“প্রিয় দিও বিরহ”
৩১.
বারান্দার গ্রিলের চিকন চিকন ফাঁকগুলোর মধ্যে দিয়ে ভো ভো করে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। কখনোবা টালমাটাল বাতাস এসে গায়ে আছড়ে পড়ে জামা কাপড় উড়িয়ে দিচ্ছে। চোখের পাপড়ি গুলো লেপ্টে থাকা জল সরিয়ে শুকিয়ে কাঠ করে দিয়েছে। ব্রাউন শেডের হেয়ার কালার করা পিঠ এলিয়ে থাকা চুলগুলো অবিন্যস্ত ভাবে উড়ে চলছে। সুদীপ্ত বিশাল আকাশটা আজ পরিষ্কার। তবে কী আজ আকাশও মেহতিশার মতো সব রহস্যের সমাধান করে ফেলেছে? জেনে গেছে অতীতের সকল রহস্য? হয়তোবা।
আনমনা চোখে দূরদূরান্তে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মেহতিশা। এতগুলো সত্যি হঠাৎ হজম করতে বেগ পেতে হচ্ছে। এতো সহজেই সবটা সমাধান হয়ে গেলো, তা চিন্তাও করতে পারছেনা। এটাই তবে ভবিতব্য ছিলো। অমীমাংসিত রহস্য গুলোর পাজেলগুলো মিললো অবশেষে। মেহতিশার চোখ দু’টো ডুবন্ত সূর্যের দিকে। সন্ধ্যা হয়ে এলো। কী চমৎকার সাজে সজ্জিত আকাশটা। রাঙাবধূর মতো দেখাচ্ছে। অপূর্ব!
‘ম্যাডাম, আপনাকে খালা ডাকছেন খাবার খেতে। ‘
কুসুমের ডাকে ধ্যান ভাঙে মেহতিশার। গ্রিলের উপর থেকে হাত সরিয়ে বারান্দার দরজা আঁটকে লাইট জ্বালিয়ে দিলো। পায়ের স্লিপারগুলো পায়ে পড়ে বলল,
‘যাও, আসছি। ‘
মেয়ে সার্ভেন্ট কুসুম মাথা নাড়িয়ে বের হয়ে যায়। মেহতিশা ফোনটা হাতে নিয়ে বের হলো। ডাইনিং টেবিলের চেয়ারটা টেনে বসলো। বিনাবাক্যে চামচ উঠিয়ে সালাদ খাওয়া শুরু করলো। অথচ,সে জানে টেবিলের সাত জোড়া চোখ তাঁর দিকেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। গোগ্রাসে গিলতে থাকে মেহতিশা।
চোখ মুখ শক্ত একেবারে। মুখাবয়ব গম্ভীর। মেহতিশার মা কিছুক্ষণ করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। শামীউল্লাহ জামান গলা পরিষ্কার করে চামচ দিয়ে টুংটাং করে বললেন,
‘কী সিদ্ধান্ত নিলে তুমি? ‘
মেহতিশা মুখের খাবারটুকু গিলে গলধকরণ করে। পানির গ্লাসটা ভরতে ভরতে বলে,
‘নতুন করেও আবার কিছু বলতে হবে? যখন সিদ্ধান্ত বললাম তখন কোথায় ছিলেন?নাকি আমি এ বাড়িতে আসলেও এখন বিরাট সমস্যা! বিপদ হয়ে গেছি কিনা! নাহলে, ডিলে লাভ ছাড়া আর কীবা কাজে আসি আমি?’
ভড়কে চুপ মেরে রইলেন তিনি। মেহতিশা নিষ্প্রাণ দৃষ্টি দিয়ে উঠে চলে এলো। খাবারের বাকি এঁটো থালায় অবহেলায় রয়ে গেলো।
মেহতিশার মা ক্ষোভভরা চোখে তাকিয়ে বললেন,
‘হলো তো! শান্তি হয়েছে?সমস্যা কী তোমার? আসলে,দোষটা আমারই। যদি মেয়েটাকে জোর করে বিয়ে দেয়ার সময়ই প্রতিবাদ করতাম। তাহলে, আজ এমনটা হতোনা। যেদিন আমার বোনের মেয়েকে নিজের পরিচয় দিয়ে বড় করার কথা বলেছিলো অনেক বেশি খুশি হয়েছিলাম। এখন জানি, মেয়েটার জীবনটা নষ্ট করার জন্যই তুমি এনেছিলে। লাভ লোকসান অতশত আমি বুঝিনা। আমার মেয়েটা এখন যদি উল্টোপাল্টা কিছু করে ফেলে তোমাকে আমি কক্ষনো ক্ষমা করবো না। ‘
গজরাতে গজরাতে চলে গেলেন তিনি। কিছুটা স্বামীর প্রতি ক্ষোভ, অসন্তুষ্টি এবং নিজের চুপ থাকার অনুশোচনা দগ্ধ করছে। তবে, সময় গেলে সাধন হয়না!
