#শেহজাদী
Part–21
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
মিরা এবং ইমান দুইজনেই খুকখুক করে কেশে উঠে৷ মিরা হন্তদন্ত হয়ে ইরার কাছে ফিরে যায়।
অতঃপর তারা কাঙিক্ষত স্থান কুয়াকাটা পৌঁছে যায়। হোটেলে চেকইন করেই যে যার রুমে ঢুকে পড়ে। মিরা আর ইরা একরুমে আর এদিকে ইমান সাদকে নিয়ে একটা রুমে উঠে৷ এদিকে মিস্টার চৌধুরী তার বৌকে নিয়ে অন্য আরেকরুমে উঠেছে৷
সকাল এগারোটা পর্যন্ত মিরা একটানা ঘুমালো। ঘুম ভাংলো গেটে টোকা পড়ার আওয়াজে৷ স্র চোখ খুলতেই তার চোখে মুখে আছড়ে পড়ে সুমিস্টি রোদ! মুচকি হাসলো সে। পাশেই ইরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন!
মিরা চুলে খোপা করতে করতে হোটেলের রুমের গেট খুলে দেখে ইমানের ছোট ভাই সাদ দাঁড়িয়ে আছে। সাদের সঙ্গে কথা তো দূর দেখাও হয়নি আগে কখনো। শুধুমাত্র শুনেই এসেছে ইমানের একজন সৎ ভাই আছে৷
মিরা মুচকি হেসে বলে, হাই৷
— হ্যালো আপু। তোমার সাথে পরিচিত হয়ে এসেছি। উই আর নাও ট্রাভেল মেইট!
— ইয়াহ।
–মাইসেল্ফ সাদ।
— আই এম মিরা৷
— হ্যাঁ জানি! ভাইয়ার মুখে আপনার নাম শুনেছি বহুবার!
মিরা সাদের কথা শুনে ভ্রু কুচকে বলে, আমার নাম?
— হ্যাঁ। আপনি ইমান ভাইয়ার কাজিন হন। ভাইয়া আপনার কথা বলেছে আমাকে।
মিরা অবাক হলো। ইমান সাদের সঙ্গে তাকে নিয়ে গল্প করেছে? তার বড্ড জানতে মন চাচ্ছে, কি বলেছে তার নামে? আচ্ছা সাদ কি জানে? মিরা তার ভাবী হতে গিয়েও হয়নি? সরাসরি তো জিজ্ঞেস করাও যায় না!
মিরা বলে, নাস্তা করেছে তুমি?
— হ্যাঁ।
— আমি করিনি৷
— ভাইয়াও মাত্র নাস্তা করতে নিচে নেমেছে৷ আপনি ও যান আপু৷
মিরা কি যেন ভেবে দ্রুত নিচে নেমে যায়। সাদ অদ্ভুত নয়নে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, ওনার আবার কি হলো?
মিরা হাত খোপা করা ছিল। জোরে জোরে হেটে আসার ফলে তার চুল গুলো উম্মুক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে কাধের চারপাশে।
সে দেখলো, ইমান খাবার ওর্ডার দিচ্ছে। মিরা প্রায় চেচিয়ে উঠে বলে, ইমান! আমার আর ইরার জন্য ও খাবার ওর্ডার দিও।
ইমানের সঙ্গে সঙ্গে সবাই তার দিকে কৌতুহল চোখে তাকায়। আজকের পরিবেশ সম্ভবত অনুকূলে। ইমান আজকে একদমই কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করলোনা। বরং তাকে দেখে হাসলো। ইশ কি ধারালো সেই হাসি৷ ওই ওত দূর থেকেও দাঁড়িয়ে হাসলেও মিরার বুকের ভেতর আটকে থাকা মনটা কেটে-কুটে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে লাগলো।
ইমান তিনজনের খাবার অর্ডার দিলো। আজকে আসলেই তার মন ভালো। কেন ভাল কেন জানে? মেজাজ ও ফুরফুরে!
সে যেই চেয়ারে বসলো। একটু পর মিরাও সেখানে এসে বসলো। ইমান তখন ফোন চালাচ্ছিল। সে তার দিকে না তাকিয়েই বলে, ইরা কোথায়?
— ও তো ঘুমাচ্ছে।
— ঘুমে আছে। তাহলে এখনো একজন ঘুমন্ত নাগরিকের জন্য কেন খাবার অর্ডার দিলে? ঘুমাতে ঘুমাতে খাবে ও?
মিরা হোহো করে হাসা শুরু করলো। ইমান ভ্রু কুচকে তাকালো তার পানে। ঘুরতে এসে একটু বেশি খুশি হয়ে কি মেয়েটার মাথার এক-দুই টা তাড় ফিউজ হয়ে গেছে?
