স্মৃতির দেয়াল🍁
#পর্ব_৪১
Writer -Afnan Lara
.
স্মৃতির দেয়ালটা এবার যেন স্মৃতির পাতা হয়ে গেছে
এক পাতা এক পাতা করে উঠছে আর পুরো গল্পটা যেন শেষের দিকে যাচ্ছে
যাকে নিয়ে পুরো গল্পটা সে আজ মন খারাপ করে রুমের জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে
তার মন খারাপের কারণ নীল নয়,,কিংবা তার অসুখটাও নয়
বরং সাকিব,,কারণ সাকিব তাকে আজ বকেছে,কারণটা হলো হিয়া জোর করে সকল বাধা নিষেধ উপেক্ষা করে হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরে চলে এসেছে,যার কারণে সাকিব তার উপর প্রচণ্ড রেগে আছে
হিয়ার ধারনা মরেই তো যাবো তাহলে কেন শুধু শুধু হসপিটালের ঐ বিষাদ রঙের ফার্নিচার দেখে মরবো??
.
সাকিব হসপিটালে এখন,,ডাক্তারের সাথে কথা বলছে কেনো ভাবে বাসায় ট্রিটমেন্ট করতে পারবে কিনা তা নিয়ে
মোটা অংকের ফিস দিয়ে দুজন নার্স সমেত সাকিব ফিরলো বাসায়
হিয়া ওদের দিকে ব্রু কুঁচকে চেয়ে বললো”আমার বাসায় আমাকে শান্তিতে থাকতে দিবেন না আপনি?”
.
না দেবো না,দরকার হলে এই নার্সের সাথে আমিও তোমার খেয়াল রাখার জন্য সারাক্ষণ তোমার সামনে সামনে থাকবো
.
হিয়া আর কিছু বললো না,চুপচাপ বিছানায় এসে বসে পড়লো,,তার অসুখের খবর জানার আজকে এক মাস পূর্ন হয়েছে,,নীলের সাথে সকালে কথা হয়েছিলো
নীল এখন মুন সহ কথা বলে,নীলের সাথে কথা বলার সময় মুন ও এক দু লাইন বলে ফেলে
ওদের দুজনকে এরকম হ্যাপি থাকতে দেখে হিয়ার ও ভাল্লাগে
সে সাকিবের দিকে প্রাণভরে চেয়ে থাকে,আর সাকিব সে তো আজকাল মহা ব্যস্ত মানুষ
দিনে চারবার হসপিটালে দৌড়াদৌড়ি করতেই হয় তাকে
এখন যেন না গেলে হয় না,অভ্যাস মতন হয়ে গেছে
♣
নীল দুপুরে ঘুমাচ্ছিল হঠাৎ ভারী বাতাসে কি যেন নিচে পড়ার আওয়াজে তার ঘুম ভেঙ্গে গেলো,নিজের পাশে মুনকে দেখতে না পেয়ে উঠে বসলো নীল,এপাশ ওপাশ চেয়েও মুনকে না দেখে চিন্তা হলো
দুপুরবেলা আবার কোথায় যেতে পারে,নীল টিশার্ট পরতে পরতে বাসার বাহিরে চলে আসলো,আসার সময় রান্নাঘর,মায়ের ঘর ও চেক করলো,এমন কি নিপার রুম ও
তাহলে মেয়েটা গেলো কোথায়??
.
বাগানে এসে রোদ চোখে পড়তেই নীল কপালের উপর হাত তুলে ছায়া আনলো তারপর সোজা সামনে তাকিয়ে হেঁটে গেট পর্যন্ত এসে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলো মুনকে দেখেছে কিনা
দারোয়ান জানালো মুন নাকি আজ কয়েকদিন ধরে এ সময়ে এদিকে হেঁটে কোথায় যেন যায়
নীল তাই সেদিকেই গেলো,এদিকটায় তো মুনদের বাসা
কিন্তু ও তো ওর মায়ের ভয়ে বাসায় যাবে না তাহলে কোথায় যায়
কিছুটা পথ এসে তুষারের বাবার সেই তালাবন্ধ জমিখানার সামনে থেমে গেলো নীল
মুন সেই আবারও আগের মতন বাচ্চা কতগুলো নিয়ে বাউন্ডারি টপকে ভিতরে ঢুকছে,নীল যখন ওখানে পৌছালো ততক্ষণে তার বউ ভিতরে ঢুকেও গেছে
নীল মাথায় হাত দিয়ে বললো”বিয়ে হয়ে কদিন পর বাচ্চার মা হয়ে যাবে আর সে কিনা এখনও বাঁদরামি ছাড়লো না”
.
