আরশিযুগল প্রেম পর্ব – ৬৩
# লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা
সন্ধ্যার শেষ কিরণটা পশ্চিমের দিগন্তে গা ঢাকা দিয়েছে মাত্র। ব্যস্ত,ক্লান্ত পাখিরা রক্তিম আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে বাড়ি ফেরার তাড়নায়। আকাশে মেঘ নেই। বাতাসে শীতের দাপটও নেই। চারপাশটা গাড়ির তীক্ষ্ণ হর্ন আর চাকার ঘর্ষণে মুখরিত। রাস্তার এখানে সেখানে বাসন্তী শাড়ি আর পাঞ্জাবি পরিহিতা প্রেমীযুগলের প্রেমময় দৃশ্য। ঠোঁটের কোণে ভরসার হাসি। চোখে-মুখে নীরব অহংকার। পৃথা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হাতে হাত রাখা উচ্ছল প্রেমীযুগলকে দেখে কোথাও একটা আফসোস, ঈর্ষা আর ভালো লাগার তীব্র অনুভূতি হলো। মুখের কোণে অজান্তেই একটা কালো মেঘ হানা দিলো। ততক্ষণে শহরের বাতাসে রাত নেমেছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা নির্ভীক ল্যাম্পপোস্টগুলো জ্বলে উঠেছে। এই ভর সন্ধ্যায় পৃথার হঠাৎ করেই নিজেকে খুব একা, অসহায় বলে বোধ হচ্ছে। রাস্তার ধারে ছুঁটে চলা চা-কফি বিক্রেতা ওই ছোট্ট ছেলেটার থেকেও অসহায়। উটকো। মূল্যহীন। বুকের ভেতর পরিচিত এক কষ্ট উলোটপালোট মালা গাঁথছে। পৃথা অস্থির চোখে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। একটা সিএনজির জন্য ভেতরের ভীত মনটা ক্রমেই উদগ্রীব হয়ে উঠছে । ঠিক তখনই সামনে এসে দাঁড়াল একটি রিকশা। পৃথা চমকালো। রিকশায় বসে থাকা লোকটিকে দেখে হৃৎস্পন্দনটা কয়েক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। তারপর আবারও তুমুল গতিতে ছুটতে লাগল হৃৎস্পন্দন। রিকশায় বসে থাকা সুন্দর দেখতে লোকটি কপাল কুঁচকাল। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল,
—-‘ আরে আপনি?’
পৃথা থম ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। প্রথম দফায় কোনো উত্তর দিতে পারল না। শুকনো কন্ঠনালিতে কোনোরূপ শব্দ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই লোকটিকে দেখলে পৃথার সবকিছুই এলোমেলো হয়ে যায়। শব্দ,কথা,জীবন, স্বপ্ন সব। পৃথা দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো। হাসার চেষ্টা করে বলল,
—-‘ জ্বি।’
শুভ্রবের বিস্মিত কন্ঠস্বর,
—-‘ রাতের বেলা এখানে কি করছেন? কেউ আছে নাকি সাথে?’
পৃথা ঘাঁড় নেড়ে অসম্মতি জানালো। শুভ্রব তীর্যক কন্ঠে বলল,
—-‘ একা? ‘
—-‘ জ্বি।’
—-‘ ও আচ্ছা।’
কথাটা বলে ডানহাতের কব্জিতে থাকা হাত ঘড়ির দিকে তাকাল শুভ্রব। শান্ত গলায় বলল,
—-‘ বাড়ি ফিরবেন কখন?’
