শেহজাদী পর্ব-৪১ last part

0
4560

#শেহজাদী
Part–41
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

মিরার গায়ের উপর ঝিরিঝিরি পানি পড়ায় তার শরীর রক্ষা পাচ্ছে কিন্তু আগুনের এতো কাছে থাকায়, উত্তাপে মনে হচ্ছে, গা গলে গলে পড়বে। সামান্য আঁচ লাগাতেই সে যন্ত্রনায় ছটফট করছে। ঘেমে একাকার সে। ঘাম, পানি একসঙ্গে মিলেমিশে একাকার। হুট করে মিরার কানে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। কান্নার আওয়াজে সে পিলে চমকে উঠল। বাচ্চা কেন এখানে? বাচ্চাটা কি এখানে কোথাও আটকা পড়েছে? আগুন মাঝে কিভাবে আছে বাচ্চাটা?

সে কি যাবে সাহায্য করতে? বেশ দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে থাকে । চারপাশে আগুন, কাউকে বাঁচাতে গিয়ে যদি সে নিজে মরে পড়ে ছাই হয়? কি দরকার? তার চেয়ে নিজে সেইভ থাকাই উত্তম। কিন্তু বাচ্চাটার কণ্ঠে যখন আম্মু তুমি কই বলে কান্নার ধ্বনি ভেসে আসলো, মিরার মধ্যে মানবিকতা জাগ্রত হয়। আজকে যদি বাচ্চাটাকে সে সাহায্য না করে, তবে এ যাত্রায় বেঁচে ফিরলে কোনদিন কি সে নিজে নিজের মুখোমুখি হতে পারবে? পারবে না তো। এতোটাও নিষ্ঠুর না সে। মিরা সাত-পাঁচ না ভেবে বাথরুম থেকে বের হয়। সঙ্গে সঙ্গে হাতের এক অংশে দাউদাউ করে তান্ডব করতে থাকা আগুন লেগে গেল।

সে অস্থির হয়ে কান্না শুরু করে ফের ঝর্ণার নিচে আসে। সদ্য জ্বলে যাওয়া অংশে পানি লাগায়।এ যন্ত্রণা যেন মৃত্যুসম। তার কাঁদার বেগ বেড়ে গেল কিন্তু দমলো না। ফের এগিয়ে গেল। এবারে পায়ে চোট পেল। রডের চোখা অংশের সঙ্গে পা লেগে চামড়া উঠে মাংস উঠে যাওয়ার উপক্রম। রক্ত টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে।সে নাক টেনে, আরেকটু এগিয়ে যেতেই কান্নার শব্দ খুব নিকটে ভেসে আসে। ততোক্ষণে আর্তনাদের মাত্রা কমে এসেছে বা তার মস্তিষ্ক আর সেই অবস্থায় নেই যে খুব সুক্ষ্ম জিনিস ধারণ করতে পারবে৷ এক প্রকার ঘোরে চলে গেছে সে। চোখ জুড়ে কেবল আগুন আর আগুন। তার চোখের মনিতেও প্রতিফলিত হচ্ছে অগ্নি শিখা। এ যেন অগ্নি রাজ্য আর মিরা সেই রাজ্যের অগ্নিকন্যা! লাল সালোয়ার কামিজ পড়ায় তাকেও আগুনের এক অপার অংশ মনে হয়ে ভুল হতে পারে। ফর্সা গাল লাল হয়ে গেছে৷ হাতের এক অংশ জ্বলে গেছে। অদ্ভুত চোখগুলোতে দিশেহারা ভাব।

সে এগিয়ে এসে দেখলো একটা টেবিলের নিচে শ্রমিকের সেই ছোট বাচ্চাটা একাধারে কাঁদছে৷ সে হাঁটু গেড়ে রিনরিনে আওয়াজে বলে, আসো আমার সঙ্গে।

বাচ্চাটা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। তারও পায়ের বেশ খানিক জায়গা পুড়ে গেছে। সে নাকানিচুবানি দিয়ে কাঁদছে। মিরাও তাকে দেখে ডুকরে কেঁদে দিয়ে হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে বের হওয়ার আহ্বান জানায়। বাচ্চাটাও বাঁচার এক ঠুনকো আশায় হাত ধরে মিরার৷ কিন্তু তার পা ভারী দরজার চিপায় আটকা আছে। মিরা বহু কষ্টে বাচ্চাটার পা ছাড়িয়ে এনে, কোলে তুলে নিলো। তখনই বুঝি পাশে কোথায় বিষ্ফোরণ ঘটে। এতো জোরে শব্দ হলো যে আগামী পাঁচ মিনিট মিরার কানে কোন শব্দ ঢুকলো না। সে দৌঁড়াতে লাগে এক অজানা গন্তব্যে। কোনদিকে যাবে? ভেতরে ঢুকবে? বাথরুমের দিকে সবটা জ্বলে ছারখার। তবুও ওইদিকে পানি আছে। আগুমের জম তো পানি। পানির নিচেই থাকা উচিৎ, বাইরে বের হওয়ার চেয়ে। সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় বাথরুমের দিকে। কিন্তু হায় পোড়াকপাল! বাথরুমের ঝর্ণার কলই ভেঙে পড়ে আছে৷ তার মাথায় বাজ ভেঙে পড়লো। এদিকে আর এক দণ্ড থামলেই আগুনের খাদ্য হতে হবে তাদের। সে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়েই বেশ শক্ত করে বুকের সঙ্গে লেপ্টে নিয়ে প্রচন্ড বেগে দৌঁড়াতে লাগলো উলটা পথে৷

