শেহজাদী পর্ব-৩৪

0
700

#শেহজাদী
Part–34
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

ইমান যখনই মিরার মুখের দিকে হাত বাড়ালো সঙ্গে সঙ্গে মিরা বিরাট বড় একটা কান্ড ঘটালো। তার ভাবনা ছিল ইমান বুঝি অনৈতিক কিছু বাসনা করছে নাহলে এমন আড়ালে কেন ডাকবে? কাজেই সে বেশ ভয় পেয়ে গেল। চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠলেও সাহস দেখিয়ে সে ইমানের নাক বরাবর একটা ঘুষি মারলো। ইমান প্রচন্ড ব্যথা পেল। আচমকা আক্রমণে সে প্রস্তুত ছিল না। মেয়েটা আজকে তার জানই নিয়ে নিত। বাপ রে! এতো জোরে কেউ ঘুষি মারে! মিরা তাকে সহ্য করতে পারে না এইজন্য বিয়ে ভেঙে দিয়েছিল কিন্তু তাই বলে তাকে এভাবে মারবে। এটা তো ঠিক না!

সে ব্যথায় ছটফট করতে করতে অস্ফুটস্বরে বলে, আহ্!

মিরা চোখ পাকিয়ে বলে, আপনাকে আমি ভালোবাসি তাই বলে যখন-তখন যা ইচ্ছা করার অধিকার তো আপনার নেই! অপ্রীতিকর কাজ যে-ই করুক না কেন চুপ থাকব না আমি।

ইমান নাকে হাত বুলাতে বুলাতে কটমট করে বলে, এতো হাত চলে কেন তোমার? মেরে ফেলার পায়তারা। কি করতে চাইছিলাম আমি যে ডিরেক আমাকে খুন করতে হবে? বল? এরপর একটু দমে গিয়ে বলে, আমি তোমার বিজনেস রাইভাল এজন্য রাস্তা থেকে আমাকে হটিয়ে এক চাটিয়া ব্যবসা করতে চাও জন্য সোজা আমাকে মেরে ফেলার বুদ্ধি।

তার কথা শুনে মিরার চোখ যেন কপালে উঠে গেল। এতোসব কুটনৈতিক বুদ্ধি তার মাথায় কোনদিন-ই আসা সম্ভব নয়।

সে বলে উঠে, আপনি অসভ্যতা করছিলেন জন্য ঘুষি মেরেছি৷ পাবলিক প্লেসে রেপিস্টদের মতো বিহেইভ কেন করছেন?

ইমান ব্যথা পাওয়ার পরও তার উপর ওতোটা ক্ষুব্ধ ছিল না কিন্তু শেষের লাইনটা শুনে তার রক্ত গরম হয়ে উঠলো। মাথার সব স্নায়ু টনটনে করে উঠে। রেপিস্ট শব্দকেও সে ঘৃণা করে অথচ যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে সে ব্যক্তি কিনা তাকে সেই ঘৃণিত তকমার সঙ্গে তাকে তুলনা করছে। ইমানের চোখ লাল হয়ে এলো। আজ পর্যন্ত কেউ বলতে পারবে না সে কোন মেয়েকে বদনজর দিয়েছে৷ এতোবড় একটা কোম্পানি সামলাচ্ছে, প্রতিদিন ই কতো নারী কর্মীর সঙ্গে কাজ করতে হচ্ছে। কতোজনে কতো খারাপ অফার দেয় কিন্তু কখনোই তাদের কালো অধ্যায়ে ধরা দেয় না সে! সবসময়ই নিজের ইমেজ ক্লিন রেখে এসেছে। এসব মিরা বুঝবে না! মিরার পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার বড় আব্বু। বড় আব্বু কখনোই তার ধারে-কাছে বিপদ ঘেঁষতে দিবে না। মিরা কখনোই তাকে বোঝার চেষ্টা করেনা।এই যে এখন কিন্তু সে মোটেও কোন খারাপ মতলবে মিরাকে এদিকে ডাকেনি। তার ঠোঁটের কিনারায় লাচ্ছি লেগেছিল জন্য টিস্যুই এগিয়ে দিচ্ছিল অথচ বরাবরের মতোন মিরা তাকে ভুল বুঝলো। সেবার পার্ভাট বলেছিল আজ রেপিস্ট!মিরা আসলে তাকে ভুল বুঝে না! ভুল বুঝলে শুধরে দেওয়া যেত, বরং তাকে চেনেই না! ইমানের মনের শুদ্ধতা সে দেখতে পায়না, অনুভব করতে পারেনা৷ এজন্য তার কষ্ট হয়।

