প্রিয় দিও বিরহ ” পর্ব-২

0
1679

“প্রিয় দিও বিরহ ”

২.

কী সাংঘাতিক! গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে মেহতিশার। লালিমা শেখ খেয়াল করে তাকে ঘরটির ভেতরে নিয়ে গেলো। দরজা খুলতে আরেকটা চমক অপেক্ষা করছিলো যেনো। তীব্র বেগে রশ্মির ফোয়ারা এসে মেহতিশার চোখে মুখে লাগলো। চোখের উপর হাত রেখে ঢেকে নিলো। লালিমা কিছু বিব্রত হয়ে বললেন,

‘ইয়ে মানে, মা কিছু মনে করো না। আসলে আমার ছেলেটা মাঝে মাঝেই এমন করে ঘরের সবগুলো আলো জ্বালিয়ে বসে থাকে। আমি এখনই হালকা আলো দিচ্ছি। ‘

বলেই তিনি দরজার ডানপাশের সুইচবোর্ড থেকে সবগুলো বাতি নিভিয়ে দিয়ে হালকা মিডিয়াম একটা বাতি জ্বালিয়ে দিলেন৷ মেহতিশা চোখ থেকে হাত সরালো। তবে, একধাপ এগিয়ে অবাক হলো। এটা ঘর নাকি কাপড় বিক্রির দোকান? কাপড়ের দোকানে যেমন রাশি রাশি টিউবলাইট লাগানো থাকে তেমন করেই এক লাইনে অসংখ্য ঝাড়বাতি লাগিয়ে রাখা৷ তার সাথে আবার কতগুলো বিরাট আয়না রুমের প্রতিটি দেয়ালে লাগানো। আশ্চর্য! এমন উদ্ভট ঘরে কীভাবে থাকবে মেহতিশা? এ কেমন ঘরে বিয়ে দিলো তার বাবা! মেহতিশা ভীরু চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে পুরো ঘরটা অবলোকন করে। ঘরটা দেখে কেমন একটা নবাব নবাব ভাব আসছে। ঘরের বিরাট খাটটায় রাজবংশীয় ডিজাইন। অবশ্য মেহতিশা শুনেছিলো, অতীতের কোনো এক সময়ে শেখ পরিবারের সঙ্গে রাজা-বাদশাদের ভালো যোগ সংযোগ ছিলো। ঘরের আনাচে কানাচে নানান রকম দেয়ালচিত্র টাঙানো। মেহতিশাকে লালিমা শেখ তুলতুলে নরম বিছানাটায় বসিয়ে দিয়ে বললেন,

‘দর্পণ হয়তো ছাদে আছে, তুমি বসো মা। ও কিছুক্ষণের ভিতরে চলে আসবে। কোনো কিছু লাগলে আমাকে জানিও। অথবা দর্পণকে বলো৷ ‘

মেহতিশা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে৷ লালিমা শেখ চলে গেলে বিরবির করে বলল,

‘হুহ! নিজেই একটা পঙ্গু আমাকে আর কী সাহায্য করবে? আমাকেই ওটাকে নিয়ে বয়ে বেরাতে হবে। ‘

রাগে নাক মুখ লালরঙা হয়ে ওঠে মেহতিশার। হাতের আঙুলে চেপে রাখা আংটিটা মোচড়াতে থাকে। মেহতিশার খুব মনে পড়ছে নিজের ঘরের কথাটা। এরকম এতো বড় ঘর ছিলোনা মেহতিশার। তাই বলে, আমোদপ্রমোদও কম নয়৷ ঘরের একপাশে পিয়ানো সেট করে রাখা ছিলো। মেহতিশার হালকা মেজেন্টা রং ভালো লাগে। সেই রঙের পেইন্টিং করা ছিলো দেয়ালে। একটা সফট মিউজিক সবসময়ই ঘরে মাদকীয় পরিবেশ তৈরি করে রাখতো। ল্যাভেন্ডার ফ্লেভারের রুমস্প্রের শিরশিরে ঘ্রাণ চঞ্চলে পায়ে ছুটে বেড়াতো। সব মিলিয়ে কম্ফোর্ট একটা জোন। অথচ এখানে শ্বাস নিতেও ফরমালিটি মেইনটেইন করছে৷ দমবন্ধ হয়ে যায় যেনো৷ মেহতিশা উঠে দাঁড়ায়। চারপাশেই ঘেরা চকচকে আয়না। তাই সহজেই একটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গলার ভারিক্কি গহনা গুলো খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখলো। মুখ ফুলিয়ে লম্বা শ্বাস টেনে নিলো। ফরসা গলাটা টকটকে লালবর্ণ ধারণ করেছে।

