স্মৃতির দেয়াল🍁
#পর্ব_৩৯
Writer -Afnan Lara
.
ঢাকার বাহিরের একটা খোলামোলা পরিবেশের রিসোর্টে এসে পৌঁছালো দুজন
রাতের বেলা বলে গুটিকয়েক আলোর বাতি ছাড়া আর কিছুই নজরে আসলো না
মুন শাড়ীর আঁচল ঘুরাতে ঘুরাতে ঐ আলোর বাতি গুলো দেখছে
নীল রিসিপশানে কাগজপত্র ফিল আপ করছে,মাঝে মাঝে মুনের দিকেও খেয়াল করছে
কাজ শেষ করে মুনের হাত ধরে চললো সে রুমের দিকে
মুন ও চুপচাপ হাঁটছে
হাঁটতে হাঁটতে নীলকে জিজ্ঞেস করলো হুট করে এই প্ল্যান সে কেন করলো
.
নীল কিছু না বলেই চাবি দিয়ে রিসোর্টের উপরের তলার রুমটা খুললো,মুনকে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজাটা লাগাতে লাগাতে বললো”রাতে কি খাবে?”
.
আপনি যা খাবেন,রুটি কিংবা ভাত,একটা হলেই চলবে
.
ঠিক আছে,মুখ ধুয়ে আসো যাও
.
হঠাৎ মুখ ধুবো কেন?
.
যে পরিমাণ কেঁদেছো,কাজল লেপটে তোমাকে পেত্নির মতন লাগছে
.
ইস আগে বলবেন না!
.
মুন ছুটলো ওয়াসরুমের দিকে
নীল পকেট থেকে ফোন বের করে মাকে কল করে জানালো আজ তারা ফিরবে না,ডায়ালের অপশানে হিয়ার নাম্বারটা চোখে পড়তেই নীল মুচকি হাসলো,ফোন লক করে বিছানায় ফেলে গায়ের শার্টের কয়েকটা বোতাম খুললো সে
হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপর থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে ঢকঢক করে সম্পূর্নটা পানি খেয়ে নিলো
মনকে শান্ত করছে সে,,বুকে জ্বালা করছে হঠাৎ
বুকে হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে নীল চোখ বন্ধ করলো,বিকালবেলা আসিফ আর মিলনের সাথে জমিয়ে আলুর চপ আর বেগুনি খেয়েছিলো
তারই ফলস্বরুপ এই বুকে জ্বালা
চোখ খুলতেই চোখের সামনে একটা ঔষুধের পাতা দেখতে পেলো নীল
মুন হাতে নিয়ে সেটা নীলের দিকে ধরে রেখেছে,নীল বললো এটা কিসের ঔষুধ
মুন মুচকি হেসে ঔষুধটা বের করতে করতে বললো”গ্যাস্ট্রিকের”
.
পেলে কই?
.
ড্রয়ার খুললাম আর প্যারাসিটামল,পেরিসেল আর সেলাইন পেয়ে গেলাম,,নামিদামি হোটেলে এগুলোর ব্যবস্থা করা থাকে
.
তুমি না বললে জানতামই না
.
এত কথা না বলে ঔষুধটা খেয়ে নিন তো
.
নীল মুনের হাত থেকে ঔষুধটা নিতে গিয়ে থেমে গেলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য
মুন মনে হয় মুখ ধুয়ে বেরিয়েই ওর ঔষুধটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল
মুখটা ভিজে থুতনি বেয়ে পানি পড়ছে টপটপ করে,মুখের আশেপাশের চুলগুলো ও ভেজা
মুনের থেকে ঔষুধটা নিয়ে নীল চুপচাপ খেয়ে নিলো
মুন ওয়াসরুম থেকে তোয়লে খুঁজে নিয়ে মুখ মুছে ঘুরে ঘুরে রিসোর্টের রুমটা দেখছে
বেতের ডিজাইন করা বেশ সুন্দর,মনে হয় গ্রামের বাড়িতে আছি,ইউনিক আইডিয়া বটে
নীল বালিশ একটার উপর আরেকটা রেখে সেটাতে মাথা পেতে চোখ বন্ধ করে রেখেছে
মুন রুমটা দেখা শেষ করে বারান্দায় এসে ফ্লোরে গোল হয়ে বসে অন্ধকার আকাশটার দিকে তাকিয়ে আছে
চাঁদ থাকলে কতই না ভালো হতো
চাঁদ!মানে মুন,,
আমার আর চাঁদের তো ভালই সম্পর্ক
তবে ঠিক মূহুর্তে তার দেখাটা পাই না আমি, এখন চাঁদ থাকলে কিরকম রোমান্টিক মুড আসতো
চাঁদ ও নাই,ভালোবাসাও নাই
মন খারাপ করে মুন পিছন ফিরতেই আঁতকে উঠলো,নীল দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে ওর কথা শুনছিলো
মুন ঢোক গিলে বললো”এমনি বকরবকর করছিলাম,আপনি কখন এলেন”
.