ইমান ক্রোধ চোখে তাকিয়ে বলে, নিজেকে কি ভাবো তুমি? বিশ্বসুন্দরী? তোমার ছোঁয়ায় জন্য মানুষ উতলা হয়ে থাকবে? তুমি কি বলিউড নায়িকা? আমি আগেও বলেছি নিজেকে নিয়ে এতো অহংকার করবে না! এই রুপের বড়াই করা বন্ধ করো।

শেষের দিকে কথাগুলো ইমান বেশ জোর গলায় বলে। আশেপাশের সবাই তাদের দিকে তাকায় ইমানের আওয়াজে৷ চারপাশে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলো। মানুষ-জন চাওয়াচাওয়ি করছে। এমন পরিস্থিতিতে পড়ে মিরা খুব অপমানিত বোধ করছে। সে মাথা নিচু করে ফেলে।

সে পরোয়া না করে বলতে থাকে, তুমি খুব স্বার্থপর। শুধু নিজের কথা ভাবো। আর অন্যদের তাচ্ছিল্য করো। মানলাম তুমি একটা ভালো পজিশনে আছো, অনেক নাম-ডাক, এইজন্য একেবারে মাথায় উঠে নাচানাচি শুরু করে দিয়েছো।

মিরা চুপ হয়ে গেল। ইমান কিসের সঙ্গে কি মেলাচ্ছে সে বুঝে পাচ্ছে না কাজেই আহত গলায় বলে, সর‍্যি!

— ডোন্ট টক! (হুংকার দিয়ে কথাটা বলে হনহন করে হেঁটে অন্যদিকে চলে গেল। যাওয়ার আগে গাড়ির চাবি সাদের হাতে দিল)

ইমানের এহেন আচরণে মিরার চোখ ফেট জল গড়িয়ে আসল। হুট করে কেন ছেলেটা এতো রেগে গেল? রাগবার মতো কিছু ঘটেনি৷ ইমান চিৎকার-চেচামেচি তে ইরা, সাদ দুইজনেরি হতভম্ব।

ঘুরাঘুরির ইতি টেনে তারা রওনা দিল বাসার উদ্দেশ্য। ইমান কোথায় গেছে কে জানে? সাদ ড্রাইভ করতে লাগলো। পেছনে ইরা আর মিরা বসলো। মিরা গুনগুনিয়ে কান্না করছে। ইরা বারবার তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছে, আপু প্লিজ কেদো না। কেদে লাভ কি? শান্ত হও। ভাইয়া বুঝি কোন কারণে রেগে আছে। তাছাড়া এরকম একটা বিষ্ফোরণ হওয়ারই ছিল। ভাইয়ার স্বাভাবিক আচরণই আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগছিল৷

মিরা মুখে হাত চেপে কান্না থামানোর অক্লান্ত পরিশ্রম করছে৷

বাসায় এসেই মিরা রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। ইরা আর সাদ খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেল। বিশেষ করে সাদ। ভাই নেই অথচ সে এ বাড়িতে কি করে থাকে? বাসায় যাওয়ার ও উপায় নেই। কি করবে সে?

ইমান ভাইয়া আর মিরা ভাবীর মধ্যে যে সবকিছু আপনা-আপনি ঠিক হবে না তা দিব্যি টের পেয়েছে৷ একবার কি ভাবীর সঙ্গে কথা বলে দেখবে সে? ভাবীকে সব সত্য জানানো উচিত। সাদের জানা অনুযায়ী ভাইয়া কোনদিন মিরাকে মুখে কিছু বলেনি৷ সে কি জানিয়ে দিবে সব? এতে ভাইয়ার কষ্ট একটু হলেও লাঘব হলে মন্দ কি? ভাইয়ার বোঝা উচিত, একজনকে যদি আমি আমার মনের কথা নাই বলি সে জানতে কিভাবে? নিজের মনের দায়িত্ব সপে দেওয়ার আগে মুখে তো কিছু বলতে হবে!

