আরশিযুগল প্রেম পর্ব – ৬০

আরশিযুগল প্রেম পর্ব – ৬০
# লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা

শীতের প্রথম সপ্তাহ। চারপাশের ঘন কুয়াশা কাটিয়ে মাঝেমাঝেই উঁকি দিচ্ছে উত্তাপহীন সূর্য। কয়েক গুচ্ছ সোনালী রোদ শুভ্রতাদের টেবিলে ছুঁড়ে দিয়ে আবারও হারিয়ে যাচ্ছে বহুদূরে। টেবিলের উপর ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ। ক্যাফিটেরিয়ার জানালা ভেদ করে শিরশিরে হাওয়া আসছে। শুভ্রতা কাঁপা হাতে নিজের কাপটা তুলে নিলো। গায়ে থাকা মোটা চাদরটা ভালো করে টেনে নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিল। জমাট কন্ঠে বলল,

—-” কি পরিমাণ ঠান্ডা পড়েছে দেখেছিস? এই দুই তিন সপ্তাহে শীত আরো বাড়বে। ও বলল শৈত্য প্রবাহের সম্ভবনা আছে। গরম, শীত কোনো কালেই শান্তি নাই।”

শুভ্রতার কথার পিঠে কোনো জবাব এলো না। পুষ্পি গায়ের ওড়না দিয়ে মাথা-কান আরো একটু শক্ত করে বাঁধলো। সুয়েটারের ওপর চাদরটা ঠিকঠাক করে নিয়ে চায়ের কাপ হাতে তুলল। গম্ভীর কন্ঠে বলল,

—-” আমাদের ঢাকাতেই এই অবস্থা হলে উত্তরে কি অবস্থা ভাবতে পারছিস? পঞ্চগড়ে তো হাড় কাঁপা শীত এখন। আব্বু বলছিল, এবারের শীতে উত্তরের মানুষ জমেই মরে যাবে।”

প্রেমা সিংগাড়ার কোণা চিবোতে চিবোতে বলল,

—-” আর একটা পরীক্ষা আছে, শেষ হলেই বাঁচি। পরীক্ষা শেষে টানা এক সপ্তাহ আমি ঘুমের ওপর থাকব। শীতের দিন ঘুমুতে ভীষণ আরাম।”

—-” ভালো কথা। আমাদের শুভি কেমন অলরাউন্ডার হয়ে গিয়েছে দেখেছিস তোরা? অসুস্থ শরীর নিয়ে সংসার, বর সব সামলে ঠুসঠাস পরীক্ষা দিয়ে ফেলছে। কাহিনী কি রে শুভি? সাদাফ ভাই কি কোনো বিশেষ ঔষধ টৌষধ দেয় নাকি রাতে? না মানে, ঔষধ কি শুধু তোর জন্যই বরাদ্দ নাকি আমাদের জন্যও এবেলএবল?”

কথাটা বলে চোখ টিপলো পুষ্পি। প্রেমা মুখ টিপে হাসলো। অর্পণ এতোক্ষণ থমথমে মুখে বসে ছিল। পুষ্পির কথাটা কানে যেতেই নড়েচড়ে বসলো। সকাল থেকে মন খারাপের ভাব ধরে বসে থেকেও বান্ধবীদের বিশেষ পাত্তা পায় নি সে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কারো সাথে আগ বাড়িয়ে কথা টথা বলবে না আজ। সারাদিন দেবদাসীর মতো বেক্কল হয়ে বসে থাকবে কিন্তু এখন আর কথা না বলে থাকা যাচ্ছে না। শুভ্রতা চায়ের কাপে দ্বিতীয় চুমুক দিয়ে বলল,

—-” ছি! তোদের যত অশ্লীল কথা। আমি মোটেও ঠুসঠাস পরীক্ষা দিচ্ছি না। পরীক্ষার অবস্থা শোচনীয়। কোনরকম পাশ মার্কস এলেই বাঁচি। কোনো সাবজেক্টে ব্যাক লক পড়ে গেলে ঝামেলা। নেক্সট ইয়ার তুতুন থাকবে। তখন তো বাচ্চা সামলাতে সামলাতেই সময় যাবে। পড়াশোনা তেমন হবে টবে না। তাই এক চান্সে পেরিয়ে যেতে পারলেই রক্ষা।”

