মেঘপিয়নের_ডাকে পর্ব ১৪

0
2819

#মেঘপিয়নের_ডাকে
পর্ব ১৪

মেঘ ছুঁয়ে ভেসে আসা ঠাণ্ডা শিরশিরে হাওয়াটা উষ্ণ পরিবেশটা শীতল করে দিয়েছে। রুম হিটারের কার্যক্ষমতাও তার কাছে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। উষ্ণ আবরণে ছেয়ে থাকা ঘরটার পরিবেশ শীতল হয়ে উঠেছে। জুনায়েদের শীতল দৃষ্টি তার থেকেও বেশী শিহরণ তৈরি করছে অবনীর জন্য। সে অসস্তিতে পড়েছে ভীষণ। এতক্ষনের কথাগুলো এক নিশ্বাসেই বলে থেমেছে অবনী। হয়তো অনধিকার চর্চা হয়ে গেলো। কিন্তু একজন মানুষ তার চোখের সামনে এভাবে কষ্ট পাচ্ছে আর সে চুপ করে দেখে থাকবে। হোক না অনধিকার চর্চা তবুও সে সান্ত্বনা দেবেই। জুনায়েদ যদি তার উপরে খুব রাগ করেও বসে তবুও সে চুপ করে মেনে নেবে। নিচের দিকে তাকিয়ে অস্থির দৃষ্টি এদিক সেদিক ফেলছে। অপেক্ষা করছে জুনায়েদ কখন তার তীব্র রাগ দেখাবে। সবকিছু ভেঙ্গে গুড়িয়ে ফেলবে। কিন্তু তার সমস্ত ধারনা মিথ্যে প্রমান করে জুনায়েদ চাহুনির থেকেও শীতল কণ্ঠে বলল
–এসব যদি তাকে বোঝাতে পারতাম তাহলে হয়তো নিজকেও বোঝাতে পারতাম জীবনটা কত সুন্দর। আমার ভালোবাসার গভীরতা যদি সে কখনো উপলব্ধি করতে পারতো তাহলে আমি নিজেও শান্তি পেতাম। তার মাঝেই জীবনের সব সুখ খুঁজে নিতাম। একবার শুধু আমার হাত ধরে পুরো জীবন কাটিয়ে দেয়ার প্রয়াশ যদি সে করে তাহলে আমি কথা দিচ্ছি। পুরোটা জীবন তাকে ভালবাসায় আগলে রাখবো। এই জীবনে কোন কষ্ট তাকে ছুঁয়ে দিতেও পারবে না। আমার এই তীব্র ভালোবাসার চাদরে তাকে ঢেকে রাখবো যত্নে।

অবনী তাকাল অদ্ভুত ভাবে। মাথায় ঘোরাফেরা করা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টায় কৌতূহল বশত বলল
–সে টা কে?

জুনায়েদ উত্তর দিলনা। লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–দরজা খোলো। খাবার এসেছে।

অবনী কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে দরজা খুলতে গেলো। সত্যিই খাবার এসেছে। জুনায়েদের আবেগের মাঝে এতটাই গভীর ভাবে ডুবে গিয়েছিল সে যে দরজায় করা সূক্ষ্ম আওয়াজটাও তার কানে আসেনি। খাবারটা নিয়ে টেবিলে রাখল। জুনায়েদ ততক্ষণে উল্টা দিকে ঘুরে গেছে। বাইরে তাকিয়ে আছে সে। অবনী সেদিকে তাকিয়ে বলল
–খাবেন না? ভেতরে আসুন।

জুনায়েদ ঠাণ্ডায় কম্পমান ভীষণ হতাশ কণ্ঠে বলল
–ইচ্ছা করছে না। তুমি খেয়ে নাও।

অবনীর মন খারাপ হল। তারা বেড়াতে এসেছিলো এখানে। কিছু আনন্দের মুহূর্ত কাটাতে। কিন্তু এসেই অবনীর এইসব কথা হয়তো জুনায়েদকে বলা উচিৎ হয়নি। তার যে খুব মন খারাপ হয়েছে সেটা আচরনেই প্রকাশ পাচ্ছে। খাবারটা পুনরায় ঢেকে রেখে বিছানায় বসে পড়লো সে। জুনায়েদ ততক্ষনে সিগারেট জ্বালিয়েছে। সম্পূর্ণ সিগারেট শেষ করে তবেই ভেতরে এলো। এসেই চোখ পড়লো বিছানায় চোখ বন্ধ করে বসে থাকা অবনীর উপরে। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল
–এভাবে বসে আছো কেন? খারাপ লাগছে?

