স্মৃতির দেয়াল🍁
#পর্ব_৩০
Writer -Afnan Lara
.
পরেরদিন সকালবেলা যে যার মতন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলো
সবাই যার যার গাড়ীতে
কাল রাত থেকে নীল হুট করেই চুপ হয়ে গেছে,মুখে কোনো কথা নেই তার,সাথে মুন ও
নিপার বিয়ে নিয়ে এবার সবাই ব্যস্ত হয়ে যাবে কারণ পরেরমাসেই ওর বিয়ে
ভাইয়ারা সবাই আর যাবে না,এখানেই থাকবে
একেবারে বিয়ে শেষ করে তারপর যাবে
বাসায় ফিরে মুন ও নিজ থেকে নীলের সাথে কথা বললো না আর
দুজনে নিজের মত যে যার কাজ করে যাচ্ছে
.
নীল বাসায় ফিরে রেডি হয়ে নিয়ে তার ডিউটিতেও চলে গেছে
নিপা আজ ফিরবে বাসায়,ভাবীরা সব ওর বিয়ের তৈরি নিয়ে আলোচনা করছে একসাথে বসে
মুন তার মনটা খারাপ করে নীলের বারান্দায় বসে লিচু গাছটাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে
♣
নীল অফিসে বসে ভাবছে মুনের কথা,কাল রাত থেকে মুন ও চুপ হয়ে গেলো আর সাথে আমিও
সেও কথা বলতে চায়নি আর আমিও না,আমাদের হলোটা কি??
আমি তো ওকে বকিনি,কিংবা ঝগড়া ও হয়নি
.
আসবো?
.
নীল নাকের নিচ থেকে কলমটা সরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখলো হিয়া দাঁড়িয়ে আছে
কালো কোটি আর একটা হালকা গোলাপি গাউন পরা
খোলা চুল আর মুখটা মলিন,নীলের মুখে মূহুর্তেই হাসি ফুটে গেলো
নীল উঠে দাঁড়িয়ে বললো”তা আবার জিজ্ঞেস করতে হয়?”
.
হিয়া এক পা দু পা করে আস্তে আস্তে নীলের সামনে এসে দাঁড়ালো
ওর মুখে হাসি নেই,চোখ দুটো নীলকে খুব করে দেখছে যেন কতটা বছর দেখেনি মানুষটাকে
নীলের মুখ দিয়েও কথা বের হচ্ছে না,হিয়াকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সেও থমকে গেছে
হিয়া চোখ দুটো বন্ধ করে নীলকে জড়িয়ে ধরলো আর কিছু না বলে
নীল ওকে আটকাতে পারলো না,চুপ করে শুধু দাঁড়িয়ে থাকলো সে
হিয়া তার মুখ নীলের বুকে ডুবিয়ে বললো”তোমাকে অনেক ভালোবাসি নীল,তোমার চেয়েও অনেক বেশি,আমি আর পারবো না নীল,এতবছর অনেক করেও আমি সাকিবকে মেনে নিতে পারিনি,আমার মনপ্রান সবটা জুড়ে শুধু তুমি,সাকিব আমার হাত ধরলে আমি সেই ভালোলাগা খুঁজে পাই না যেটা তুমি ধরলে পেতাম
সাকিব অনেক কেয়ার করে,অনেক ভালোবাসে যাকে বলে এক্সট্রা পারফেক্ট
তবে আমার সেই পারফেক্ট লোকটাকে চাই না
আমার শুধু আমার নীলকে চাই,যে আমাকে ভালোবাসি না বললেও আমি ঠিক টের পেয়ে যেতাম,যার গায়ের গন্ধে আমি নিরাপদ অনুভব করতাম,নীল আমি আর পারবো না এই মিথ্যে বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকতে
.
নীলের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তেই হাত উঠিয়ে মুছে ফেললো সে
মৃদু সুরে শুধু বললো”আমিও”
.
আমাদের সাথে এমন কেন হলো নীল!আমরা কি ক্ষতি করেছিলাম,আমাদের ভালোবাসায় কিসের খুঁত ছিলো?