—-‘ সিএনজি খুঁজছি। পেলেই বাসায় ফিরব।’
শুভ্রব ছোট্ট করে উত্তর দিল,
—-‘ ও।’
শুভ্রব কথাটা বলল ঠিক কিন্তু রিকশা চালককে যাওয়ার অনুমতি দিল না। ধানমন্ডি থেকে বনানী খুব একটা কাছে নয়। জ্যামে পড়লে দুই/আড়াই ঘন্টা লেগে যাবে অনায়াসে। রাতের বেলা যুবতী মেয়েকে একা ছেড়ে দেওয়া কোনো পুরুষোচিত কাজ নয়। আর মেয়েটি যদি হয় নিকটাত্মীয় তাহলে তো কখনোই নয়। শুভ্রব ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে রিকশা থেকে নেমে দাঁড়াল। রিকশা ভাড়াটা মিটিয়ে দিয়ে বলল,
—-‘ চলুন। আমি পৌঁছে দিচ্ছি।’
শুভ্রবের কথায় পৃথার গোটা পৃথিবীটাই যেন দোলে উঠল। হাত-পা কাঁপছে। লোকটি কি সত্যিই তাকে পৌঁছে দেবে? সত্যিই? সিএনজিতে তার পাশের সিটটাতেই বসবে? লোকটির গায়ের অদ্ভুত সুন্দর গন্ধটা নাকে এসে লাগবে? পৃথার বিশ্বাস হয় না। সবই কেমন স্বপ্ন আর কল্পনার মিশেল এক অদ্ভুত তত্ত্ব বলে বোধ হয়। শুভ্রবকে নিয়ে এসব ভাবনায় পৃথার নিজেকে আবারও ছ্যাঁচড়া, সস্তা মনে হতে লাগল। নিজেকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করে বলল,
—-‘ না, না। ঠিক আছে। আমি পারব। সমস্যা নেই।’
শুভ্রব পৃথার কথার উত্তরে অল্প হাসল। বলল,
—-‘ পারবেন জানি। তবুও, আপনাকে পৌঁছে দেওয়াটা আমার দায়িত্ব। আপনি দাঁড়ান আমি সিএনজি দেখছি।’
পৃথাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সিএনজির জন্য পা বাড়ালো শুভ্রব। বড় বড় পা ফেলে মুহূর্তেই হারিয়ে গেল ভীড়ে। পৃথার বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো হতাশামাখা দীর্ঘশ্বাস। মনে মনে করা প্রার্থনাটাকে বাস্তবে রূপ নিতে দেখেও খুব একটা খুশি হতে পারল না সে। আজ পহেলা ফাল্গুন। ভার্সিটিতে অনুষ্ঠান ছিল বিধায় বান্ধবীদের চাপে পড়েই বাসন্তী শাড়ি পরতে হয়েছিল তাকে। শাড়ি পরার পরমুহূর্তে থেকেই মনে মনে শুভ্রবের সাক্ষাৎ কামনা করছিল সে। মনে মনে প্রার্থনা করছিল, শুভ্রব এই শাড়ি পরিহিতা পৃথাকে দেখুক। মুগ্ধ হোক। কিন্তু শুভ্রব তার গায়ের শাড়িটা খেয়ালই করল না। ভালো করে তাকাল না পর্যন্ত। কয়েক মিনিটের মাথায় সিএনজি নিয়ে এলো শুভ্রব। পৃথাকে উঠে আসতে বলে নিজে ড্রাইভারের পাশের সিটটাতে গিয়ে বসল। আবারও ভাবনায় ছন্দপতন হলো পৃথার। বুকের ভেতর সুপ্ত অভিমানগুলো ফুঁসে উঠল। লোকটি কি তারপাশে বসতে পারত না? তার শরীরে কি গন্ধ আছে? সে কি পাশে বসার মতো যথেষ্ট সুন্দরী নয়? বনানী পৌঁছানো পর্যন্ত দু’জনের মাঝে ‘হু হা’ ধরনের কথাবার্তাও চললো না। সাদাফদের বিল্ডিংয়ের সামনে পৃথাকে নামিয়ে দিয়ে মৃদু হাসল শুভ্রব। ক্লান্ত গলায় বলল,
—-‘ যান তাহলে। আমি আসি।’
—-‘ অতদূর এলেন, নিজের বোনটাকে এটলিস্ট দেখে যান।’
শুভ্রব অপ্রস্তুত হাসল। এই মুহুর্তে কারো সাথেই দেখা করতে ইচ্ছে করছে না তার। ছোট্ট একটা মেয়ে এতো বড় পেট নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখতে ভীষণ উইয়ার্ড লাগে শুভ্রবের। তাছাড়া শরীরটাও ভীষণ ক্লান্ত। শুভ্রব নম্র গলায় বলল,
—-‘ অন্যদিন আসব। আজ থাক।’
—-‘ ভাবির যে ডেলিভারি ডেইট পড়েছে জানেন?’
