিডোর অন্ধকার হবে কিন্তু নাহ করিডোর ভর্তি আলো
বড় লোকেরা করিডোরেও লাইট জ্বালিয়ে রাখে
.
মুন নিপার রুম থেকে বের হয়ে একটা ছবির মুখোমুখি হলো যেটা ওপরপাশের ওয়ালে টাঙানো ছিল
ছবিটা নীলের মায়ের আর বাবার
নীলের মাকে মুন চিনলো তবে তার পাশের লোকটাকে চিনলো না
পরে নিজে নিজে মিলিয়ে নিলো হয়ত উনি নীলের বাবা,তার গায়েও পুলিশের পোশাক,তার মানে উনিও পুলিশ
মুন ছবিটা দেখে সামনে চেয়ে দেখলো আরও অনেক অনেক ছবি
করিডোরের এই দেয়ালটা যেন পরিবারের সবার ছবি রাখার স্থান
মুনের মনটা অটোমেটিক ভালো হয়ে গেলো,ছবিগুলো দেখতে দেখতেই
হঠাৎ একটা ছবিটা এসে আটকে গেলো সে
একটা উদম বাচ্চা ছেলের ছবি
তার পরনে কিচ্ছু নাই,কিচ্ছু মানে কিচ্ছুই না
বয়স ১-২বছর হবে,হাতে গোলাপ ফুল নিয়ে ব্রু কুঁচকে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে আছে সে,তার সাথে আরও তিনটা ছেলে মায়ের দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে,তাদের সবার পরনে ছোট প্যান্ট থাকলেও গোলাপ হাতে ছেলেটির গায়ে কিছু নেই
মুন ফিক করে হেসে দিলো,কারণ তার ব্রু কুঁচকানোর মানে হয়তবা এত ভালো ছবিটায় তার গায়ে জামা না থাকার কারণ
ছেলেটা যে নীল তা নিয়ে সিউর হলো মুন,কারণ নীলের ডান ব্রুতে একটা তিল আছে,মুন ছবিটাগুলো দেখা শেষ করে মুখে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে করিডোরের শেষ প্রান্তে চলে আসলো,এতক্ষণ আসতে আসতে দু তিনটে রুম পড়েছে তবে সেগুলো সব লক করা ছিলো,শেষের এই রুমটা একটু ফাঁক হয়ে আছে
মুন ভাবলো চলে যাবে পরে ওর মাথায় ভূত চেপে বসলো
রুমটার ভেতরে এক নজর দেখার,তার পরেও নিজের সাথে যুদ্ধ করে সে মুখ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছিলো এই ভেবে যে কারোর রুমে বিনা অনুমতিতে ঢুকা ঠিক না
কিন্তু সে কারোর বমি করার আওয়াজ পেয়ে থেমে গেলো
দরজাটা একটু ঠ্যালা দিয়ে ভিতরে ঢুকলো সে
রুমটা প্রচণ্ড অন্ধকার,শুধু ড্রিমলাইট জ্বালানো পার্পল কালারের
মুন মনে মনে ভাবছে রুমটায় ঢুকে ভুল করলো না তো
যাই হোক এখন সবার আগে ভাববার বিষয় হলো কে বমি করছিলো
বাথরুমে আলো জ্বলছে
মুন সেদিকটার দিকে চেয়ে আছে
রুমটা নীলের,খালি পেটে দেড় বোতল মদ খাওয়ার কারণে তার এই নিয়ে তিনবার বমি হলো,হাতটা দেয়ালে রেখে,শরীরের ভার সামলে বাথরুম থেকে বের হলো সে
মুন চোখ কপালে তুলে ফেললো নীলকে দেখে
নীল লাইটটা অফ করে ফেলে অন্ধকার রুমে পা রাখলো বাথরুম থেকে বেরিয়ে
মুন পিছিয়ে যাচ্ছে,বমি করার মানুষটা মেয়ে হলে হয়তবা সাজতো,কিন্তু এ তো একটা পুরুষ,আমার মোটেও এখানে থাকা ঠিক হবে না
এই ভেবে সে সে পিছন ফিরে চলে যেতে নিতেই নীল ওর ওড়না ধরে ফেললো
মুন মুখে হাত দিয়ে চুপ করে আছে
.
হিয়া?তুমি এসেছো??আমার কাছে??
কিন্তু!কেন এসেছো?কি চাই?
.
মুন মুখে হাত দিয়ে ভাবছে এই হিয়াটা কে আবার,আমি তো মুন আর উনি তো আমায় তাহা ডাকবেন বলেছিলেন,এসব ভাবতে ভাবতেই মুন খেয়াল করলো নীলের হাত ওর কোমড় জড়িয়ে ধরেছে
মুন চোখ মুখ উলটে কিছু বলতে যাবে তার আগেই নীল এক টান দিয়ে মুনকে নিজের দিকে ফিরালো,মুনকে কিছু বলার সুযোগই দিচ্ছে না সে
খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওকে সাথে কান্না ফ্রি
মুন মূর্তির মতন নীলের কান্না দেখছে
ছেলেমানুষ এমন করে কাঁদে??মুনের জানা ছিলো না,সে জানতো ছেলেরা কাঁদে না,তার মায়ের ছবি দেখে তার বাবা কাঁদে না কারণ সে বিশ্বাস করে ছেলেরা কাঁদে না
কিন্তু এই লোকটা দেখি তার উল্টো
আর আমাকে এমন করে ধরেছে কেন,কে এই হিয়া??