সাকিবকে আমি মানতে পারছি না আর তুমি মুনতাহাকে মেনে নিতে পারছো না
আমার সাথে একই ঘরে সাকিবের থাকা নিয়ে তোমার প্রব্লেম না হলেও আমার হয়,আমার সহ্য হয়না তোমাকে আর মুনকে একসাথে দেখে
আমি তো তোমাকে ভালোবেসেছি,আমার কেন সহ্য হবে বলো?
তুমি তো কষ্টটাকে চাপা দিতে পারো,কিন্তু আমি যে পারি না নীল
আমার নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে,সাকিব আর আমি আজ পর্যন্ত স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে জড়ায়নি
সাকিব আমাকে জোর করেনি,আর আমার ও ওর প্রতি সেই ভালোবাসা আসে না আমি কি করবো?
জোর করে এই অনূভূতি আনানো যায় না নীল
তুমি প্লিস আমাকে মুক্ত করো এসব থেকে
আমি আর এভাবে লাইফটাকে চলতে দিতে পারি না
তোমার ভালোবাসা আমাকে শেষ করে দিচ্ছে,তুমি আমাকে এতটাই ভালোবাসো যে এখন অন্য কেউ আমাকে বাসলেও সেটা আমার চোখে পড়ে না
আমিও তো বাসি তাহলে কেন ৩য় পক্ষ আসে বারবার?
চলো না!! চলে যাই অনেক দূরে,যেখানে কেউ আমাদের খুঁজে পাবে না
নীল এক কাজ করলে কেমন হয়?আমি সাকিবকে আর তুমি মুনতাহাকে ডিভোর্স দিয়ে দিলে??
আমরা মুক্ত তাই না??আমাদের আর কোনো দায় রইলো না
আমরা আবারও একে অপরের হয়ে যাব,বলো না নীল এটা হয় না??
.
নীল হিয়ার হাত দুটো ধরে ওকে বুক থেকে সরিয়ে ফেললো তারপর নিজে জানালার কাছে চলে গিয়ে চোখের পানি মুছে নিলো
হিয়া এক দৃষ্টিতে নীলের দিকে চেয়ে আছে নীলের উত্তরের আশায়
.
নীল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললো”না,এটা হয় না !”
.
কেন হয় না নীল??
.
তাহা আমার দায়িত্ব
.
আমি কি তাহলে?
.
তুমি আমার ভালোবাসা,যাকে ছোঁয়ার অধিকারটা আমি তিনবছর আগে হারিয়ে ফেলেছি আর কখনও পাবো না
.
চাইলেই পাবে নীল,চলে না আমরা পালিয়ে যাই
.
আমি চাই না সেটা
.
কেন চাও না নীল,আমার সবকিছু তোমার,আমি সাকিবকে ছুঁতে দেই না কারণ আমি সেই কবে থেকে স্বপ্ন দেখে এসেছি আমাকে নীল ছুঁবে আর কেউ না,এটার রাইট শুধু নীলের
.
আমি তোমার হাসবেন্ড না হিয়া,যার অধিকার তাকে বঞ্চিত করতে পারে না তুমি
.
তাহলে মুনতাহাকে তুমি কেন বঞ্চিত করছো?
উত্তরটা কিন্তু একই নীল
কারণ তুমিও আমাকেই চেয়েছো,আমার জায়গায় অন্য কোনো মেয়েকে ছোঁয়ার মনমানসিকতা তোমায় হয় না
.
হিয়া তুমি চলে যাও
.
যাব না,আমি জানতে চাই তুমি কেন আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছো?ভালোবাসার কাছে আজ দায়িত্ব হেরে গেছে??
দায়িত্ব যে কেউ নিতে পারে
.
তা পালন করতে পারে কজন??তাহার সারাজীবনের দায়িত্ব আমি নিয়েছি এজ এ হাসবেন্ড,ক্লিয়ার???
.
হিয়া কাঁদতে কাঁদতে নিচে বসে গেছে,নীল জানালার গ্রিল ধরে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলেছে,হিয়ার কান্না তাকে আরও বেশি করে কষ্ট দিচ্ছে
নিজেকে আজ সে সামলাতে পারছে না
.
তার মানে তুমি বুঝাতে চাও আমার চেয়ে মুনতাহা বেশি জরুরি তোমার কাছে?
.
