শেহজাদী পর্ব-২৬

0
714

#শেহজাদী
Part–26
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

আকাশে তখন ধূসর মেঘ। মিরা এক আকাশ আশা নিয়ে ইমানের দিকে তাকিয়ে আছে। রাত বারোটা ছুঁইছুঁই। এই রুমে একটা দেয়াল ঘড়ি আছে। রুমটাতে এতোটাই পিনপতন নীরবতা যে দেয়াল ঘড়িটার টিকটিক আওয়াজ কানে বাজছে৷ মিরা বহু প্রতিক্ষায় দুরুদুরু বুকে প্রহর গুনছে। ইমান কি রেগে গেছে? মিরা কি নিজের অনুভূতি বুঝতে ভুল করছে? এইযে হুটহাট করে ভালোবাসি বলে দিলো এটা কি সঠিক কাজ করেছে সে?মিরা একটা দম ফেললো। সে যে ইমানকে ভালোবেসে ফেলেছে এটা সে পইপই করে টের পাচ্ছে আর এই সত্যটা তাকে বলার পর বুকটা প্রশান্ত মহাসাগরের পানির মতো শান্ত, টলমল করছে৷

মিরা নিজের বাঁধন আলগা করে বলে, কি হলো? চুপ করে আছেন যে? কিছু বলুন! আপনি যা বলবেন তাই সই!

ইমান জানালার দিকে একদৃষ্টিতে তার রইল।বর্ষাকাল চলছে এখন। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। সেই সাথে দমকা হাওয়া তো আছেই। বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে৷ পাশে কোথাও বেলী গাছ আছে বোধহয়। একটা মিস্টি সুভাস ও নাকে এসে লাগছে৷

আকাশের দিকে তাকিয়ে করুণস্বরে বলে, আমাকে ভালোবাসো এই কথাটা কেন যেন বিশ্বাস হচ্ছে না আমার৷

মিরা হতভম্ব হয়ে বলে, মানে?

এবারে ইমানের আকাশের দিক থেকে চোখ সরিয়ে মিরার হাত দুটো নিজের বুক থেকে এক ঝটকায় সরিয়ে দেয়। হুট করে এমন ঝটকা খাওয়ায় মিরা টাল সামলাতে না পেরে কিছুটা পিছিয়ে যায়। আরেকটু হলেই পরে যেত সে। দু’পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করলেও, মচকে যাওয়া পাটাতে আবারো চোট পেয়ে সে মৃদ্যু চেচিয়ে উঠে।

ইমান একবার ভাবে সে মিরার কাছে যাবে৷ পরবর্তীতে মত বদলে ফেলে। আর মায়া দেখানো যাবে না৷

মিরা নিজেকে ধাতস্থ করতেই সম্মুখীন হতে হলো ইমানের শান্ত কিন্তু রুক্ষ্ম গলায় বলা ঝাঝালো বিতৃষ্ণাময় কথাগুলোর৷

ইমান মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বলে, তোমার প্রেমিক কোথায়? যার জন্য রাত-বিরেতে ঘর ছেড়ে পালাতেও একবারও ভাবোনি?

মিরা কাতর গলায় বলে, তখন এতো-সতো বুঝতাম না! ছোট ছিলাম।

— মোটেও ছোট ছিলে না। ইন্টারে পড়া মেয়ে ছোট হয় কিভাবে?

— ছোট নাহলেও খুব একটা বড়ও কিন্তু ছিলাম না। অনেক কিছুই বুঝতাম না। না বুঝেই অনেককিছু করে ফেলেছি।এরমধ্যে আবিরের সঙ্গে সম্পর্কটা একটা ভুল ছিল৷

— বাহ! সম্পর্কটাই এখন ভুল লাগছে ?

— হ্যাঁ।

— তা বিদেশি হাওয়া লেগে আবিরকে ভুল মনে হলো আর গ্রামের হাওয়া লেগে আমাকে ভালোবাসা শুরু করলে।

— আমার গায়ে কোন হাওয়াই লাগেনি৷ আবিরের সঙ্গে আমার ভারচুয়ালে রিলেশন ছিল। তখন মাত্র ফেসবুক খুলেছি কলেজে উঠে। এরমধ্যেই ওর সাথে পরিচয়। কলেজের সিনিয়র জন্য ম্যাসেজ দিলেই রিপ্লে দিতাম। হুট করে একদিন প্রোপোজ করলো। আমি,,,,,