নীলের কথা বার্তায় বোঝা যাচ্ছে এতবার বমির পরেও তার নেশা কাটেনি
নীল কান্না থামিয়ে বললো”কেন প্রতিরাতে আমার কল্পনায় আসো তুমি??এতদিন তোমাকে ছুঁতে পারতাম না আর আজ দেখো ছুঁয়েও ফেলেছি,, এরকম ভালোবাসা দিয়ে আমাকে কিসের সাথে যুক্ত করতে চাও??
বেনামি বন্ধনে আটকাতে চাও আমাকে?কিন্তু কেন হিয়া??আমি তো চেয়েছি তুমি আমার স্ত্রী হয়ে এই পরিবারে আসো,আমার সাথে সম্পর্ক জুড়ো
কিন্তু ভাগ্য তো এক করেনি আমাদের,তাহলে কেন বারবার আমাকে এভাবে কষ্ট দাও প্রতিরাতে!আজ তোমাকে ছুঁতেও দিলে!
.
মুন গলাটা ঠিক করে বললো”আআআআআমমমমি মুন ওরপে তাহা”
.
কথাটা স্পষ্ট শুনার সাথে সাথে নীল এক ধাক্কা মেরে দিলো,এমন জোরে ধাক্কা দিলো মুন গিয়ে একেবারে দরজার সাথে বাড়ি খেলো
.
নীল মাথার চুল ঠিক করতে করতে লাইট জ্বালালো
মুন হাতের কুনুইতে ব্যাথা পেয়ে চুপ করে আছে,চেঁচালে তুলকালাম হবে তাই ব্যাথা পেয়েও আওয়াজ করলো না সে
নীল ঠিকমত দাঁড়াতে পারছে না,কথাও মুখ দিয়ে বের করতে পারছে না সে
তাও নিজেকে কন্ট্রোল করে সে রাগী লুক নিয়ে বললো”তুমি এ সময়ে আমার রুমে কি করো?আর এতক্ষণ চুপছিলা কেন?”
মুন কপাল কুঁচকে কুনুই ঘষতে ঘষতে নিচ থেকে উঠে দাঁড়ালো,তারপর বললো”এক্সকিউজ মি!!আপনি জোর করে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন,আমি আপনার থেকে হাইটে ছোট বলে আমার মুখ আপনার বুকে চেপে ছিলো,দম ফেলতে পারছিলাম এটাই অনেক
নাহলে আগামীকাল খবরের কাগজে বের হতো”বালকের বুকের চাপায় বালিকা দম আটকে নিহত,বিস্তারিত পরের পৃষ্ঠায় দেখুন”
.
এটা মোটেও ফান করার কিছু না,যা আস্ক করলাম সোজাসুজি উত্তর দাও
.
বমি করার আওয়াজ আসছিল আর তাই আমি দেখতে আসছিলাম আসার সাথে সাথে আপনাকে দেখে আমি চলেই যাচ্ছিলাম কিন্তু না তার আগেই আপনি আমাকে খপ করে ধরে-হিয়া তুমি এটা,হিয়া তুমি ওটা,কেন কেন কেন,কেন আসলে,কেন????!এসব বলা শুরু করে দিছেন
.
নীলের খুব রাগ হচ্ছে,কাছে এসে মুনের হাত ধরে রুম থেকে বের করে দিলো সে তারপর বললো”চুপচাপ নিপার পাশে গিয়ে ঘুমাও”
.
এরপর দরজা লাগিয়ে দিলো নীল,লক করলো না
মুন মুখটা বাঁকিয়ে নিপার রুমে ফেরত যেতে যেতে ভাবলো কে এই হিয়া??কিসের ভাগ্য মিলায়নি??
এমন করে ধরছিলো আমাকে,মানে ঐ হিয়া ভেবে ধরছিলো,প্রতিরাতে আসে??
ছিঃ ছিঃ,কি চরিত্র লোকটার,আজ মনে হয় আমি একটু জলদি এসে পড়েছিলাম,এখনও মনে হয় হিয়া আসেনি
ছিঃ ছিঃ!!দুজনের বিয়ে অসম্ভব বলে প্রতি রাতে দুজনে!! ছিঃ ছিঃ
.
কি হলো মুন??এত ছিছিছি করতেছো কেন?আর তুমি কই গিয়েছিলে,আমি তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে,ভাবলাম তোমার হিটলার মা আবার আসলো নাকি
.