মেহতিশা নিজের স্কিন নিয়ে ভীষণ প্রোটেক্টিভ। এই মুহুর্তে হালকা ঠান্ডা পানি দিয়ে গা মুছে নাইট ক্রিম মাখা দৈনিক রুটিন। যেটা এখন করতে না পেরে গা জ্বলজ্বল করছে। মেহতিশা হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাখে।
কপাল চাপড়ে মনে মনে নানাবিধ চিন্তা ভাবনা করতে থাকে। খট করে একটা আওয়াজ হলো। মেহতিশা তাকিয়ে দেখে দরজা খুলে গেছে। ভ্রু কুচকে তাকায় মেহতিশা। দরজা খুলে দুজন লোক ভেতরে এসেছে। গায়ে কালো এক ধরনের পোশাক। মেহতিশা ভেতরে প্রবেশ করার সময় খেয়াল করেছে, বাড়ির সকল কাজের মহিলা এবং পুরুষের গায়ের কাপড়ের রঙ কালো। লোক দু’টো মাথা নিচু করে দরজা পুরোটা খুলে বাহির থেকে খুবই যত্নসহকারে একটা হুইলচেয়ার টেনে নিয়ে আসছে। হুইলচেয়ারের দিকে তাকায় মেহতিশা। একজন পুরুষ যে ওটায় গুরুগম্ভীর নয়নের সহিত তাকিয়ে আছে এতোটুকু শুধু বুঝতে পারলো। লোক দুটো হুইলচেয়ার রেখে একে একে কিছু খাবারের থালা নিয়ে আসে। তিনটা রাজকীয় ট্রে টি-টেবিলে রেখে মাথা নিচু করে চলে গেলো দরজা বন্ধ করে। মেহতিশা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে হুইলচেয়ারটির দিকে তাকালো। লোকটা তখনই মাথা তুললো। মেহতিশা হা করে তাকালো। চমকালো, ভড়কে শুঁকনো ঢোক গিলে ফেললো দুই তিনেক। লোকটার মুখের গৌড় বর্ণ সঙ্গে মুচকি হাসি এক মুহুর্তের জন্য থমকে দিলো মেহতিশাকে। বড়সড় চোখে মিনিট দুয়েক তাকিয়ে রইলো। হুইলচেয়ারে বসা মানবটি মৃদু কন্ঠে বলল,

‘আসসালামু আলাইকুম, আশা করি ভালো আছেন বউজান। ‘

মেহতিশার ঘোর কেটে গেলো। মনে পড়লো সামনের ব্যাক্তিটি তার স্বামী। যার সঙ্গে তার অনিচ্ছায় বিয়ে হয়েছে। যাকে মেহতিশা নিজের এই দুর্দশার মূলকারণ ভাবে। মনে মনে বিদ্রুপ করে অন্য দিকে তাকালো। চোখ মুখে ফুটে উঠলো অনীহা। লোকটা বোধ হয় জানতো এমনই হবে। কিছুটা অপ্রসন্ন হয়ে বলল,

‘বউজান,সালামের উত্তর দেয়া ফরজ। ‘

মেহতিশা রেগে ক্ষুব্ধ হয়ে তাকালো। বড় কদম ফেলে হনহনিয়ে সামনে এলো হুইলচেয়ারটার। হাতজোর করে ঝুঁকে চিৎকার করে বলল,

‘ওয়ালাইকুম আসসালাম! খুব ভালো আছি। এতোটাই ভালো যে আমার ইচ্ছে করছে ধেইধেই করে নাচতে। ‘

পুরুষটি হয়তো আহত হলো। মলিন হলো মুখ। বিনম্র গলায় বলল,

‘আপনি এমন করে বলছেন কেনো? ‘

মেহতিশার ক্রোধ একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে চাইলো। চিৎকার করে গগণকে ধ্বংস করে দেয়ার প্রবল ইচ্ছে হলো। মেহতিশা হুইলচেয়ারের হাতলে দুই পাশে দুই হাত রেখে মুষ্ঠি করে কর্কশ কন্ঠে বলল,

‘আচ্ছা আপনার কী লজ্জা নেই? কোন মুখে আমাকে বিয়ে করলেন! পঙ্গু একজন মানুষ হয়ে সুস্থ একজনকে বিয়ে করে গর্বিত লাগছে বুঝি? কী যেনো নাম আপনার?ওহ দর্পওওণ। ‘