শামীউল্লাহ জামান মাথা নিচু করে বসে রইলেন। তার ছোট ভাই বললেন,
‘বড় ভাই, প্রতিশোধের নেশায় আমরা এতোই অন্ধ ছিলাম ঠিক ভুল বিচার করিনি। আজ এর ফল আমাদের বাড়ির মেয়েটাকে ভোগ করতে হচ্ছে। ‘
শামীউল্লাহ জামান নিম্নস্বরে বললেন,
‘পাপ করার সময় সবাই-ই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। হুঁশ তখনই ফিরে যখন ফলটা ভোগ করতে হয়। ‘
‘যে যাওয়ার সে তো যাবেই, অথচ আমরা এই সত্যিটাই মানতে পারছিলাম না। মেঝো যে আমাদের সবার আগে চলে যাবে তা বিশ্বাস করাটা অনেক কঠিন ছিলো।আমরা সত্যিই বোকা!একজন মৃতের জন্য জীবিত মেয়েটাকে খেলার গুটি বানিয়ে রেখেছিলাম। ‘
সবাই টেবিল থেকে উঠে গেলো। শামীউল্লাহ জামান মাথা চেপে রাখলেন। বুকপকেট থেকে রুমালটা বের করে চোখটা মুছে নিলেন। রুমালটায় চোখ পড়লো। সাদা কাপড়ের উপর সেলাই করে কাঁচা হাতে লেখা -মাই হ্যান্ডসাম ড্যাডি!
তিনি আরও একবার চোখ মুছে নিলেন। আজ যে কেনো এতো কান্না পাচ্ছে কে জানে!
–
তুলতুলে টেডিবিয়ারটা বুকে জড়িয়ে খাটের এক কোণায় মাথা ঝুলিয়ে শুয়ে আছে মেহতিশা। ফুল স্পিডে ফ্যান চলছে। এসিটা বন্ধ। গায়ে টপস একটা। এই বাড়িতে আসার সময় কোনো জামা কাপড় নিয়ে আসা হয়নি। অনন্যের কোম্পানি থেকে ফিরে আর ওই বাড়িমুখো হয়নি সে। সরাসরি এখানেই চলে এসেছে। বিছানা হাতরিয়ে মোবাইলটা নিলো। সাইলেন্ট মোডে দেয়ায় ভাইব্রেট করছে সেই কখন থেকে। সতেরোতম বার মেহতিশা কল কাটতে নিয়েও কাটলো না৷ রিসিভ করে কানে দিলো। হ্যা, ওর ধারণাকে সত্যি করেই অস্থির এক ক্লান্ত কন্ঠ কানে এসে লাগলো,
‘মেহতিশা, তুমি কোথায় আছো? এরকমটা কেউ করে! জানো আমি কতো টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম! রাস্তায় এক্সিডেন্ট করে ফেলেছি! দৌড়ে বাড়ি চলে এসেছি। মা কাঁদতে কাঁদতে পাগলপ্রায়। হেলো, হেলো?’
মেহতিশা নিঃশব্দে সবটা শুনে গেলো, যেমন এতগুলো দিন সে শুনে এসেছে। নিস্তব্ধ গলায় বলল,
‘বলা শেষ? ‘
দর্পণ অবাক হয়ে বলল,
‘মানে? ‘
‘মানে, আপনার কথা শেষ হয়েছে? এবার আমি বলি?’