—-‘ তাই নাকি? শুনিনি তো। আজ চেক-আপ ডেইট ছিল। ডক্টর কি বলেছে জানা নেই।’
—-‘ একমাস পরই ডেইট। আমার ভীষণ আনন্দ লাগছে।’
শুভ্রব হাসল। বুকের ভেতর তীব্র অনুভূতির তরল ঢেউ খেলে গেল। শুভ্রতার বাচ্চাটার জন্য সেইও তো কম অপেক্ষা করছে না। সেই ছোট্ট শিশুটিকে ঘিরে রয়েছে কতগুলো মানুষের তীক্ষ্ণ প্রতীক্ষা, আশা, স্বপ্ন। শুভ্রব মৃদু গলায় বলল,
—-‘ ওকে একটু দেখে রাখবেন। আসছি। মামা চলো।’
ইঞ্জিনে তুমুল শব্দ তুলে মুহূর্তেই রাস্তার মোড়ে হারিয়ে গেলো শুভ্রবের সিএনজিটা। পৃথার আবেগ, ভালোবাসা তাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারল না। পৃথা রাস্তার মোড়টার দিকে উদ্দেশ্যহীন তাকিয়ে রইল। বুকের ভেতর থেকে একের পর একে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। মনের মাঝে একটা প্রশ্নই বাজতে লাগল বরংবার, এই লোকটিকে কি আদৌ বাঁধতে পারবে পৃথা?
______________________
বিছানার ওপর রঙ বেরঙের সুতোর গুটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শুভ্রতা বালিশে ঠেস দিয়ে বসে কুশি কাটায় ফুল তুলছে। প্রেগনেন্সির জন্য আগের থেকেও গোলগাল হয়ে উঠেছে তার মুখ। ফর্সা টসটসে মুখটাতে একটা ‘মা’ ‘মা’ ভাব চলে এসেছে। সাদাফ সোফায় বসে অফিসের ফাইল ঘাটছে। মাঝে মাঝেই চোরা চোখে শুভ্রতাকে দেখছে। কিছুদিন যাবৎ শুভ্রতাকে অতিরিক্ত সুন্দর লাগছে। শুভ্রতার হঠাৎ এই মাত্রারিক্ত সৌন্দর্যের কারণটা সাদাফের কাছে স্পষ্ট নয়। বেশ কিছুক্ষণ শুভ্রতার গোলগাল আদুরে মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন ছুঁড়লো সাদাফ,
—-‘ এই মেয়ে? কি করছ?’
শুভ্রতা চোখ তুলে তাকাল। কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিতে দিতে বলল,
—-‘ টুপি বানাচ্ছি।’
—-‘ টুপি? কার জন্য? তুতুনের কয়টা লাগে? মা না সেদিন বানিয়ে পাঠাল?’
—-‘ এটা তুতুনের জন্য নয়। আরহামের জন্য।’
সাদাফের পুরু ভ্রু খানিকটা কুঁচকে এলো।
—-‘ আরহাম? আরহাম কে?’
—-‘ তনুর ছেলে।’
সাদাফের বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল,
—-‘ তনয়ার ছেলে হয়েছে নাকি? কবে হলো? বলো নি তো।’
শুভ্রতা অবাক হয়ে বলল,
—-‘ বলি নি? ইশ! একদম ভুলে গিয়েছিলাম। বাচ্চার প্রায় দু’মাস হতে চলল আর আমি তোমাকে জানাই নি!’
সাদাফের বিস্ময় এবার আকাশ ছুঁলো। চোখ বড় বড় করে বলল,
—-‘ দু’মাস! বলো কি? ‘
শুভ্রতা মন খারাপ করে বলল,
—-‘ দেখেছ? কেমন ভুলো মন হয়ে গিয়েছি আমি। দু’মাস আগে বান্ধবীর বাচ্চা হয়ে গিয়েছে অথচ সেই খবর আজ দিচ্ছি তোমায়। আমি কি পাগল টাগল হয়ে যাচ্ছি নাকি, বলো তো?’
