#মেঘপিয়নের_ডাকে
পর্ব ৬
কাঁচ দ্বারা আবদ্ধ ঘরটাতে দামি দামি আসবাব পত্র। আশেপাশে চোখ গেলেই চোখ যেন জুড়িয়ে যায়। সব কেমন ঝকঝকে। ভেতরে শনশন আওয়াজে রুম হিটার চলছে অনবরত। কর্নারে এক পাশে ছোট একটা সোফা। আর তার সামনেই টেবিল রাখা আছে। যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব এই ঘরেই আছে। কোন কিছুর জন্য বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। অবনী চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। মেয়েটি অবনীকে সোফার দিকে বসতে ইশারা করে বলল
–ম্যাম এখানে বসুন। স্যার এখনই আসছে।
অবনী মুচকি হেসে সোফায় বসে পড়লো। মেয়েটি অতি বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলো
–আপনার কিছু লাগবে ম্যাম? লাগলে আমাকে বলতে পারেন।
অবনী মুচকি হেসে বলল
–আপনার নামটা কি?
মেয়েটি সৌজন্য হেসে বলল
–রমা। আপনি আমাকে তুমি বলবেন। আমার কাজ আছে ম্যাম। আমি আসছি। স্যার কিছুক্ষনের মধ্যেই চলে আসবেন। আপনাকে ততক্ষন এক কাপ কফি দিতে বলি?
অবনী মাথা নাড়ল। মেয়েটি বের হয়ে গেলো। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই গরম ধোঁয়া ওঠা কফি নিয়ে একজন ইংরেজ নারী রুমে প্রবেশ করলো। অবনীর হাতে কফির কাপটা ধরিয়ে দিতেই দরজায় মৃদু আওয়াজ হল। সেদিকে দুজনই ঘুরে তাকাল। জুনায়েদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অবনী সেই দৃষ্টি দেখে একটু ঘাবড়ে গেলো। বুঝতে পারলো জুনায়েদ বেশ রেগে আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। তাকে না জানিয়েই অফিসে চলে এসেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার ঘাবড়ালে কিছুতেই চলবে না। নিজেকে শক্ত রাখতে হবে। জুনায়েদের সামনে দুর্বলতা দেখালে চলবে না। তাই যথেষ্ট চতুরতার সাথে নিজেকে সামলে নিলো। মেয়েটি যেভাবে নত দৃষ্টিতে এসেছিলো তার চেয়েও দিগুন নত হয়ে চলে গেলো বাইরে। সে চলে যেতেই জুনায়েদ কাচের দরজাটা লক করে দিলো। অবনী কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো। দুই হাতে শক্ত করে কফির কাপটা চেপে ধরল সে। নিজের অস্বাভাবিকতা লুকাতেই কফিতে চুমুক দিলো। জুনায়েদ দরজার কাছে দাড়িয়েই সুতোর মতো কিছু একটা ধরে টান দিলো। সাথে সাথেই কাচের স্বচ্ছ দেয়ালটা পর্দা দ্বারা আবৃত হয়ে গেলো। এবার আর বাইরে থেকে কিছুই দেখার উপায় নেই। অবনীর মনের ভয়টা এবার গাড় হল। জুনায়েদ আবার রাগের মাথায় তাকে না মারতে শুরু করে। না জানি এখন কি চলছে তার মাথায়। আচ্ছা অবনী যে ভয় পাচ্ছে সেটা কি জুনায়েদ বুঝতে পারছে? এবার জুনায়েদ ধির পায়ে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ালো। রিমোটটা হাতে নিয়ে ক্যামেরার দিকে তাক করে সেটা বন্ধ করে দিলো। অবনী আবারো কফির কাপে চুমুক দিলো। কিন্তু কফিটা গলা বেয়ে নামতে নামতে মনে হল যেন পৃথিবীর সবথেকে গরম কোন পদার্থ তার ভেতরে প্রবেশ করলো। যার ফলে সে ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছে। মুহূর্তেই গলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেলো। আশ্চর্য! কলোরাডোর শীতের মাঝেও সে এভাবে কেন ঘামছে। জুনায়েদ গায়ের কালো কোর্টটা খুলে এক পাশে ঝুলিয়ে রাখল। অবনী এবার শুকনো ঢোক গিলে তার দিকে তাকাল। বুকের ভেতরের ঢিপ ঢিপ শব্দটা এতটাই তীব্র যে বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট। জুনায়েদ হাতের ঘড়িটা টেবিলে রেখে চেয়ারে বসে পড়লো। মাথাটা এলিয়ে দিয়ে কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে থাকলো। অবনী একটু সস্তির নিশ্বাস ফেললো। আপাততর জন্য রক্ষা পেয়েছে। পরে কি হবে সেটা পরের ব্যাপার। কিন্তু উত্তেজনা এখনো কমেনি। অবনী নিজেকে সামলে নিয়ে পুনরায় কফিতে চুমুক দিতে গেলেই জুনায়েদ চট করে উঠে অবনীর সামনে এসে দাঁড়ালো। অবনীর ভয়টা গাড় হল। চোখ জোড়াতে এক রাশ ভয় নিয়ে তাকাল সেদিকে। জুনায়েদ সোফার হাতলে দুই পাশে হাত রেখে ঝুঁকে গেলো অবনীর দিকে। ভীত চোখ জোড়া দিগুন হয়ে গেলো বিস্ময়ে। জুনায়েদ অতি গম্ভীর কণ্ঠে বলল
–তোমার সাহসের প্রশংসা করতে হয়। বলেছিলাম এরপর সামনে আসলে মেরে ফেলবো। তবুও একা একা আমার অফিস অব্দি পৌঁছে গেছো। নিজেকে সাহসি দেখাতে চাও নাকি সত্যিই তুমি এমন সাহসি?
