শেহজাদী পর্ব-৮

0
1031

#শেহজাদী
Part–8
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

ভরদুপুর। ঠাঠা রোদে যেন গা ঝলসে যাবার উপক্রম। কিন্তু এই উত্তাপ ইমানের গায়ে এসে লাগছে না৷ তার বুক পুড়ে যাচ্ছে সেই জ্বালার সামনে গায়ে রোদের প্রখরতা খুবই তুচ্ছ। চোখের সামনে দিয়ে মিরাকে হেঁটে যেতে দেখছে সে।মেয়েটা একবারও পেছনে ফিরে তাকালো না পর্যন্ত! এমন কেন মেয়েটা?একবারও কি পিছনে ফিরে তাকাতে মন চায় না? সে কি জানে না? ছাই দেখলেও থেমে গিয়ে ছাইয়ের ভেতরটা খুঁজা দেখা উচিত। ছাইয়ের মতো আবর্জনার মধ্যেও মূল্যবান কিছু লুকায়িত থাকতে পারে!

মিরার জন্য কি ইমান সেই ছাই নাকি ছাইয়ের ভেতর লুকিয়ে থাকা মূল্যবান রত্ম ছিল?এই উত্তর ইমানের জানা নেই। সম্ভবত সে কেবল ছাই! যার সংজ্ঞাই জ্বলে-পুড়ে ছারখার হওয়া। উফফ! বুকের ভেতরে এতো তীব্র ব্যথা কেন হচ্ছে? এই ব্যথা প্রশমিত করার ঔষধ কি?

রোদের তীব্রতা বেড়ে যাচ্ছে। গায়ে এসে সূর্যের তাপ লাগছে। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে মিরার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল৷ তার চোখে পানি এসে গেল! সম্ভবত রোদের প্রখরতার জন্য চোখে জল এসে গেছে। চোখের কোণায় জল আসতেই ইমান তার চোখের পানি মুছে ফেলে। অশ্রু বিসর্জন দিতে ভালো লাগেনা ইমানের! সে কেন কাঁদবে? সে তো মনের দিক দিয়ে শক্ত অনেক।

আচ্ছা পাহাড় ও তো অনেক শক্তিশালী তাও ঝর্ণা হয়ে অশ্রুপাত ঘটায় রোজ কতো শত বেহিসেবী অশ্রুমালা!

ইমান একবার চোখ বুজলো। বেশিক্ষণ চোখ বন্ধ করে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। সে তৎক্ষনাৎ চোখ খুলে সোজাসুজি রাস্তার দিকে তাকালো। সরু চিকন রাস্তা কিছু দূর গিয়ে মিলিয়ে গেছে। মিরাকে আর দেখা যাচ্ছে না। ইমানের কি যে কি পরিমাণ কষ্ট হতে লাগলো সেই মুহূর্তে কেবল সে জানে! বুকটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে তার। সে তড়িঘড়ি করে রাস্তার মধ্যে দিয়েই ছুট লাগালো। উদ্দেশ্য বাস স্ট্যান্ড! কেন সে ছুটে যাচ্ছে বাসস্ট্যান্ডে তা জানা নেই। তার গন্তব্য আছে কিন্তু উদ্দেশ্য নেই। আপাতত নিজেকে ভারসাম্যহীন লাগছে তার! পুরান ঢাকার গিঞ্জি সংকীর্ণ রাস্তায় দৌঁড়াতে গিয়ে দু’বার দুটো রিকশার সঙ্গে ঘেঁষা লেগে হাতে ও হাঁটুতে ব্যথা পায় ইমান। তবুও নির্বিকার সে। কে যেন বলেছিল, মন ও শরীর একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হলো, ইমান তার শারিরীক এই ব্যথা গুলো অনুভব করতে পারছে না। নিজেকে লাইফলেস মনে হচ্ছে তার।

বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছাতে পৌঁছাতে হাপিয়ে উঠে সে। পিপাসায় গলা চৌচির! সে যখন বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে তখন মাত্র বাস ছেড়ে দিয়েছে। মিরাও এই বাসেই আছে তা সে জানে। ইমানের খুব করে মন চাচ্ছে বাসের পিছু দৌঁড়ে সে যেন মিরার কাছে চলে যায় এবং বাস থামিয়ে মিরাকে ফিরিয়ে আনে! কিন্তু আবারো আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, ইমানের পা আর চলছে না। সে একই জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। বাসটাও ত্রিসীমানার বাইরে চলে যাচ্ছে। ইশ! হাত বাড়িয়ে যদি মিরাকে তার কাছে ফিরিয়ে আনা যেত! কিন্তু মিরা যে তার চেয়ে বহুদূর! দূর, বহুদূর! এতোটাই দূরবর্তীতে তাদের চলাচল যে একজন আরেক জনকে ইচ্ছা থাকলেও, দেখা মিলবে না!

ইমান অস্ফুটস্বরে বলে উঠে, মিরা! সেই অস্ফুটস্বরের মধ্যে ছিলো একটা চিৎকার! যেই চিৎকার শ্রবণশক্তির বাইরের শব্দ! মানুষ শুনবে না সেই আওয়াজ!

_______________

বাসে উঠে বসতেই মিরার মনের ভেতর অন্যরকম একটা সাহস এসে হানা দিলো। এর আগে নিজের বাসা থেকে বান্ধবীর বাসা যেতেও তার মনে ভয় কাজ করত কিন্তু আজ তার ভেতর কোন দ্বিধা, ভয়, সংকোচ কাজ করছে না। নিজেকে স্বার্থপর মনে হলেও সে খুশি! নিজের জন্য সে খুশি৷ একটাই জীবন তার। খুব অল্প সময়ের জন্য এসেছে পৃথিবীতে সে। এই ক্ষণিকের জীবনটা সে নিজের মতো করে সাজাতে চায়। রাঙ্গাতে চায় নিজ আলপনায়! অন্যকারো হস্তক্ষেপ সে চায় না! একদমই চায় না সে! হ্যাঁ বাবা-মায়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু একবার বিয়ে করে ফেললে আজীবন নিজের অনিচ্ছায় সংসার করতে হতো। হয়তোবা সে নিজেকে মানিয়ে নিত কিন্তু সুখী কি হতে পারত? ইমানকে কি সুখী রাখতে পারত?

মিরা জানে সে অন্যায় করেছে। কিন্তু মাঝেমাঝে নিজের সুখের জন্য হলেও অন্যায় করা দোষের কিছু না। বাস চলছে নিজ গতিতে। এসি বাস জন্য জানালা লাগানো। ইমান ভাইয়া যেহেতু দুইটা টিকিট কেটেছিল এবং দুইটা টিকিটের দাম দিয়েছিলো কাজেই মিরার পাশের সীটটা ফাঁকা পড়ে আছে। সে ফাঁকা সীটের দিকে তাকিয়ে রইল।

এরপর জানালা থেকে পর্দা সরিয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। তার সর্ব প্রথম কাজ হলো একটা সীম কিনা। মিরার এসিতে কিছুটা শীত লাগছে৷ তার মনে চাচ্ছে, বাসের এসি অফ করে জানালা খুলে দিয়ে মুক্ত বাতাস গায়ে মাখাতে! উত্তেজনায় আর উল্লাসে তার বুক দুরুদুরু করে কাঁপছে। ইমানকে সে মনে মনে হাজারবার ধন্যবাদ দিয়েছে৷ সে সীটে হেলান দিয়ে কানে হেডফোন গুজে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে হলুদের সময়কার কথা মনে পড়ে গেল তার। ইমান ভাইয়াও কানে হেডফোন লাগিয়ে অনলাইন ক্লাস করছিলো। সে পিলে চমকে উঠে। কি অদ্ভুত! যার কাছ থেকে সে দূরে সরে যেতে চাচ্ছে তার স্মৃতিই কেন তাকে তাড়া করবে!