সাদাফ হাসলো। সোফা থেকে উঠে এসে শুভ্রতার পাশ ঘেঁষে বসল। শুভ্রতাকে আলতো আদর করে বলল,
—-‘ সেসব কিছু না। প্রেগনেন্সিতে এমনটা মাঝে মাঝে হয়।’
শুভ্রতা সাদাফের সাথে খানিকটা ঘনিষ্ঠ হয়ে বলল,
—-‘ আমার মনটা ভীষণ খারাপ।’
সাদাফ শুভ্রতাকে ছেড়ে দিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। শুভ্রতাকে আগাগোড়া নিরক্ষণ করে বলল,
—-‘ দেখে তো মনে হচ্ছে না। কিন্তু, মন খারাপ কেন?’
শুভ্রতা আধো মুখে বলল,
—-‘ সামনের মাসের শেষের দিকে অর্পণের বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিয়ের পর বরের সাথে অস্ট্রেলিয়া চলে যাবে অর্পণ। তাই, বিয়ের আগে পুরাতন ঢাকায় ওদের যে ফ্ল্যাটটা আছে সেখানে সব বান্ধবীরা একত্রিত হবে। তনুও আসবে। সাথে ওর হাজব্যান্ডও। ইভেন, প্রেমার কালাচানও আসবে।’
—-‘ তো? এখানে মন খারাপের ব্যাপারটা কি? সবাই একত্রিত হচ্ছে এ তো ভালো কথা।’
শুভ্রতা মন খারাপ করে বলল,
—-‘ একটুও ভালো কথা নয়। আমি যেতে না পারলে সেটা ভালো কথা কি করে হলো? শাশুড়ী মা স্ট্রিক্টলি জানিয়ে দিয়েছেন শেষ মাসে উড়নচণ্ডীর মতো ঘুরে বেড়ানো চলবে না। প্রেগনেন্ট মেয়েদের লোকসম্মুখে কম যাওয়ায় ভালো। নজর টজর লাগে নাকি।’
সাদাফ শব্দ করে হেসে উঠল। বলল,
—‘ ধুর! ওসব তো কুসংস্কার। এই ছোট্ট বিষয়ে মন খারাপ করতে হয় নাকি?’
—‘ কুসংস্কার হোক আর যায় হোক। মা তো মানা করে দিয়েছে নাকি?’
সাদাফ খানিক ভেবে বলল,
—‘ এই মাসটা আপাতত যেতে দাও। দরকার হলে আমি নিজেই নিয়ে যাব তোমাকে। মা জানতে পারবে না।’
শুভ্রতা খুশি হয়ে বলল,
—‘ সত্যি?’
শুভ্রতার খুশি দেখে হাসল সাদাফ। কপালে ছোট্ট চুমু একে দিয়ে বলল,
—‘ সত্যি। এখন ঘুমাও। আমার একটু কাজ আছে।’
শুভ্রতা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা দুলালো। সুতোর গুটিগুলো জড়ো করে বেড টেবিলে রাখল। সাদাফের ফর্সা মুখটির দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতর অদ্ভুত এক গর্ব কাটা দিয়ে উঠল।
রাত প্রায় দুটো। বসার ঘরের আলো ব্যতিত প্রতিটি ঘরেই খা খা অন্ধকার। আলোতে শুভ্রতার ঘুমের ব্যঘাত ঘটতে পারে ভেবে বসার ঘরেই ফাইল পত্র নিয়ে বসেছে সাদাফ। কোলের ওপর ল্যাপটপ রেখে অফিসের হিসাব-নিকাশ করছে। হঠাৎই ডানদিকের ঘরটাতে আলো জ্বলে উঠলো। কিছুক্ষণ চটির চটচট শব্দ শোনা গেল। তারপরই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো পৃথা। পৃথা ধীর পায়ে সাদাফের পাশে সোফায় এসে বসল। সাদাফ একবার চোখ তুলে তাকিয়ে আবারও ল্যাপটপে মন দিল। ভ্রু কুঁচকে বলল,
—-‘ কি ব্যাপার? এখনও ঘুমাস নি কেন?’