আমার কাছে তুমি সবচাইতে বেশি জরুরি
সবসময় ছিলে,এখনও আছো
কিন্তু তোমার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য,সারাজীবন আগলে রাখার জন্য সাকিব আছে তোমার পাশে
কিন্তু মুনতাহার কেউ নেই,ওর বাবা থেকেও নেই
মা তো সৎ মা,আর কে আছে?আমি আজ ওর দায়িত্ব থেকে দূরে চলে গেলে ওকে তুষারের মতন হিংস্র ছেলেরা একদিনও বাঁচতে দেবে না
.
ওওও!পুলিশ হয়ে এখন জনগণের সেবা এমন করে করছো??
.
হিয়া তুমি যাও প্লিস!আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো
আমিও তোমাকে ভালোবাসি তবে আমাদের দুজনের পথ দুদিক দিয়ে,আমরা কেউ কারোর নয়
আমাদের জীবনটা আরেকজনের জীবনের সাথে ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িয়ে আছে যা থেকে চাইলেই পিছু হটা যাবে না
তুমি সাকিবকে আজকেই ডিভোর্স দিতে পারবে
কিন্তু আমি মুনতাহাকে দিতে পারবো না কারণ আমি নিজের সজ্ঞানে ওকে বিয়ে করেছি,ওর দায়িত্ব নিয়েছি,আমার পুরো পরিবার ওকে মেনে নিয়েছে,এবার একটা ভুল ডিসিশানে আমি পুরো পরিবারকে ভাঙ্গতে দিতে পারি না
তিনটা বছর আগেও তোমাকে ভালোবেসে আমি হেরে গিয়েছিলাম ভাগ্যের কাছে
এখন নিজে দাঁড়িয়ে সেই ভাগ্যকে বদলানোর মতন ভুল আমি করতে পারি না
তুমি তোমার বাবার কথা রাখতে সাকিবকে বিয়ে করেছিলা
আর আমি এখন মুনতাহা ডিভোর্স দিলে আমার গোটা পরিবার আমাকে ত্যায্য করে দেবে
আজ তুমি বলতে পারবা না পরিবার বড় নাকি ভালোবাসা
কারণ সেদিন আমি তোমাকে এই প্রশ্ন করিনি, তুমি সেদিন হেল্পলেস ছিলে
আর আজ আমি হেল্পলেস
গভীর ভালোবাসা বুকে রয়ে আছে তোমার জন্য অথচ সেটা প্রকাশ করার অধিকারটুকু আমার নেই
সো! বাসায় ফিরে যাও,পারলে সাকিবকে মেনে নাও
.
হিয়া চোখ মুছে উঠে দাঁড়িয়ে বললো”তুমি পারবে মুনতাহাকে মেনে নিতে?আমার জায়গা ওকে দিতে?ওকে ছুঁতে,ভালোবাসতে?”
.
কখনও হিয়ার জায়গায় অন্য একটা মেয়ের সাথে একই বিছানায় থাকতে হবে এটাও তো ভাবিনি কিন্তু তা তো হয়ে গেলো
.
তার মানে তুমি মুনতাহাকে মেনে নিবে?
.
যে স্মৃতি গুলো দিনরাত আমার চেখের সামনে ঘুরপাক খাচ্ছে,উঠতে বসতে মনে করিয়ে দিচ্ছে আমি সেই প্রেমিক যে নিজের সব থাকতেও ভালেবাসার মানুষটাকে আপন করে পাইনি সেই আমি মুনতাহাকে মেনে নিতে পারবো কিনা জানি না
.
ঠিক এই যন্ত্রনায় আমি আজ পর্যন্ত সাকিবকে আপন করতে পারিনি,জীবনের প্রথম প্রেম কখনও ভুলা যায় না
না আমি ভুলতে পারছি
না তুমি ভুলতে পারছো
.
হ্যালো?লোকমান?দুই কাপ কফি পাঠাও আমার রুমে
হিয়া,বসো চেয়ারে!
.
সেই আগের মতন কাঁদিয়ে কফি খাওয়ানোর অভ্যাসটা তোমার গেলো না
.
নীল হাসলো,চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো”তোমার বিয়ের দিন যে ভাবে কাঁদিয়েছো আমাকে,সেটার সামনে এটা কম না??”