মিরা কান থেকে হেডফোন সরিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। আচ্ছা ইমান ভাইয়া কি বাবা-মাকে ম্যানেজ করতে পারবে? বড়-আব্বু নিশ্চয়ই খুব রেগে যাবেন! সায়েমা আপু আর সোনালী আপু কিভাবে রিয়্যাক্ট করবে? মিরার এমন একটা পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য নিশ্চয়ই মা-বাবা ইরাকে আরো চোখে চোখে রাখবে। মিরার উপরের সব রাগ ইরাকে সহ্য করতে হবে! আহারে! ইরার জন্য তার কষ্ট লাগছে। ইরা মেয়েটা সারাদিন এককোনায় পড়ে পড়ে মোবাইল চালায়। আজকে থেকে সম্ভবত ইরাকে আর ফোন ও ব্যবহার করতে দিবে না! কঠিন পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখা হবে তাকে।

বাস মধ্যরাতে এসে থামলো। বাসের এক যাত্রীর মোবাইল নিয়ে মিরা তার খালাতো বোনকে ফোন করে সব বলে দিয়েছিলো। তার খালাতো বোন সব শুনে আকাশ থেকে পড়ে যায় যায় অবস্থা! খুব করে বকলোও তাকে। একনাগাড়ে বলে দিলো, সে নাকি মিরাকে বাসস্ট্যান্ডে নিতে আসবেনা। মিরার যেখানে ইচ্ছা সে যেতে পারেনা। সে কোন দায়িত্ব নিবে না। বলে ফোন কেটে দেয়। এসব শোনার পর ও মিরা একবিন্দু ভয় পেল না। সে জানে আপা যতোই চিল্লাক না কেন। অবশ্যই তাকে নিতে আসবে এতে কোন প্রকার সন্দেহ নেই।

কক্সবাজার বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে মিরা দেখলো, আপু এবং দুলাভাই খুবই চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

মিরা বাস থেকে নিজের ব্যাগ নিয়ে নেমে পড়ে তাদের দিকে এগিয়ে এসে এক গাল হেসে বলে, কেমন আছো তোমরা?

মিরার খালাতো বোন জান্নাত মুখ গোমড়া রেখে বলে,রাখ তোর ভালো থাকা! মিরা তোর জন্য আমাকে এখন জেলে না যেতে হয় রে।

একথা শুনে মিরা শব্দ করে হেসে দিলো। জান্নাত আপা চোখ বড় বড় করে বলে, এমন এক পরিস্থিতি তেও তুই হাসছিস কেমনে? আমার তো ইতিমধ্যেই হাত-পা কাপাকাপি শুরু হয়ে গেছে।

মিরা নিজেও অবাক না হয়ে পারলো না। আসলেই তো! সে এতো স্বাভাবিক আছে কিভাবে? তার ও তো ভয়ে হাত-পা, মাথা, কিডনি, ফুসফুস সবই কাঁপা উচিত।

দুলাভাই বলে উঠে, তোমাদের ছুটি তে কক্সবাজার ঘুরতে আসতে বলি! কিন্তু তুমি আসলে পালিয়ে। তোমার জামাই কেস করে দিলে আমি শিক্ষক মানুষ কিভাবে এসব সামলাবো?

মিরা মিস্টি করে হেসে বলে, উনিই আমকে পালাতে সাহায্য করেছে। আর আব্বু-আম্মুর ব্যাপার টা নিয়ে কিছু দিন না ঘাটাই । পরে আস্তে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে৷ এসব বাদ দাও। আমাকে কি এখানে রেখে দিবে? বাসায় নিয়ে যাবে না? আমি খুব ক্ষুধার্ত। সেই দুপুর একটায় খেয়েছি। এরপর থেকে না খাওয়া একদম।

জান্নাত আপু চিন্তিত মুখেই মিরাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। মিরা যখন ফোন দিয়ে তাকে সব বললো, এক দফা সে মিরাকে বকেছেও। কিন্তু বাসস্ট্যান্ডে এসে তাকে রিসিভ করার অনুরোধ ফেলতে পারেনি জান্নাত আপু। যতোই হোক নিজের কাজিন হয় মিরা তার। এতো রাতে মেয়েটা যে জার্নি করে আসছে এতেই টেনশনে মরে যাচ্ছিল সে। বাস কক্সবাজার পৌঁছানোর একঘন্টা আগেই সে স্বামীকে নিয়ে হাজির।

জান্নাত আপার বাসায় গিয়ে মিরা পাক্কা আধা ঘণ্টা ধরে শাওয়ার নিলো। সকল ক্লান্তি ঘুচিয়ে সে ফ্রেস হয়ে বের হলো। আপা সঙ্গে সঙ্গে তার জন্য টেবিলে ভাত বেড়ে দিলো। গরম গরম ধোয়া উঠা সাদা ভাত, আলু ভর্তা আর পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে ডিম ভাজা৷ এতো রাতে গরম ভাত দেখে মিরা অবাক হলো। আপা তার জন্য এই মধ্য রাতে ভাত রাধলো?