চোখ মেলে তাকাল অবনী। মৃদু কণ্ঠে বলল
–খারাপ লাগছে না। এমনিতেই।

খাবারের দিকে তাকিয়ে বলল
–তোমাকে না খেতে বললাম? খাওনি কেন?

অবনী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল
–আমিও তো আপনাকে খেতে বলেছিলাম। আপনি খেলেন?

আচমকা এমন ধমকে জুনায়েদ ভড়কে গেলো। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো কয়েক মুহূর্ত। ভীষণ অপরাধীর মতো বলল
–সরি। আসো। খাবে।

————
সানফ্রানসিসকোর তাপমাত্রা এখন মাইনাসে। ভীষণ শীত সেখানে। হাড় হিম করা ঠাণ্ডা। হিম শীতল হাওয়াটা শরীরে এসে লাগতেই পুরো শরীর যেন টনটন করে উঠছে। সাথে হাত পা অসাড় হয়ে যাচ্ছে। জুনায়েদ অবনীকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে। সকালের নাস্তা খাওয়ার পর অবনীর শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল তাই তারা একটু দেরিতেই বের হয়। দুপুরে লাঞ্চ করে বেরিয়েছে তারা। তাই ঠাণ্ডাটা এখন একটু বেশীই। ভারী শীতের কাপড় আর গাড়িতে রুম হিটারের ব্যবস্থা থাকায় তেমন ঠাণ্ডা এখনো লাগছে না। অবনী আর জুনায়েদ একটা ট্যাক্সি হায়ার করেছে। তারা বে ব্রিজ দেখতে যাবে। পেছনে বসে অবনী জানালা দিয়ে উঁকি ঝুকি মেরে বাইরে দেখার চেষ্টা করছে। কিছু একটা চোখে পড়তেই কৌতূহল বশত জুনায়েদের দিকে তাকাল জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু তার থমথমে মুখ দেখেই থেমে গেলো। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে স্থির দৃষ্টিতে। খুব একটা কথাও বলছে না সে। আনমনেই কিছু একটা ভাবছে। সেই সকাল থেকেই এমন করছে। জুনায়েদের মুখ দেখেই অবনীর সকল প্রশ্ন করার ইচ্ছা বিসর্জন দিয়ে দিলো মন। তাই আবারো জানালার বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সে। তৎক্ষণাৎ কানে এলো ভারী গম্ভীর কণ্ঠ
–কিছু বলবে?

অবনী ঘুরে তাকাল। জুনায়েদ ফোনের দিকেই তাকিয়ে আছে। অবনী বেশ অবাক হল। সে যে তার দিকে তাকিয়েছিল সেটা তো জুনায়েদ দেখেনি। কিভাবে বুঝল অবনী কিছু বলতে চায়? প্রথম প্রশ্নটা মাথায় আসতে করেই ফেললো
–আপনি কিভাবে বুঝলেন আমি কিছু বলতে চাই কিনা?

জুনায়েদ চোখ তুলে তাকাল। অবনীর কৌতূহলী চঞ্চল দৃষ্টির মাঝে নিজের গভীর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল
–আমার চোখ আছে। মস্তিষ্কও বেশ সচল। সব থেকে বড় কথা আমার অনুভূতি অনেক গভীর। এই গভীরতা আমার পাশের মানুষটার ছোট ছোট আহ্বান জানিয়ে দেয়।

অবনী বিস্মিত চোখে তাকাল। জুনায়েদের কথার অর্থ তার মস্তিস্ক ধরতে পারলো না। জুনায়েদ ওভাবেই তাকিয়ে থেকে বলল
–কি বলতে চেয়েছিলে?