মিরা বারান্দায় বসে আছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে।আযান শেষ হলো মাত্র। তার মন ভীষণ খারাপ। ইমান কেন এমন করলো? তাদের সঙ্গে ইমানকে না দেখে বড় আব্বু ভীষণ রাগ করেছেন। মিরা কড়া কয়েকটা কথা শোনাতে ভুলেননি। শুধু বড় আব্বু নয়, মাও কিছুক্ষণ আগে তাকে বকে গেল। ইমান বাড়ি না ফেরাটা যেন মিরা নিজ ইচ্ছায় ঘটিয়েছে সবার মনোভাব কিছুটা এমনই। সে উদাস হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বলে, প্লিজ ইমান বাসায় আসো! আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। তুমি এমন কেন করছো? কোথায় আছো এখন? প্লিজ কাম ব্যাক৷

তার চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। তার এই মূহুর্তে মনে হচ্ছে, সব দোষ তার৷ তার জন্যই ইমান রাগ করে বাসায় আসছে না। মিরা মৃদ্যু কণ্ঠে কান্না করছে।

এমন সময় সাদ রুমের দরজা নক করলো। মিরা চোখ মুছে দরজা খুলে দিল।

তাকে দেখে সাদ হালকা হেসে বলে, আসি?

মিরা সরে দাড়ালো। সাদ রুমে এসে চেয়ার টেনে বসে পড়ে৷

মিরা নাক টেনে, নিজেকে ধাতস্থ করে বলে, তোমার ভাইয়া কই? বাসায় আসছে না কেন? ইদের দুইদিন আগে নিশ্চয়ই অফিসে কাজ থাকবে না? কোথায় ও?

সাদ মাথা নিচু করে বলে, ভাইয়া তার ফ্রেন্ডের বাসায় গেছে। আজকে আসবে না।

মিরার মুখ কালো হয়ে গেল। সে শুকনো গলায় বলে, ও।

সাদ বলে, ভাবী?

মিরা চমকে উঠে সাদের দিকে অদ্ভুত চোখে তাকায়।

সাদ মাথা চুলকে বলে, সর‍্যি আপু।

— তোমার ভাবী বোধহয় আমি হতে পারব না।

— আপনি ভাইয়াকে ভালোবাসেন?

মিরা মুখে কিছু বললো না কিন্তু মাথা নাড়িয়ে সহমত পোষণ করলো। এরপর কোমল গলায় বলে, তোমার ভাইয়া আমাকে একদম পছন্দ করেনা৷ আগেও সে আমাকে পারিবারিক চাপে, দাদীর মন রক্ষার্থে বিয়ে করতে চেয়েছিল, এখন সব জানার পর ও আমাকে মানবে না সে।

সাদ কিছুটা বিষম গেল। সে প্রশ্ন করে, ভাইয়া এগুলো নিজে বলেছে?

— কোনগুলি?

— এই যে পারিবারিক চাপে বিয়ে করছে?

— হ্যাঁ। আমাকে নিজ মুখে বলেছে৷

সাদ হতভম্ব হয়ে গেল। সে বলে উঠে, ভাইয়া এসব কিভাবে বললো? আমি জানি সে আপনাকে কত্তো ভালোবাসে। সারাদিন আপনার কথা বলত আগে। ভাইয়া আপনাকে ম্যাথ পড়াত তাই না? আপনার অংক না পারা মুখ দেখে নাকি সে আপনার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল! আপনার চশমা পড়া চোখের মায়ায় সে তলিয়ে গিয়েছিল।

মিরা চমকে উঠে। সাদের কথা বিশ্বাস করতে তার কষ্ট হচ্ছে। শুধু তাই না! নিজের কানকেও বিশ্বাস হচ্ছে না। স্বপ্ন লাগছে সবকিছু!

সাদ মুচকি হেসে বলে, ভাইয়া আপনাকে এক বিশেষ নামে ডাকে৷ শুনতে চান সেই নামটা?

— কি?

— শেহজাদী। আমি তো আপনাকে শেহজাদী নামেই জানি। এইজন্য প্রথমে চিনতে পারিনি আপনাকে।

শেহজাদী শব্দটা কর্ণপাত হতেই মিরার গা বেয়ে শিহরণ বয়ে গেল। তার কান্না পাচ্ছে। ভীষণ কান্না। উহু এ কান্না দুঃখের না বরং সুখের। জীবনটা এতো সুন্দর কেন?

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here