মেঘপিয়নের ডাকে পর্ব-৯

0
3037

#মেঘপিয়নের_ডাকে
পর্ব ৯

কলোরাডোর পাহাড়ি পরিবেশের বাড়িটা নিস্তব্ধ হয়ে আছে। অবনী নিজের ঘরে ছিল সারাটা বিকেল। শরীরটা তেমন ভালো নেই। এখানে আসার পর থেকে মাত্র কয়েক দিন পর্যন্তই ভালো ছিল সে। তারপর হুট করেই কি হয়ে গেলো। প্রতিদিনের মতো আকাশে বিশাল চাঁদ উঠেছে। কাঁচ দেয়ালের পর্দাটা সরানো। অবনী সেদিকে তাকিয়েই কফিতে শেষ চুমুকটা দিয়েই কাপটা টেবিলে রাখল। দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হতেই খুলে দিলো। রোজ ভীষণ মিষ্টি হেসে বলল
–ম্যাম আপনাকে নিচে ডাকছে খেতে। স্যার অপেক্ষা করছেন।

–আসছি।

অবনী ক্লান্ত হেসে কথাটা বলতেই রোজ চলে গেলো। পাতলা চাদর শরীরে জড়িয়ে নিচে নেমে এলো। সিঁড়িতে পা দিতেই গতি কমে এলো। চারিদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো। মস্তিস্ক ধরতে না পারলেও দৃষ্টি জানিয়ে দিচ্ছে আজ বাড়িতে কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে। ধির পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো অবনী। আশেপাশে দেখতে দেখতে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ালো। জুনায়েদ রহমান অবনীর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকেই বললেন
–তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। সিট।

অমনোযোগী অবনী আচমকাই এমন কথা শুনে চমকে উঠলো। অপ্রস্তুত হয়ে বলল
–জি?

জায়েদ রহমান মৃদু হেসে বললেন
–বসে পড়ো। তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

অবনী চেয়ার টেনে বসার আগেই খেয়াল করলো জুনায়েদ তার পাশেই বসে আছে। দৃষ্টি তার ফোনে আবদ্ধ। এক পলক তার দিকে তাকিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়লো। সবাই চুপচাপ খাবার খাচ্ছে। কাঁটা চামুচ আর প্লেটের টুংটাং আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই কানে আসছে না। জায়েদ রহমান কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন অবনীর দিকে তাকিয়ে। কয়েকদিন যাবত মেয়েটা বেশ চুপচাপ। নিজের কথাটা চেপে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন
–তোমার কি শরীর খারাপ মামনি? এমন দেখাচ্ছে কেন?

অবনী মলিন হাসল। বলল
–তেমন কিছু না বাবা। কয়েকদিন যাবত একটু শরীরটা খারাপ যাচ্ছে। ওয়েদার এর জন্য হয়তো এমন হতে পারে।

জায়েদ রহমান চিন্তিত কণ্ঠে বললেন
–কি হয়েছে? ডক্টরের কাছে যাবে?

–না না বাবা। তেমন কিছুই হয়নি। ক্লান্তিটা একটু বেড়ে গেছে। আর মাথাটাও ঘুরে উঠছে। রাতে ভালো ঘুম হওয়ার পরও সারাদিন মাথাটা ঝিমঝিম করে। মনে হয় ঘুমটাই কাটছে না।

অবনী কথা শেষ করে খাবারের দিকে মনোযোগ দিলো। জায়েদ রহমান অবনীর দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে জুনায়েদের দিকে তাকালেন। জুনায়েদ বুঝতে পেরে চোখ তুলে তাকাল বাবার দিকে। চার চোখ একত্রিত হয়ে বিনিময় হয়ে গেলো গভীর রহস্যের। যা অবনীর ধারের কাছেও ঘেঁষল না। কিছুই আন্দাজ করতে পারলো না সে। খাবার শেষ করে জায়েদ রহমান বেশ কঠিন গলায় বললেন
–জুনায়েদ তোমার কাজ শেষ করে আমার ঘরে এসো। কথা আছে।

বলেই তিনি ঘরে চলে গেলেন। শুধু জুনায়েদের উদ্দেশ্যে বলা কথাটা ক্লান্ত অবনী শুনল। কিন্তু কোন কথা বলল না। খাবার শেষ করে এলোমেলো পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। জুনায়েদ সেদিকেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অবনী তার ঘরে ঢুকে যেতেই জুনায়েদ একটা শ্বাস ছেড়ে বাবার ঘরের দিকে পা বাড়াল। ঘরে ঢোকার আগে অনুমতি নেয়ার উদ্দেশ্যে দরজা ঠেলে মাথা বাড়িয়ে দেখল অস্থির ভাবে পায়চারী করছেন জায়েদ রহমান। জুনায়েদ চিন্তিত হয়ে ঘরে ঢুকেই পড়লো। অনুমতি নেয়ার কথাও ভুলে গেলো। বিচলিত হয়ে বলল
–কি হয়েছে বাবা? তোমাকে এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?