পুষ্পি আনন্দ ধ্বনি করে বলল,

—-” হুহ! ইট’স অসাম। আর মাত্র ছয় মাস, তারপর দ্বিতীয়বারের মতো খালামনি হয়ে যাব আমরা। তুতুনের জন্য একটা টয় বানাবো আমি। ছোট্ট বেলায় নানু লাল সুতো দিয়ে পুতুল বানানো শিখিয়েছিল। দুই বাবু সোনার জন্যই বানাবো।”

প্রেমা উৎসাহ নিয়ে বলল,

—-” আমার দাদি কুশিকাটা দিয়ে খেলনা বানাতে পারত। ছোট্ট বেলা দেখতাম আর অবাক হতাম। গ্রামে কিন্তু তালপাতা দিয়েও খেলনা বানায়, দেখেছিস তোরা?”

শুভ্রতা কপাল কুঁচকে বলল,

—-” গ্রামে বেশি যাওয়া হয় নি। যতবার গিয়েছি সমবয়সীদের মাটির হাঁড়ি-পাতিল দিয়েই খেলতে দেখেছি। রান্না-বান্না আর হাঁড়ি-পাতিল খেলা।”

পুষ্পি খিলখিলিয়ে বলল,

—-” কোনো হাঁড়ি-পাতিল টাতিল না। ওটাকে বলে বউ-জামাই খেলা। আমি খেলেছিলাম ছোট বেলায়। সাইফ নামে আমার একটা চাচাতো ভাই ছিল। সে সবসময়ই আমার বর সাজতো। এখনও সে আমার ওপর ক্রাশড। কিন্তু আমার তাকে বলদ বলদ লাগে। টু মাচ ইরিটেটিং ইয়ার…।”

প্রেমা, শুভ্রতা দু’জনেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। অর্পণ অভিমানে নাক-মুখ ফুলিয়ে বান্ধবীদের দিকে তাকাল। ক্ষুণ্ন গলায় বলল,

—-” তোরা এতো খারাপ!”

অর্পণের কথায় তিন জোড়া বিস্মিত দৃষ্টি ওর ওপর স্থির হলো। খানিকক্ষণ প্রশ্নমাখা দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে একে অপরের দিকে তাকাল। অর্পণ আগের মতো করেই বলল,

—-” আমার এতো মন খারাপ আর তোরা হাসছিস!”

—-” ওমা! তোর মন খারাপ নাকি?”

অর্পণ থমথমে মুখে বলল,

—-” হু।”

শুভ্রতা, প্রেমা ঠোঁট টিপে হাসল। পুষ্পি মায়া মায়া গলায় বলল,

—-” আহারে! সরি দোস্ত, আমরা বুঝতে পারি নি। তোর যে মন খারাপ এই ভয়ানক বিষয়টা বুঝতে ব্যর্থ হওয়ায় আমরা ভীষণ লজ্জিত। তুই কিন্তু চাইলেই আমাদের সাথে হাসতে পারিস। মন খারাপ থাকলে হাসা যাবে না এমন কোনো নিয়ম নেই। আমরা কিছু মনে করব না।”

অর্পণ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। পুষ্পি তার সাথে ফাজলামো করছে কিনা বুঝতে চেষ্টা করল। পাশ থেকে প্রেমা বলল,

—-” তা তোর মন খারাপের কারণ কি?”

অর্পণ দুঃখী দুঃখী গলায় বলল,

—-” পার্মানেন্ট ক্রাশটা হয়ত দু’ এক মাসে বিয়ে টিয়ে করে ফেলবে। শালার দাওয়াতটা পর্যন্ত দিল না আমায়। এতোদিন ধরে কন্টিনিউয়াসলি ক্রাশ খেয়ে কি লাভ হলো আমার?”

অর্পণের এমন কথায় তিন জোড়া চোখ ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। তাদের চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে এহেন অদ্ভুত কথা এ জীবনে আর কখনও শোনা হয় নি তাদের। শুভ্রতা বিস্ময় নিয়ে বলল,

—-” যে ছেলেকে তুই রিজেক্ট করেছিস, সে তোকে বিয়েতে দাওয়াত দিবে? এটা তুই এক্সপেক্টও করিস? তোর দ্বারাই সম্ভব এসব।”

—-” আমি কি ইচ্ছে করে রিজেক্ট করেছি নাকি? অটো রিজেক্ট হয়ে গিয়েছে। তাই বলে আমি যে তার কাজিন হই তা সে ভুলে যাবে? দাওয়াত করবে না? অকৃতজ্ঞ!”