দর্পণের স্থির দৃষ্টি মেহতিশার দিকে এতোক্ষণ নিবদ্ধ থাকলেও এখন মাথাটা নিচু হয়ে গেলো। মেহতিশার সবচেয়ে বাজে স্বভাব হচ্ছে, মুখের কথায় যে কাউকে রক্তাক্ত করে ফেলতে পারে। সে যেই হোক না কেনো। মেহতিশা সবসময় রাগে না। কিন্তু যখন গুরুতর ভাবে কোনো কারণে রেগে যায় তখন সামনের মানুষটাকে না কাঁদানো পর্যন্ত ও থামেনা৷ মাথা ঠান্ডা হলে পরবর্তীতে নিজেই অনুতপ্ত হয় বটে। তবে ইগোর জন্য কখনো মাথা নত করে না। দর্পণ যখন ডান হাতের আঙুল দিয়ে চোখটা মুছলো ঠিক তখন মেহতিশার মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো। মেহতিশা সোজা হয়ে দাঁড়ালো। দর্পণ তখন জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল,

‘আপনি যান হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন। খাবার রাখা আছে খেয়ে নিন। ‘

মেহতিশা দর্পণকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। হাত মুখ ধুয়ে এসে বিছানায় পা উঠিয়ে বসলো। প্রচন্ড ক্ষুধা অনুভব হচ্ছে ওর ৷ ঠান্ডা হাত ঘষে প্লেট উঠিয়ে নিলো। দুটো পরোটা, একবাটি সেমাই আর কিছুটা সালাদ নিয়ে খাওয়া শুরু করলো।
এ ঘরে নিজে ব্যতিত যে আরও একজন মানুষও বসে আছে। এই খেয়াল ওর মোটেও নেই। অথবা ইচ্ছে করেই অবহেলা করছে দর্পণকে। দর্পণ হালকা হেসে বলল,

‘আমাকে একটু বিছানায় বসাতে পারবেন? ‘

এবার একটু ভালো ব্যবহার আশা করেছিলো দর্পণ। নিজেও কিছু খায়নি সারাদিনে তেমন। রাতে আটটার ভেতরেই খাওয়া হয় সবার। কিন্তু দর্পণ সেসময় খায়নি ভেবেছিলো, নতুন বউটা না খেয়ে অপেক্ষা করছে। একসাথে খাবে। কিন্তু মেহতিশা ওকে একবারের জন্যও জিজ্ঞেস করলো না, মনে মনে একটু খারাপ লাগলো দর্পণের। এখন ভাবলো, মেহতিশা খেতে থাকুক বরং। ক্লান্ত লাগছে প্রচুর। তাই ক্ষুধার্ত পেট আর ক্লান্ত দেহেই বিছানায় বসার চেষ্টা করলো। কিন্তু অবস পায়ে সম্ভব না হওয়ায় অগত্যা মেহতিশাকে ডাকতে হলো। বিপরীতে মেহতিশা মুখের খাবারটা গিলে তাকালো। মনে মনে কিছু একটা শয়তানি বুদ্ধি এটে বলল,

‘ইশশ! আমি কী বোকা! ভুলেই গেছি আপনিও বসে আছেন। নিন হা করুন৷ ‘

বলেই এক টুকরো রুটি আলুভাজি মাখিয়ে দর্পণের মুখের সামনে ধরলো। দর্পণ ভীষণ খুশি হলো মনে মনে। অল্প একটু হা করতেই মেহতিশা খাবারটা নিচে ফেলে দিলো। দর্পণের টলমলে দৃষ্টি ফ্লোরের দিকে। লজ্জায়, অপমানে থমথমে মুখ হলো তার। মেহতিশা ভ্রুক্ষেপ না করে বলল,

‘ওপস! খাবারটা পড়ে গেলো। আপনি হয়তো খেয়েই এসেছেন৷ আমার খাওয়া শেষ। আমি এখন ঘুমাবো। আশা করি আর ডিস্টার্ব করবেন না। ‘

মাথা এলিয়ে, পা টানটান হয়ে শুয়ে পড়লো কাত হয়ে। দর্পণের মলিন হাসিটুকু ঠুনকো হয়ে পড়ে রইলো। কেউ জানতেই পারলো না নববধূবেশী ধনী রাজকন্যাটি কী সহজেই একজনের হৃদয়কে পা পিষে হত্যা করলো। আঁধারে নিমজ্জিত হয়ে হুইলচেয়ারেই একসময় নিদ্রায় চোখ বুঁজে নিলো দর্পণ।

চলবে-
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here