#মেঘপিয়নের_ডাকে
পর্ব ২
–অনেকদিন পর তোমার সাথে কথা হচ্ছে তাই না? তারপর বল কেমন আছো তুমি?
পুরো বাক্যটা ইংরেজিতে উচ্চারন করে ফোনটা কানে লাগিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে জুনায়েদ। প্রশস্ত হাসি ঠোঁটে বিদ্যমান। অবনী নিজের ঘরের দরজায় দাড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। জুনায়েদের ঘর আর তার ঘরের মাঝে একটা এক্সট্রা ঘর আছে। যেটাতে আপাতত কেউ থাকে না। অবনী ইচ্ছা করলে সেই ঘরেই শিফট করতে পারতো। কিন্তু এসব নিয়ে তার মাঝে তেমন আগ্রহ নেই। কারন তার আসল উদ্দেশ্য তো জুনায়েদের ঘর দখল করা। বাকি সবকিছু নিয়ে আপাতত মাথা ব্যাথা নেই। ধির পায়ে নিচে নেমে এলো সে। সকালের শাড়িটা এখনো তার গায়ে জড়ানো। শুধু একটা শাল যোগ হয়েছে নতুন করে। কাঁচে মোড়ানো বাড়িটার ভেতরে তেমন ঠাণ্ডা নেই। কারন নিচের তলায় ফায়ার প্লেসের ব্যবস্থা আছে। আর বেডরুম গুলোতে রুম হিটার চালু আছে। কিন্তু বাইরে অসহনীয় ঠাণ্ডা।
–ওহ! কামান ফ্লোরিনা। এভাবে বলো না।
কথাটা বলেই উচ্চ শব্দে হেসে উঠলো জুনায়েদ। অবনী আড় চোখে তাকাল। ফায়ার প্লেসের পাশে রাখা চেয়ারটাতে বসে দুলতে লাগলো মনের সুখে। উপরেই সিলিং এ স্থির করলো দৃষ্টি। জুনায়েদের ইংরেজিতে বকবক করা শুনেই বুঝে গেছে বিদেশী কারো সাথে কথা বলছে। কিন্তু এ যে বিদেশিনী সে ধারনা ছিলনা। ব্ল্যাক কফি নিজের হাতে বানিয়ে নিয়ে এসে অবনীর সামনের চেয়ারটাতে বসল জুনায়েদ। কিন্তু অবনীর দিকে তার পিঠ থাকায় সে খেয়াল করেনি যে তার পেছনে বসেই কথাগুলো ভীষণ মনোযোগ দিয়ে শুনছে কোন এক রমণী। আরও কিছুক্ষন কথা বলে ফোনটা কেটে একটা মেইল অন করলো সে। গভীরভাবে সেদিকে তাকিয়ে আনমনে কফির কাপে চুমুক বসাল কয়েকবার।
–গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছিলেন জুনায়েদ সাহেব?
গরম কফির কাপটা তখন মুখে তুলেছে। পেছন থেকে এমন মেয়েলী কণ্ঠ কানে আসতেই থমকে গেলো সে। কিছুক্ষনের জন্য মস্তিস্ক ধরতেই পারলো না গলাটা কার। এই বাড়িতে দুজন মেয়ে মেলিনা আর রোজ। বাংলা ভাষায় কথা বলার মতো কেউ নেই তো। অবনীর কথাভুলেই বসেছে সে। ততক্ষণে কফির গরমে ঠোঁট পুড়ে গেছে। কাপ নামিয়ে ঠোঁটে হাত দিয়ে পেছন ফিরে তাকাল। অবনীর চেহারা দেখার পরেই পুরাতন রাগটা তরতর করে মাথায় উঠে গেলো। রক্তিম চোখে তাকিয়ে উঠে দাড়িয়ে গেলো সে। অবনী মিষ্টি হেসে বলল
–আপনার তো খুব সাহস জুনায়েদ সাহেব। বউয়ের সামনেই গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছেন? বউ যদি মনে কষ্ট পায় তাহলে সামলাবেন কি করে?
জুনায়েদ ঠোঁট বাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসল। বলল
–এমন উড়ে এসে জুড়ে বসা বউ মনে কষ্ট পেলো কি শরীরে তাতে আমার কিছু যায় আসেনা। আর আমার সাহসের তুমি এখনো কিছুই দেখনি। ধিরে ধিরে সব দেখবে। চিন্তা কর না।
–আরে জুনায়েদ কখন এসেছ?
জুনায়েদ নিজের মুখভঙ্গি পরিবর্তন করে ফেললো। স্বাভাবিকতা আনার চেষ্টা করলো। জায়েদ সাহেব তার দিকেই তাকিয়ে আছে নিজের উত্তরের অপেক্ষায়। মৃদু হেসে বলল
–একটু আগেই এসেছি বাবা।
জায়েদ সাহেব ছেলের কাছে এসে দাঁড়ালেন। তিনি বেশ আহত কণ্ঠে বললেন
–সকালে দেখা করে গেলে না যে? খুব ব্যস্ত ছিলে বুঝি?