— তোমার লাভ লাইফ সম্পর্কে শুনতে চাইনি মিরা৷

— আপনি নিশ্চয়ই আমাকে খারাপ কোন মেয়ে ভাবছেন। কিন্তু আমি মোটেও খারাপ না৷

— আমি তোমাকে নিয়ে কিছুই ভাবছি না। বরং তুমি নিজেই নিজেকে খারাপ ভেবে নিয়েছো৷

মিরা এইকথার উল্টো জবাব দিলো না। চুপ করে মাথা নিচু করে ফেললো।

ইমান এবারে তার দিকে এগিয়ে এসে বলে, আমরা জীবনে অনেক ভুলই করি। কিছু ভুল অমঙ্গল বয়ে আনে আবার কিছু ভুল অজস্র সুখ বয়ে আনে৷

মিরা তার দিকে চোখে চোখ রাখলো। সে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। আপাতত মিরার চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস তার নেই৷ পুনরায় দৃষ্টি নিবন্ধ করলো জানালার দিকে৷ এরপর কঠিন গলায় বলে, তোমার কি মনে হয়? আমি লাইফে মুভ অন করিনি? তুমি ল্যাং মেরে চলে গেছো জন্য আমি উঠে দাঁড়াইনি? আমাকে কি দেবদাস ভাবো? তোমার দেওয়া আঘাতে আমি দগ্ধ হলেও ছাই হয়নি মিরা৷

মিরা টলমল চোখে পায়ে ব্যথা নিয়েই হেঁটে ইমানের মুখোমুখি তাকালো। এবারে ইমান বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যায়। সে আবার মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে, আমার জীবনে অন্যকারো পদচারণ আছে৷ বহু আগেই তোমাকে আমার জীবন থেকে সরিয়ে ফেলেছি। জানো মিরা! আমাদের অফিসের ম্যানেজার আজাদ ভাই বলে, আমি নাকি যন্ত্রমানব। বিশ্বাস করো আজ একথা আমি নিজেও বিশ্বাস করছি৷ যন্ত্র নাহলে কি তোমাকে নিজের মন থেকে ডিলিট করতে সক্ষম হতাম? বলো?

মিরার চোখ বেয়ে টসটসে মোটা মোটা দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো৷

সে আবারো ইমানের মুখোমুখি হয়ে বলে, মুখ ফিরিয়ে কথা বলছেন কেন? বড় আব্বু বলে, চোখে চোখ রেখে যে কথা বলা যায়না সেটা অসত্য কথা৷

— তোমাকে মিথ্যা বলে আমার লাভটা কি?

— লাভ-ক্ষতির হিসাব তো জানিনা কিন্তু আপনার কথা বিশ্বাস করিনা।

ইমান এবারে কিছুটা রাগী গলায় বলে, কেন বিশ্বাস করো না? আমি কি একবারও বলেছি তোমাকে ভালোবাসি? বলেছি? বলো? বলিনি তো! ছয় বছর আগে বিয়ে করতে রাজী হয়েছিলাম জাস্ট বিকজ নানীর ইচ্ছা ছিলো। অসুস্থ বৃদ্ধা নানী। মায়ের পর কেউ যদি আমাকে নিস্বার্থ ভাবে ভালোবাসে সেই ব্যক্তি হলো নানী। আমার কাছে ভালোবাসার কদর আছে। ছোট থেকে কম ভালোবাসা পেয়েছি তো এইজন্য ভালোবাসা, স্নেহের মূল্য বুঝি।তুমি তো সোনার চামচ মুখে জন্মেছো। ভুল করলেও মা বুকে টেনে নেয়। বাবা বকলেও ঠিকই মেয়ের সব চাহিদা পূরণ করেই যাচ্ছে।

— আমি অনুতপ্ত তো৷

— তোমাকে অনুতপ্ত হতে বলেছে কে? আমি নাকি তোমার বাবা?

— আমার নিজের বিবেকই আমাকে ক্ষমা চাইতে বলছে৷

ইমান তর্কের এই পর্যায় থেমে গেলো৷ অযথা তর্ক বাড়ানো হচ্ছে। এইসব অতীতের কথা বলার মানে হয় না৷

তর্কের সঙ্গে সুতোর একটা বৈশিষ্ট্য খাপে খাপ মিলে। তাহলো যতোই গুছাতে চাইবে ততোই প্যাচিয়ে যাবে। তর্কের প্যাচ আর সুতোর প্যাচ খোলার জন্য খুবই ঠাণ্ডা মাথায় আগাতে হয়। একটা ভুল টান দিলেই প্যাচে গিট বেজে যায়৷

মিরা ও চুপ রইল এরপর বলে উঠে, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন যে আমাকে ভালোবাসেন না!

ইমান জগ থেকে পানি ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে নিয়ে বলে, এইসব ছেলেমানুষী খেলা খেলবার সময় আর এনার্জি কোনটাই আমার নেই৷

মিরা একবার তার দিকে তাকালো। তারপর ডুকরে কেদে উঠে বলে, আপনি আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন তাই না?