দৌঁড়াতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে যায় তারা। দুইজনই আহত হয়। মিরার পেটের বাম দিকের বেশ খানিকটা অংশ কেটে যায়৷ কামিজ ছিঁড়ে যায়। সে তবুও দমে না। বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে দোয়া পড়ে। দোয়া পড়তেই অন্য কোন ভূবন থেকে এক রাশ সাহস, স্পৃহা তার ভেতর এসে হানা দিলো। সে সাহসীকতার সঙ্গে হাঁটা ধরে। এবারে হাঁটার গতি মন্থন হয়ে গেছে। নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে হাঁটছে সে। নিস্তেজ শরীর নিয়ে হাঁটা দায়। ইতিমধ্যেই বাচ্চাটা অজ্ঞান হয়ে গেছে ভয়ে। বাচ্চাটা কিভাবে বাথরুম অব্দি এলো তা জানে না সে।

বাথরুম পেরিয়ে, কলিডোর পার করে সদর দরজার কাছে আসার আগেই মিরার মাথায় উপর দিয়ে কিছু একটা পড়লো। মাথায় আঘাত পাওয়ায় গলগল করে রক্ত পড়তে লাগে। সে বুঝে গেল, মিনিট একের মধ্যে জ্ঞান হারাবে। জ্ঞান হারানো মানেই পুড়ে যাওয়া। নিজের চোখ খুলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। লাভ হচ্ছে না। আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে আসছে চোখ। হাতের বন্ধন আলগা হচ্ছে। সে হাঁটু ভাজ করে বসে৷ কানে এবারে শব্দ ভেসে আসছে। দূরে কোথাও কেউ বাঁচার আকুতি করছে৷ মিরা চোখ বুজে বিড়বিড় করে বলে, ইমান তোমাকে করা ওয়াদা বুঝি পূরণ করতে পারব না। না চাইতেও ছেড়ে চলে যাচ্ছি।

ধপ করে লুটিয়ে পড়লো দুটি প্রাণ। মাটিতে নিস্তেজ, অযত্নে পড়ে রইল কারো রাজ্যহীন রাজ্যের শেহজাদী। কেউ কি নেই যে তাকে বাঁচাতে পারবে? মৃত্যু কি এতো সহজ? মৃত্যু কি খুব কাছে? সে কি মৃত্যুকে দেখতে পাচ্ছে নাকি মৃত্যু তাকে ঈগল চোখে দেখছে?

★★★

ইমান লন্ডনের সবচেয়ে বড় শপিংমল থেকে মিরার জন্য জামা কিনেছে। জামাগুলো হাতে ধরে মনে মনে কল্পনা করেছে মিরাকে কেমন লাগবে এই জামা পড়লে? মিরা দুধে আলতা ফর্সা হওয়ায় তার গায়ে গোলাপি খুব মানায়৷ সে মিরার জন্য একটা দামী হিরার নোসপিন কিনে। এরপর ফ্লাইটের জন্য এয়ারপোর্টে রওনা হয়। আজ সাতটা দিন ধরে মিরা বা বাসায় কারো সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই। সে ভীষণ ব্যস্ত ছিল। অপর দিকে মিরাকে একটানা বিশ বার কল করেও যখন মিরা রিসিভ করেনি বা ব্যাক করেনি সে রেগে গিয়ে আর কল করেনি৷ ইমানের মনে, কল্পনায় একবারের জন্যও খারাপ কিছু ভাবনা জাগেনি। সে এয়ারপোর্টে পৌঁছে বাবাকে কল লাগায়। বাবাও ধরলো না। সাদের সঙ্গে তিন দিন আগে কথা হয়েছিল৷

ইমান যখন বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে পৌঁছে তখন রাত বারোটা। অনেক ক্লান্ত থাকায় সে আর মিরার বাসায় না গিয়ে নিজের বাসায় এসে এক ঘুম দেয়। ঘুম যখন ভাঙ্গল তার, তখন সকাল দশটা৷ সে উঠে ফ্রেস হয়ে নাস্তা করতে গিয়ে বুঝতে পারে, বাসার পরিবেশ ঠিক না কিন্তু সবই আপাতদৃষ্টিতে ঠিক মনে হচ্ছে। কিন্তু তার মন বলে উঠে, কিছু একটা ঠিক নেই। সে নাস্তা খেতে বসে জানলো, বাবা আর সাদ অফিসে। এখানেও খটকা লাগে। সাদ তার সঙ্গে দেখা করেনি এটা হতেই পারেনা। তবে কি কোন কারণে সাদ তাকে ইগনোর করছে? কিন্তু কি জন্য?

হাসনাহেনা রুম থেকে বেরিয়ে ইমানের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে৷ ইমান নাস্তা খেয়ে বলে, বাসায় বিয়ের আমেজ নেই কেন? দুদিন পর বাসায় একটা বিয়ে অথচ বাসা দেখলে মনে হচ্ছে শোকসভা পালিত হচ্ছে৷

হাসনাহেনা বলে, বিয়ে হলে তো বিয়ের আমেজ থাকবে?