বাবার কথায় জুনায়েদের মন খারাপ হয়ে গেলো। আবার অপর পাশেই রাগে ভেতরটা তিক্ততায় ভরে উঠলো। প্রতিদিনের নিয়ম মাফিক কাজে আজ ব্যঘাত ঘটল। বাবা নিশ্চয় অনেক কষ্ট পেয়েছেন এমন কাজে। আর এই সবকিছুর জন্য দায়ী এই মেয়েটা। যেদিন থেকে তার সামনে এসেছে সেদিন থেকেই তার জীবনটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তার নিয়ম মাফিক কাজে আজ অব্দি কখনো ব্যাঘাত ঘটেনি। কিন্তু এই মেয়ের জন্য আজ এমনটা হল। একটা শ্বাস ছাড়তেই জায়েদ রহমান মুচকি হেসে বললেন
–এক কাজ করো। তোমরা নেক্সট উইকে সানফ্রানসিসকো থেকে ঘুরে আসো। আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলছি। তুমি অফিসটা কিছুদিনের জন্য একটু ছুটি নিয়ে নাও। বিয়ের পর তো দুজন কোথাও ঘুরতে যাও নি।
জুনায়েদের রক্তিম চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। রাগটা সরে গিয়ে এবার অসহায়ত্ব ভিড় করলো। এই মেয়েকে সামনে দেখেই তার মেজাজ কন্ট্রোল করতে পারছে না। নেহাত বাবার জন্য কোন অঘটন ঘটাচ্ছে না। নাহলে এতক্ষন এই মেয়েকে মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিত। আর একা বেড়াতে গেলে তো নির্ঘাত খুনই না করে বসে। নাহ! এই রিস্ক নেয়া যাবে না। সুদূর বাংলাদেশ থেকে এসেছে তার বউয়ের পরিচয় নিয়ে। সে খুন হলে তো দায়ভার জুনায়েদের উপরেই এসে পড়বে। সে আকাশ পাতাল কল্পনা করে ফেললো। নিজেকে কিছু সময়ের জন্য জেলের মাঝেও বন্দি হিসেবে কল্পনা করে ফেললো। চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–আগেই সবকিছু রেডি করো না বাবা। আমি আগে অফিসে কথা বলি। তারপর তোমাকে জানাবো। একটু কাজের ব্যস্ততা চলছে। ছুটি পাওয়া যাবে কিনা সেটা এখনো বলতে পারছি না।
জায়েদ রহমান মুচকি হেসে বললেন
–ঠিক আছে। চেষ্টা করো ছুটি নিতে।
জুনায়েদ বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ল। জায়েদ রহমান অবনীর দিকে তাকিয়ে বেশ রহস্যময় একটা হাসি দিলেন। কারন তার সামনে ছেলের এই সংসার সংসার খেলার সবটাই তিনি জানেন। আর তিনি তার দিক থেকে সর্বচ্চ চেষ্টা করছেন ছেলের সংসার গুছিয়ে দিতে। অবনীকে এখানে নিয়ে আসার কারণটা ঠিক এটাই। অবনীর আসার কথা শুনে যাতে জুনায়েদ কোন বাহানা না করতে পারে তাই জুনায়েদকে কথাটা তিনি জানতেই দেননি। নিজের লোককে দিয়ে খুব গোপন ভাবে আনা হয়েছে অবনীকে। তিনি নিজের ঘরে চলে গেলেন। অবনী এতক্ষন চেয়ার ছেড়ে পাশেই দাড়িয়ে বাবা ছেলের কথোপকথন শুনছিল। জায়েদ সাহেব চলে যেতেই সে শব্দ করে হেসে ফেললো। জুনায়েদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থির করলো তার উপরে। খিলখিল হাসির শব্দ শুনে তার মাথায় প্রথম যে কথাটা এলো সেটা হল কফির কাপটা অবনীর মাথায় ছুড়ে মারলে ভেতরটা ঠাণ্ডা হতো তার। অবনী হাসি থামিয়ে বলল
–বিয়ের পরে স্বামী স্ত্রী একসাথে বেড়াতে যাওয়াটাকে কি বলে জানেন তো জুনায়েদ সাহেব। হানিমুন বলে।
জুনায়েদ নিজের রাগ সামলাতে পারলো না। কফির কাপটা ছুড়ে মেঝেতে ফেলে দিলো। এগিয়ে গিয়ে অবনীর দুই বাহু ধরে কাছে টেনে আনল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল
–স্টে ইন ইউর লিমিট। বাবা আছেন জন্য কিছু বলছিনা। নাহলে ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিতাম এতক্ষন। তোমাকে সহ্য করা আমার পক্ষে ইম্পসিবল। জাস্ট ইম্পসিবল।