মিরা বললো, ওর জন্য পারসেল নিচ্ছি।
তখনই মিস্টার চৌধুরী এসে তাদের পাশ বসলো। সে একবার ব্রেকফাস্ট করেছে। আবার করবে ইমানদের সঙ্গে।
খাবার চলে এসেছে। নান রুটি আর গ্রীল ওর্ডার দেওয়া হয়েছিল। মিরা খাবার সার্ভ করে খাওয়া শুরু করে।
তাকে দেখে ইমান মিটমিটিয়ে হাসলো। মিরা ভ্রু কুচকে বলে, আমার খাওয়া দেখে হাসছেন আপনি?
ইমান শীতল কণ্ঠে বলে, না।
— তাহলে কেন হাসলেন?
— তুমি উলটো করে জামা পড়েছো তাই।
মিরা সঙ্গে সঙ্গে নিজের দিকে তাকালো। আসলেই তাই! এবারে মিরার লজ্জা লাগতে লাগলো। এভাবেই সে বাইরে চলে এসেছে?
তার ঘোর ভাংলো ইমানের শব্দ করে হাসার আওয়াজে। ইমানের হাসি তার সহ্য হচ্ছে না। ওই যে করাত দাতটার হাসলে চিকচিক করে সেটাও সহ্য হচ্ছে না তার। ছেলেটাকে হাসলে যে এতো অমায়িক লাগে তা আগে কেন কোন দিন খেয়াল করেনি সে?
মিস্টার চৌধুরী মিরার সামনে হাত এনে তা ওঠা-নামা করতে করতে বলে, ম্যাডাম কার চোখে হারিয়ে গেলেন?
মিরা হচকচিয়ে উঠে। কেমন জানি অসহ্য লাগছে তার। হুট করেই মন খারাপ হয়ে গেল। একদন্ডতেই মন ভালো থেকে খারাপ হয়ে গেল।
মিস্টার চৌধুরী বললো, আজকের ওয়েদার ভালো না। সারা দিন বৃষ্টি হবে। মেঘ ওলরেডি কালো করে এসেছে। আজকে আর ঘুরতে বের হওয়া যাবে না।
ইমান বললে, আজকের দিনটাই মাটি হলো।
— বার্বিকিউ করা হবে।
মিরা উঠে দাড়ালো এবং রুমের দিকে ফিরে যেতে লাগলো।
★★★
মিরা নিচে নেমে যেতেই সাদের মধ্যে একটা অন্যায় ইচ্ছা জাগ্রত হলো। তার খুব করে ইরাকে কাছ থেকে দেখতে মন চাইলো। সে জানে এভাবে একটা মেয়ের রুমে ঢুকে পড়া অসভ্য আচরণ তবুও মনকে কিছুতেই বুঝ দিতে পারছে না সে। তার মধ্যে ভেতরে ভেতরে চরম উত্তেজনা কাজ করছে। সে আশেপাশে তাকিয়ে নিল। এরপর জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে হোটল রুমের গেটের হ্যান্ডেল ধরে ঘুরালো।গেট আনলক ছিলো। ভেতর থেকে কেউ লক করে দেয়নি। এইজন্য সাদের দুশ্চিন্তা ও হলো। তার জায়গায় যদি কোন অসাধু লোক ইরার রুমে ঢুকলে কি হত?
রুমের ভেতর ঢুকতেই তার নাকে মিস্টি একটা পারফিউমের গন্ধ ভেসে আসলো। সাদ আস্তে আস্তে পা বাড়ালো।
বিছানায় ইরাকে দেখা যাচ্ছে। সে গুটিসুটি মেরে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে। ঘুমে আচ্ছন্ন। ভারী নিঃশ্বাস পড়ছেব।সাদ সাহস করে আরেকটু এগিয়ে যায়।
“প্রেম করতে চাইলে আধ-একটু সাহসী হতে হবে ”
সাদ একেবারে বিছানার পাশে এসে দাড়ালো এবং ইরাকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। মেয়েটা এমনিতেই রূপবতী। ঘুমের মধ্যে ও সুন্দর লাগছে তাকে। চুল গুলো এলোমেলো।নিচের ঠোঁটটা ডেবে আছে৷
সাদের চোখ আটকে গেল অন্য জায়গায়। ইরার গলার একটু নিচে ছোট্ট একটা লাল তিল আছে। সেই লাল তিলটা ভীষণভাবে আকর্ষণ করছে তাকে। ছুঁয়ে দেখতে ও মন চাচ্ছে। সাদের নিজের অন্যায় আবদারকে পাথর চাপা দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ইরার পানে অপলক দৃষ্টি নিবন্ধ করে আছে সে।
এই মেয়েকে নিজের করে পাওয়ার জন্য যা দরকার পড়ে করত্ব রাজী আছে সে। যদি কেউ বলে, সাগরে ছাপিয়ে পড়লে এই মেয়ে একান্ত তার হবে তাহলে সাদ সেটাই করবে৷
আচমকা সাদ বিকট শব্দ তুলে হাঁচি দিলো। তার হাচির শব্দে ইরার ঘুম ভেঙে যায়।এইজন্যই ইরার চোখ খুলে তার দিকে তাকালোর আগেই সাদ টের পেয়ে যায় দ্রুত ফ্লোরে শুয়ে পড়ে এবং বুদ্ধি খাটিয়ে বিছানার তলে ঢুকে যায়৷