ইমান চমকে উঠে। নামহীন এক চাপা ভয় খামচে ধরে তার মনে। সে শুকনো ঢোক গিলে বলে, মানে? কি বুঝাতে চান আপনি?

হাসনাহেনা মুখ কালো করে বলে, তোমার বউ আর এই বিয়ে করবে না। বিয়ে ভেঙে দিয়েছে ওরা।

ইমানের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। বুক ভারী হয়ে আসে। সে কিছুতেই ছোটমায়ের কথা বিশ্বাস করেনা। সে জানে মিরা একাজ কখনোই করবে না। সে কথাটা আমলে না নিয়ে খাওয়া বাদ দিয়ে, এমন কি এক চুমুক পানি না খেয়েই রওনা হলো সূত্রাপুর। নিশ্চয়ই মিরা তার সঙ্গে গেম খেলছে। মেয়েটা কি বড় হবে না? এখনো কি এসব শোভা পায়? আজকে মিরাকে ছাড় দেওয়া যাবে না। খুব করে বকতে হবে। সবসময়ই ফাজলামো ভালো লাগে না।

রাস্তার জ্যাম ঠেলে যখন মিরাদের বাসায় সে পৌঁছে তখন বেলা একটা পাঁচ। কাছের মসজিদটা থেকে আযান ভেসে আসছে৷ সে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি অতিক্রম করে মিরার বাসায় আসলো। বেল বাজাতেই বড় আব্বু গেইট খুলে, তাকে দেখে যেন হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন।

ইমান ভনিতা না করে বলে, মামা মিরা কই?

— ওতো বাসায় নেই।

— বাসায় নেই মানে কই গেছে?

বড় আব্বু থেমে গেলেন। কিছু বলতে পারলেন না। শুধু বললেন, মিরা তোমাকে বিয়ে করবে না। এ বিয়েটা হচ্ছে না৷ বাসায় যাও৷

মামার কণ্ঠস্বর অত্যাধিক শীতল আর কঠিন ছিল বিধায় ইমান স্তব্ধ হয়ে গেল। মাথা ভোভো করতে লাগলো তার। বুকে ফাটল ধরলো।

সে পাগল প্রায় হয়ে বলে, মিরা কই? সাতদিন ধরে ওর সাথে কথা হয় না? একবার দেখা করতে দিন প্লিজ।

— ওতো নেই। চলে গেছে৷

ইমানের বুক দুমড়েমুচড়ে ছারখার হতে লাগলো। সে এলোমেলো পায়ে নিচে নেমে এলো। সবকিছু দুঃস্বপ্ন যেন হয় এই প্রার্থনা করছে সে। তার ভালোবাসার মানুষ তাকে প্রতারণা করবে না এইটুকু ভরসা তার আছেই৷ সে ঘণ ঘণ শ্বাস নেয়। ফুসফুসে অক্সিজেনের ঘাটতি হলো বুঝি। সে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসলো। মামার কঠোরতা তার হজম হচ্ছে না। মিরার সাথে কথা বলার সুযোগ হচ্ছে না কেন তার? কোথায় ও? ইমান আবার তিনতলা উঠে একাধারে বেল বাজাতে লাগলো। ততোক্ষণে সে ঘেমে-নেয়ে একাকার। চিপচিপে ঘেমে গেছে। শার্ট ভিজে উঠেছে। আবারো বড় মামা গেইট খুলে তার দিকে আহত চোখে তাকিয়ে বলে, কি হলো আবার?

— মামা আমি মিরার সঙ্গে কথা বলব।

— ওতো বাসায় নেই।

— কই গেছে?

— আমার জানা নেই৷

— মামা আপনি কি মজা করছেন আমার সঙ্গে?

বড় মামা কঠিন গলায় বলে, না।

— প্লিজ আমার উপর দয়া করে একবার বলুন ও কোথায়?

মামা মুখ ঘুরাতেই ইমান তার পায়ে পড়ে বলে, মামা এমন কেন করা হচ্ছে আমার সঙ্গে? আমি কি কিছু ভুল করেছি? প্লিজ আমার উপর দয়া করুন৷

— মিরা তোমাকে বিয়ে করবে না। এ বিয়েটা হচ্ছে না।

ইমান উঠে দাড়িয়ে বলে, আমাকে না জানিয়েই আমার বিয়ে ভাংলো কিভাবে?

— কনে রাজী না থাকলে কি করার?

ইমান থমকে যায়। ভীষণ আহত হয়েছে সে। মেঝেতে বসে পড়তে মন চাচ্ছে তার। মামা মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলেও নির্বাক রইল। দরজার সামনে এক ঘন্টা বসে কাটালো সে। মিরার ফোন বন্ধ। সে কি ফের পালিয়ে গেল? তার বুক হাহাকার করে উঠে। হুট করে রিং বেজে উঠল। সে রিসিভ করতেই ডেলিভারি ম্যান তাকে জানালো মিরা নামের কেউ একজন তাকে ফোন গিফট দিবে। তারা ডেলিভারি দিতে আসবে। ইমানের খড়া ধরা বুকে যেন এক পশলা বৃষ্টির আর্বিভাব ঘটে। তার মানে মিরা পালিয়ে যায়নি। পালিয়ে গেলে কি আর ফোন গিফট দিত? সে আশার আলো খুজতে লাগে। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। কিন্তু এমন হলো? উত্তর জানা নেই তার।

সে হাঁটা ধরতেই মিরাদের বাসার দোতলার এক মহিলার সঙ্গে ধাক্কা খায় সে। ইমানের আসলে শরীরের প্রতিটা কোষ উত্তেজিত। স্নায়ুকোষ উত্তেজনায় ঠকঠক করে কাঁপছে। সে কোনমতে বলে, সর‍্যি৷

— এই তুমি ইমান না? আজমল ভাইয়ের ভাগ্না?

