#মেঘপিয়নের_ডাকে
পর্ব ৩
কলোরাডোতে তখন গভীর রাত। উচু নিচু পাহাড়ি রাস্তা ধরে পাহাড়ের গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা শহরটা থেকে রাতের ঝকঝকে আকাশটা দৃশ্যমান। বাইরে ফুরফুরে হাওয়া জোরালো ভাবে বইছে। কাঁচ দেয়ালের পর্দাটা সরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে অবনী। তার মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই আকাশটা ছুঁয়ে দিতে পারবে অনায়াসেই। কিছুদুরে পাহাড়ের মাথায় চাঁদটা জ্বলজ্বল করছে। যেন আকাশ থেকে নেমে এসেছে মাটির বুকে। চোখের সামনের এই দৃশ্যটা বাংলাদেশেও মাঝে মাঝে চোখে পড়লেও একই রকম হয়না। অনেকটাই পার্থক্য রয়েছে। কলোরাডোর এই দৃশ্যটা কেমন অদ্ভুতভাবে অবনীর চোখ জুড়িয়ে দিচ্ছে।
–কি রে? ঘুমিয়ে পড়লি নাকি?
ক্যামেরার ওপাশ থেকে তিশার স্পষ্ট আওয়াজ কানে আসতেই অবনী চমকে উঠলো। মুচকি হেসে বলল
–নাহ! চাঁদ দেখছিলাম।
–আজকে কি পূর্ণিমা? এই শোন না আমি শুনেছি কলোরাডোতে নাকি পূর্ণিমা দেখতে বেশ হয়। মনে হয় চাঁদ একদম মাটিতে নেমে এসেছে।
কথাটা উতফুল্য কণ্ঠে বলেই নড়েচড়ে বসল তিশা। বেশ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে উত্তরের জন্য। অবনী তার আগ্রহ দেখে হেসে ফেললো। বলল
–হ্যা। আজ পূর্ণিমা। বিশাল চাঁদ উঠেছে। আর একদম ঠিক পাহাড়ের মাথায় নেমে এসেছে।
তিশার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। ঠোঁটের কোনে গাড় হাসির রেখা টেনে বলল
–তোর ঘর থেকে দেখা যায়?
অবনী হেসে মাথা নাড়ল। তিশা আরও অবাক হল। সম্মোহিতের মতো কয়েকবার পলক ফেললো। চোখের সামনের দৃশ্যটা কল্পনা করে ফেললো ঝটপট। বিছানায় শুয়ে বাইরের বড় চাঁদটা দেখছে। সেই চাঁদের আলো ঠিক এসে পড়ছে তার মুখে। তার আশেপাশে তারা জ্বলজ্বল করছে। ভাবতেই চোখ চকচক করে উঠলো তার। ভীষণ আপ্লূত হয়ে উঠলো সে। অবনী লম্বা একটা হাই তুলল। সেটা দেখেই তিশা বলল
–তোর এখনই ঘুম পেয়েছে?
অবনী এমন কথা শুনে ভ্রু কুচকে ফেললো। ক্লান্ত গলায় বলল
–কয়টা বাজে জানিস?
তিশা সময় দেখার আগেই অবনী থেমে দিলো। বলল
–গাধা! বাংলাদেশের সময়ের সাথে কি আর মিলবে? এখানে এখন মধ্যরাত।
তিশা জিহ্বায় কামড় দিয়ে নিজের মাথায় নিজেই হালকা হাতে মারল। নিজের ভুলটা স্বীকার করে বলল
–সরি। দেখ কলোরাডোর মধ্যরাতের চাঁদ নিয়েই গল্প করছিলাম। কিন্তু ভুলেই গেছি যে ওখানে এখন মধ্যরাত। আচ্ছা তুই শুয়ে পড়।
অবনী ক্লান্ত ভঙ্গীতে হাত নেড়ে বিদায় জানানোর আগ মুহূর্তেই আবার ব্যস্ত ভঙ্গীতে তিশা বলল
–আরে অবনী শোন?