পুষ্পি হাসলো। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,

—-” বেচারার কি দোষ বল? যে মেয়ে বউ হওয়ার কথা ছিল তাকে কি বোন হিসেবে ইনভাইট করা যায়? তুই এতো টেনশন নিস না তো। প্রেমার কালাচানের একটা ছোট ভাই আছে শুনেছি। তুই নতুন উদ্যমে তার উপর ক্রাশ খা। এক ক্রাশ নিয়ে পড়ে থাকলে তো চলবে না। তোকে প্রচুর ক্রাশ খেতে হবে।”

অর্পণ এবার নিজের কাপটা তুলে নিলো। ঠান্ডা হয়ে আসা চায়ে চুমুক দিয়েই চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল। তিক্ত গলায় বলল,

—-“ক্ষেমা দে মা। ওই কালাচানের ভাইকে দেখার জন্য অলওয়েজ চারশো আশি ভোল্টেজের টর্চ লাইট নিয়ে ঘুরতে হবে আমায়। দিন-রাত যদি টর্চই মারি তাহলে ক্রাশটা কখন খাব? আজাইরা আইডিয়া।”

পুষ্পি-প্রেমা মুচকি হাসল। অর্পণ ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,

—-” কি ব্যাপার? হাসছিস কেন?”

শুভ্রতা ঠোঁট জোড়া প্রসারিত রেখেই বলল,

—-” হাসছি না ভাবছি।

অর্পণ সন্দিহান গলায় বলল,

—-” কি ভাবছিস?”

পুষ্পি রহস্যমাখা কন্ঠে বলল,

—-” ভাবছি, তোর পার্মানেন্ট ক্রাশের পার্মানেন্ট বউটাকে যদি উলোট পালোট করে দেওয়া হয়, তাহলে কেমন হয়?”

অর্পণ চোখ বড়বড় করে বলল,

—-” মানে? কি বলছিস তুই?”

পুষ্পি দাঁত কেলিয়ে হেসে বাম চোখ টিপলো। অর্পণ আরো কিছু জিগ্যেস করবে তার আগেই শুভ্রতার ফোন বাজল। শুভ্রতা ফোনটা কানে নিতেই ওপাশ থেকে নরম কন্ঠ ভেসে এলো,

—-” হ্যালো।”

—-” হুম।”

—-” কোথায় আছো এখন?”

—-” ভার্সিটি ক্যাফিটেরিয়াতে।”

—-” ফ্রেন্ডরা সাথে আছে?”

—-” হ্যাঁ।”

—-” শরীর কেমন এখন? বমি হয়েছিল আরো?”

শুভ্রতা মৃদু হেসে বলল,

—-” না হয় নি। তুমি খেয়েছ দুপুরে?”

সাদাফ কৌতুকভরা কন্ঠে বলল,

—-” ম্যাডামের পরিক্ষা কেমন হলো? পাশ করবে নাকি ফেইল? আহা! আমার বাচ্চাটা পেটে বসে ফেইল করা শিখে যাচ্ছে।”

শুভ্রতা হেসে ফেলল। চাপা গলায় বলল,

—-” একদম বাজে কথা বলবা না। আমি অতো খারাপ ছাত্রী না। ফেইল টেইল করব না।”

সাদাফ শব্দ করে হাসল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,

—-” কিছু খাবে? আনব কিছু?”

শুভ্রতা ফট করে বলল,

—-” আইসক্রিম।”

—-” আপনি অতিশীঘ্রই মাইর খাবেন। এই ঠান্ডায় আইসক্রিম? অন্যকিছু বলো।”

শুভ্রতা মুখ কালো করে বলল,

—-” অন্যকিছু খাবো না।”

সাদাফ হেসে বলল,

—-” খেও না। আমি আসছি তোমায় নিতে। ভার্সিটি গেইটে গিয়ে কল করব।”

শুভ্রতা তাড়াহুড়ো করে বলল,

—-” মা বাসায় যেতে বলেছে আজ। থাকতে হতে পারে।”

সাদাফের কন্ঠে কোমল ভাব এলো। মন খারাপ করা কন্ঠে বলল,

—-” ওই বাসায় থাকাটা জরুরি? খুব মিস করছ মাকে?”