অবনী ঘোর থেকে বের হল। বলল
–কিছুনা।

জুনায়েদ হতাশ হয়ে ফোনের দিকে তাকাল। এই মেয়ে কি তার কথা কোনদিনও বুঝবে না। তার মনের অনুভূতি গুলো কি কখনো অবনীকে জানাতে পারবে না। ভেতর থেকে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। অবনী বুঝে গেলো জুনায়েদের মনের অবস্থা ভালো না। তাই আর তাকে বিরক্ত করলো না। সেও চুপচাপ হয়ে গেলো। কিন্তু অবনীর এমন চুপ থাকাটাই জুনায়েদের পছন্দ না। কিভাবে অবনীকে বোঝাবে সে। ফোনের পাওয়ার বাটন চেপে স্ক্রিনটা বন্ধ করে দিলো। গম্ভীর কণ্ঠে বলল
–মনের কথা জমা রাখতে নেই। যা বলতে ইচ্ছা করে বলে দিতে হয়। এতে নিজের মনের বোঝা হালকা হয়।

অবনী ঘুরে তাকাল। মৃদু স্বরে বলল
–তেমন কিছু বলার ছিল না।

অবনীর কেমন মন খারাপ। বিষয়টা জুনায়েদ বুঝতে পেরেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলল
–ঠিক আছে। তবে অন্যকিছু তো বলতে পারো। কেমন লাগছে বেড়াতে এসে সেটা নিয়ে কিছু বলো।

অবনী কিছুটা সময় নিয়েই উত্তর দিলো। ঠোঁটে মুচকি হাসি রেখে বলল
–এতো সুন্দর ওয়েদার। এতো সুন্দর জায়গা আর আপনার মতো ভ্রমন সঙ্গী থাকলে খারাপ লাগার কোন প্রশ্নই ওঠেনা। সঙ্গী হিসেবে আপনি খারাপ না জুনায়েদ সাহেব।

জুনায়েদ সরু চোখে তাকাল। বলল
–ফ্লার্ট করছ আমার সাথে?

অবনী শব্দ করে হেসে উঠলো। হাসি থামিয়ে বলল
–কেন ভয় পাচ্ছেন? ফ্লার্ট করলে প্রেমে পড়ে যাবেন বুঝি?

–যদি পড়ে যাই?

জুনায়েদের ভীষণ আবেগি কণ্ঠ শুনে অবনী আবারো স্থির হয়ে গেলো। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে বলল
–কারো প্রেমে পড়া কি এতটাই সহজ? বললেই প্রেম হয়ে যায়?

জুনায়েদ সামনে তাকাল। মুচকি হেসে বলল
–সহজ কি কঠিন জানিনা। তবে প্রেমের বিষয়টা অনেক জটিল। প্রেমে না পড়া অব্দি উপলব্ধি করা সম্ভব হয়না। এই যে আমি সারাজীবন প্রেম বিষয়টাকে ইগনোর করে এসেছি। অথচ কখন কোথায় কিভাবে প্রেমে পড়লাম সেটা নিজেও জানিনা। প্রেমে পড়ে তবেই উপলব্ধি করতে পেরেছি।

অবনী মুগ্ধ হয়ে জুনায়েদের কথা শুনছিল। জুনায়েদ বাইরে তাকিয়ে আছে আর অবনী তার দিকে। মানুষটাকে প্রথম যেমন ভেবেছিলো ঠিক তার উল্টা। ভীষণ বদমেজাজি একজন মানুষের মধ্যে এতো নরম মনের বসবাস থাকতে পারে সেটা হয়তো জুনায়েদ কে না দেখলে বুঝতেই পারতো না। অবনীর মনে হল জুনায়েদ যাকে ভালবেসেছে সে সত্যিই অনেক ভাগ্যবতী। তার ভালোবাসা গ্রহন না করার অপরাধে সেই নারীকে পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম ভাগ্যের অধিকারী হিসেবে আখ্যা দিলেও কিছুই ভুল হবে না।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here