অবনী কলটা কাটল না। ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইল কি হয়েছে। তিশা ক্যামেরার ওপাশ থেকেই উঁকিঝুঁকি দিলো। বলল
–তোর বর কই?
অবনী হতাশ শ্বাস ছেড়ে বলল
–নিজের রুমে।
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল তিশা। তারপর বলল
–তোরা আলাদা থাকিস?
অবনী ভীষণ বিরক্ত হল। চোখ মুখ কুচকে বলল
–বিয়ের পর থেকেই তো আমরা আলাদা। তার সাথে আমার দেখা হয়েছে হাতে গনা কয়দিন। বিয়ের দিনের পর ঐ যে আমাকে রেখে চলে আসলো। তারপর তো আর কথাও হয়নি দেখাও হয়নি। দীর্ঘ ৪ মাস পর আবার দেখা হল এই কলোরাডোতে এসে। তাও আবার আমাকে দেখা মাত্রই নিজের ঘর থেকে বের করে দিলো।
হতাশ একটা শ্বাস ছাড়ল অবনী। তিশা বলল
–ব্যটার বহুত ধৈর্য! তোর মতো এমন কিউট মেয়েকে অন্যঘরে রেখে একা একা ঘুমাচ্ছে? সো স্যাড! আমি ওর জায়গায় হলে এমন টা হতেই দিতাম না। বউকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়তাম। কি শান্তি।
অবনী বিরক্তিকর শ্বাস ছেড়ে বলল
–এখন আমাকে ঘুমোতে দে। আমার খুব ঘুম পেয়েছে। আবার সকালে উঠতে হবে। জুনায়েদ সাহেবকে জ্বালানোর নতুন প্ল্যান করতে হবে। কত কাজ আছে।
কথা শেষ করেই দুজন অট্টহাসিতে মেতে উঠলো। শেষ পর্যন্ত বিদায় নিয়ে অবনী শুয়ে পড়লো বিছানায়। ক্লান্তিতে গভীর ঘুমে ঢলে পড়লো।
—————
হিম শীতল হাওয়ার সাথেই শুরু হল একটা সকাল। অবনী বিছানা ছেড়েছে কিছুক্ষন আগেই। পুরনো অভ্যেস বশত কড়া কফির কাপটা নিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালো। কাচের দরজাটা খুলতেই হিম হাওয়া গায়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিলো। পাহাড়ি হাওয়া আর মেঘের শুভ্রতা শরীর ছুঁয়ে দিয়েই আগমন জানাল কলোরাডোর আরও একটা নতুন সকালের। অবনী কিছুটা অবাক হয়েই তাকাল আশেপাশে। চারিদিকে শুভ্র তুষার পড়ছে তুলোর মতো। বিরতিহীন, অবিন্যস্তভাবে। দাঁতে দাঁত লেগে গেলো অবনীর। দাঁতে দাঁত লেগে খটখট আওয়াজটা কানে আসছে। নাক দিয়ে সুড়সুড় করে ঠাণ্ডা হাওয়াটা ঢুকে পড়ছে। কয়েকটা গরম কাপড়ও সেই শীতের তীব্রতা আটকাতে অক্ষম। হাত বাড়িয়ে তুষার ধরতে গেলেই খেয়াল করলো হাত জমে যাচ্ছে। তাই তাড়াতাড়ি করে হাত গুটিয়ে নিয়ে গরম কফির কাপ চেপে ধরল। একটু হলেও যদি গরম হয়। সামনে তাকাতেই চোখে পড়লো দূর থেকে জুনায়েদ দৌড়ে আসছে। কৌতূহল জেকে বসল অবনীর। এতো ঠাণ্ডার মাঝে কই গিয়েছিল ছেলেটা? পরক্ষনেই মনে হল মর্নিং ওয়াকে। এটা তার প্রতিদিনের রুটিন। জুনায়েদ কাছাকাছি চলে আসতেই আধ খাওয়া কফিটা রেখে নিচে চলে গেলো। রান্না ঘরে