অবনী ঘাবড়ে গেলেও সেটাকে পাত্তা দিলনা। এই মুহূর্তে নিজেকে সাহসি প্রমান করাটাই মুখ্য। তাই নিজের মনের জোর বাড়িয়ে নিয়ে বলল
–মেরে ফেললে ফেলবেন। তাতে আমার তেমন কিছু যায় আসেনা। আপনার হাতে মরতে পারলেও নিজেকে ভাগ্যবতি মনে করবো জুনায়েদ সাহেব। অন্তত এই সান্ত্বনাটুকু তো থাকবে যে আপনার মনে জায়গা পেয়েছি। হোকনা সেটা ঘৃণার। আমার তো আপনার মনের জায়গাটাই দরকার।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আচমকাই শান্ত হয়ে গেলো। কয়েক মুহূর্ত হতবিহবল হয়ে তাকিয়ে থাকলো। অবনীর দৃষ্টির গভীরতা মাপার চেষ্টা করলো হয়তো। পারলো কিনা কে জানে। কিন্তু দূরত্ব আর একটু ঘুচিয়ে নিয়ে মাদক কণ্ঠে বলল
–মনের জায়গাটা তো অনেক আগেই পেয়েছ। সেটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। ভুল ধারনাটাকে ঠিক করার পালা এবার।
অবনীর দৃষ্টি অস্থির হয়ে উঠলো। মুহূর্তেই সবকিছু কেমন বদলে গেলো মনে হয়। মনের মাঝে এক অজানা ঝড় শুরু হল। কিঞ্চিৎ আশা দেখা মিলল ক্ষণিকের। জুনায়েদ কয়েক সেকেন্ড ওভাবে তাকিয়ে থেকে সরে দাঁড়ালো। আবারো নিজের জায়গায় বসে পড়লো। গম্ভীর গলায় বলল
–রাগ, ঘৃণা যত তিক্ত অনুভূতি আছে সবটাই তোমার জন্য। তাই নিশ্চিন্তে থাকতে পারো। আমার মনে তোমার জায়গা আছে।
আহত দৃষ্টিতে তাকাল অবনী। মনের মাঝে ঝড়টা থেমে গিয়ে কেমন একটা শ্বাস রুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হল। আশাটা ভেঙ্গে গিয়ে এক তিক্ত অনুভুতির আভাষ পাওয়া গেলো। সবটা অনুভব করতে পারলো অবনী। কিন্তু হুট করেই এমন অনুভুতির পরিবর্তন হওয়ার কারণটা তার কাছে কোনভাবেই স্পষ্ট হল না। এই পরিস্থিতিটার সাথে সে সম্পূর্ণ অপরিচিত। সময়ের সাথে নিজেকে সামলে নিলো। জুনায়েদ নিজের দৃষ্টি আবারো তীক্ষ্ণ করে বলল
–কেন এসেছ?
অবনী নিজের উত্তরটা দেয়ার প্রস্তুতি নিতেই ভেতর থেকে আপনা আপনি একটা তাচ্ছিল্যের হাসি বেরিয়ে এলো। তাচ্ছিল্য হেসে বলল
–আপনার সাথে লাঞ্চ করতে এসেছি। ঐ যে বললেন আপনার মনে নিজের জায়গা করে নিতে পেরেছি। সে হিসেবে অন্তত আপনার কাছ থেকে একটা ট্রিট আমার পাওয়াই উচিৎ জুনায়েদ সাহেব। বিষয়টা আপনার কাছে সহজ হলেও আমার জন্য যে বিশেষ।
জুনায়েদের চাহুনির মাঝে বিস্ময়। এমন উত্তর সে আশা করেনি। কথাটার অর্থ ঠিক কি ধরে নেবে সেটাই বুঝতে পারছে না সে। সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ফেলে শব্দ করে হেসে ফেললো সে। হাসি থামিয়ে বলল
–নট ব্যাড! তোমার এই ইচ্ছাটা আজ আমি পুরন করবো। তোমার বিশেষ দিনে তোমাকে তোমার প্রাপ্য হিসেব বুঝিয়ে দেবো। ফ্রম নাউ দা ডে ইজ ইউরস! কোথায় যেতে চাও বল?