.
আমার হাতে কিছুই ছিলো না,আমাকে দোষারোপ কেন করছো?
.
আমার হাতে কি কিছু আছে এখন?তুমি বলো তো!
.
আমি বিয়ের পরেই বলেছিলাম ডিভোর্স দিবো সাকিবকে
কিন্তু তুমি!!আমাকে সেটা করতে দাওনি
.
এখনও দিচ্ছি না
.
কেন নীল?
.
সাকিব আমার চেয়েও ভালো ছেলে,আমার মতন তোমাকে এত কাঁদাবে না
.
আমি কাঁদতে চাই,তোমার হাতের মার খেলেও আমার সেই কষ্ট হবে না যতটা সাকিবকে নিজের স্বামী বলতে গেলে হয়
.
কফি এসে গেছে,খেয়ে নাও,তারপর যাবে
.
ফাইন!!!আমি সাকিবকে আজকে ছুঁবো!
.
অল দ্যা বেস্ট
.
তোমার কি জ্বলছে না?
.
আমি মুনতাহাকে ছুঁয়েছি,সো তুমি সাকিবকে ছুঁলে আমার সমস্যা হওয়ার কথা না
.
কোথায় ছুঁয়েছো?
.
বলা বাহুল্য না
.
বলতে হবে,নাহলে গরম কফি গিলে ফেলবো
.
কানে
.
কানে কেন ছুঁতে গেসো?
.
ভাল্লাগছিলো ওকে
.
যদি আবার ভাল্লাগে?
.
তাহলে আবার ছুঁবো,ছেলে মানুষ তো আমি,মাথা ঠিক না থাকলে তো কথাই নেই
.
আমি আজকেই প্রেগন্যান্ট হবো দেখিও,সাকিবের বাচ্চার মা
.
তাহলে অভিনন্দন,অনেক শুভেচ্ছা,একটা ফুলের তোড়া কাল তোমার বাসায় পৌঁছে যাবে
.
আমাকে সাকিব ছুঁলে তোমার কি কিছুই যায় আসবে না?
.
আমি তো ভেবেছিলাম এই তিনবছরে অন্তত দুটো বাচ্চার মা হয়ে যাবা তুমি
.
আমি যাচ্ছি
.
নীল কফিতে চুমুক দিয়ে ল্যাপটপের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলো হিয়া দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর দিকে তাকিয়ে
.
কিছু বলবে?
.
আমার উপর রাগ করে মুনতাহাকে ছুঁতে হবে না
.
আমি ওকে তোমার উপর রাগ করে ছুঁই নিই,কিছু কিছু অনুভূতির নাম হয় না,কারণ হয় না,ওসব অনুভূতি এমনি এমনি সৃষ্টি হয়
.
তুমি ওকে ভালোবেসে ফেলো নি তো?
.
লোকমান??ম্যাডামের কারের দরজা খুলে দিও!!!
.
হিয়া চলে গেলো,আর পিছন ফিরে নীলের দিকে তাকালো না
নীল হিয়ার চলে যাওয়া দেখছে জানালা দিয়ে
ফোন বেজে উঠলো ওর,মুনের কল
কানে ধরতেই ওপাশ থেকে মুন গাল ফুলিয়ে বললো”আমি ফোন করতে চাইনি,নিপা আপু বললো কল করতে,আপুর এঙ্গেজমেন্টের রিং কিনতে সবাই শপিংমলে যাচ্ছে,আমাকে বলেছে আপনার সাথে যেতে,কাইন্ডলি অফিস থেকে ফিরে আমাকে নিয়ে যাইয়েন,নাকি হিয়ার চক্করে সেটাও ভুলে যাবেন?
.
ওকে
.
নীল ওকে বলে লাইন কেটে দিয়ে হেসে বললো”তাহা তুমি জানো না! আজ তোমার জন্য! শুধু তোমার জন্য আমি হিয়াকে ফিরিয়ে দিয়েছি,আজ স্মৃতির দেয়াল নয় বরং দায়িত্বের দেয়ালের উচ্চতা সব চাইতে বেশি ছিলো তাহা!
তুমি বুঝবে না
চলবে♥