নীল হাত বাড়িয়ে কাছে এসে দাঁড়ালো,মুন নীলের হাতের দিকে তাকিয়ে ভাবলো হাত কেন বাড়ালো
নীল যখন দেখলো মুন ওর হাত ধরছে না তখন সে তার হাত আরেকটু এগিয়ে মুনের হাত ধরে ওকে বসা থেকে উঠিয়ে আনলো
মুনকে কাছে টেনে বললো”আজ যদি তোমাকে আমি আমার স্ত্রীর অধিকারটা দিই, তুমি কি আমাকে মেনে নিবে?”
.
ভালোবেসে নাকি বাধ্য হয়ে?
.
ভালোবাসাটা কি জিনিস তার সমস্ত সংজ্ঞা জানা হয়ে গেছে আমার,তবে এটা বলতে পারো আজকের পর থেকে আমাদের মাঝে তুমি থার্ড পারসন খুঁজে পাবে না
ভালোবাসি কিনা জানি না তবে আমার বর্তমান এবং ভবিষ্যত শুধু তুমি,রাজি?
.
মুন নিজের হাত থেকে নীলের হাতটা ছাড়িয়ে পিছিয়ে গেলো,,গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ওর
এতদিন নীলের চোখে চোখ রেখে সে এমন প্রশ্ন করত আর আজ কিনা নীল নিজ থেকে ওকে পেতে চাওয়ায় ওর ভয় করছে
জর্জেটের শাড়ীর আঁচল দিয়ে ঘাম মুছা সহজ নয় তার পরেও আঁচল টেনে মুন নিজের কপালটা বারবার মুছে যাচ্ছে
নীল দু পা এগিয়ে পকেট থেকে সাদা রুমালটা নিয়ে মুনের কপাল মুছে দিলো
মুন আর সাত পাঁচ না ভেবে নীলকে জড়িয়ে ধরে বললো”সত্যি জীবনে প্রেম করিনি,,ভেবেছিলাম বিয়ের পর বরের সাথে প্রেম করবো,তবে আপনার প্রাক্তনের কথা শুনে মনটাই ছোট হয়ে গিয়েছিলো আমার,,আজকে কি সত্যি আপনি আমাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে চান?নাকি কাল আবারও সেই মানুষটাকে ফিরে পেলে আমাকে ভুলে যাবেন?”
.
এখন থেকে সে নাম আর তুমি আমার সাথে জড়িত পাবে না মুন,হ্যাঁ ঠিক তাকে ভালোবাসতাম,কিন্তু ভালোবাসার ভাগ অন্যের নাম হয়ে জীবনে আরেকটিবার আসে তার প্রমাণ হলে তুমি
ভালোবেসেছিলাম ঠিক তবে সেটা হিয়াকে দিতে পারিনি আমি,আমার ভাগ্যে সে ছিলো না
সেই ভালোবাসাটা তোমার প্রাপ্য কারণ তুমি এখন আমার স্ত্রী
ভাবিনি ওকে ভুলতে পারবো,তবে এতে হিয়ার ও হাত আছে
ও নিজ থেকেই সরে গিয়েছে,সাকিবকে মানতে শুরু করেছে
আর তাই তো আমার মন ও আজ এতদিনের আবেগটাকে মাটি চাপা দিতে পারলো
পারবে না আমার মনের কোণায় কোণায় নিজের নামটা ফুটিয়ে তুলতে?
