প্রিয় দিও বিরহ ” পর্ব-১১

0
1150

”প্রিয় দিও বিরহ ”

১১.

হেমন্তের শুরু। পরিবেশের বিচিত্রিতা ধরা যাচ্ছে না। এই বৃষ্টি তো এই গরম। এই সর্দি লাগছে তো আবার দৌড়ে পালাচ্ছে। কী জানি, কত রূপই না সে দেখাবে।
সময় পাল্লা দিয়ে এগোচ্ছে। কেটে গেছে সংসারে পদার্পণের চারটি মাস। রাগ, অভিমান, আর দিনশেষে
প্রণয়সিক্ত অজস্র ভালোবাসা। মেহতিশা এখন আর সেই আগের মতো রাগারাগি করে না। দিন যতই যায়
সে ততই সংসারী রূপে আবর্তিত হচ্ছে। কখনো তাকে দেখা যায় সকালে দর্পনের জন্য চায়ের কাপ হাতে হাজির হতে, দর্পণের কাপড় গুছিয়ে ভাজ করতে, কখনোবা কাঁচা হাতে রান্না শেখার আকুল চেষ্টায়। সব মিলিয়ে পাক্কা গৃহিণী। কে জানে এসব কী সে মন থেকেই করে নাকি সবই নাটক! প্রশ্ন থেকে যায় বটে।
উত্তর মেলেনা। চোখ নাকি মনের কথা বলে। দর্পণ যতবার মেহতিশার ধূসর গোধূলির মতো দুটি চোখের দিকে তাকায় ততবারই নতুন করে প্রেমে পড়ে। মন বলে ঐ দুটি চোখও একরাশ ভালোবাসে তাকে! দর্পণের সন্দিহান মন তখন মেহতিশাকে কাছে পেলেই সুধায়,
‘সত্যিই ভালোবাসেন তো বউজান?’

মেহতিশা মুচকি হাসে। প্রতুত্তর করেনা। দর্পণ আস্বস্ত হয়। ভেবে নেয়, নিশ্চুপতা সম্মতির লক্ষ্মণ। দর্পণ অধর ছোঁয়ায় মেহতিশার ললাটে ৷ গাঢ় স্পর্শ। আবেশে ঘোর লেগে যায় মেহতিশার। টুকরো টুকরো মায়ার বাঁধনে বেঁধে যেতে থাকে দর্পণ। ভালোবাসা মানে হয়তো সত্যিই ধ্বংস। মানুষ অবলীলায় সেই ধ্বংসের খাতায় নাম লেখায়। দর্পণের মাঝে মাঝে এখন মনে হয় মেহতিশার জন্য সে প্রাণও দিতে পারে। শুধু তার একটাই চাওয়া, ভালোবাসা কাছে থাকুক।

ঘড়ির কাটায় ছয়টা বেজে চার মিনিট। একে অপরের হাতে হাত রেখে গভীর তন্দ্রায় ডুবে আছে একজোড়া কপোত-কপোতী। নড়েচড়ে উঠলো দর্পণ। দর্পণের বাহুর উপরে নিয়ম করে শুয়ে ছিলো মেহতিশা। দর্পণের নড়ায় ঘুম হালকা হয়। উঠে বসলো সে। দর্পণের দিকে তাকিয়ে রইলো দুয়েক মিনিট। এতো নড়ছে কেন মানুষটা! ভোর রাত থেকেই বারবার নড়াচড়া করছে। দর্পণ ঘুমের মধ্যে একেবারেই শান্ত থাকে। কখনো আঙুলটাও নাড়াতে দেখেনি। মুখটা যেভাবে অল্প একটু হা করে থাকে তেমনটাই সকাল হলে দেখা যায়। ঠোঁট দুটো উল্টে আছে। চুলগুলো বড় হয়েছে। ফর্সা রঙের মুখটা লাল হয়ে গেছে। মেহতিশা ভ্রু কুচকায়। দ্বিধাহীন হাতটা ছুঁইয়ে দেয় দর্পণের কপালে। পিলে চমকে উঠে। গা গরম হয়ে আছে। এজন্যই বুঝি মেহতিশার গরম লাগছিলো। মেহতিশা
অস্থির ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়। প্রায় দৌড়ে বাথরুম থেকে পানি নিয়ে আসে মগে। পরিষ্কার কাপড় এনে জলপট্টি দিতে থাকে। এতো সকালে অন্যরা কেউই ওঠেনি। তাই বসে বসে জলপট্টি দিতে থাকলো। তাপমাত্রা হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে। মেহতিশা দর্পণের দিকে তাকিয়ে এবার ভয় পেয়ে যায়। নীল হয়ে গেছে মুখটা। মেহতিশা কাঁপা হাতে দর্পণের দুই গালে হাত রাখে। আলতো করে ডাক দেয়,

‘দর্পণ, উঠুন। শুনছেন?’