— হ্যাঁ।

— কেমন আছো বাবা? জানি এই শোক খুব বেদনার কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। কিছু করার নাই তো! আমাদের হাতে কিছু নেই।

সবকিছু আল্লাহর হুকুমে হয়। আমরা মানুষ কি বা করব? নিজেকে সামলাও। শক্ত হও। বেশি বেশি দোয়া করো।

ইমান ভ্রু কুচকে করুণ গলায় বলে, কি বলছেন আপনি? আমি কিছুই বুঝছি না।

মহিলাটা হতাশ হয়ে বলে, বাবা তুমি কিছু জানো না?

— কি জানব আমি?

— দেশের সব জায়গায়ই তো খবরটা ছাপানো হয়েছে।

ইমান ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে, আমাকে প্লিজ ডিটেইলস জানান। মামা কিছুই বলছে না৷ আমি দেশের বাইরে ছিলাম। কিচ্ছু জানি না। আমার মিরার কি হয়েছে? প্লিজ সব খুলে বলুন! আমি মারা যাচ্ছি।

মহিলাটি একে একে সব খুলে বলতেই ইমান হাঁটু গেড়ে বসে ওখানে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। বুকের ভেতর এতো ব্যথা হচ্ছে। হাত কাঁপছে, পা কাঁপছে। মরে যেতে মন চাচ্ছে তার। বেঁচে থেকেই বা কি লাভ?

★★★

ডিসেম্বর মাস। ক্রিসমাসের দুইদিন আগে সারা নিউইয়র্ক জুড়ে যেন উৎসবের মেলা বসে। প্রতিটা বাসার সামনে সাজানো হয়, লাইটিং করা হয়৷ এবার নিউইয়র্কে প্রচন্ড শীত। অবশ্য প্রতি বছরই শীত পড়ে খুব। মাইসেনের ঘরে তাপমাত্রা আছে। আজকে সামান্য ঝিলিক মেরে আয়েসী ভঙ্গিতে সূযিমামা নিউইয়র্কের উপর দয়া দেখিয়েছেন। সব বাচ্চারা ইতিমধ্যেই পার্কে চলে গেছে খেলতে। কিশার-কিশোরীরা সাইকেল নিয়ে বের হয়েছে। থেকে থেকে হীম শীতল বাতাস বয়ে বেড়াচ্ছে। কালকে রাতেও বরফ পড়েছে। চারপাশে স্নোতে মাখা।

সাদা শুভ্র তুতোর প্যাচার মতো বরফে যখন সূর্যের কিরণ পড়ে কি যে অদ্ভুত সুন্দর লাগে! আজকেও এমন দৃশ্য নিউইয়র্কের বুকে দেখা যাচ্ছে। তবে তুষারপাত সবার জন্য আনন্দময় নয়। তেমনই “চড়ুই রাজ্যে”র কর্তার কাছেও তুষারপাত বেশ বিরক্তির এক কারণ। কেননা বাসার সামনে জমা বরফ তাকেই ক্লিন করা লাগে।

আমেরিকার কোন স্ট্রেটে বাংলায় কারো বাসার নাম রাখার কাজটিকে চড়ুই রাজ্যের মালিক সম্ভব করে দেখিয়েছেন। যেটা কিনা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। আমেরিকার বুকে বাংলা ভাষায় একটা ছোট্ট বাসার নামকরণ হয়েছে। আমেরিকান এটাকে বেশ এপ্রিসিয়েট করে। নামটা নিয়ে অনেকেই কৌতুহল দেখায়। দেখাবে বা না কেন? ছোট রাজপ্রাসাদের মতো সাদা বাড়িটার গেইট ঘেঁষেই চেরি ফুলের রাজ্য। ছিমছাম হলেও অদ্ভুত সুন্দর বাড়িটা।বাসাটার জানালায় কাচের থাই নেই বরং খুব সুন্দর নকশা করা, পুরাতন আমলের কাঠের জানালা। জানালার সঙ্গে সানসেট। সানসেট বেয়ে পাখির বাসাও আছে। এবং জানালা বেয়ে দারুণ এক নীল রঙের লতানো ফুল গাছ আছে। এই বাসার মালিক যে শৌখিন তা দিব্যি বোঝা যায়।

সবার নজর কাড়তে সক্ষম এই সাদা বাড়িটা। ক্রিসমাসে কেবল এই সুন্দর বাড়িটাই সাজানো হয় না কারন এই বাড়িতে মুসলিম ফ্যামিলি থাকে।

দিনের শুরুতেই মিস্টার হ্যানকসের সঙ্গে দেখা হলো ইমানের। সে মুচকি হেসে বলে, হ্যালো স্যার। হাউ ইজ ইউর ডে?

মিস্টার রবার্ট হ্যানকস একজন ফিজিক্স প্রফেসর। উনি ইমানকে দেখে এক গাল হেসে বলে, আই এম ফাইন। ইটস এ সাইনি এন্ড বিউটিফুল ডে। হাউ এবাউট ইউ?