তাদের মাঝে কয়েক ইঞ্চির দূরত্ব। জুনায়েদের গাড় নিশ্বাস অবনীর মুখে আছড়ে পড়ছে। ভীষণ রকমের অসস্তি আর অস্থিরতা কাজ করছে তার মাঝে। এই প্রথম কোন পুরুষের এতো কাছাকাছি এসেছে সে। জুনায়েদের রক্তিম চেহারা অবনীর মাঝে কোন ভাবান্তর তৈরি করলো না ঠিকই। কিন্তু হুট করে এই কাছে আসাটা সে সহজভাবে নিতে পারলো না। এক প্রকার ছিটকে সরে গিয়েই নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো সে। জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে স্থির করার চেষ্টা করলো। জুনায়েদের কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো। এরকম আচরনের মানেটা বুঝতে পারলো না সে। তার দিকে তাকিয়েই থাকলো স্থির দৃষ্টিতে। অবনী শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক করে নিলেও কথার মাঝে কেমন আড়ষ্টতা খেয়াল করলো। উচ্চারিত কথাটা পুরোটা একসাথে বের হলনা। ভেঙ্গে ভেঙ্গে বেরিয়ে এলো।
–দে…দেখুন এভাবে যখন তখন গায়ে হাত দিয়ে কথা বলবেন না। যা বলার দূর থেকে বলবেন। আমি কানে খুব স্পষ্ট শুনতে পাই। এভাবে পুরুষ মানুষ হয়ে একটা মেয়ের গায়ে হাত দেয়াটা অসভ্যতা।
জুনায়েদ অদ্ভুত চাহুনি নিক্ষেপ করলো। রাগ, অপমান আর বিস্ময় মিশ্রিত চাহুনি। অবনী বিষয়টা ধরতে পারলো খুব সহজে। নিজের বোকামির জন্য হাজার খানেক বকা দিলো নিজেকে। জুনায়েদ যাতে পুরো ঘটনাটা বুঝতে না পারে তাই খুব চতুরতার সাথে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
–বিয়ে করলেও আমাকে তো এখনো নিজের স্ত্রী হিসেবে মেনে নেন নি। তাই যতদিন স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারছেন না ততদিন দূরে থাকবেন আমার থেকে। এভাবে ছুঁয়ে কথা বলার দরকার নেই।
অদ্ভুতভাবে জুনায়েদ নিজের অজান্তেই সাফাই দেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলো। নরম কণ্ঠে বলল
–শুধু তো হাত ধরেছি। এটাতে অসভ্যতার কি হল? কলোরাডোর পরিবেশে এর থেকে অনেক গভীর বিষয় গুলোকেই সবাই স্বাভাবিক ভাবে নেয়।
অবনী স্তব্ধ হয়ে গেলো। এই বিষয় নিয়ে আর বেশী ঘাঁটানো যাবে না। সে যে জুনায়েদের এভাবে কাছে আসাটা সহজ ভাবে নিতে পারছে না। সেটা তো কোনভাবেই তাকে বুঝতে দেয়া যাবে না। নাহলে তালগোল পাকিয়ে ফেলবে সে। যা ধুরন্ধর ছেলে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত হেটে চলে গেলো। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে গভীর ভাবে ভাবছে অবনী। পরিস্থিতির চাপে এটা বলেছে যে জুনায়েদকে সে ভালবাসে। আর তার জেরেই সবাই মিলেই বিয়েটা দিয়েছে। কিন্তু আসল ঘটনা তো অন্য জায়গায়। ভালবাসা তো দুরের কথা আজ পর্যন্ত কোন বিশেষ অনুভুতির দৃষ্টিতেই সে জুনায়েদের দিকে তাকায়নি। শুধু পরিস্থিতি সামলাতে আর জায়েদ রহমানের অনুরধেই বিয়েটা করা। সে তো বিশেষ কারনে জুনায়েদের মনে জায়গা করে নিতে চেয়েছে। কিন্তু পরের বিষয়টা তো ভেবে দেখেনি। এখন যদি জুনায়েদ কোনভাবে তার উপরে দুর্বল হয়ে পড়ে। আর স্বামীর অধিকার ফলাতে আসে। তখন কি করবে? জুনায়েদ যদি কোনভাবে জানতে পারে তার ভালোবাসার বিষয়টা সম্পূর্ণ নাটক ছিল। তাহলে আর রক্ষা নেই। রকি মাউন্টেন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেবে। কল্পনার দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই চাপা আর্তনাদ করে উঠলো অবনী। শুকনো ঢোক গিলে ফেললো। আর এই সবটা খুব সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলো জুনায়েদ। হুট করেই এই মেয়ের কি হল সেটা ভেবেই পাচ্ছে না। খুব ছোট্ট একটা বিষয় নিয়ে তাকে অসভ্য উপাধি দিয়ে বসল? সবকিছু বিবেচনা করে তার মাথায় প্রথম প্রশ্নটা এলো মেয়েটা আদৌ সুস্থ তো? কিন্তু তাকে দেখে তো বোঝার উপায় নেই যে অসুস্থ। জুনায়েদের মস্তিস্ক একের পর এক এলোমেলো উত্তর সাজাতে লাগলো। মেয়েটা হয় অসুস্থ নয়তো খুব ধুরন্ধর। নাহলে কি একটা অপরিচিত ছেলেকে প্রথম দেখায় ভালোবাসার কথা বলে। শুধু তাই নয় একেবারেই জোর করে বিয়ে করে সংসার পাতার স্বপ্ন দেখছে। বেশ অদ্ভুত মেয়ে।
চলবে…