বাচ্চাগুলো নীলকে দেখে বাতাসের গতিতে ছুটে পালিয়েছে
মুন এক এক করে আম পেয়ারা নিচ্ছে আর এদিকে ছুঁড়ে মারছে
নীল এক এক করে ক্যাচ নিচ্ছে সব
মুন সব শেষে আবারও বাউন্ডারি টপকে নিচে নামতে নামতে বললো”পিনু তিনু!!!ঠিকমত সব কুড়িয়ে নিয়েছিস তো?আমি কিন্তু ৮০% নেবো,তোরা ভয়ে ভেতরে যাস নাই এটা তোদের দোষ,কি হলো কথা বলছিস না কেন?”
.
আঁচল কোমড় থেকে ছুটিয়ে শাড়ীটা ঠিকঠাক করতে করতে মুন পিছনে তাকিয়ে এক প্রকার ঝটকা খেয়ে দেয়ালের সাথে লেগে পড়লো
.
কি??এসব করো আমি ঘুমালে?
.
না মানে,শুধু আজকেই
.
আমি খবর পেয়েছি তুমি কদিন ধরে এমন আসছো এদিকে
তোমাকে কতবার মানা করলাম এরকম গাছে চড়ো না
তাই তো বলি ঐদিন পায়ে ছড়ে যাওয়ার দাগ কোন দেখেছিলাম তোমার
বাঁদরামি ছেড়ে একটু ভদ্র হও,কদিন পর আমার বেবির মা হবে,একটু ম্যাচিউর হও
.
হবো,আগে মা হই তারপর,আম খাবেন?
.
তোমায় খাব
.
নীল মুনের হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে,মুন বাচ্চাগুলোকে দূরের গাছের পিছনে দেখতে পেয়ে চোখ মেরে ইশারা করে দিলো
তার ইশারার মানে হলো পরে আম পেয়ারা ভাগ করে দেবে,আজ আর সম্ভব না
.
নীল হাঁটতে হাঁটতে বললো”আমার মতন এমন ভদ্র ছেলের কপালে কিনা এমন বাঁদর মেয়ে জুটলো,ভাবতেই অবাক লাগে আমার বাবুর মা কিনা গাছে গাছে থাকে দিনের বেশিরভাগ
এখন থেকে এই স্বভাব পাল্টাও,নাহলে পরে দেখবে আমার বেবিও এমন গাছে উঠার জন্য বায়না ধরবে
.
এত করে বকছেন কেন?ছোটবেলা থেকে এগুলো করেই বড় হয়েছি আমি
.
তো?এখন আর সেই ছোট না তুমি,আমি আর একদিন তোমায় গাছে দেখলে একদম রাঙামাটিতে ট্রান্সফার হয়ে চলে যাব
.
না না,সেটা করবেন না,আচ্ছা আমি আর গাছে উঠবো না
.
হুম,গুড গার্ল,এবার চলো ঘুমাবে
.
আম আর পেয়ারা খাব না?
.
নাহারকে দিয়ে লবণ মরিচ সহ আনিয়ে নেবো,চলো এখন
.
ঠিক আছে
♣
মুন নীলের পাশে গোল হয়ে বসে এক টুকরে আম লবণ মরিচে ডুবিয়ে মুখে দিয়ে চোখ আর ঠোঁট খিঁচিয়ে ফেলছে
আর নীল মুগ্ধ হয়ে তা দেখছে
এত সুন্দর করেও কেউ আম খেতে পারে তা জানা ছিলো না
প্রতিদিন একটু একটু করে নীল মুনতাহাকে জানছে,যেন জানার শেষই নেই
নীলের প্রতি মুনের আর একটা অভিযোগ ও নেই,নীল এখন ওকে এতটা ভালোবাসে যে ওর বিয়ের পরের প্রেম করার শখ মিটে এখন হোল স্কয়ার হয়ে গেছে
নীল মাঝে মাঝে ওর হাত চেপে ধরে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে
কিছু বলে না,মুন তার আরেক হাত নীলের চোখের সামনে ধরে নাড়াচাড়া করে তাও নীল চোখের পলক ফেলে না
এত কিসের মুগ্ধতা তাই ভেবে মুন নিজেকে আয়নায় দেখে আর নিঁখুত করে নিজের পুরো বডিপার্ট দেখে
কিন্তু মনে হয় কই আমি তো আগের মতই,তাহলে নীল এত কি দেখে??