দর্পণ শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে শান্ত করলো। এতক্ষণ যাবৎ মনে হচ্ছিল শুধু শরীরটাই আছে। আত্মা নেই। মূল্যহীন অচল দেহ। গত তিন ঘন্টা পাগলের মতো ছুটাছুটি করেছে। মেহতিশা ভালো আছে, সুস্থ আছে এখন এটাই মূলকথা৷
‘বলো। ‘
‘প্রথমত, আমি আপনাদের খেলার পুতুল নই যে যা মন চায় করবেন। কেউ নিজের প্রতিশোধের জন্য জোর করে বিয়ে দিয়ে দিবে, কেউ বিয়ে করে নিজের কাছে আঁটকে রাখবে। আমি তো আর মেশিন নই। আমারও অনুভূতি আছে। দ্বিতীয়ত, যে নিজের স্ত্রীকে একবিন্দু বিশ্বাস না করে এতবড় সত্যিটা আড়াল করে রাখে তাঁকে নিয়ে অন্তত সংসার করা সম্ভব নয়। ‘
দর্পণ ভেঙে ভেঙে কাঁপা গলায় বলল,
‘আপনি এসব কী বলছেন বউজান?’
মেহতিশার কঠিন কন্ঠ –
‘ভালো থাকবেন। ‘
‘এটা তুমি করতে পারো না! আমি এখুনি আসছি তোমাকে নিতে। তুমি কোথাও যাবেনা। তুমি যেতে পারোনা! আমার বাচ্চাকে নিয়ে কোথাও যেতে পারবেনা তুমি! ‘
‘আমি পারবো দর্পণ, আমি পারবো! ‘
–
মাথায় হাত চেপে বসে পড়লো মেঝেতে দর্পণ। এটা কীভাবে সম্ভব! এটা তো হওয়ার কথা ছিলো না! মেহতিশাকে কে বলল সবকিছু! দর্পণ তো চেয়েছিলো বেবি হওয়ার পর সব খুলে বুঝিয়ে বলবে সে। অথচ, মেহতিশা সবটা আগেই কী করে জানলো! মুখ চেপে ডুকরে উঠলো সে। এটা সেই ঘর যেখানে দর্পণ আগে থাকতো। চারপাশে বিরাট বিরাট আয়না দিয়ে ঘেরাও করা। প্রতিফলিত হচ্ছে প্রতিটি কোণা। যেই আয়নায় একসময় নিজের এক রহস্যময়ী অবয়ব দর্পণ দেখতো, সেই আয়নাই যেনো আজ তাঁকে তাচ্ছিল্যে হো হো করে হেঁসে উঠলো।
দর্পণ রাগে দুঃখে দেয়ালে টাঙানো পুরনো আমলের বন্দুকটায় গুলি লোড করে সবগুলো আয়নায় অনবরত চালাতে থাকলো। প্রত্যেকটা কাচের আয়না খন্ড বিখন্ড হয়ে পড়ে রইলো। ভাঙাচোরা আয়নাটার দিকে তাকিয়ে হাসলো দর্পণ। শক্ত করে ঠোঁট দুটো চেপে রাখলো দাঁত দিয়ে। কয়েক সেকেন্ডের ভেতরই ঠোঁট কেটে রক্ত বের হতে লাগলো। পাশেই জ্বলজ্বল করে ওঠা মোবাইলে একটা মেসেজ পড়ে, দর্পণ নিজের চুল নিজেই টানতে বলল,
‘অনন্য অনন্য অনন্য, তোর ভালোবাসা চাওয়াচাওয়ির ফল আমি তোকে দেখাচ্ছি!’
ফ্লোরে ভাঙা আয়নাগুলোতে দর্পণের দর্পণ বা অবয়বই ভেসে উঠলো বিকৃতাকারে। ঠোঁটের চারিদিকে রক্ত মাখানো ফর্সাদেহী মানুষটাকে দেখে হয়তো দেয়ালেরা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। কী অবাকতর এ দৃশ্য!
চলবে-
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।
(অনেকটা সময় পর নিজের পেজে ঢুকতে পেরে শান্তিটুকু ফিরে পেলাম। ভালোবাসা সবাইকে। রহস্যেতে যাদের মাথা আমি ঘুরিয়ে অজ্ঞান করে ফেলেছি, তাদের জন্য বলছি আর খুব একটা বড় করবোনা। এই পর্বটায় হয়তো অনেক কিছুই বোঝেননি। বলা চলে, এটা শেষ কয়টা পর্বের একটা ধারণামাত্র। কয়েকদিন প্রতি দিন গল্প দিয়ে শেষ করবো। শেষ পর্যন্ত সাথে থাকার অনুরোধ পাঠকদের।)