নিশুতি_তিথি পর্ব ২০

0
1786

#নিশুতি_তিথি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ২০
___________

৪৭.
অস্বস্তিতে গা কাঁটা দিয়ে উঠছে। যতই বলুক না কেন, স্বাভাবিক থাকো। তবুও কি স্বাভাবিক হওয়া যায়? যখন একটা লোক তাকে বিবাহিত জানার পরও পাওয়ার চেষ্টায় অবিবাহিত থেকে যায়, তখন দেহ-মন সবকিছুই সংকুচিত হয়ে আসে আপনা-আপনিই। বছর তিনেক আগে, রিমাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়েছিল ছোটো ভাবি সামিয়া নিজের বাড়িতে। অবশ্য কারণ আছে এমন টানাটানির। সেটা হলো, বরপাগল মেয়ে রিমা বাবার বাড়ি আর গ্রাম ছাড়া কোথাও বেরোয়-টেরোয় না খুব একটা। উপরন্তু রিমার ভাইয়ের সাথে সামিয়ার বিয়ে হয়েছিল ফোনে ফোনে। ছেলে বিদেশ ছিল তখন নতুন নতুন। দু’বছর পরে গিয়ে আকামা পায়। এর আগে আসা-যাওয়ার সুযোগ নেই, যার ফলে সামিয়াকে বাড়িতে তুলে নেওয়া হয়নি তখন। পরে একসময় তুলে নেওয়া হয়। তবে এর আগে সামিয়া শ্বশুর বাড়িতে এসে দু-একদিন থেকে যেত। রিমার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ভালোই গড়িয়েছিল, যে ক’দিন তাকে পেয়েছিল। রিমার স্বামী আলীর সাথেও কথাবার্তা হয়ে ফ্রি মাইন্ডে। একদিন যখন শুনল আলী আসবে না কয়েকদিন, গ্রামে থাকবে জরুরি কাজের ভিত্তিতে৷ তখন সামিয়া আবদার রাখে রিমাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে ঘুরিয়ে আনতে। একগুঁয়ে রিমা রাজি না হলেও পরক্ষণে রাজি হয়েছিল, যখন আলী বলল ঘুরে আসতে। মন ভালো থাকবে। সে-ও তো আসবে না কয়েকদিন। সেদিন হাসিখুশি মুখে নিতে আসা সমীরের সাথে গাড়ি চড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে আজও সেই ব্যক্তি নিতে এসেছে, সে-ও গাড়িতে চড়েছে, তবে মুখে হাসির বদলে ঢাকা পড়া কালো মেঘে। লুকিং গ্লাসে আড়চোখে কয়েকপলক দেখল সমীর। গাড়ির ভেতর থাকা গুমোট বাঁধা আবহাওয়াকে বেগে আনতে সামিয়া কথা জুড়ে দিলো রিমার সাথে। কিন্তু নিম্নস্বরের হু, হা ছাড়া কোনো কথা বের করতে পারল না রিমার মুখ থেকে। ঘন্টাখানেক এমনই নিশ্চুপ আবহাওয়া ও বৃষ্টির মাঝে পৌঁছে গেল কাঙ্ক্ষিত স্থানে।