গিয়ে রোজের সাহায্য নিয়ে বানিয়ে ফেললো জুনায়েদের পছন্দের ফ্রুট জুস। বাইরে এসে টেবিলের উপরে রেখে দিলো সেটা। জুনায়েদ ততক্ষণে নিজের ঘরে চলে গেছে। একবারে শাওয়ার নিয়ে অফিসের জন্য রেডি হয়ে তারপর বের হবে। অবনী অনেকটা সময় টেবিলে বসে অপেক্ষা করলো জুনায়েদের জন্য। কিন্তু নিচে এলো না সে। অপেক্ষার প্রহর আর দীর্ঘ না করে নিজেই উঠে গেলো জুনায়েদের ঘরে। জুনায়েদ তখন আয়নার সামনে দাড়িয়ে টাই বাঁধছিল বেশ মনোযোগ দিয়ে। দরজায় আওয়াজ হতেই গম্ভীর আওয়াজে বলল
–খোলা আছে।
অবনী কোনরকমে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। তাকে ঢুকতে দেখেই অপ্রত্যশিত দৃশ্য দেখার মতো দাড়িয়ে গেলো জুনায়েদ। আয়নার ভেতর দিয়েই সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলো। আজ বেশ মোটা লাগছে মেয়েটাকে। কালকেই কেমন রোগা লাগছিল। একদিনেই মোটা হয়ে গেলো কিভাবে? কৌতূহল নিয়ে ঘুরে তাকাল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো ভাবে দেখে নিলো কয়েকবার। অতঃপর বুঝতে সক্ষম হল যে কয়েক পরত গরম কাপড় পড়ার সুবাধে মেয়েটাকে এতো মোটা লাগছে। মস্তিস্ক বিষয়টা ধরতে পেরেই এই ঘরে আগমনের কারন খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ভারী গলায় বলল
–তুমি এখানে কি করছ?
ঠোঁট এলিয়ে হাসল অবনী। হাতের ট্রে টা এগিয়ে দিয়ে বলল
–আপনার জন্য জুস এনেছিলাম জুনায়েদ সাহেব। নিজের হাতে বানানো।
দৃষ্টি সরু করে তাকাল। সকাল সকাল কি নাটক শুরু করলো এই মেয়েটা। ধমকের সুরে বলল
–আমি কি বলেছি তোমাকে জুস বানিয়ে আনতে? পাকনামো করে আনতে গেছো কেন? আমি এসব একদম পছন্দ করিনা।
অবনী দৃষ্টি নামিয়ে নিচের দিকে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে মাথা তুলে রহস্যময় একটা হাসি দিলো। বলল
–বাংলাদেশে বুজুর্গরা বলে পুরুষ মানুষের পেটের দ্বারা নাকি মন জয় হয়। কথাটার মানে হচ্ছে ভালো ভালো রান্না করে খাওয়ালে তবেই সেই পুরুষের মন জয় করা সম্ভব হয়। তাই চেষ্টা করছিলাম আর কি।
জুনায়েদ তাচ্ছিল্য হেসে বলল
–আমার মন জয় করতে চাইছ? এই দুঃস্বপ্ন কবে দেখা বন্ধ করবে তুমি? এ জীবনে এসব হবে না বুঝলে? অযথা সময় নষ্ট করো না। দেশ থেকে এতো দূরে এসেছ নিজের মতো কিছুদিন ঘুরে বেড়াও। ঘোরা শেষ হলে দেশে ফিরে যাও। এতেই ভালো।
অবনী কথাটা মাথায় নিলো না। টেবিলে ট্রে টা রেখে জুস গ্লাসে ঢেলে জুনায়েদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মৃদু হেসে বলল