অবনী শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল। বিষয়টা আনন্দের হলেও তার কাছে এই মুহূর্তে তেমন কিছুই মনে হচ্ছে না। তবুও জুনায়েদের সাথে এই প্রথমবার বাইরে যাচ্ছে সেটা ভেবেই অন্তত তার খুশী হওয়া উচিৎ। কিন্তু মনের ভেতর থেকে কাঙ্ক্ষিত কোন খুশীর খবর পেলো না। তাই জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল
–আজকে দিনটা আমার হলেও দায়িত্বটা কিন্তু আপনার। আমার দিনটা কিভাবে ভালো কাটবে সেটা আপনার ভাবা উচিৎ জুনায়েদ সাহেব।
জুনায়েদ ভ্রু কুচকে তাকাল। নিচের ঠোঁট কামড়ে একটু ভাবল। তারপর বলল
–ঠিক আছে। চলো। আজ তোমাকে নিরাশ করবো না। এই দিনটার কথা তুমি মনে রাখবে।
অবনী মুচকি হেসে বলল
–দেখি আপনি আমার এই দিনটাকে সারাজীবন মনে রাখার মতো কিছু করতে পারেন কিনা। আমি সত্যিই অধির আগ্রহে আছি। এই দিনটাকে আমিও মনে রাখতে চাই।
জুনায়েদ উঠে দাঁড়ালো। একটা ফোন করে ইংরেজিতে কিছুক্ষন বকবক করে অবনীর দিকে ফিরে বলল
–লেটস গো!
অবনী জুনায়েদের পেছনে পেছনে বেরিয়ে গেলো। অবনীকে রাস্তার এক পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে জুনায়েদ পারকিং এরিয়া থেকে গাড়ি আনতে গেলো। সকাল থেকে তুষারপাত হলেও এখন আবহাওয়া অনেকটা শিথিল। কিন্তু বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। অবনী রীতিমতো কাঁপছে। হঠাৎ করেই মৃদু আওয়াজ শুনে আকাশের দিকে তাকাল সে। একপাশ থেকে কালো মেঘ এসে শুভ্র আকাশটা গ্রাস করে ফেলছে। হয়তো কিছুক্ষনের মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হবে। তার ভাবনার মাঝেই জুনায়েদ গাড়ি নিয়ে এসে রাস্তার অপরপাশে দাঁড়ালো। কাঁচ নামিয়ে হাত বাড়িয়ে ইশারা করলো। অবনী সেটা দেখেই এক দৌড় দিয়ে রাস্তা পার হয়ে গেলো। জুনায়েদ দরজা খুলে রেখেছিল বলেই সে দ্রুত গাড়িতে উঠে বসল। তারপর দরজা বন্ধ করে দিলো। জুনায়েদ সামনে তাকাল। গাড়ি স্টার্ট দিতেই গুগল ওয়েদার আপডেট দিয়ে দিলো অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হবে। অবনী খেয়াল করলো অল্পকিছু মুহূর্তের ব্যবধানে বাইরে ঝড় হাওয়া শুরু হয়েছে। ঠাণ্ডাটা ক্রমশ বাড়ছে। তাই জুনায়েদ গাড়ির হিটারের পাওয়ার বাড়িয়ে দিলো। জুনায়েদ গাড়ি চালাতে চালাতে ভ্রু কুচকে সামনে তাকিয়ে অত্যন্ত বিরক্তির সাথে বলল
–আন সিজনাল রেইন। ডিসগাস্টিং!
অবনী সেটা শুনেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। ঝড় হাওয়াটা বইছে তীব্রভাবে। আনমনে সেদিকে তাকিয়ে বলল
–এটা অসময়ের বৃষ্টি নয় জুনায়েদ সাহেব। প্রেমিকার আজ মন খারাপ। সুপ্ত অনুভূতি গুলো আজ অভিমানে রুপ নিয়েছে। নিজের সবটুকু অভিমান মন খারাপ ব্যক্ত করতে চাইছে সে।
জুনায়েদ ভ্রু কুচকে তাকাল। অবনীর কথা বুঝতে পারলো না। কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
–হোয়াট ডিড ইউ সে?
অবনী মৃদু হাসল। বিষাদময় কণ্ঠে বলল
–মেঘপিয়নের_ডাকে অভিমানী প্রেমিকার চিঠি এসেছে। আজ বিশাল অভিযোগের ঝুলি জমেছে। আকাশের কাছে সেই অভিমানী প্রেমিকা নিজের অভিমান অভিযোগ ব্যক্ত করছে। আর আকাশ সেই অনুভুতির বর্ষণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
টুপটুপ করে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি গাড়ির জানালার কাঁচে পড়তেই অবনী ভেতর থেকে ছুঁয়ে দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল
–মন খারাপের খবর আসে আকাশে মেঘ করে মেঘপিয়নের_ডাকে। কিন্তু কেউ কি সে মন খারাপটা বুঝতে পারে? কারণটা কয়জনই বা জানে। তীব্র কষ্ট যখন বৃষ্টি রুপে পৃথিবীতে ঝরে পড়ে তখন সেটাকে অসময়ের বৃষ্টি বলে তাচ্ছিল্যে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু এই বৃষ্টির আসল কারণটা অজানাই থেকে যায়।
চলবে……