—-‘ ঘুম আসছিল না।’
সাদাফ এবার পূর্ণদৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকাল। পৃথার চোখ-মুখ শুষ্ক। মাথার চুল অগোছালো, এলোমেলো। দৃষ্টি অস্থির। সাদাফ বোনকে ভালোভাবে নিরক্ষণ করে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। বলল,
—-‘ হঠাৎ ঘুম আসছে না কেন? কি হয়েছে? ‘
পৃথা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে ফট করেই প্রশ্ন করল,
—-‘ আমি কি সুন্দরী নই ভাইয়া? ‘
সাদাফ এমন কোনো প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না। বিস্মিত চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে ধমক দেওয়ার ইচ্ছেটাকে তোয়াক্কা না করে শান্ত গলায় প্রশ্ন করল,
—-‘ হঠাৎ এই প্রশ্ন? কেউ কি তোকে অসুন্দর বলেছে?’
পৃথা অধৈর্য গলায় বলল,
—-‘ আহা! এতো প্রশ্ন করছ কেন? বলোই না। আমি সুন্দর নাকি অসুন্দর।’
পৃথার কথাবার্তায় বেশ অস্বস্তি ফিল করছিল সাদাফ। মনে মনে খানিকটা বিরক্তও হলো। বিরস মুখে বলল,
—-‘ সুন্দর।’
পৃথার কৌতূহলী প্রশ্ন,
—-‘ কতটা সুন্দর? আচ্ছা? ছোট ভাবি বেশি সুন্দর নাকি আমি?’
পৃথার এমন প্রশ্নে বিষম খেলো সাদাফ। পৃথার থেকে এমন কোনো প্রশ্ন স্বপ্নেও আশা করে নি সে। সাদাফ চূড়ান্ত বিরক্তি নিয়ে পৃথার দিকে তাকাল। এই মুহুর্তে মেয়েটিকে ঠাটিয়ে চড় লাগাতে পারলে ভালো হত। কিন্তু তা সম্ভব নয়। এতো বড় বোনের গায়ে হাত তোলা যায় না। পৃথার সেন্টিমেন্টাল অবস্থাটা বিবেচনা করলে, তাকে উঁচুগলায় ধমকও দেওয়া যায় না। সেই সাথে বোন আর বউ দু’জনকে একই রূপের পাল্লায় ওজনও করা যায় না। স্ত্রীর দিকে স্বামীর দৃষ্টি আর বোনের প্রতি ভাইয়ের দৃষ্টি সম্পূর্ণই ভিন্ন। এই মেয়েটা কি তা বুঝে না? সাদাফ কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
—-‘ আমার জানা মতে, আমাদের মা এই পৃথিবীর সবথেকে সুন্দরী রমণী। আর তুই আমার মায়ের মতোই সুন্দরী। হয়তো তাঁর থেকেও বেশি। কিন্তু এক ফোঁটাও কম নস।’
পৃথা কয়েক সেকেন্ড ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
—-‘ তুমি মিথ্যা বলছ ভাইয়া। আমি আসলে অতটা সুন্দরী নই। মোটামুটি রকম সুন্দরী। মোটামুটি রকম সুন্দরী মেয়েরা সহজে কারো চোখে পড়ে না। শাড়ি পরে সাজগোজ করলেও না।’
সাদাফ প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। কপাল কুঁচকে বোনের এলোমেলো কথাগুলো শুনতে লাগল। পৃথা কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থেকে বলল,
—-‘ আচ্ছা! তুমি কি কখনো তনয়া আপুকে দেখেছ ভাইয়া? উনি কি অনেক বেশি সুন্দরী? একদম পরীর মতো?’