শুভ্রতার বুকে চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। মৃদু গলায় বলল,

—-” না। জরুরী না। সারাদিন থেকে সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরে আসব। রাতে থাকব না।”

—-” তোমার খারাপ লাগলে তুমি থেকে যেতে পারো শুভ্রা।”

শুভ্রতা উত্তর দিলো না। সাদাফ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

—-” আচ্ছা আমি সন্ধ্যায় নিতে আসব তোমাকে।”

—-” তোমাকে আসতে হবে না। সারাদিন অফিস করে এমনি টায়ার্ড থাকবে। ভাইয়া পৌঁছে দিবে আমায়। তাছাড়া সিএনজি করে একাই চলে যেতে পারব, সমস্যা নেই।”

—-” তোমার সবসময় পাক্নামো। খবরদার একা আসার চিন্তাও করবে না। আমি নিজে গিয়েই নিয়ে আসব।”

—-” ভাইয়া আছে তো।”

সাদাফ কাঠ কাঠ কন্ঠে বলল,

—-” থাকুক!”

পাশ থেকে অর্পণ চেঁচিয়ে উঠে বলল,

—-” বউয়ের সাথে আর কত প্রেমালাপ করবেন ভাইয়া? শালীদের কথা তো ভুলেই গিয়েছেন।”

সাদাফ হাসল। মৃদু গলায় বলল,

—-” আচ্ছা, তাহলে আর প্রেমালাপ করি না। ফ্রেন্ডদের সময় দাও। আর শুনো, খারাপ লাগলে পাক্নামো না করে আমায় ফোন দেবে। সাবধানে থেকো। আল্লাহ হাফেজ।”

—-” আল্লাহ হাফেজ।”

শুভ্রতা ফোনটা কাটতেই ব্যস্ত গলায় বলে উঠল প্রেমা,

—-” এই শুভি? তোকে একটা কথা জিগ্যেস করব করব বলে করা হচ্ছে না। পৃথার কাহিনি এখন কতদূর রে? আমি দু-একদিন ওই বাসস্টপের দিকে দেখেছিলাম ওকে। মনে হলো অযথায় দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা।”

শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকে বলল,

—-” তাই নাকি? কই, আমি জানি না তো।”

_____________________

ঘড়িতে তিনটা কি চারটা বাজে। চারপাশের কুয়াশামাখা আলোয় সকাল বিকেল বুঝা যাচ্ছে না। ঘন কুয়াশা ভেদ করেই ছুটে চলেছে যাত্রীবাহী গাড়ি। এক দু’জন ব্যস্ত পথচারী। শুভ্রব গায়ের ছাই রঙা কোটটা আরেকটু টেনে দিয়ে বাস থেকে নামল। ভীষণ ঠান্ডা পড়েছে আজ। ঠান্ডায় হাত-পা ঝিমঝিম করছে। শুভ্রব হাতের পিঠে হাত ঘঁষে কপাল কুঁচকালো। মাথায় রাজ্যের দুঃশ্চিন্তা ঘুরছে তার। আজ মাসের দশ তারিখ। সামনের মাসেই অবসর নিবেন বাবা। পরিবারের একমাত্র ইনকাম সোর্স বন্ধ হবে। বাবা-মার দুঃশ্চিন্তা বাড়বে। গ্রামের বাড়ি থেকে বছরে দু’বার চাষের টাকা এলেও সেই টাকার ওপর সংসার ছেড়ে দেওয়া যায় না। এই মাসেই একটা চাকরি না পেলে এই ঝঞ্জাট থেকে বেরোনো যাচ্ছে না। শুভ্রব দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতেই মোড়ের কোণে পৃথাকে চোখে পড়ল। শুভ্রব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই দাঁড়াল। প্রতিদিনের মতো বিরক্ত নিয়ে পাশ কাটাল না। পৃথার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,

—-” ভালো আছেন?”

পৃথা অবাক চোখে তাকাল। দ্বিধান্বিত কন্ঠে বলল,

—-” জ্বি। ভালো আছি। আপনি?”

শুভ্রব ঠোঁটজোড়া প্রসারিত করল। ডানহাতের কব্জির ওপর পরা ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে বলল,

—-” তিনটা বাজে। আপনি ফ্রী? এক কাপ কফি খাওয়া যেতে পারে?”