৪৮.
বৃষ্টির পরে মেঘ সরে যেই সূর্যতাপ নিসৃত হয়, সেটা বেশ আরামপ্রদ। আদ্র উষ্ণতা মিশানো উত্তাপে আরামে আঞ্জুমানকে আরেকটু গভীরভাবে জড়িয়ে নিলো আলী নিজের সাথে। ঘুম কাটেনি এখনো কারোরই। তৃপ্তির রেশ হয়তো বেশ। তাই যেখানে আলীর ঘুম আগে কাটার কথা, সেখানে তার মুখ পরিতৃপ্ততার সাথে ঘুম পরি’রা এসে ভর করেছে। ঘড়ির কাঁটা দশটার ঘরে পৌঁছায় ফোন আসে তখন, ভাইব্রেশন মুডে। বিপ বিপ’ শব্দ তুলে। ব্যাঘাত ঘটায় আলীর ঘুমে। আলী এতদিন বেশ ভালোভাবে বুঝেছে আঞ্জুমানের ঘুমের গভীরতা। আলীর ঘুম পাতলা বিধায় টের পায় সুক্ষ্ম শব্দও। সাইড-টেবিলে হাতড়ে ফোন নিয়ে দেখে রিমার কল আসছে। রেখে দেয় সেভাবেই। মেয়েটা ড্রাইভার দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে ফোনটা। ইদানীং কেন জানি এত বাড়াবাড়ি ভালো লাগে না, অসহ্যকর ঠেকে। হয়তো আঞ্জুমানের সান্নিধ্যে বাঁধা প্রদান করায়। বিরক্তিতে মুখ তেঁতো হয়ে এলেও পরক্ষণেই মুখের মুগ্ধতার মোহজাল তৈরি হয় বুকের বাঁপাশে মাথা রাখা আঞ্জুমানের পবিত্র মুখ দর্শনে। জাগতিক সুখের খোঁজ যেন এই মুখের মধ্যে নিহিত। পাষণ্ড মনে ভালোবাসার বীজ এই শুভ্র, নির্মল, নিষ্পাপ মেয়েটির মাধ্যমেই তো বপন করা হয়েছিল। এখন সেই বীজ থেকে থেকে পরিণত গাছে পরিপূর্ণ হচ্ছে। হয়তো আজ পরিপূর্ণ হলো। আদুরে বিড়ালছানার ন্যায় আলীর বুকে চুপটি করে শুয়ে থাকা আঞ্জুমান এবার ঘুম ভেঙে চোখ পিটপিট করে মেললে আলী তার দিকে তাকিয়ে ভুবন ভুলানো হাসি দেয়। পিটপিট করে তাকিয়ে থাকা আঞ্জুমান হাই তুলে। বোধগম্য হয়নি বোধহয় মেয়েটার ঘুম ভাঙা বাকি। শরীরও হালকা গরম। জ্বর আসার পূর্ব সংকেত বুঝল আলী। আঞ্জুমান আবারো চোখ বোজার আগে আলী তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘আর ঘুমোতে যাস না। ওঠে ফ্রেশ হয়ে নে।’

কথাগুলো কর্ণকুহরে পৌঁছতে দেরি আঞ্জুমানের চোখ ডিম্বাকৃতি হতে দেরি হয় না। আলীর অতি নিকটে নিজেকে দেখে মিনিট খানেক লাগে ধাতস্থ হতে ঘটনা বুঝতে। মিনিট গড়ালে কুঁকড়ে যায় আলীর সাথে থাকা একই চাদরে। মুখ ডেকে ফেলে লজ্জা না কান্নার কারণ আলী ঠাওর করতে পারে না। আঞ্জুমানকে তখনের জন্য ছেড়ে ওঠে পা বাড়ায় ফ্রেশ হওয়ার তাগিদে লাগোয়া ওয়াশরুমে।

৪৯.
রিমা ফোনের ওপর ফোন দিয়ে যাচ্ছে আলীকে। নাহ, তার নাগাল পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ছে। অতটা জরুরি নয়, তবুও জানানোর তাগিদ অনুভব করছে বাধ্য, অনুগত স্ত্রী মন। গতবার যখন এসেছিল আলী জানত না। ঘটনা ঘটার পরে জেনেছে। এবার আগেভাগেই জানিয়ে দিয়ে চাইছে রিমা। কিন্তু, মিয়া ফোনটা ধরলে তো। ক্লান্ত হয়ে একসময় রেখে দিলো ফোন। সামিয়ার সাথে এক রুমে থাকবে সে। আলাদা গেস্টরুম যদিওবা দিতে চেয়েছিল কিন্তু রিমা-ই রাজি হয়নি। ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়- প্রবাদে বিশ্বাসী কি না। সকলের সাথে সকালের নাস্তার টেবিলে যায়নি মাথা ধরার নাম করে। সেজন্য সামিয়া নিয়ে এলো নাস্তা ট্রে করে। খেতে খেতে আলোচনা করল দু’জন মিলে হলুদে কে কী পরবে, মেয়ের বাড়ি যাবে না কি। যাবতীয় অনুষ্ঠানের আনুষাঙ্গিক বিষয় নিয়ে। বিয়ে হবে এই বাড়ি থেকেই। সামিয়ার বাবা নেই বিধায় সামিয়া মা চার সন্তানকে নিয়ে মা’য়ের বাড়িতে ওঠেন শ্বশুর বাড়ি ছিল না। স্বামীসহ ভাড়া থাকত ফ্ল্যাট নিয়ে। বড়ো মেয়ে, ছোটো মেয়ে দুটোরই বিয়ে দিয়েছেন, বড়ো ছেলেরও বিয়ে হয়ে গেছে আলাদা থাকে বউ-সন্তান নিয়ে। ছোটো ছেলে সমীর রয়েছে বাকি। সে না কি পণ করেছে বিয়ে না করার। অতি আদরের ঘাড়ত্যাড়া বলে বিয়ের জন্য চাপও দিতে পারছেন না। আগের ঘটনাও কিছুটা দায়ী সেখানে।