জায়েদ রহমান থমথমে মুখে তাকালেন। জুনায়েদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। কঠিন গলায় বললেন
–কি করছ তুমি জুনায়েদ? মেয়েটাকে কি মেরে ফেলতে চাও?

এমন কথা শুনে জুনায়েদ হকচকাল। আহত দৃষ্টিতে তাকাল বাবার দিকে। অসহায়ের মতো বলল
–কি বলছ বাবা? আমি কেন এমন করবো? বিশ্বাস নেই তোমার আমার উপরে?

জায়েদ রহমান কঠিন গলায় বললেন
–বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা নয় জুনায়েদ। এটা মেয়েটার জীবন মরণের প্রশ্ন। তুমি যা করছ সেটা ওর জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমি কি এই জন্যই তোমার সাথে ওর বিয়ে দিয়েছিলাম? এখন আমি ভাবতে বাধ্য হচ্ছি তুমি ওর যোগ্য কিনা।

জুনায়েদ আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে অসহায়ের মতো বলল
–বাবা!

জায়েদ রহমান গাম্ভীর্যতা বজায় রেখেই বলল
–আমার মেয়েটাকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে। আমি ওকে নিয়ে কোন রিস্ক নিতে চাই না। তোমার উপরে ভরসা করাটাই আমার ভুল হয়ে গেছে। তুমি এখন যেতে পারো।

জুনায়েদ অস্থির শ্বাস ছেড়ে বলল
–আমার কথাটা শোন বাবা। আমি এমন কিছুই করিনি। তুমি আমাকে ভুল বুঝছ।

জায়েদ রহমান উল্টা দিকে ঘুরে বললেন
–আমি এই মুহূর্তে তোমার কোন কথা শুনতে চাইছি না। তুমি যাও এখন।

জুনায়েদ নিজেকে সামলাতে পারলো না। হতাশ হয়ে চলে গেলো ঘরে। নির্দিষ্ট স্থান থেকে একটা বোতল বের করে ঢাকনা খুলে গলায় ঢেলে দিলো। বোতলটা হাতে নিয়ে সোফায় বসে পড়লো। বাবা তাকে কোন ভাবেই বিশ্বাস করছে না। সে কেন অবনীর ক্ষতি করবে? সে তো অবনীর কোন ক্ষতি চায় না। ক্ষতি চায়না বলেই তো তাকে এনে নিজের কাছে রেখেছে। বোতলটা পাশের টেবিলে রেখে চোখ বন্ধ করে ফেললো। মাথা চেপে ধরে কিছুক্ষন বসে থেকে ভাবল। হাতের ঘড়িটা দেখে নিয়ে বের হল ঘর ছেড়ে। অবনীর ঘরের দরজার হাতল ঘোরাতেই বুঝে গেলো ভেতর থেকে লক করা। তাই পকেট থেকে চাবি বের করে খুলে ফেললো। অবনী তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। জুনায়েদ কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে তার পাশে গিয়ে বসল। একটু ঝুঁকে এলোমেলো চূলগুলো আলতো করে গুছিয়ে দিলো। কপালে গাড় চুমু খেয়ে ঘোলাটে কণ্ঠে বলল
–বাবা এমন কেন বলল অবনী? আমি সত্যিই তোমার যোগ্য নই? আমি কি তোমাকে ভালো রাখতে পারছি না? তোমার ক্ষতির কারণ কি আমি নিজেই?

কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে উঠে বসল। সোজা হয়ে বসে কঠিন গলায় বলল
–এমন হতে পারে না। আমি তোমার ক্ষতির কারণ কিছুতেই হতে পারি না। ডক্টরের সাথে কথা বলেই তো আমি তোমাকে স্লিপিং পিলস দেই। এটা তোমার কোন ক্ষতি করবে না। তাহলে বাবা কেন ভরসা করতে পারছে না আমার উপরে? আমি তো তোমার ক্ষতির কথা কোনদিন ভাবতেই পারি না। তোমাকে ভালো রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করি। সেসব কিছু কেউ বুঝতে পারেনা অবনী। আমি যে চাইলেও তোমার ক্ষতি করতে পারব না। কারণ…।

আবারো ঝুঁকে গেলো অবনীর কাছাকাছি। আলতো করে গালে হাত রেখে বলল
–আমি তোমাকে ভালোবাসি অবনী। খুব বেশী ভালোবাসি। যতটা ভালবাসলে সেই মানুষটা নিশ্বাসের সাথে মিশে যেতে পারে ঠিক ততটাই ভালোবাসি তোমাকে। তোমার হৃদপিণ্ডের গতির সাথে আমার হৃদপিণ্ড চলে। ওটা থেমে গেলে এটাও যে থেমে যাবে। বেঁচে থাকতে পারব না আমি। তবুও কিভাবে আমি তোমার ক্ষতি করছি অবনী? বলতে পারো? একটা মানুষ কিভাবে নিজের অস্তিত্বকে মেরে ফেলার কথা ভাবতে পারে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here