— আমি এম ওলস ফাইন।

— হোয়ার ইজ ইউর সান?

ইমান গেটের সামনের বরফ পরিষ্কার করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সোয়েটারের হাতা গুটিয়ে নিয়ে ইংরেজিতে বলে, এমন দিনে আপনার মনে হয় ও বাসায় থাকবে? খেলতে চলে গেছে।

মিস্টার হ্যানকস হেসে বলে, এটা খেলারই বয়স। মজা করতে বাঁধা দিও না।

আমেরিকানরা ফুর্তিবাজ হয়।তারা বেশিক্ষণ শোক পালান করতে নারাজ। সবসময়ই আনন্দের মাঝে থাকতে পছন্দ করে। ছেলেকে দেখলে ইমান নিজেই ভ্যাবাচেকা খায়। ছেলের আচরণে আমেরিকার প্রভাব আছে সবকিছুতেই। এমনকি চেহারাটাও বিদেশি-বিদেশি লাগে। ভীষণ ফর্সা, বিলাই চোখ। অবশ্য আমেরিকান বাচ্চার মধ্যে তো আমেরিকার প্রভাব থাকবেই। সে আর বাঙালী না।

ইমান বরফ পরিষ্কার করে ব্যাক ইয়াডে গেল। বাগান পরিষ্কার করতে হবে। বাগানে যেতেই তার মন ভরে যায়৷ কি সুন্দর ফুল ফুটেছে। সে মৃদ্যু হেসে কাজে লেগে পড়ে। সময় নষ্ট করা যাবে না।

সে বাগান ক্লিন করে, টবে পানি দিয়ে, রান্নাঘরে গেল। ব্রেকফাস্ট করা হয়নি। দ্রুত স্যান্ডউইচ বানানোর জন্য ব্রেড বের করে, নাগেটস ভাজতে দিলো। ওর্টসের জন্য দুধ বয়েল করতে দেওয়া হলো। দুই প্রকার ফল কেটে, সর্বশেষে চা বানাতে দিলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ওলমোস্ট এগারোটা বাজে। ফালাক এখনো কিছু খায়নি।ছেলেটার আসারও কোন নাম নাই এখনো। উপায় না পেয়ে সে নিজেই বের হলো পার্কের উদ্দেশ্য।

পার্কে পৌঁছাতেই তার চোখ কপালে। ফালাক সহ তার কিছু ফ্রেন্ড বরফ ছোড়াছুড়ি করছে।স্নোম্যান বানিয়েছে তারা৷ আবার বরফ মুখে নিয়ে চিবুচ্ছে। ইমান হতভম্ব হয়ে রইল। সে এগিয়ে এসে ফালাককে কোলে তুলে নিলো। ফালাক বিরক্ত হয়ে বাবাকে ইংরেজিতে বলে, আমি কি এখনো ছোট আছি যে কোলে নিবে। নামাও পাপা। আমার ফ্রেন্ডরা হাসাহাসি করবে।

ইমান তার কথা না শুনেই কোলে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্য রওনা হলো। নাস্তা না করে বরফ খাওয়ার মানে হয়!

★★★

সাদ পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিল। শীতের সকাল। কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুম যেন স্বর্গসুখ। কিছুক্ষণ আগে নাকও ডাকছিল কিন্তু এখন সে বেশ তিক্ততা নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে বসলো। তার সামনে ইরা রাগী চোখে দাঁড়িয়ে আছে। সাদ উঠে বসতেই, সে বেজায় রাগী গলায় বলে, কি সমস্যা তোমার? এতো ঘুমাও কেন? বাজারে কে যাবে?

সাদ হাই তুলে বলে, ড্রাইভারকে পাঠাও না।

ইরা দ্বিগুন রাগী গলায় বলে, সংসারের সব কাজ যদি ড্রাইভার করে তবে আপনাকে কেন বিয়ে করলাম? ড্রাইভারের সঙ্গে ই সংসার করতাম।

কথাটা শেষ হওয়া মাত্র ইরার হাত ধরে হ্যাচকা টান মেরে, তাকে বুকের উপর ফেলে সাদ থমথমে গলায় বলে, কি বল্লা? আবার বলো?

— কিছু না।

— কথাটা কিন্তু খুব খারাপ বলেছো!

— আহারে তাহলে এবার উঠে বাজারে যান। বাবুর ডায়পার শেষ।

সাদ তার কোমড় জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমু খেতে ধরলে ইরা সরে এসে বলে, লজ্জা করে না? পাশেই মেয়ে আছে। এতো অসভ্য কেন তুমি?