পৃথা যেন আকাশ থেকে পড়ল। অতিরিক্ত বিস্ময়ে পাথর বনে গেল। শুকিয়ে যাওয়া গলায় শুকনো ঢোক গিলে বলল,

—-” জ্বী?”

—-” কফি?”

—-” হ্যাঁ। হ্যাঁ চলুন।”

এতোক্ষণের চেষ্টায় এই দুটো শব্দ বলতে পেরে বেশ স্বস্তি পেল পৃথা। বলহীন দেহ নিয়ে শুভ্রবের পিছনে হাঁটতে লাগল। বাসস্টপ থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে ছোট্ট একটা কফি শপ। সেখানের একটি টেবিলেই মুখোমুখি বসলো দু’জন। শুভ্রব আশেপাশে চোখ বুলিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

—-” কফির সাথে কিছু খাবেন?”

অস্বস্তিতে জড়োসড়ো হয়ে থাকা পৃথা মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালো। শুভ্রব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে দু’কাপ কফি অর্ডার করল। কফি না আসা পর্যন্ত কেউ কোনো কথা বলল না। টেবিলে কফি সার্ভ করতেই নিজের কাপটা তুলে নিয়ে মৃদু গলায় বলল শুভ্রব,

—-” আপনার বয়স কত?”

পৃথা তৃতীয় বারের মত অবাক হলো। নিজের কাপটা হাতে তুলে নিয়ে দ্বিধান্বিত চোখে তাকাল। শুভ্রবের হাবভাব কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না পৃথা। কি চাইছে সে? পৃথা খানিক চুপ থেকে নিচু গলায় বলল,

—-” উনিশ চলছে।”

শুভ্রব মৃদু হেসে বলল,

—-” আমার বোনের বয়স ২৩। এই ডিসেম্বরে ২৪ হবে।”

পৃথা কোনো কথা খুঁজে পেল না। শুভ্রতার বয়স জেনে তার কি লাভ হবে সেটাও বুঝে উঠতে পারল না। শুভ্রব কফির কাপে চুমুক দিল। পর পর দু’বার চুমুক দেওয়ার পর অন্যমনস্ক হয়ে বসে রইলো। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর টেবিলের দিকে ঝুঁকে এসে বলল,

—-” আমার নাম শুভ্রব। আমি আপনার ভাবির বড় ভাই। এটুকু ছাড়া আমার সম্পর্কে আর কোনো তথ্য জানা আছে আপনার?”

শুভ্রবের এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল পৃথা। বিস্ময় নিয়ে খেয়াল করল, এই দুটো তথ্য ছাড়া শুভ্রব সম্পর্কে আসলেই আর কিছু জানে না সে। শুভ্রব চাকরী খুঁজছে। তারমানে পড়াশোনা শেষ। আচ্ছা? এটা কি কোনো তথ্য হতে পারে না? এই কথাটা কি শুভ্রবকে বলবে সে? পৃথা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। অস্থির চোখে এদিক ওদিক তাকায়। শুভ্রব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

—-” আমার সম্পর্কে কোনো কিছু না জেনেই আমাকে বিয়ে করতে চান কেন? আর রোজকার এই পাগলামোই বা কেন, পৃথা?”

পৃথা নিশ্চুপ বসে রইল। শুভ্রবকে তার অযথায় ভালো লাগে। ভালো লাগার পেছনে কোনো কারণের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু, এই কথাটা মুখ ফুটে বলা যাচ্ছে না। কথাগুলো জিহ্বার কাছে এসে কেমন পেঁচিয়ে পুঁচিয়ে যাচ্ছে। শুভ্রব কয়েক সেকেন্ড তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

—-” আপনার বয়স অল্প পৃথা। অল্প বয়সে মনে অনেক ধরনের ফ্যান্টাসি কাজ করে। এই বয়সটা আমিও পেরিয়ে এসেছি। বুঝতে পারছি ব্যাপারটা। কিন্তু সব ধরনের ফ্যান্টাসিকে পাত্তা দেওয়া ঠিক না। আমি আপনার অনুভূতিকে ছোট করছি না। কিন্তু, ট্রাস্ট মি আমি আপনাকে ঠিক টলারেট করতে পারছি না। প্রতিদিন এই একই ঝঞ্জাটে ভীষণ বিরক্ত হচ্ছি। আপনি যথেষ্ট সুন্দরী পৃথা। সুন্দরী মেয়েদের পুরুষদের রূপে আকৃষ্ট হতে নেই। আর আমার এই রূপ ছাড়া অন্যকোণ গুণ নেই। চাকরী বাকরীও করি না।”