এদিকে ইরার কিছু একটা শব্দ কানে বাজতেই ঘুম ছুটে যায়। সে উঠে বসে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে আপু নেই রুমে। সময় দেখে নিলো সে। শাওয়ার নিতে হবে।এরপর খেতে যেতে হবে।
ইরা উঠে দাড়ালো এবং আয়নার কাছে গিয়ে চুল চিরুনী দিয়ে আঁছড়াতে লাগে।
সাদ নিজের মাথাটা বের করে দিয়ে ইরাকে দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু এতে হীতে বিপরীত ঘটল।
ইরা আয়নায় একটা কাটা মাথা দেখতে পায় এবং ওহ আল্লাহ গো বলে চিৎকার দিয়ে উঠে৷
ইরা চিৎকার করে যাচ্ছে অনবরত। এদিকে সাদ উপায় না পেয়ে বিছানার তল থেকে বের হয়ে ইরার কাছে গিয়ে দাড়ালো এবং, ইরার একটা হাত ধরে তার নিজের দিকে এনে ইরার মুখে নিজের আরেকটু হাত চেপে ধরলো। যেন মুখ দিয়ে শব্দ করতে না পারে সে।
সাদ আস্তে করে বলে, দোহাই লাগে চিৎকার করবে না!
ইরা চোখ বড় বড় করে তাকালো সাদের দিকে। সাদ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে, ইরাবতী তুমি অনেক হট!
ব্যাস এই কথাটাই কাল হয়েছিল সাদের জন্য। ইরার কানে কথাটি যেতেই সে দাত দিয়ে সাদের হাতে কামড় বসাতে লাগে। সাদ না পেরে তাকে ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে যায়৷
★★★
বিকেলের অগ্রভাগ। ইরা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। সকালের পর থেকে সে বড্ড বিরক্ত।
মিরা এক কাপ চা হাতে এগিয়ে এসে বলে, শোন আমি রাস্তায় হাটতে যাব। তুই যাবি আমার সঙ্গে?
ইরা বোনের দিকে তাকালো। এরপর বললো, না। তুমি যাও।
— সিউর?
–হু।
মিরা বলে, ইমান মেবি হোটেলে আছে। ওর ভাই বাইরে বেরিয়েছে৷
ইমান হোটেলে আছে কথাটা শোনামাত্র ইরার চোখ উজ্জ্বল হয়ে গেল।
মিরা ইরাকে জানিয়েই একটা ওড়না পেচিয়ে হোটেল থেকে বের হলো হাঁটার জন্য। মনোরম প্রকৃতির মাঝে হাটতে দিব্যি লাগছে তার। আজকের আবহাওয়া ফাটাফাটি। হুহু করে বাতাস বইছে। বাতাসে নাইটকুইন ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে।
মিরা নাইটকুইন গাছটার অনুসন্ধানে উলটো দিকে হাটা ধরলোন।বেশ খানিকটা যেতেই পেয়ে গেল গাছটা। মিরা গাছের কাছে দৌড়ে গেল। কিছুক্ষণ সেখানে একা একা গুনগুন করে গান গেয়ে ফেরত আসার সময় বিপত্তি ঘটলো। সে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে। কোন দিকে যাবে সে?
মিরা চিন্তায় পড়ে যায়। হাতের ডান দিক দিয়ে হেটে যেতে লাগে। রাস্তাটা একেবারেই অপরিচিত। আকাশ কালো হয়ে এসেছে। মেঘ ডাকছে। যখন-তখন বৃষ্টি নামনে। সে সমানে হেটে চলেছে৷ এমন সময় মনে হলো, কারো পায়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। সে ভয়ে পেছনে তাকাচ্ছে না।
কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সে জানে না। কানে ট্রাকের হর্ণ ভেসে আসছে। হুট করে এই রাস্তায় ট্রাক কোথা থেকে আসলো। মিরার বুদ্ধি লোপ পেল। চারদিক অন্ধকার দেখছে সে।চোখ হেডলাইটের আলো এসে চোখ ধাধিয়ে দিচ্ছে। চোখ খোলা রাখা দায়। তবে কি মরণ সন্নিকটে? মৃত্যুর আগে একবার ও কি সে ইমানকে জানাতে পারবে না যে সে অনুতপ্ত? ক্ষমাপ্রার্থী? দূরে কোথাও গান বাজছে বোধহয়? মিরার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।
চলবে।