সাদ মেয়ের দিকে তাকালো। বাপ-মেয়ে একসঙ্গে ঘুমাচ্ছিল কিন্তু মাঝ দিয়ে ভিলেন এসে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।মেয়ে তার ঘুমে জল। সকালে উঠে দুধ খেয়ে কিছুক্ষণ খেলা করে এখন আবার ঘুমাচ্ছে। সাদ মেয়েকে দেখে বলে, ও কি এসব বুঝে নাকি? হ্যাঁ? খালি পালানোর ধান্দা।

ইরা ততোক্ষণে সরে এসে চুল বাঁধতে বাঁধতে বলে, আজকে কিন্তু মায়ের ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। বিকেলে নিয়ে যেও৷

— আচ্ছা।

ইরা রান্নাঘরে চলে গেল। খান পরিবারের রাজত্ব বলতে গেলে এখন ইরার হাতে। জহির খান আর হাসনাহেনার বয়স বেড়েছে। তারা আর ফ্যামিলি কর্তত্বে নেই। এ বাড়ির বড় ছেলে পিএইচডি করার জন্য নিউইয়র্ক সেটেল হওয়ায় ছোট ছেলের উপর দায়িত্ব বেড়েছে। ইরা কফি বানাচ্ছে। আজকে সাদের জন্য একটা বিশেষ সারপ্রাইজ আছে। তারা দ্বিতীয়বারের জন্য বাবা-মা হতে যাচ্ছে। ব্যাপারটা সাদ এখনো জানে না। বর্ষার ছোট কোন ভাই বা বোন আসছে খুবই শীঘ্রই।

★★★

মিরা ঘুম থেকে জেগে উঠে রান্নাঘরে কফি মেকারের আওয়াজে। শব্দ কানে আসতেই মিষ্টি হাসি ফুটে উঠে তার ঠোঁটের কোনে। নিশ্চয়ই আজকেও ইমান নাস্তা বানাচ্ছে তাদের জন্য আর আজকেও মিরা দেরিতে ঘুম থেকে উঠেছে। যেদিন করে সে লেটে উঠে, ওইদিনে ইমান রান্না করে তাদের জন্য। মিরা দিন দিন অলস হয়ে যাচ্ছে। সে আড়মোড়া ভেঙে নাইট সুট পড়েই বাথরুমে গিয়ে ব্রাশ হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে আসে।ততোক্ষণে কফি মেশিন থেমে গেছে। সে বারান্দায় আসতেই অবাক হলো। ইমান আর ফালাক মিলে গিফট প্যাকিং করছে। নিউইয়র্কের ট্রেডিশন হলো ক্রিসমাস উপলক্ষে সবাই সবাইকে উপহার দিবে। যদিও বা তারা ক্রিসমাস পালন করে না কিন্তু প্রতিবেশীরা গিফট তবুও দিয়ে যায়। কাজেই রিটার্ন গিফট না পাঠালে খুব বাজে দেখায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ব্রাশ করে মুখ-হাত ধুতে বাথরুমে এসে বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে মুখ ধুলো এরপর সামনের দিকে তাকাতেই গুটি গুটি বাংলা অক্ষরে লেখা, “রাজকন্যারা আয়না দেখে না।”

সে মুচকি হেসে বের হয়ে চুল আছড়াতে লাগলো। তাদের ডেসিং টেবিলে কোন কাঁচ নেই। কাজের বদলে সুন্দর করে লেখা, শেহজাদীরা সর্বদাই সুন্দর।

লেখাটা পড়ে মিরা অতীতের ভাবনায় পাড়ি জমায়।অতীতের কথা গুলো সব ইমানের মুখে শোনা তবুও যেন মিরার অদ্ভুত সুন্দর চোখে সবটা দৃশ্য ভাসে যেন ঘটনাগুলো তার সঙ্গেই ঘটেছিল।

সেদিন মহিলাটার কাছ থেকে সব শোনার পর ইমানের পাগল প্রায় অবস্থা হয়৷ ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে তার। মিরাকে প্রতারক মনে হচ্ছে। সে নিজের শরীর এগিয়ে নিয়ে যেতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। বহু কষ্টে কাক্ষিত জায়গায় পৌঁছে প্রায় একঘন্টা পর। এই এক ঘন্টা সে মূর্তির মতো বসে ছিল গাড়িতে।

চানখারপুলের শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের সামনে দাঁড়াতেই তার বুক হুহু করে উঠে। মহিলাটার কথাও তার বিশ্বাস হচ্ছে না।সবাইকে মিথ্যুক মনে হচ্ছে। সবাই মিথ্যুক, সব মিথ্যা, কেবল সত্য সে মিরাকে ভালোবাসে। আর সবকিছু ধুলিমাখা, জঞ্জালে ঘেরা।

এগিয়ে যাওয়াটাও দুষ্কর। তবুও সাহস সঞ্চার করে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে পড়ে। শত মানুষের ভীড় সেখানে। সদ্য নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে আগুন দুর্ঘটনায় দগ্ধ হওয়া মানুষগুলোর আত্মীয়রা ভীড় করে আছে। সারাদেশে ছড়িয়ে গেছে রূপগঞ্জের টেক্সটাইল কারখানায় আগুন লাগার খবর। দারোয়ান কারখানার মেইন গেইট তালাবদ্ধ করে চা খেতে চলে গিয়েছিল, তখন দুর্ঘটনা ঘটে যায়। মেশিন ব্লাস্ট হয় , মূলত বিদুতের শর্টসার্কিট থেকে আগুন লেগে যায় কারখানায়। পুলিশ তদন্ত করে খবর পেয়েছে, কারখানায় চোরাই বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল এবং এই দুর্ঘটনার পর দারোয়ান পলাতক। তালাবদ্ধ থাকায় কেউ বের হতে পারছিল না ফলে উনচল্লিশ জনের মৃত্যু হয় এবং ত্রিশজনের মতো আহত। আর দুইজনের খবর পাওয়া যায়নি। অবশ্য ফায়ার সার্ভিসের লোক ঠিক সময় এসে পৌঁছেছিল জন্য অনেকেই রক্ষা পায় সেদিন।

ইমান হন্তদন্ত হয়ে বার্ন ইউনিটের প্রতিটা বেড খুঁজা আরম্ভ করে। রোগী বেশি হওয়ায় ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থার অবনতি হয়েছে। সে ভীড় ঠেলে প্রতি ওয়ার্ডের বেডে বেডে তার শেহজাদীকে খুঁজছে। শ্বাসরুদ্ধদ্বার অবস্থা তার। চারপাশের কোনদিকে হুশ নেই। ভীষণ অস্থিরতা গ্রাস করে ফেলেছে। তার মরনও এরচেয়ে সহজ!

