“প্রিয় দিও বিরহ ”
২১.
শীতের কনকনে ঠান্ডা কুয়াশায় মিনিট খানেক গা ডুবিয়ে বসে থাকলেও এখন একটু কষ্টই হচ্ছে। সকালের সময়টা রোজ বারান্দায় দাঁড়িয়ে বা জানালায় পাশে বসেই কাটায় মেহতিশা। নাহয়, এই সময়টা দর্পণ তার সাথে রাজ্যের গল্প জুড়ে বসে। দর্পণের হাসিমাখা মুখটাই তখন দিনের শুরুটা রঙিন করে তোলে। অথচ, আজ মেহতিশা ঘুম থেকে উঠে আনমনেই বলছিলো,
‘দর্পণ, এসিটা বন্ধ করে দিন শীত লাগছে। ‘
পুরনো অভ্যাস চাইলেই হঠাৎ করে ছাড়ানো সম্ভব না। একদিন দুইদিন তিনদিন, তারপর ধীরে ধীরে হয়তো সয়ে যায় মনে। মনটা মানিয়ে নিতে শিখে। মেহতিশার তখন প্রচন্ড মন খারাপ হলো। ভাবতে লাগলো, ‘এতদিনই তো ভালো ছিলো দর্পণ, নাটক হলেও আমি ভালো ছিলাম। এভাবে কতদিন ধুঁকে ধুঁকে মরবো? ‘
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বিছানা ছাড়ে। আজ আর বারান্দায় দাঁড়াতে ইচ্ছে করলো না। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে চলে এলো। অনেক গুলো গোলাপ, হাসনাহেনা ফুলের টব লাগানো আছে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলো মেহতিশা। ফুলগুলো অনেক স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। কী অপরূপ! এগুলো নাকি দর্পণের টব। সবগুলোর যত্নই সে নিজের হাতে নিতো। ঘরে বসার পর এগুলো লিমন কাকার দায়িত্বে ছিলো। যিনি এখনো মালি হিসেবে এ বাড়িতে কাজ করে। আজ সকালেও নাকি দর্পণ এগুলোতে পানি দিয়েছে। মেহতিশা ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবলো, এত সুন্দর ফুলগুলো যার, তার মনটা এতো কুৎসিত কেনো?
আধা ঘণ্টা সময় কাটানোর পর শীতে গা কুঁকড়ে আসছিলো। তাই নিচে নেমে আসলো। রুমে এসে গায়ে চাদর পেচিয়ে নামলো। অন্য দিনগুলোতে রান্না ঘরে ঢুকে দর্পণের জন্য চা বানায়। তারপর দিয়ার সঙ্গে গল্প করে। এখন মেহতিশার সামান্য হাসিটুকু দিতেও অনেক কসরত মনে হচ্ছে। সোফায় বসে টিভিটা অন করলো যদিও মনোযোগ সেখানে নেই। লালিমা শেখ মেহতিশাকে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে বললেন,
‘একি মা, তুমি ওভাবে না খেয়ে বসে আছো কেনো? ‘
মেহতিশা হাসার চেষ্টা করে বললো,
‘এমনি, খেতে ইচ্ছে করছে না। ‘
‘ওহহো, এখন তো আর দিপু নেই। নাহলে নিজেই এসে তোমাকে খাইয়ে দিতো। পাগল ছেলে আমার, সকালেই অফিসে ছুটছে। কিছু খায়ওনি। ‘
‘উনি কিছু খেয়ে যাননি! ‘
‘না তো, সাড়ে সাতটাতেই রেডি হয়ে দৌড়েছে। টাইম নিয়ে অনেক পজেসিভ। যা কাজই করে অনেক দায়িত্ব নিয়ে ভালোবেসে করে। ‘
প্রথমে মেহতিশার চিন্তা হচ্ছিল দর্পণ খালি পেটে বের হয়ে গেছে বলে। কিন্তু, লালিমা শেখের প্রশংসা শুনে তাচ্ছিল্য ফুটে উঠলো ওর চোখে মুখে। হাহ! কত গর্ব নিয়ে প্রশংসা করছেন তিনি৷ অথচ, আসলে দর্পণ কেমন তা তো জানে মেহতিশা। আর কিছু পারুক আর না পারুক, অভিনয়টা ঠিকই পারে। তাও নিখুঁত। নাহলে দু’টো বছর কীভাবে কেউ প্যারালাইসের নাটক করে ঘরে বসে থাকে। হঠাৎ করেই মেহতিশার মনের বিদ্যুতের গতিতে একটা প্রশ্ন খেলে গেলো, ঠিকই তো দু’টো বছর কীভাবে দর্পণ প্যারালাইসের অভিনয় করলো? একজন সুস্থ মানুষ কী পারে এভাবে! আর করলেও কেনো? মেহতিশা তো নিজেও দর্পণের রিপোর্ট নিয়ে নিজের কাজিনকে দেখিয়েছিলো। ভাইয়াও তো বলেছিলো, সত্যিই দর্পণের পা অচল। সে হাটতে পারেনা। অনেক সময় লাগবে তার সুস্থ হতে। তাহলে? মেহতিশা তাড়াতাড়ি উঠে গেলো। লালিমাকে বললো, মা আমি রুমে যাচ্ছি আমার শরীরটা ভালো লাগছেনা। নাহার খালাকে বলে নাস্তাটা উপরে পাঠিয়ে দিয়েন।