দর্পণের সারাশব্দ পাওয়া যায় না। এমনিতে বেশ সজাগ সে। ঘরে পাতা পড়ার শব্দ হলেও ঘুম ভাঙে। এখন উঠছেনা কেন? মেহতিশা বুঝতে না পেরে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে৷ শ্বাশুড়ির ঘরের দরজায় ঠকঠক করে। দর্পণের মা ঘুমঘুম চোখে বের হন। মেহতিশাকে দেখে অবাক হয়ে বলেন,

‘কী ব্যাপার বউমা? এতো সকালে এখানে! ‘

মেহতিশা কেঁদে ফেললো। আঁটকে আঁটকে বলল,দর্পণ ঘুম থেকে উঠছেনা গায়ে প্রচুর জ্বর। তিনি ভয় পেয়ে গেলেন। দর্পণের বাবাকে ডাকলেন। একে একে চেচামেচির আওয়াজে সবাই ঘর ছেড়ে বের হলো। এমনকি নিশিতাও। মেয়েটা সবসময় ঘরেই থাকে। মানসিক ভারসাম্যহীন হলেও সবসময় পাগলামি করেনা। ঘরে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। জানালার দিকে তাকিয়ে কী যেনো ভাবে৷ সেও বের হয়ে আসতে চাইলো। কাজের মহিলা এসে তাকে ভেতরে নিয়ে গেলো। দিয়া, দর্পণের মা, বাবা দর্পণের ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছেন। ডাক্তার ডাকা হলো। ডাক্তার পর্যবেক্ষণ করে বললেন,জ্বর ১০৪ ডিগ্রিতে। সিজনাল জ্বর হলেও একবার টেস্ট করে নেয়া ভালো। যেহেতু এখন করোনা মহামারী পরিস্থিতি ভালো না। ঘন্টা খানেকের মাঝেই হাসপাতালে শিফট করানো হলো দর্পণকে। জ্বরের কারণে ঘুমের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়েছে সে।

কেবিনের সাদা বিছানায় মলিন শরীরে শোয়ানো দর্পণ৷ মেহতিশা নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে সেদিকে। কী দেখছে কে জানে। সকাল থেকে সে একদমই খালি পেটে। গলা দিয়ে খাবার নামেনি৷ লালিমা শেখ নিজেও অসুস্থ মানুষ। তাকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন শুধু মেহতিশাই আছে৷ দিয়া যদিও এসেছিলো৷ তবে তারমধ্যে হাসপাতালে থাকার কোনো আগ্রহবোধ দেখা যায়নি। কেমন গা ছাড়া ভাব। মেহতিশা বুঝতে পারে, নিজের পরিবারের সবার থেকে একটু দূরে সরে থাকে দিয়া। কী কারণ, বোঝেনি।

ক্লান্ত নেত্রপল্লবে শূন্যে তাকিয়ে আছে মেহতিশা। বিকট শব্দে মোবাইলটা বেজে উঠলো। সেটায় বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘বাবা ‘। মেহতিশা বেখায়ালী হাতে তুলে কানে লাগায়। শামীউল্লাহ জামান ওপাশ থেকে গম্ভীর গলায় বলেন,

‘শুনলাম, দর্পণ নাকি এখন অসুস্থ। ‘

মেহতিশা প্রশ্ন করে,

‘তুমি কীভাবে জানলে?’

‘সেটা তোমার না জানলেও চলবে। টাকা থাকলে বাঘের চোখও পাওয়া যায়। যা বলার জন্য কল করেছি, এখন যেহেতু দর্পণ হাসপাতালে। তাই তোমার জন্য কাগজ বের করা সহজ হবে৷ বাসায় গিয়ে হাত চালাও। ‘

মেহতিশা বিরক্ত হয়। অভিভ্যাক্তিতে ধরা পড়ে। সে মনোযোগ না দিয়ে হেলা করে বলে,

‘হু, দেখবো। ‘

তিনি রাগত স্বরে বলেন,

‘দেখবো কী? এখনই বাসায় যাও। ‘

‘উনি অসুস্থ বাবা। ‘

‘অসুস্থ তো! ও মরুক ৷ তোমার কী? ‘

‘আমি হাসপাতালে থাকবো। রাখলাম। ‘

শান্ত কন্ঠস্বরে কথাটা বলেই কল কেটে দেয় মেহতিশা।
এগিয়ে যায় দর্পণের বিছানার দিকে। এককোণে বসে মাথা এলিয়ে দেয়। ঘুম নেমে আসে চোখে। দর্পণের জ্ঞান ফিরে হঠাৎ। সে নড়তেই মেহতিশা সজাগ হয়। অস্থির ভাবে বলে,’আমি এখনই ডক্টর ডাকছি। ‘

দর্পণ মেহতিশাকে আঁটকে দেয়। মেহতিশা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকায়। দর্পণ মেহতিশার হাত টান দিয়ে কাছে আনে। মেহতিশার চোখ টলমল করে। সেই সকাল থেকে কী নির্জীব হয়ে ছিলো এই মানুষটা। বুক ভারি লাগে। করুণ দৃষ্টিতে তাকাতেই দর্পণ মুচকি হাসে। দুই হাতে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে। মেহতিশা নরম বিড়াল ছানার মতো গুটিয়ে যায়। দর্পণ ঠান্ডা স্বরে বলে,

‘ভয় পেয়েছিলেন বউজান?’

অনেকটা সময় পর বউজান ডাক শুনে আবেগি হয় মেহতিশা। দর্পণের হাতটা আঁকড়ে ধরে বলে,

‘আপনি অনেক খারাপ। ভোররাতে আপনার খারাপ লাগছিলো,আমায় ডাকেননি কেনো? ‘

‘আপনাকে ঘুম থেকে উঠাতে ইচ্ছে করছিলো না। ‘

‘কেনো?’

‘ঘুমালে আপনাকে সুন্দর লাগে। ‘

মেহতিশা অস্বস্তিতে আড়ষ্ট হয়। লজ্জায় মুখ লুকায় দর্পণের বুকে। দর্পণ সশব্দে হাসে৷ মনে মনে আওড়ায়,

‘আমি বলেছিলাম, আপনি আরশীজালে ফেঁসে যাবেন। আপনি ফেঁসে গেছেন বউজান। ‘

চলবে –
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here