পৃথা ফট করেই বলল,

—-” আপনার গানের গলা সুন্দর। অনেক বেশি সুন্দর। ”

শুভ্রব হেসে ফেলল। কফি কাপে চুমুক দিয়ে বলল,

—-” অনেকের গানের গলাই সুন্দর হয়। এটা কোনো বিশেষ গুণ না।”

শুভ্রব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

—-” শুভি আমার একমাত্র বোন। ‘একমাত্র’ শব্দটাই অনেক বেশি স্পেশাল। শুভিও আমার জন্য অনেক বেশি স্পেশাল। ভাগ্যক্রমে সে এখন আপনার ভাইয়ের বউ। আমি জানি সাদাফ ভাই আশেপাশের কোনো কারণের উপর ভিত্তি করে শুভির সাথে খারাপ ব্যবহার করবেন না, কষ্ট দিবেন না। তবুও, আপনিও তো তার একমাত্র বোন। বোনের খুশির স্বার্থে ভাইয়েরা অনেক সময়ই ভাবনাতীত কাজ করে ফেলে। আমি চাই না শুধুমাত্র আমার জন্য আমার বোনের সংসারে বিন্দুমাত্র সমস্যা হোক। আপনি প্লিজ এই পাগলামোগুলো বন্ধ করুন। একজনের চেষ্টায় কখনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। আর সত্যি বলতে, আমি আপনাকে কখনোই মেনে নিতে পারব না। তার অবশ্য কারণও আছে।”

পৃথার দমবন্ধ লাগছে। শুভ্রবের কথাগুলো মাথার ভেতর ঢুকে কেমন ঝনঝন করছে। পৃথা নিচু গলায় প্রশ্ন করল,

—-” অন্যকেউ আছে আপনার জীবনে?”

শুভ্রবের নিঃসংকোচ উত্তর,

—–” হ্যাঁ আছে। তার নামের পাশে এখন অন্যকারো নাম জুড়ে গিয়েছে। কিন্তু আমি জানি মেয়েটা এখনও আমাকে ভালোবাসে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমাকেই ভালোবাসবে। আমাকে এতোটা ভালোবাসার পরও ওকে ওর প্রাপ্যটা দিতে পারি নি আমি। বলেছিলাম হাত ছাঁড়ব না অথচ সবচেয়ে ভয়ংকর সময়টাতেই হাত ছেড়ে দিয়েছি। চার বছর আগে প্রথম দেখায় ভালোবেসে, যে আমি ওকে ভালোবাসতে বাধ্য করেছিলাম। সেই আমিই চরম কষ্টে ওকে একা ছেঁড়ে দিয়েছি। যে মেয়েটির ঠোঁটে হাসি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো কথা থাকতো না সেই মেয়ের সেই হাসিটাই কেড়ে নিয়েছি। আমি জানি, আমার তনুজা ভালো নেই। আমার তনুজা এখন আর আগের মত হাসে না। ও সবসময় বলত, শুভ্রব নামক ছেলেটা শুধু তার। পৃথিবীর অন্য কোনো রমনী তাতে ভাগ বসাতে পারবে না।”

কথাগুলো বলতে বলতে কন্ঠ কেঁপে উঠল শুভ্রবের। সামনে যে একটি যুবতী মেয়ে বসে আছে তা যেন বেমালুম ভুলে গেল। কিছুক্ষণ পর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে নিজেকে সামলে নিল শুভ্রব। মুখে-চোখে গম্ভীর ভাব ফুটিয়ে বলল,

—-” তনুজা থাকুক বা না থাকুক। শুভ্রব তারই থাকবে। ওর যত যন্ত্রণা, দুঃখ এই শুভ্রবকে আজীবন বহন করতে হবে৷ এটাই আমার নিয়তি আর আমি এতোটুকুতেই খুশি। অন্যকাউকে নিজের সাথে জড়াতে চাই না আমি। ভুলবশতও না। আমাকে আমার ভুবনটা নিয়ে থাকতে দিন। জোরজবরদস্তি করে কিছু হয় না।”

—-” মানুষ কি দ্বিতীয়বার বাঁচার স্বপ্ন দেখে না? আপনি যাকে ভালোবাসতেন সে যদি সংসার করতে পারে তাহলে আপনি কেন পারবেন না?”