৫০.
‘কেমন আছ শ্যামাঙ্গী?’

একা একা দাঁড়িয়ে ছিল বিধায় সমীর সুযোগে জিজ্ঞেস করেই ফেলল বছরখানেক থাকা আবদ্ধ হওয়া প্রশ্ন। মেয়েটাকে যে খুবই ভালোবাসে সে। অন্যের কাছে ভালো থাকা দেখা যায় না বিধায় প্রশ্ন করা। তার কাছে থাকলে কী হতো? আলীর চেয়ে দ্বিগুণ ভালোবাসা কি দিতে পারে না সমীর? অবশ্যই পারে। সারাক্ষণ বক্ষের সাথে লেপ্টে রাখত তার শ্যামাঙ্গীকে। কিন্তু মেয়েটা, সে তো মত্ত অন্য পুরুষে। অন্য পুরুষ নয়, তার শ্যামাঙ্গে।

‘জি, ভালো।’

রিমার মুখ থেকে দু শব্দের উচ্চারিত হওয়া ভালো থাকার কথা যেন তৃপ্ত হলো না সমীর। মেয়েটা কি আর একটু কিছু বলতে পারল না? নিষ্ঠুর, পাষণ্ড, হৃদয়হীন কত কী যে উপাধি দিলো সমীর তাকে। শুনল না মেয়েটা। মনের কথা কি আর শোনা যায়, যদি যেত তাহলে আজ অর্ধাঙ্গ হতো সে-ই।

‘চলো, কোথাও বসি গিয়ে। সামিয়ার আসতে সময় হবে সম্ভবত।’

‘না আমি এভাবেই ঠিক আছি।’

‘এত রোদে ঘেমে-নেয়ে আছ। ঠিক থাকার কথা না। আসো ওখানে এক…’

এমন সময় আলীর ফোনকলে অদূরে সরে দাঁড়ায় রিমা ফোন রিসিভ করে। সেটা দেখে রাগে কপালের শিরা দপদপ করতে লাগল। এই আলী সবসময়ই তাদের কথার মাঝে আসবেই, তাকে যেন আসতেই হবে। এর কিছু একটা এবার করেই ছাড়বে। কিন্তু নির্বোধ, ভালোবাসায় না কি মোহে অন্ধ হওয়া সমীর বুঝল না, রিমা ও আলী বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে জড়িত আগে থেকেই। মাঝে তো সে এসেছে। সামিয়া ফুলের অর্ডার দিয়ে এলো। এবার সমীরের কাছে বায়না রাখল রেস্টুরেন্টে খাওয়ার জন্য। কিন্তু আশেপাশে রিমাকে না পেয়ে আঁতকে ওঠে সমীরকে জিজ্ঞেস করে,

‘রিমা কোথায়?’

‘ফোনে কথা বলে। ওই যে।’

চোখ-মুখ কুঁচকে জবাব দেয় সমীর। হাতের ইশারা দিয়ে ফোনে কথায় ব্যস্ত রিমাকেও দেখিয়ে দেয়। সমীরের বিরক্তভাব সামিয়ার চোখে পড়ে। সেটা দেখে সমীরকে বুঝাতে বলল,

‘ভাই প্লিজ এবার কোনো অশান্তি ডেকে এনো না। মেয়েটা ভুলে গেছে সব, তুমি-ও ভুলে যাও। লাইফে এগিয়ে যাও। রিমাকে সুখে থাকতে দাও, প্লিজ। বারবার বলছি, অনুষ্ঠানে কোনো ব্যাঘাত চাই না।’

এতগুলো কথার মাঝে কেবল সমীরের কর্ণকুহরে ঘন্টার ন্যায় বাজছে, মেয়েটা সব ভুলে গেছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here