পুলিশের বউ হয়ে একটা লাভ হয়েছে,কোথাও গেলে কেউ দেখলে বলে ভাবী ভালো আছেন?,নীল স্যার কেমন আছে হ্যানত্যান
নিজেকে সেলিব্রেটি মনে হয় তখন
ইস আমাকে সবাই চেনে!
♣
হিয়ার মন চায় দূরে কোথাও থেকে ঘুরে আসতে,,কিন্তু সাকিবের কড়া নিষেধ
সে বলে হসপিটাল চেঞ্জ করে বাসায় থাকতেছো এটা মেনেছি দ্যাটস্ এনাফ,কিন্তু ট্যুরে যাওয়ার কথা ভুলেও মুখে আনা যাবে না
হিমু আর তার মায়ের, সাথে সাকিবের বড় বোনের অনুরোধে একটা সময়ে সাকিব রাজি হলো হিয়াকে নিয়ে দূরে কোথাও য়েতে
ঘুরতে যেতে নয়,,,চিকিৎসা ঠিক ভাবেই চলবে কিন্তু জায়গা বদল হবে,যাকে বলে হাওয়া বদল,ডাক্তার ও মত দিলেন
ঠিক হলো তারা বিদেশে যাবে,সেখানের চিকিৎসা উন্নত মানের সাথে জায়গা বদল ও হয়ে যাবে
সাকিবের টাকা নিয়ে চিন্তা ছিলো না
তার বোন আর সে,,বাবা মা নেই,,সকল সম্পত্তি তারা দুজনে ভাগাভাগি করে নিয়েছে,,আর সাকিব হিয়াকে কতটুকু ভালোবাসে তা সে দেখিয়ে দিয়েছে হিয়ার ট্রিটমেন্ট শুরুর দিন থেকে,প্রতিবার মোটা অংকের ফিস দিতে হয়,,কখনও হাজারের ঘরে নামে না সেই সংখ্যা
সাকিব হাসিমুখে সবটা পূরণ করে যাচ্ছে,,তবে একটা রহস্য যেটা কিনা হিয়া জানে না
আর সেটা হলো হিয়ার চিকিৎসায় নীল নিজের একাউন্ট থেকেও টাকা দিচ্ছে,কথাটা সাকিব আর মুন ছাড়া আর কেউ জানে না
সাকিব একা আর কত টাকা দিবে,ওর সকল কিছু হিয়াকে নিয়েই,ও পারে না নিজেকে বিলিয়ে দেয়
তবে বিদেশ যাওয়ার খরচে তার বড় বোন সাহায্য করেছিলো তাকে,,
কাল বাদে পরশু রওনা হবে তারা,,সাকিব আর হিয়া
.
হিয়ার মনে অনেক আনন্দ,আবার কষ্ট ও আছে,কারণ সে জানে না এ দেশ ছেড়ে গেলে আর কখনও ফিরে আসতে পারবে কিনা,কারণ তার জীবনের তো ঠিকঠিকানা নেই কোনো
সাকিব বড় আপুর হাত ধরে বসে আছে সন্ধ্যা থেকে
বোন থেকে এত দূরপথে পাড়ি দেবে তাই মন খারাপ তার,আপু ওকে বুঝাচ্ছে যে সে যেন হার না মানে
তিনি জানেন সাকিব হিয়াকে কতটা ভালোবাসে তাই তিনিও চান হিয়া সুস্থ হয়ে উঠুক, হিয়া সেরে ওঠা মানে তার ভাইয়ের মুখে সেই চিরচেনা হাসি ফুটে উঠবে
তাই তিনি তার সাধ্যমতন সবটা চেষ্টা করছেন হিয়াকে বাঁচাতে
♣
নিপার বিয়ের ডেট পিছিয়ে ছিলো এতদিন,নিপা নিজেই পিছিয়ে দিয়েছিলো,কারণ সে চায় না তার বিয়েতে তার প্রিয় ভাইয়া মন খারাপ করে থাকুক
তবে এখন নীলকে হাসিখুশি দেখে নিপা বিয়েতে রাজি হয়েছে
পরের সপ্তাহে ওর বিয়ের আয়োজন শুরু হবে
ভাইয়া ভাবীরা যে যার বাসায় চলে গিয়েছিলো,নিপার বিয়ের খবর শুনে এখন আবার আসবে সবাই
বাসাটা আবারও হইহই রইরইতে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে
.