ইমান একেবারে শেষ ওয়ার্ডে ঢুকতেই হিমশিম খেয়ে গেল। ওয়ার্ডের তিন নাম্বার বেডে গুটিসুটি মেরে একটা নারী অবয়ব শুয়ে আছে। চেহারায় ব্যান্ডেজ করা। হাতে ব্যান্ডেজ। এতো এতো রোগীর মাঝেও ইমান ঠিক ঠিক চিনতে পারলো, ওটা আর কেউ নয় বরং তার মিরা।

সে থমকে দাঁড়িয়ে রইল। কাছে যেতে সাহস পাচ্ছে না। মিরা কেন এমন করছে? কেন? কেন? তার থেকে দূরে সরার পরিকল্পনা করেছে কেন? কেন বড় মামা মিথ্যা বলছে আর সবচেয়ে বড় কথা তার সঙ্গেই কেন এমন হলো? একটারও উত্তর জানা নেই৷

সে এগিয়ে গিয়ে তিন নাম্বার বেডের সামনে দাঁড়ালো। গা ঠকঠক করে কাঁপছে৷ মনে হচ্ছে একটু পরই খিঁচুনি শুরু হবে তার৷

সে বেডের কাছে হাঁটু ভাজ করে বসে আস্তে করে ডাক দেয়, মিরা?

মিরা চোখ খুলে। চিরপরিচিত কণ্ঠটা শুনে তার হৃদয় ভাংচুর হতে থাকে। এই ছেলেটার কাছে সে মুখ দেখাবে কিভাবে? এই কুৎসিত, পুড়ে যাওয়া বীভৎস চেহারা সে নিজেই দেখতে চায় না, সেখানে তার সামনে কিভাবে যাবে সে? চোখের সামনে তার ক্লান্তসিক্ত, কাহিল, অসহায় মুখটা দেখতেই মিরা বুকটাও পুড়ে যেতে লাগলো। কান্নারা দলা পাকিয়ে এসে চোখ উপচে পড়লো।

ইমান মলিন গলায় বলে, কাঁদে না। আমি আছি তো।

— আমি চাই না আপনি থাকুন। আমি অনেক কুৎসিত হয়ে গেছি। আগের মতো সুন্দর নেই। ইমান আমি মরে যেতে চাই। প্লিজ আমাকে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করুন।

মিরার কথাগুলো কর্ণপাত হতেই ইমানের চোখ ফেটে নোনাজল গড়ালো৷ সে বাকহারা হয়ে চেয়ে রইল। কথা বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে। মিরা সমানে কেঁদেই যাচ্ছে। বিরতিহীন কান্নারা প্রতিধ্বনি হয়ে বারংবার ইমানের কানে এসে ঠেকছে৷ অসহ্য অসহ্য যন্ত্রনায় তারা কাবু হতে থাকলো। তাদের কাছে পৃথিবী নিষ্ঠুর, সৌন্দর্যর ছিটেফোঁটাও রইল না স্বপ্নের মতো রঙিন হতে পারা জীবনটায়।

আচমকা ইমান তার হাত ধরে বলে, তুমি আমার রুপকথার ওই প্রাণভোমরা! তোমার মধ্যে আমার প্রান সঞ্চার আছে।ব্যক্তি স্বয়ং নিজে কখনোই নিজের কাছে কুৎসিত হয় না! তোমাতে আমি জীবিত, তুমিহীনা আমি বিলীন! নিজের বেঁচে থাকার জন্য হলেও তোমার প্রয়োজন! মিরা জানো? সৌন্দর্য আপেক্ষিক কিন্তু ভালোবাসা ধ্রুবক।

মিরার কান্নার বেগ বেড়ে গেল। সে তার হাত চেপে ধরে বলে, আপনাকে অনেক ভালোবাসি। কিন্তু,,,,,,

— ভালোবাসায় কোন ধরনের কিন্তু অথবা থাকে না।

মিরা বেড থেকে উঠার চেষ্টা করলে, ইমান বাঁধা দিয়ে বলে, উঠতে হবে না। রেস্ট নাও। আমি আছি। আর সবসময় থাকব। সেদিন ভাগ্যক্রমে সে জীবিত বেচে ফিরেছিল। তার জ্ঞান হারানোর পরপর ফায়ার সার্ভিসের লোক উদ্ধার কাজে আসে এবং মিরা একেবারে ফ্রন্টে থাকায় তাকে উদ্ধার করতে ঝামেলা না হলেও বির্সজন দিতে হয়েছে রুপ, সৌন্দর্য। একবার যা জ্বলে যায় তা কি আর ফিরে পাওয়া যায়?

