“প্রিয় দিও বিরহ”
২২.(বোনাস পার্ট)
টিকটিক করতে করতে ঘড়ির কাটা যখন একটা বেজে দশ তখন বাড়ি এসে পৌঁছালো দর্পণ। ডান হাতে ডিপ ব্লু কোর্টটা ঝুলানো। গায়ের গোছানো ইন করা সাদা শার্টটা এখন এলোমেলো হয়ে গেছে। ললাট ঘেমে উঠেছে। কলিজায় কেমন যেন কামড়াচ্ছে। লালিমা শেখ ওকে দেখেই তাড়াতাড়ি করে বললেন,
‘দিপু, দেখতো সেই কখন মেয়েটা ঘরে গেলো। নাহারকে পাঠালাম খাবার দিয়ে দরজা খুললো না। বলছিলো শরীর খারাপ লাগছে। ‘
হঠাৎ করেই বুকটা মুচড়ে উঠলো দর্পণের। সে একপর্যায়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরের দিকে ছুটলো। একের পর এক করাঘাত দেয়ার পরও যখন মেহতিশা দরজা খুললো না। তখন বাধ্য হয়েই লকটা ফ্লাওয়ার ভাস দিয়ে বারি দিয়ে ভেঙে ফেললো। দরজা খুলে ঢুকতেই পিলে চমকে উঠলো তার৷ ফ্লোরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে তুলতুলে নরম দেহটা। হাতে দর্পণের ঔষধগুলো। দর্পণ বুঝতে পারলো,প্রায় অর্ধেকটাই জেনে গেছে মেয়েটা। তড়িৎ প্রবাহের গতিতে মেহতিশাকে কোলে তুলে ছুটে গেলো নিচে।
গাড়িতে তুলে হসপিটালে ছুটে গেলো। নার্সরা এসে বেডে করে কেবিনে শিফট করলো। দর্পণও ভেতরে আসতে চাইলে নার্স বাঁধা দিয়ে বললো,আপনি এখানেই থাকুন। অস্থিরচিত্তে কপালে দুই হাত চেপে বসে রইলো অগত্যা চেয়ারে। লালিমা শেখ এসে পাশে বসলেন। দর্পণের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘ভয় পাসনা বাবা, কিছু হবেনা। ঠিক হয়ে যাবে দেখবি।’
দর্পণের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন তিনি। দর্পণ তার দিকে তাকাতেই দেখলেন চোখদুটো লাল হয়ে গেছে ওর। তিনি দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। দর্পণের কেনো জানি কান্না পেয়ে গেলো। পুরোনো কিছু স্মৃতি দাগ কেটে যায় মাঝেমধ্যে। সে মায়ের কোলে মাথা রেখে বাচ্চাদের মতো বললো,
‘মা,তুমি জানো না আমার হাসপাতাল দেখলে ভয় করে। মনে হয়, আবারও কেউ হারিয়ে ফেলবো। ‘
‘এমন বলেনা বাবা, এক ঘটনা বারবার হয়না। তোর ভাইয়ের হায়াত অতোটুকুই ছিলো। আমি মেনে নিয়েছি। ‘
‘তারপরও আমার হাসপাতালে আসলেই মনে হয়, আবারও কেউ বুঝি এসে বলবে, আমরা তাঁকে বাঁচাতে পারিনি। আমার কষ্ট হয় মা। তুমি দেখো, আমার ভাইয়াকে যারা এতো নির্মম মৃত্যু দিলো, আমার ছোট বোনের মতো মেয়েটাকে পাগল বানিয়ে ফেললো ওদের আমি শাস্তি দিবোই। ‘
‘সব ঠিক আছে। কিন্তু দেখো,অপরাধীর জন্য নিরপরাধ কাউকে শাস্তি দিওনা আবার। ‘
দর্পণ মায়ের দিকে তাকালো। তিনি মৃদু হেসে বললেন,
‘আমার চুলগুলো তো বাতাসে পাকেনি বাবা। মেয়েটার কিন্তু দোষ নেই। তুমি ওকে অযথা দোষ দিবেনা। ‘
দর্পণ দুই হাতে কপাল ঘষলো। মনে হচ্ছে, আসলেই সেই রাগটা মেহতিশাকে না দেখালেই হতো। সব তো প্ল্যানমাফিক চলছিলো। এমন না যে দর্পণ প্যারালাইস কখনোই ছিলোনা। টানা দশটা মাস সে সত্যিকারেই অচল ছিলো। আল্লাহর রহমতেই ট্রিটমেন্টে সুস্থ হয়। কিন্তু কিছুতেই যেনো শত্রুরা খবর না পায়, এবং তাকে দূর্বল ভাবে তাই তো সুস্থ হওয়া পরও নাটক চালিয়েছে। অর্পণের পর নেক্সট টার্গেট তো দর্পণই ছিলো। এমনকি এখনো আছে। দর্পণের যদি কিছু হয় তাহলে ওর মা, বাবা, বোন আর ভাইয়ের রেখে যাওয়া আমানতটা সে রক্ষা করতে পারতোনা।