মুন দাঁত কেলিয়ে বললো”ঘুমের ঘোরে হাঁটার রোগ আছে তো,স্বপ্নে কি না কি দেখে হয়ত ছিছি করছিলাম,চলো ঘুমাই

পরেরদিন সকাল সকাল সবার আগে মুন উঠলো ঘুম থেকে,তার মনের কৌতুহলটা তাকে কিছুক্ষন বাদেই খোঁচাচ্ছে,আর বারবার বলছে মুন গিয়ে দেখ হিয়া মেয়েটা নীলের রুমে কিনা
যেমন ভাবা তেমন কাজ
মুন চুপিচুপি বিছানা থেকে নেমে গেলো,নিপা মরার মতন ঘুমোচ্ছে
মুন ওড়না মাথায় পেঁচিয়ে নীলের রুমের দিকে যাচ্ছে,সকাল সাতটা বাজে তখন,রান্নাঘর থেকে আওয়াজ আসছে,বুয়া হয়ত রান্না করছেন
মুন নীলের রুমের দরজায় আঙ্গুল দিয়ে টোকা দিয়ে ঠ্যালা দিলো একটা
দরজাটা খুলে গেলো,নীল মনে হয় দরজা লক করে না তেমন
মুন ভেতরে চেয়ে দেখলো বারান্দার পর্দা টাঙানো,আর নীল বিছানার মাঝখানে চিৎ হয়ে ঘুমাচ্ছে,উদম গায়ে
গায়ের উপর এ্যাশ এবং কালো রঙের একটা ব্ল্যাংকেট
পুরো রুমটা আগোছালো,মুন এক এক করে দেখছে সব,কাল ভালোমতন দেখা হয়নি
হঠাৎ ওর মনে হলো কোথাকার কোন নীলের জন্য সে এত সময় বরবাদ কেন করছে?
নিজেই নিজেকে এক গাদা বকে সে নিপার রুমে ফেরত চলে আসলো আবার
এই বাসায় কেউই এখনও উঠছে না,এদিকে মুনের বিরক্ত লাগছে এভাবে বসে থাকতে থাকতে
তাই আবারও সে নিপার রুম থেকে বের হলো,এবার বাসার সামনে যাবে
বাসার সামনে এসে তার মনটা ভালো হয়ে গেলো,গাছগাছালিতে ভর্তি করে রাখা সবটা
কোনটা থকে কোনটাতে উঠবে তাই ভেবে যাচ্ছে মুন
পরে মনে পড়লো সে দূর্বল,এখন তো গাছে ওঠা সেফ হবে না
.
নীলের ফোনে এলার্ম বাজছে সকাল নয়টার,সে বিছানা থেকে নেমে ফ্লোর থেকে খুঁজে নিজের টি-শার্টটা পরলো তারপর আড়মোড় ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে বারান্দার পর্দা সরালো
তারপর বারান্দার গ্লাস সরিয়ে বারান্দায় পা রাখতেই সে মুনকে দেখলো দূরের কাঁঠাল গাছটার দিকে চেয়ে আছে সে
গাছটাকে ভালোমতন দেখছে মুন,কিন্তু উঠছে না তার মানে এখনও অসুস্থ
নাহলে ও যেরকম মেয়ে এতক্ষণে গাছে উঠে বসে থাকতো
.
নীলের কালকে রাতের কথা মাথায় আসতেই নিজেই নিজের মাথায় বাড়ি দিয়ে রুমে ফেরত চলে আসলো আবার
জলদি করে ফ্রেশ হয়ে অফিস যেতে হবে
.
মুন হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরে এসেছে আবার,গাছ সবগুলো এক এক করে দেখেছে সে
নীলের মা টেবিলে খাবারের প্লেট সাজাচ্ছেন,মুনকে দেখে হেসে বললেন”উঠে গেছো?”
.
মুন চোরের মতন মুখ করে বললো”সাতটায় উঠেছি,আপনারা মনে হয় দেরি করে উঠেন তাই না?”
.
হুম সেটা ঠিক,তবে নীল আগে সকাল সকালই উঠতো,কিন্তু এখন সেও দেরি করে
.
মুন বিড়বিড় করে বললো”এত রাত জেগে বমি করলে আর হিয়ার সাথে থাকলে এমনি হবে”
.
কিছু বললে?
.
নাহ,কিছু না তো,,
.
বসো খেতে বসো
.
মুন খেতে বসলো,নীল তড়িগড়ি করে মাথার চুল হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে এগিয়ে আসছে নাস্তা করতে,চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো”জলদি জলদি”
.
মা সাজানো প্লেটটা ওর দিকে ঠেলে দিলেন
নীল খাবার মুখে দিয়ে সামনে তাকাতেই দেখলো মুন কৌতুহল ভরা চোখে ওর খাওয়া দেখছে
.
কাল রাতের কথা নীলের মাথায় ঘুরে উঠলো,মা রান্নাঘরের দিকে চলে যেতেই নীল টেবিলে এক থাবা দিয়ে বললো”চোখ নিজের খাবারের দিকে রাখো,আমার দিকে ওমন করে তাকাবা না একদম”
চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here