–আমি তো ঘুরতে আসিনি জুনায়েদ সাহেব। আর ফিরে যেতেও আসিনি। এই ঘরে আর এই মানুষটার মনে নিজের পাকাপোক্ত জায়গা করে নিতে এসেছি। আর নিজের উপরে আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে। আমি সেটা করতে পারব।
–লিসেন মিস অবনী! আপনার এই…।
কথাটা শেষ করতে পারলো না জুনায়েদ। অবনী তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল
–আহা! নট মিস অবনী। মিসেস জুনায়েদ ইশতিয়াক। আর এটাই আমার পরিচয়। আমাকে ডাকতে গেলে এই নামেই ডাকতে হবে।
জুনায়েদ হতভম্ভ হয়ে তাকিয়ে থাকলো। এই মেয়ের লজ্জা নেই। একদম নেই। নাহলে এভাবে এতো অপমান হওয়ার পরও কেউ বারবার নিজের অধিকার নিয়ে পড়ে থাকে। বিরক্ত নিয়ে উল্টা ঘুরে গেলো। গম্ভীর গলায় বলল
–তোমার এই পরিচয় বেশীদিন থাকবে না। এসব নিয়ে এতো অহঙ্কার করো না।
অবনী হাসল। বলল
–এই পরিচয় খুব শীঘ্রই আপনি নিজেই দেবেন জুনায়েদ সাহেব। আমি অপেক্ষা করছি সেইদিনের জন্য।
জুনায়েদ উত্তর দিলো না। অবনী দূরত্ব আর একটু কমিয়ে নিয়ে জুসের গ্লাসটা বাড়িয়ে দিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত তার হাত লেগে উল্টে জুসটুকু জুনায়েদের গায়ে পড়ে গেলো। আহত দৃষ্টিতে তাকাল জুনায়েদ। এ বছর জন্মদিনে এই শার্টটা বাবা তাকে দিয়েছিলেন। খুব পছন্দের একটা শার্ট ছিল তার কাছে। সেটাও নষ্ট করে দিলো এই মেয়েটা। রক্তিম চোখে তাকাল অবনীর দিকে। অবনী শুকনো ঢোক গিলে ভীত কণ্ঠে বলল
–আ…আপনি অন্যকিছু পরুন আজকে। আমি ঠিক করে দেবো এটা।
জুনায়েদ চুপ থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো অবনীর দিকে। মেজাজটা এখন তার ঊর্ধ্বমুখী। কিছুতেই কমাতে পারছে না। প্রতিশোধের নেশা রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছুটে বেড়াচ্ছে। এই মুহূর্তে প্রতিশোধ নিতে না পারলে কিছুতেই শান্ত হবে না সে। তাই এদিকে সেদিকে অস্থির ভাবে তাকিয়ে জুসের পুরো জগটা তুলে মাথায় ঢেলে দিলো অবনীর। ঠাণ্ডা জুস মাথা বেয়ে শরীরে লাগতেই কেঁপে উঠলো সে। জুনায়েদ হাত ধরে তাকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে হুঙ্কার ছেড়ে বলল
–নাউ গেট লস্ট! আর কোনদিন এই রুমে আসতে দেখলে জানে মেরে দেবো। আর হ্যা ভুলেও এটাকে ফান ভাববে না। আমি যা বলি তাই করি।
বলেই উচ্চ শব্দে দরজা বন্ধ করে দিলো। অবনী দরজার বাইরে দাড়িয়েই কাঁপতে লাগলো। দুই হাত আড়াআড়িভাবে নিজের সাথে আটকে ধরে নিজেকে উষ্ণতা দেয়ার বৃথা চেষ্টা করে অসহায়ের মতো বলল
–এভাবে আমি সারাজীবন চেষ্টা করেও জুনায়েদ সাহেবকে মানাতে পারব না। এমন চলতে থাকলে তার মনে তো দুরের কথা। কিছুদিন পর এই বাড়িতেই আমার জায়গা হবে না।
চলবে……