দর্পণ অনুশোচনা নিয়ে মুখ নিচু করে রাখলো। মেহতিশাকে সে ভয়টা এজন্যই দেখিয়েছিলো যেন মেহতিশা ভয় পেয়ে কোনো কাগজপত্র অন্য জায়গায় ট্রান্সফার করতে না পারে। অন্তত বাচ্চাটা হওয়ার আগ পর্যন্ত যেনো দর্পণকে ছেড়ে যেতে না পারে। এখন মনে হচ্ছে, এতোটা ভয় দেখানো উচিত হয়নি৷ অতিরিক্ত শক পেয়ে এখন যদি কিছু হয়ে যায়! বাচ্চাটা হওয়ার পর সে সবকিছু খুলে বলবে মেহতিশাকে। আর কোনো ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হতে দেবেনা। দর্পণকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে লালিমা শেখ বললেন,
‘দিপু, আমি কী বলেছি বুঝেছিস? ওর কোনো ক্ষতি করিসনা। ‘
দর্পণ শূন্যে তাকিয়ে রইলো। দরজার ফাঁক দিয়ে মেহতিশার বেডটা অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সে চোখের গ্লাসটা খুলে হাতায় মুছতে মুছতে বললো,
‘সে আমার প্রিয় হয় মা। ‘
–
দীর্ঘ একটা সময় কেটে যাওয়ার পর মেহতিশার জ্ঞান ফিরে। উঠতে চাইলেই হাতে ক্যানালোতে টান লেগে রক্ত ভেসে উঠলো। স্যালাইন শেষ হয়ে গেছে। চারদিকে হালকা আলো জ্বলছে। দূর্বল লাগছে শরীর।
পরিবেশ দেখে বুঝলো সে হাসপাতালে অবস্থান করছে। হাতটা চিনচিনে ব্যথা করতেই ‘উহ’ করে উঠলো। সজাগ হয়ে গেলো দর্পণ। ঘুম ভেঙে গেলো তার। পাশেই চেয়ারে বসে ছিলো সে। দশ মিনিট হবে চোখটা লেগেছে। মেহতিশার বাম হাতটা এখনো তার মুঠোবন্দি হয়ে আছে। সে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। মেহতিশার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ দাঁড়ান দাঁড়ান, আমি ডক্টরকে ডেকে আনছি। টানবেন না ওটা। ‘
মেহতিশা মাথা উঁচু করে তাকালো। দর্পণের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বললো,
‘এক্ষুনি খুলবো আমি এটা। অসহ্যকর! ‘
দর্পণ মেহতিশার হাতটা চেপে ধরলো। রাগী দৃষ্টি দিয়ে বললো,
‘চুপপ! একদম টানাটানি করবেনা৷ তোমাকে আমি খুব বকবো মেহতিশা। ‘
‘আমার বয়েই গেলো আপনার বকা শুনতে। ‘
বিরবির করে বললেও শুনে ফেললো দর্পণ। সে ভ্রুক্ষেপ করলোনা৷ দৌড়ে ডক্টরের খোঁজ করে একপ্রকার টেনেই আনলো এক ডক্টরকে। তিনি বোধ হয় সারাদিন ডিউটি করে একটু রেস্ট করছিলেন। তাই দর্পণের কাজে বিরক্তই হলেন। তিনি অবশ্য এই বিভাগের না। তিনি শিশুবিষয়ক ওয়ার্ডের। তবুও, তিনি মেহতিশার হাতের ক্যানালোটা খুলে চেকআপ করে বললেন, শরীরে দূর্বলতা আছে এখনো। এছাড়া সব ঠিক আছে। তবে বাসায় যেতে পারবেন। সবটা বলে একপ্রকার হাফ ছেড়ে চলে গেলেন তিনি। দর্পণের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বিছানায় শুয়ে রইলো মেহতিশা। চোখে ঘুম নেমে আসলো। সারারাত ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে একের পর এক দীর্ঘ শ্বাস ফেললো দর্পণ। কপালে আদুরে স্পর্শ এঁকে দিয়ে চেয়ারে বসে থাকলো। যেনো তার বিশাল অন্যায় হয়ে যাবে উঠে গেলে।
মেহতিশার যখন ঘুম ভাঙলো,তখন দশটা বাজে প্রায়। রাতের কথা মনে পড়তেই পাশে তাকালো। দর্পণের বসার চেয়ারটা খালি পড়ে আছে। কোথায় গেলো অসভ্য ধোঁকাবাজ লোকটা?এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো বালিশের পাশে একটা কাগজ রাখা। হাত বাড়িয়ে খুলতেই দেখলো,
তোমার রাগগুলোকে বাক্সবন্দি করে নাও,
আমায় দিওনা, আমি যত্ন জানি না,
আমি মনভোলানো পথিক।
তোমার অভিমানের ঝুলি খুলে ফেলোনা,
আমি শব্দ গোছাতে পারিনা,
বড্ড হাওয়ায় ভাসা নাবিক।
তুমি ভালোবাসার চোখে চেয়োনা,
আমি বুঝিনা ওসব, সাজাতে পারিনা ভেঙে,
আমি বুঝতে পেরেও, নাবোঝা থাকি,
তোমার অভিমানী চোখ চেয়ে।
চলবে-
লেখনীতে -নাঈমা হোসেন রোদসী।