মিরার পেটে ইদুর দৌঁড়াচ্ছে। সে খাওয়ার লোভ আর সামলাতে পারলোনা। প্লেটে ভাত আর ভর্তা নিয়ে খাওয়া শুরু করে দিলো।
জান্নাত আপা প্লেটে ডিম তুলে দওয়ে বলে, খুবই সামান্য আয়োজন রে! তোর সমস্যা হচ্ছে নাতো ভর্তা-ভাত খেতে?

মিরা গ্রোগাসে খেতে খেতে বলে, কি যে বলো না আপা! আলু ভর্তা আমার সবচেয়ে প্রিয়। আমার মনে হয় প্রতিটা বাঙালীর প্রিয় আলু ভর্তা!

জান্নাত আপা তার খাওয়া দেখে হেসে বলে উঠে, তুই তো এখনো বাচ্চাই আছিস রে মিরু বাবু! ভালো করেছিস পালিয়ে এসে। তোর এখনো বুদ্ধি-সুদ্ধিই হয়নি! সেখানে সংসার কিভাবে সামলাবি?

মিরা জবাব দিলো না। সে এক মনে ভাত খাচ্ছে। যা ক্ষুধা পেয়েছে তার! এমন ক্ষুধা এর আগে কোন দিন পায়নি তার৷

★★★

মিরার বড় আব্বু বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে থ মেরে। সেই সন্ধ্যা থেকে সে বারান্দায় দাঁড়ানো। তার দুই মেয়ে এমনকি মেয়ে জামাইরা এসে অনুরোধ করেও তাকে রুমে নিয়ে যেতে পারেনি। সন্ধ্যায় যখন সবাই বুঝে গেল মিরা বাসায় নেই,পালিয়ে গেছে সে, তখন থেকেই সে বারান্দায় দাঁড়ানো। তার মন বলছে, মিরা ফিরে আসবে। এই বারান্দা থেকে বাসার মেইন গেট দেখা যায়। কেউ বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করলে সবটা দেখা যায়। কাজেই সে এখনো দাঁড়িয়ে আছে যেন মিরা ফিরলে সবার আগে সে তাকে দেখতে পায়। তিনি ঘন ঘন চশমার কাচ তার পরনের ফতুয়া দিয়ে মুছে চলেছেন। মিরার মায়ের প্রেশার বেড়ে অবস্থা কাহিল। ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে সে। মিরার বাবাও নিজের রুমে ঝিম মেরে বস্র আছে।

ইমান বড় মামার কাছে এসে দাঁড়ালো এবং বিনয়ের সঙ্গে বলে উঠে, মামা, ঘরে আসুন তো!

— কাজটা তুমি ঠিক করলে না ইমান।

— মামা আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আমিও নিরুপায়। কাউকে জোর করে বিয়ে করার মতো নিচু মানসিকতার না আমি৷ মিরা চলে যেতে চাইছিলো। আমি বাঁধা দিতে পারিনি। ও মুক্তি চাচ্ছিলো, আমি আটকানোর সাহস পাইনি।

— মিরা অবুঝ। বুঝে না কিছু

— নিজের ভালো পাগল ও বুঝে মামা। যাইহোক আমি চলে যাব এখনই। আমাকে আর কোন দিন এই বাসায় ডাকবেন না। আমি ভালো থাকব। আপনারাও ভালো থাকুন। পারলে মিরাকে ক্ষমা করে দেন। আমি চলে যাচ্ছি মামা।

— কোথায় যাবে তুমি?

— ঢাকার বাইরে।

চলবে৷

[ কালকে থেকে গল্পের আসল প্লট শুরু। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here