ইমান শব্দ করে গ্লাসটা টেবিলে রাখলো। সেই শব্দে হালকা চমকে উঠে মিরা।

সে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার আগে মিরাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ভালোবাসার উপর বিশ্বাস উঠে গেছে আমার৷ ভালোবাসাকে এখন সুচালো কাটা মনে হয়, যা হাতে নিলেই ফুটে রক্তাক্ত ঘটাবে। আমি বাইরে উঠানে থাকব৷ সকাল হলে রুমে আসব। গেলাম৷

— আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না তো!

–উত্তর দেওয়ার কোন দায়বদ্ধতা আমার নেই।

ইমান বের হয়ে দরজা ভিজিয়ে দিলো। মিরা কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল৷

এরপর বিছানার একপাশে এসে গুটিসুটি মেরে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। তার খুব কাঁদতে মন চাচ্ছে। বাসায় ফিরে গিয়ে আম্মুর বুকে মাথা রেখে ঘুমানোর প্রবল ইচ্ছা জাগ্রত হলো মনের গহীনে ।

মিরার কাঁদতে কাঁদতেই মনে হলো, কে সেই রমণী যার পদচারণ ইমানের হৃদয়ে। যার জন্য ইমান তাকে ঘুরেও দেখলো না!

খুব খুব কষ্ট হচ্ছে তার। ভালোবাসার মানুষের কাছে রিজেকশন যে এতোটা যন্ত্রণাময় তা আজ এই প্রথমবারের মতো অনুভব করছে সে। ঠোঁট কামড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করলো সে। কিন্তু লাভ হলোনা।

★★★

পরেরদিন সকালে মিরা ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। সারা রাত কাঁদার পর সে নামাজের পর পর ঘুমিয়েছে৷ তার ঘুম ভাংলো মুখে পানির ছিঁটা পড়ায়। সে ধড়ফড় করে উঠে বসলো।

ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরও তার মাথা কাজ করছে না। সে চোখ কচলিয়ে সামনে তাকাতেই দেখে ইমান দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখতেই রাতের জখম তাজা হলো শতগুণ।

ইমান নম্র গলায় বলে, আর কত ঘুমাবে? ফ্রেস হও। আমরা হোটেলের উদ্দেশ্য রওনা দিব।

মিরা তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে শাড়ির আচলের সঙ্গে হোঁচট খেয়ে পড়তে ধরলে ইমান তাকে আকড়ে ধরে ফেলে। একহাতে তার বাহু ধরে নিচে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে এবং অন্য হাত দিয়ে তার কাঁধ স্পর্শ করে৷

মিরা কেঁপে কেঁপে উঠে ইমানের স্পর্শ পেয়ে। তার গোলাপের মতো ঠোঁটযুগল ও তিরতির করে কাপছে৷ ইমানের এতো কাছে দাঁড়িয়ে, তার শরীরের উষ্ণ ওম পেতেই তার চোখে জল এসে গেলো। এই আগলে রাখা হাত দুটো তার নয়। অন্যকারো ভাবতেই কান্না পাচ্ছে তার৷

ইমান কাঁধের উপর ভালোভাবে আঁচলটা পেচিয়ে দিয়ে বলে, সকাল-সকাল কাঁদার মানে কি ?কি বুঝাতে চাও? খুব ভালোবাসা-বাসি হচ্ছে?

মিরা নাক টেনে এক হাত তার আঁচলে ঠেকাল, অন্যহাত দিয়ে চোখের জল মুছে বলে, আমি কিছুই বুঝাতে চাই না। আপনি সুখে থাকুন আপনার প্রিয়তমা কে নিয়ে।

এরপর একদন্ড থেমে বলে, ওই ডাইনী মেয়েটাকে ডেডিকেট করেই আপনি রেডিওতে কাকা করতেন তাই না? হুহ!

ইমান ভ্রু কুচকে বলে, ডাইনী কে? তুমি ডাইনী কাকে বললে ?

মিরা ঢোক গিলে বলে, কাউকেই ডাউনী বলিনি।

এরপর ইমানের দিকে তাকিয়ে ভয় পাওয়া কণ্ঠে বলে, আমি নিজেই ডাইনী। আপনার প্রিয়তমা পরী। খুশি এবার?

ইমান বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে বলে, আমার প্রিয়তমা আমার হৃদয়ের রাজ্যহীন রাজ্যের একমাত্র আদুরে শেহজাদী এবং তুমি সেই রাজ্যে প্রবেশ করা এক দুষ্ট ডাইনী।

চলবে।

[ আজকে আমি দারুণ খুশি এজন্য কি একটা বোনাস দিব নাকি? বোনাস পড়তে চাইলে জানাবেন। [

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here