শুভ্রব থমথমে গলায় বলল,

—-” আমি চাই না।”

কথাটা বলেই উঠে দাঁড়াল। গম্ভীর কন্ঠে বলল,

—-” সে যে নারকীয় যন্ত্রণা ভোগ করছে তা ভোগ করার সাহস বা ইচ্ছে কোনটাই আমার নেই। আশা করছি, কাল থেকে এমন পাগলামো আর করবেন না আপনি। যদিও তাতে আমার বিশেষ যায়ও আসবে না। ব্যাপারটা খারাপ দেখায় বলেই আপনাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। এরপরও যদি আপনার মনে হয় আপনি যা করছেন ঠিক তাহলে, আই হেভ নাথিং টু ছে। আসছি।”

কথাটা বলে কফির বিলটা টেবিলের উপর রেখে বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেল শুভ্রব। হঠাৎই ভীষণ মেজাজ খারাপ হচ্ছে তার। পৃথিবীটাকে ভেঙে চুরমার করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। উফ! বেঁচে থাকায় এতো কষ্ট কেন? চারপাশটায় এতোটা বিরক্তি, এতোটা বিষাদ কেন?

____________________

প্রচন্ড শীতের রাতে পৃথার পায়ে জুতো নেই। গায়ে শীতের কাপড়টাও নেই। উত্তরের জানালাটা খোলা। রাতের শিশির ভেজা শিরশিরে বাতাস স্বাধীন চিত্তে এসে ধাক্কা খাচ্ছে পৃথার ফুলে যাওয়া চোখ আর লাল হয়ে আসা নাকে। শরীরের লোমগুলো প্রচন্ড ঠান্ডার সতর্কবার্তা দিচ্ছে কিন্তু পৃথা অনড়। বিন্দুমাত্র নড়ছে না সে। জানালার সামনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। এমন সময় দরজা ঠেলে ভেতরে এলো কেউ। পৃথার ঠিক পেছনে এসে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বলল,

—-” পৃথা?”

সাদাফের কন্ঠে ফিরে তাকাল পৃথা। শীতের কাপড় না পরায় এখন যে সাদাফ হরবর করে বকতে শুরু করবে তা পৃথার জানা। কিন্তু মনের সুপ্ত জেদে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল পৃথা, হাজার বকলেও সে এখান থেকে নড়বে না৷ শীতের কাপড়ও পরবে না। যা হয় হোক, পৃথিবী উল্টেপাল্টে ধ্বংস হয়ে যাক। সে নড়বে না। কিন্তু পৃথাকে অবাক করে দিয়ে সাদাফ তেমন কিছুই বলল না। বিছানা থেকে গায়ের চাদরটা নিয়ে পৃথার গায়ে জড়িয়ে দিল। বিছানায় বসে হাতের ইশারায় পাশের জায়গাটা দেখিয়ে বলল,

—-” আমার পাশে এসে বস। গল্প করি।”

পৃথার আজ অবাক হওয়ার দিন। সারাদিন ধরেই ক্রমাগত অবাক হয়ে চলেছে সে। কিছুক্ষণ দ্বিধান্বিত চোখে তাকিয়ে থেকে নড়েচড়ে উঠল পৃথা। ভাইয়ের আদুরে ডাকে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারল না। ধীর পায়ে ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসল। সাদাফ হেসে পৃথার মাথায় হাত রাখল। নরম গলায় জিগ্যেস করল,

—-” কেমন আছিস?”

সাদাফের ছোট্ট প্রশ্নে বুক ভার করে কান্না পেয়ে গেল পৃথার। মাথা নিচু করে রুদ্ধস্বরে বলল,

—-” ভালো।”

—-” মন খারাপ?”

পৃথা টলমলে চোখে ভাইয়ের দিকে তাকাল। তার চোখদুটোতে কি ভীষণ অসহায়ত্ব, কি ভীষণ অস্থিরতা!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here