ফালাকের চেচামেচিতে অতীত থেকে বের হলো মিরা। এরপর আস্তে-ধীরে সে রুম থেকে বের হতেই ফালাক চেচিয়ে বলে, মাম্মা! দেখো পাপা কতো বড় চকলেট এনেছে। তুমি আসো। একসঙ্গে খাব।

মিরা ছেলের কাছে গেল। এরপর মা-ছেলে মিলে চকলেটের প্যাকেট খুলে খাওয়া শুরু করে দিলো।

ইমান বলে, মিরা খালি পেটে চকলেট কেন খাচ্ছো? আগে নাস্তা করো৷

— নাস্তা মজা না৷

— তাহলে অন্তত একটা ওমলেট খাও।

মিরা তার কথায় পাত্তা দিলো না। ইমান চেয়ে আছে তার চড়ুই রাজ্যের দুই মাত্র বাসিন্দাদের দিকে। তার শেহজাদী আর রাজপুত্র চকলেট খাচ্ছে আর সে মুগ্ধ হয়ে দেখছে। আগুনে পুড়ে যাওয়া ওই ঝলসানো চেহারার মেয়েটাকে সে জান-প্রান উজাড় করে ভালোবাসে। সে চড়ুই রাজ্যের সৈনিক। তার প্রধান দায়িত্ব শেহজাদীকে সকল অনিষ্ট থেকে রক্ষা করা। সে নিজ দায়িত্বে নিরলস ভাবে নিয়োজিত। সে একজন ইমানদার সৈনিক ।

এই মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকলেও তার শান্তি লাগে। সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে যায় সে। তার হাতে হাত রাখলে পৃথিবীর সব আবদার মিটে যায়। চোখে চোখ রাখলে ভূবন থেকে হারিয়ে যায় বহুদূর। এমন এক রাজ্যে বিচরণ করে, যেখানে সৌন্দর্যের বড়াই নেই, অহংকার নেই। এমনকি সৌন্দর্যের কোন ভূমিকাও নেই। ভালোবাসাই মূখ্য এবং ভালোবাসাই গৌণ।

ভালোবাসা এমন এক শক্তি যা সবকিছুকে ঠুনকো করতে অবলীলায় সক্ষম।

ইমান তার ছোট্ট পরিবারের দিকে যতোবারই তাকায় ততোবারই মনে একটা প্রশ্ন জাগে,

Why life is so beautiful?

উত্তরটা তার জানা নেই। এক জীবনে সব প্রশ্নের উত্তর মেলানো যায় না। তার এই প্রশ্নের উত্তর হয়তোবা অন্য কেউ জানে। জানে না? কি জানি? কেউ কেউ জানে বোধহয় !

The end.

[ আসসালামু আলাইকুম।এদিকে আসেন, কিছু কথা বলি, পার্ট ৪০ এবং এই পার্ট একসঙ্গে পড়লে বেশি ভালো লাগত কারণ অর্ধেক পড়ার পর অনেকেই গল্প সংক্রান্ত চিন্তা-ভাবনা করেছে। এরপর অনেক যৌক্তিক বিষয় ভেবে বের করেছে। কিন্তু মনে রাখা উচিৎ, গল্পের আরেক নাম কেচ্ছা। গল্প সবসময়ই অবাস্তব, কাল্পনিক। গল্প মানে প্রতরণা। লেখক তার লেখনি দিয়ে পাঠককে ধোকা দেয়৷ এবং তার কল্পনায় ক্রুটি থাকবেই।

আরেকটা কথা, গল্পটা যখন প্রকাশ করা হচ্ছে, তখন দশজন পড়ছেন। সেই দশজনের মধ্যে পাঁচজনের ভালো লাগে, বাকি দুইজনের মোটামুটি লাগবে এবং অবশিষ্ট তিন জন অপছন্দ করবে। তাদের তিনজনের ভালো লাগে নি বলে আমি থেমে থাকব না। আমি আমার মতো লিখে যাব। এর মানে এই না যে তাদের চয়েজকে আমি অসম্মান করছি। আমি শুধু নিজের শ্রম এবং লেখাকে সম্মান করছি। নিজে যদি নিজের কাজকে সম্মান না করি, অন্যের কাছে সম্মান আশা করা ভুল। আগে আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস ছিল না।কিন্তু লেখালেখিতে টিকে থাকার জন্য হলেও আমি আত্মবিশ্বাসী হতে শিখেছি। গল্পটা পড়ে অনেকেই নেগেটিভ মন্তব্য করতে পারেন, বিশ্বাস করেন আমি তাদের প্রত্যককেই শ্রদ্ধা ও সম্মান করি কিন্তু তাদের কথায় বিন্দুমাত্র বিচলিত হইনা কারন আমি লিখছি আমার জন্য। কাউকে মুগ্ধ করানোরজন্য নয়। অন্যকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা আমার মধ্যে নেই।

ধন্যবাদ সবাইকে শেহজাদীর সঙ্গে থাকার জন্য। আজ এই লম্বা পথচলার সমাপ্তি ঘটল। শেষবেলায় একটা কথা বলতে চাই, এই গল্পটা এতোদিন ধরে যারা পড়েছেন তারা প্রত্যকেই নিজ রাজ্যের শেহজাদী ও শেহজাদা। ভালোবাসা অবিরাম। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here