লালিমা শেখ বললেন, ঠিক আছে তুমি রেস্ট নাও মা যাও। নিচে নামার দরকার নাই। বেশি খারাপ লাগলে আমি দর্পণকে কল করে বলবোনে তোমাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে।
মেহতিশা কোনোরকমে মাথা নাড়িয়ে ঘরে এসে গেলো। এসেই ড্রয়ার থেকে দর্পণের মেডিসিন গুলো বের করলো, তারপর ঔষধের নাম গুলো সার্চ গুগলে সার্চ দিলো। রেজাল্টে দেখালো, ঔষধগুলো এক ধরনের সিভিট আর কিছু ভিটামিন। অথচ, ভাইয়া কিছু পায়ের হেলথ ইমপ্রুভমেন্টের মেডিসিন দিয়েছিলো। মেহতিশা বুঝতে পারলো, দর্পণ এখানেও কোনো চাল খাটিয়েছে। এবার বুঝতে পারছে, ঔষধ গুলো মেহতিশা নিজেই আনতে চেয়েছিলো কিন্তু দর্পণ দারোয়ানকে দিয়ে আনিয়েছিলো। তার মানে, টাকা দিয়ে দর্পণ এখানেও কারসাজি চালিয়েছে। তাইতো, ঔষধের প্রেসক্রিপশনটা আর পরবর্তীতে খুঁজে পায়নি। ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো মেহতিশা। চোখ বেয়ে জল পড়ছে। চোখ মুছে মেহতিশা ঠিক করলো এবার যেভাবেই হোক, সে বের করবে কী কারণে দর্পণ এসব করলো। আর তারপরই এ বাড়ি ছেড়ে, দর্পণকে ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে যাবে। আর বাচ্চাকেও নিয়ে যাবে। এটাই হবে দর্পণের উত্তম শাস্তি। উঠে বাবাকে কল করে থমথমে কন্ঠে বললো,
‘আমি আসছি। ‘
–
গলার টাইটা আরও একবার ঢিলে করে নিয়ে পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পানিটুকু গিলে নিলো।
এতো ঠান্ডাতেও ঘামছে দর্পণ। কী অসহ্য রকমের গরম লাগছে। উঠে এসির পাওয়ারটা বাড়িয়ে দিলো। মাকে দু’বার কল করে খোঁজ নিয়েছে মেহতিশা কী করছে,কোথায় যাচ্ছে। মেহতিশাকে কল করেছিলো। মেয়েটা ধরেনি। দর্পণ জানে, ইচ্ছে করেই ধরেনি। নাহ, গার্ড লাগাতে হবে। না জানি মেহতিশা কখন কী করে বসে। সকালে মেহতিশার দৈনিক ঔষধগুলো সাইডে রেখে দিয়েছিলো, একটা কাগজে লিখেও রেখেছে। যাতে ব্রেকফাস্ট করে নেয়। দেখেওনি হয়তো। দর্পণের মেজাজটা গরম হয়ে গেছে। অফিসের কাজ গুলো শেষ করে একবার ক্লাবে যেতে হবে।
অর্পণ থাকতে এই ব্যবসাপাতির দায়িত্ব ছিলো অর্পণেরই। দর্পণ ক্লাব, রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। এখন দুইদিক কীভাবে যে সামলাতে হয়, শুধু দর্পণই জানে। আগে মাঝে মধ্যে দুই একবার এসে পেন্ডিং এ থাকা কাজগুলো দেখে দিতো। বাড়তি কিছু কাজ ছাড়া কিছু করা লাগেনি। এখন তো বাবারও বয়স হয়েছে। তিনি খুব একটা প্রেশার নিতে পারেন না। দর্পণ ঘড়িতে সময় দেখলো সাড়ে এগারোটা বাজে। মেয়েটা কী এখনো না খেয়ে বসে রইলো! নাহ, অস্থির অস্থির লাগছে দর্পণের। বাসায় থাকলে মেয়েটা কতশত পাগলামি করতো। ল্যাপটপটাকে নাকি মেহতিশার সতীন মনে হয়। দর্পণ যখন ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করে, তখন মেহতিশা হিংসার দৃষ্টি দিয়ে বলতো, আমার ইচ্ছে করে এই ল্যাপটপটাকে দুই ভাগ করে ভেঙে ফেলতে! দর্পণ সারাক্ষণ এটা নিয়ে কাজ করতো বলে কত রাগ করতো। আনমনে হাসলো। কল করলো মেহতিশার নাম্বারে।
–
নিজের বাড়ি থেকে চোখ মুখ ফুলে থাকা অবস্থায় বাসায় ফিরলো মেহতিশা। চোখ মুখের অবস্থা করুণ।
লালিমা দেখে এক মুহুর্ত থমকে গেলেন। অস্থির হয়ে দর্পণকে কল করলেন। মেহতিশা ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো। নির্মম দহনে পু্ড়ছে যেন।
কাঁদতে কাঁদতে শ্বাসকষ্ট লাগছে। ব্যাগে মোবাইলে রিং হচ্ছে। তীব্র ঘৃণা নিয়ে মেহতিশা বিরবির করে বললো,
‘আই হেইট ইউ দর্পণ, আই জাস্ট হেইট ইউ। ‘
চলবে-
লেখায়-নাঈমা হোসেন রোদসী।
(অনুরোধ করছি, যারা এখনো নকল করছেন এসব করা বন্ধ করুন। লেখার মনমানসিকতাটা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়।)