মুন আজ নিপার রুমে এসে নিপার হাতে সাজছে,,নীলকে সারপ্রাইজ দেবে বলে
নীল এখনও ডিউটি থেকে ফেরেনি,,আজকে সন্ধ্যা থেকে ডিউটি
রাত ১০টার দিকে ওর জিপের আওয়াজ শুনতে পেয়ে মুন এক দৌড়ে ওর রুমে ঢুকে লাইট অফ করে দিলো
নীল রুমে ঢুকতেই অন্ধকার দেখে অবাক হলো,কারণ এখানে মুন থাকার কথা,আর মুন থাকলে আলো থাকবে তাহলে আলো কই,মুন কই?
.
লাইটে হাত দিয়ে জ্বালাতেই মুন সামনে এসে বললো”সারপ্রাইজ!! ”
.
নীল চোখটা বড় করে মুনকে দেখছে,,আগের মতনই লাগে তবে চোখের কোণায় আই লাইনার আর চুলে কার্লটা নতুন
নীল মুচকি হেসে বললো”ভালোই”
.
শুধু ভালোই?আর কিছু না?
.
চুল সোজাই ভালো ছিলো,বাঁকা করতে গেলে কেন?
.
স্টাইল,তিরিশ মিনিট লেগেছিলো,একটু সুন্দর করে প্রশংসা করুন না
.
করলে?কি হবে?কেউ দেখবে নাকি শুনবে
.
তাহলে নিপা আপুকে বলতে পারবো উনার পরিসশ্রম সফল হয়েছে
.
নিপাকে বলিও ওর কপালে মাইর আছে,আমার এত সুন্দর প্রাকৃতিক বউকে কিনা কৃত্রিম বানিয়ে দিলো
.
মুন ব্রু কুঁচকে চুলকে এক টান দিয়ে সোজা করে বললো”নিন এবার ঠিক আছে?”
.
এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খাওয়াও তো,কিছু জরুরি কথা আছে
.
কি কথা?
.
আগে পানি
.
মুন এক দৌড়ে পানি নিয়ে আবার ফেরত আসলো
নীল গায়ের পোশাক পাল্টে বাসার একটা টিশার্ট পরছে
মুন গ্লাসটা এগিয়ে ধরে বললো”বলুন না কি বলবেন?”
.
নীল পানিটা খেয়ে নিয়ে মুখ মুছে বললো”খুব করে তৃষ্ণা পেয়েছিলো,,তুমি যে সাজ দিয়েছিলো,আমার মুখ দিয়ে হাজার খানেক প্রশংসা শোনা পর্যন্ত আমাকে খাবার খাওয়া থেকে বিরত রাখতে,,তাই তোমাকে দিয়ে হাই স্পীডে পানি আনানোর জন্য বললাম জরুরি কথা আছে
তো জরুরি কথাটা হলো”কিছুই না,এপ্রিল ফুল,হেহহেহে!!”
.
মুন রেগে গজগজ করে নীলের শার্ট খাঁমছে ধরে বললো”বল আমায় কেমন লাগছে নাহলে ডিনারের “ড” ও জুটবে না আজ”
.
আরে আরে করছো টা কি!!!জেলে পুরে দিব কিন্তু
.
আগে এই রুম থেকে বেরিয়ে দেখাও তারপর জেলে পুরিও,শয়তান পুলিশ কোথাকার
.
আচ্ছা সরি,বলছি তোমায় কেমন লাগছে,তোমায় আজ বেশ লাগছে, আসো এই খুশিতে বুকে জড়িয়ে ধরি
.
মজা করছেন না তো?
.
আরে না,কিসের মজা,,আসো বুকে আসো
.
নীল মুনকে কাছে টেনে বললো”আমার কাছে তুমি এমনিতেই সুন্দর,তা ঘটা করে সাজার কারণটা কি শুনি?”
.
এমনি ভাবলাম আপনাকে একটু সারপ্রাইজ দিই
চলবে♥