সাদাফ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। এতোক্ষণে বোনের আসল রোগটা স্পষ্টভাবে ধরতে পারল সে। ক্লান্ত গলায় বলল,
—-‘ দেখেছি। কিন্তু ওভাবে খেয়াল করা হয় নি।’
এটুকু বলে থামলো সাদাফ। তারপর শান্ত গলায় বলল,
—-‘ সৌন্দর্য জিনিসটা আপেক্ষিক পৃথা। সবার কাছে সবাইকে সুন্দর লাগে না। আমার চোখে যা ভালো লাগবে তা তোর চোখে ভালো নাও লাগতে পারে। আবার তোর চোখে বিশ্রী জিনিসটা আমার কাছে অনেক বেশি কাম্য হতে পারে। তাই এভাবে সৌন্দর্য মাপাটা বোকামো। যা ঘুমোতে যা। তনয়া কতটা সুন্দর তা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তনয়ার প্রতি শুভ্রবের অনুভূতি শুধু সৌন্দর্যের ওপরই আটকে আছে এমনটা ভাবা ঠিক না। অনেক রাত হয়েছে ঘুমোতে যা।’
পৃথা কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে সাদাফের পাশে এসে বসল। সাদাফের কোল থেকে ল্যাপটপটা সরিয়ে রেখে অকল্পনীয় এক কাজ করে বসল। সাদাফের কোলে মাথা রেখে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়ল সোফায়। পৃথার এমন কান্ডে প্রথম দফায় হতভম্ব হলো সাদাফ। ভীষণ অস্বস্তিতে শরীর,মন কাটা হয়ে রইলো। পৃথা মৃদু গলায় বলল,
—-‘ বাবার কথা খুব মনে পড়ছে ভাইয়া। তোমার গায়ে বাবার গন্ধ আছে। তুমি যখন আদর করে কথা বলো তখন দেখতেও ঠিক বাবার মতোই লাগে।’
কথাটা বলতেই পৃথার ফর্সা গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। সাদাফ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বোনের মাথায় হাত রাখল। চুলের ভেতর আলতো হাত চালাতে চালাতে বলল,
—-‘ তোর ভাবির ডেলিভারিটা হয়ে গেলেই সবাই মিলে চট্টগ্রাম যাব আমরা। বাবা-মা ও ঢাকায় আসবে। আর বেশি দিন তো নেই। আমি তো আছি। মন খারাপ করে না।’
পৃথা জবাব দেয় না। ভাইয়ের কোলে মাথা রেখেই চোখ বন্ধ করে। ভাইয়ের কোলে বাবার গায়ের মিষ্টি গন্ধটা খুব টের পায় পৃথা। পৃথার চোখে ঘুম নেমে আসে। বুকে চেপে রাখা কান্নাটা চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। ফোঁটা ফোঁটা পানিতে ভিজিয়ে দেয় সাদাফের জামা। সাদাফ একদৃষ্টিে বোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। বুকের ভেতর ভাঙচুরের শব্দ তার কানে বাজে। কিন্তু, কি করবে সে? জোর করে কি কাউকে দিয়ে ভালোবাসানো যায়? যদি সম্ভব হতো, তাহলে হয়ত সাদাফও চেষ্টা করত। খুব করে চেষ্টা করত। সাদাফের বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
#চলবে…
[ বিঃদ্রঃ অনেক বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার জন্য দুঃখিত। কিছু পার্সোনাল সমস্যার জন্য আটকে গিয়েছিলাম। আমার এই গল্পটাতেই যত বাধা-বিপত্তি পাড়ি দিত হলো আমায়। গল্পের তালও কাটলো অসংখ্য বার। নয়তো, এতো দেরি করে কোনো গল্পই লিখি নি আমি। আজকের লেখাটাও কেমন খাপছাড়া হয়েছে। তবে বেশি অপেক্ষা করতে হবে না আপনাদের। আর মাত্র ২/৩ টা পর্ব বাকি মাত্র। তারপরই স্বস্তি। দেরি হওয়ার জন্য আবার দুঃখ প্রকাশ করছি। ধন্যবাদ সকলকে।
বিঃদ্রঃ২ রি-চেইক করা হয় নি।]