তাহা জানো!আমার মনে এখন হিয়ার নাম নেই,তুমি নিজের মতন করে গুছিয়ে নিতে পারো
আমাকে সুযোগ দাও আমার ভুলটা ঠিক করার,,তোমাকে আমি অবহেলা কম করিনি
মাফ করে দিয়ে আমাকে নিজের করে নিতে পারবে না তাহা??যেমনটা শুরু থেকে করে আসছো,এত এত অবহেলা,অপমানের পরেও তুমি আজ আমার পাশে,আমার স্ত্রী রুপে আছো,,আললেই তুমি আমার জীবনের একজন সুভাগ্যবতী হয়ে এসেছো
তুমি দূর্ভাগ্যবতী হতেই পারো না,তুমি এমন একজন নারী যে একজন মন ভাঙ্গা পুরুষের মনটাকে আবারও জোড়া লাগাতে চেষ্টা করেছো এবং পেরেছো
এতদিন এটা অসম্ভব ছিলো মুনতাহা!আর আজ তা সম্ভবে পরিণত
আমি পারছিলাম না হিয়াকে ভুলতে,ওকে প্রচণ্ড ভালেবাসতাম বলে নিজের মন থেকে ওকে মুছতেই পারছিলাম না
আর যার কারণে সেদিন তোমার সাথে আমার প্রথম দেখা হয় এবং এর পর থেকে রোজ দেখা হয়,এবং একটা সময় তুমি আমার স্ত্রী হয়ে যাও
আর আজ আমি তোমাকে মেনেও নিলাম
আর কোনোদিন তাকে নিয়ে কাঁদবো না,কারণ তুমি আমায় কাঁদতে দেবে না,পারবে না তাহা?
.
মুনের খুব করে কান্না পাচ্ছে,নীলের মনে এত কষ্ট ছিলো তা বাহির দিয়ে বোঝাই যাচ্ছিলো না
এত এত কষ্টের কথা শুনে মুন নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না
ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিয়ে বললো”আমি তো শুরু থেকেই আপনার প্রেমে ঝুলার জন্য রেডি ছিলাম,আপনি তো সারাদিন ঐ হিয়ার নাম নিতেন,আমি তো শুরু থেকেই আপনাকে বোঝানোর যথাযথ চেষ্টা চালিয়ে আসছিলাম”
.
এভবে কাঁদছো কেন!বললাম তো সব শেষ,এখন এমন কেঁদে আমাকে আরও কষ্ট দিচ্ছো কি কারনে
.
বিয়ের আজ এক মাসের বেশি দিন হয়ে গেলো আজও আমি স্বামীর ভালোবাসা পেলাম না, আমার তো মাইক নিয়ে কান্না করা উচিত
.
কান্না করাই উচিত না
আসো এদিকে আসো,তোমাকে কাঁদানোর জন্য কথা গুলো বলিনি আমি,এত ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছো কেন,বসো এখানে
.
নীল মুনকে বিছানাতে বসিয়ে দুহাত দিয়ে ওর চোখ মুছে দিয়ে হাঁটুগেড়ে বসলো ওর সামনে তারপর বললো”হিয়া আর কখনও আমাকে ফোন করবে না,, আর আমিও না”
.
তাহলে দিন
.
কি?
.
যেটা আপনাকে নিজ থেকে দিতে বলেছিলাম
.
নীল ব্রু কুঁচকে উঠে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে চলে গেলো
মুন ইয়া বড় ঝটকা খেয়ে ওর চলে যাওয়া দেখছে আর ভাবছে মূহুর্তেই এত বদল,সামান্য ভালোবাসাই তো চেয়েছিলো সে
আবার চলে ও গেলো
উনি নিজেই তো বললেন আমাকে ভালোবাসবেন তাহলে এখন আবার ভাব দেখিয়ে চলে গেলেন কেন,আজব মানুষ তো!
.
নীল দশ মিনিট পর হাতে খাবারের প্যাকেট সমেত ফেরত আসলো
মুন বিছানায় থাকা একটা গোলাপ আর রজনীগন্ধাকে ওলটপালট করে দেখছে
নীল ভেতরে ঢুকে দরজা লাগাতে লাগাতে বললো”হাত ধুয়ে নাও,খাবে”
.
কথা নাই আপনার সাথে
.
আমি খাওয়াই দেব???
.
দরকার নাই,বললাম না আপনার সাথে কথা বলবো না আমি
.
ঠিক আছে বলো না,আমি একাই দু প্লেট বিরিয়ানি খেতে পারবো
.
নীল হাত ধুয়ে এসে খেতে বসে গেছে,মুন ফুলগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বললো”সবেমাত্র না বললেন আমাকে ভালোবাসতে চান,আমি অনুমতি দিলে নাকি সাথে সাথে….”
.
নীল মনযোগ দিয়ে খেয়ে যাচ্ছে
মুন এবার খুব রেগে রেগে বললো”কি বলছি কথা কানে যাচ্ছে না আপনার?”
.
খেয়ে নাও,ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে
.
খাব না,আমার কথার উত্তর চাই আমি
.
নীল তার খাবার শেষ করে এবার হাত ধুতে চলে গেলো
মুনের মেজাজ তো বিগড়ে গিয়ে শেষ সীমানায় চলে গেছে
মন চাচ্ছে নীলকে খুন করে ফেলতে
কিন্তু নাহ!এরে খুন করলে তো আর ভালোবাসা পাবো না,উল্টে বিধবা হয়ে বসে থাকতে হবে
তাহলে কি করলে রাগ যাবে আমার
.
নীল ওয়াসরুম থেকে এসে গায়ের শার্টটায় হাত দিয়ে বললো”কি বলছিলে?”
.
মুন গোলাপটা হাত থেকে ফেলে এক ছুটে খেতে বসে গেছে ততক্ষণে
নীল হাসতে হাসতে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো
মুন গপাগপ তার বিরিয়ানি সাবাড় করতে করতে ভাবলো
নীলের মনের ভেতর ঠিক কি চলছে এখন
আদৌ আমাকে ভালোবাসবে নাকি বাসতে গিয়েও সেই হিয়াকে ভেবে টাসকি খেয়ে বসে থাকবে
খোদা জানে কপালে কি আছে,এই লোকটাকে বিশ্বাস নাই
.
খাওয়া শেষ করে মুন খুশিতে আটখানা হয়ে হাত ধুয়ে এসে দেখলো নীল ঘুমে কাতর
মুখটা ফ্যাকাসে করে মুন নীলের কাছে এসে বসলো,তারপর ভাবলো আজ কাজ বেশি হয়ে গেছে বলে হয়ত ঘুম আটকে রাখতে পারলেন না উনি
রাগ না করে নীলের একটা হাতকে জড়িয়ে মুন নীলের পাশেই শুয়ে পড়লো
মিনিট পাঁচেক পর মুন খেয়াল করলো নীল ওর চুল নিয়ে খেলছে,হাতে নিয়ে গোল গোল করে পেঁচাচ্ছে
মুন মাথা তুলে বললো”ঘুমের একটিং করা হচ্ছিলো তাহলে?”
.
একটু একটু,দেখলাম আমাকে ঘুমোতে দেখে তোমার কেমন রিয়েকশান হয়
.
তাহলে আমি এবার সত্যি সত্যি ঘুমাচ্ছি,বাই
.
তাহলে আর কি করার আমিও আমার সেই পুরোনো…
.
কথা শেষ করার আগেই মুন উঠে বসে চোখ বড় বড় করে বললো”কি করবেন?আবারও সেই?”
”
.
না,তার কথা মনে করবো না,তবে আরেকটা বিয়ে করলে
??
.
আপনি জানেন!আপনি খুব খারাপ একটা লোক,এত কষ্টে আপনার মন থেকে আপনার প্রাক্তনকে সরালাম আমি আর আপনি কিনা এখন আবার আরেকটা বিয়ের কথা বলছেন!আমি তাহলে তুষারকে বিয়ে করে নেবো দেখিয়েন
.
নীল মুনের চুলগুলো একসাথ করে ধরে কাছে টেনে এনে বললো”খবরদার!”
.
কেন কি করবেন শুনি!আপনার তো আরেকটা বিয়ে করার কথা
তাহলে আমি বরং সাকিব আর তুষারকে একসাথে বিয়ে করে এক ধাপ বেশি করে দেখিয়ে দেবো আপনাকে
চলবে♥