“প্রিয় দিও বিরহ”
৩২.
পনেরো থেকে ষোলোয় পা দেওয়া সদ্য ষোড়শী কন্যা। দীঘল কালো কেশ ছিলোনা। তবুও, সে আমার মনের সোনার কন্যা। বড্ড কাব্যিক কথাবার্তা তাইনা! আমার বয়সটাও তখন খুব একটা বেশি না। সদ্য ভার্সিটি পাশ করে বেরিয়েছি। চোখের রঙিন পর্দাটা সরেনি। যা চোখে আসে তাই ভালো লাগে। কিশোরীর মুখ অন্য মেয়েগুলোর মতো আবেগী নয়। ওর মুখে সবসময়ই রাজ্যের গাম্ভীর্য, বিশাল এক বস্তা রাগ। কথার সে কী তেজ! আমি জীবনে অনেক মেয়ে দেখেছি। ঘুরেছিও কম না। যাকে ভালো লেগেছে তাঁর সঙ্গেই প্রেম করেছি। তা অবশ্য মনের সঙ্গে মনের নয়। মনের প্রেমটা আসার মতো সুখানুভূতী আমি কক্ষনো পাইনি এই জীবনে। আমার বাবা নায়েব শায়েরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শামীউল্লাহ জামানের বাড়িতে সেদিন গ্র্যান্ড পার্টির আয়োজন। তাঁর একমাত্র মেয়ের জন্মদিন। বাড়িতে ঢুকে আমার বাবা তাঁর বন্ধুর সাথে কথা বলতে লেগে পড়লেন। আমি ইন্ট্রোভার্ট ধরনের। সহজে মানিয়ে নিতে পারিনা। চুপচাপ এক পাশে মোবাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তারপর সেই শুভ সময় এসে পড়লো। সেটা কী আসলে আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিন কিনা আমি জানিনা, তবে সেদিনের মতো সুন্দর মুহূর্ত আমার জীবনে আর পাইনি। সাদা গোল জামা পড়া লম্বা, ফর্সা, কালার করা চুলের কিশোরী মেয়েটাকে দেখে পলক ফেলার জো ছিলো না আমার। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খুঁত ধরার চেষ্টা করেও একবিন্দু খুঁজে পাইনি। মেয়েটা খুব মেপে মেপে হাসলো। আদুরী একটা! কেক কেটে নিজের বাবা মা’কে খাইয়ে চলে গেলো ওপাশে। জানলোই না আমার মনটাও সে নিয়ে চলে গেলো নিজের মনভোলানো রূপে। হ্যা, প্রথম মুগ্ধতাটা আমার তাঁর মুখ দেখেই এসেছিলো। রঙিন বসন্তের মতো চোখ ধাঁধানো একটা মেয়ে। আমি সেই প্রথম ভীষণ অপ্রস্তুত হলাম। একটু পর পর চোখ দু’টো দিয়ে ওকে খুঁজে চললাম। একসময় শামীউল্লাহ জামানই তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে বড়ই গর্ব করে বললেন,এটি তাঁর কন্যা মেহতিশা জামান। মেয়েটা আমার দিক তাকিয়ে কিঞ্চিৎ ঠোঁট প্রসারিত করলো। এটাকে কী হাসি বলে? মেয়েটা এতো কম হাসে কেনো কে জানে! আমার ইচ্ছে করলো মেয়েটাকে সামনে বসিয়ে চোখ ভরে দেখে নিতে। শান্ত না কঠিন কাটকাট চোয়াল। নাকে ছোট নোজপিন। বোঝা যায়, বেশি দিন হয়নি নাক ফুরিয়েছে। খাবার খেয়ে উঠে যাওয়ার সময় বড্ড বেসামাল হয়ে আমি মেয়েটার কাছে চলে আসলাম কথা বলতে। অন্তত নিজের নামটুকু তাঁর মুখে শুনতে। কেমন লাগবে তাঁর মুখে?নিশ্চয়ই খুব মধুর! লাগুক। দুনিয়ার সবচেয়ে বিশ্রী নাম দিয়ে আমাকে ডাকলেও আমি খুশিতে পাগল হয়ে যাবো। মেহতিশা, বড়ই গোছানো টিপটপ নাম! তাইনা?শুনতে সুন্দর লাগে। আর কারো না লাগুক আমার লাগে। আমি মেয়েটার সামনে হাত বাড়িয়ে দিলাম হ্যান্ডশেকের জন্য। মুখটা তখনও হাসিহাসি। তবে,বেশিক্ষণ স্থায়ী হলোনা কথা শুনে।
মেয়েটা কাঠকাঠ গলায় বলল,
‘আপনি তো বেশ অভদ্র! সেই সময়ও কেমন লু’চ্চার মতো তাকিয়ে ছিলেন। এখন কী উদ্দেশ্যে এসেছেন আমি বুঝিনা ভেবেছেন?’
আমি বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম। আমার ভাবনা থেকেও এক কাঠি উপরে চলে গেছে এই মেয়ে। আমি ফিক করে হেঁসে বললাম,
‘লু’চ্চামি করছি বুঝলে কী করে? ‘
মেয়েটা ভ্রু কুঞ্চন করে বলল,
‘আপনি তো ভারি অসভ্য! প্রথম দেখাতেই তুমি!’
‘তুমি করে বললে বুঝি অসভ্য হয়ে যায়! ঠিক আছে আর তুমি বলবো না, খুশি?’
‘জ্বি।’
মেয়েটা চলে গেলো সেদিন। কিন্তু আমার মন সরেনি। জেদি হয়ে রইলো। আসক্তিতে পরিণত হলো। টানা এক বছর যাওয়ার পর বাবা মাকে আমি আমার মনের কথাটা জানিয়ে দিলাম। আমার বাবা খুশিই হলেন। প্রস্তাব পাঠালেন তাঁর বন্ধুকে। কিন্তু, সেখানে বিপত্তি ঘটলো। প্রথম ধাক্কাটা খেলাম, মেহতিশাকে আরও আগে থেকেই ব্যবসায়ী ওয়াসিফ শেখের ছেলের দর্পণ শেখের জন্য পছন্দ করে রাখা হয়েছে। আমি পাগলের মতো হয়ে গেলাম। শামীউল্লাহ জামানের হাতে পায়ে ধরে তাঁকে রাজি করালাম
তিনি প্রথমে নাইনুকুর করলেও পরে রাজি হলেন মেয়ের সুখের কথা ভেবে। আমাকে শর্ত দিলেন, আমি এখন তাঁর মেয়ের সঙ্গে কোনোরকম দেখা সাক্ষাৎ করতে পারবোনা। ওর পড়াশোনার কথা ভেবে আমিও দূরে রইলাম। দেখতাম দূর থেকে। ওর সামনে যাইনি। মেয়েটা ভুলে গেলো আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ। আমি দিনদিন বেপরোয়া হতে লাগলাম। আর মেয়েটা ততদিনে আরও বড় হলো। কথামতো ওর অনার্স শেষের পর আমাদের চার হাত এক হওয়ার কথা৷ হিসাবমতে আমি আমার আমানত পেয়ে যাবো। ভাগ্য তা চায়নি হয়তো। ঠিক আড়াই বছর আগে ফাটল ধরে আমার বাবা আর মেহতিশার বাবার সঙ্গে। এতগুলো বছর দু’জনের যে একসাথের বিজনেসটা আছে সেটা আমার বাবা পুরোপুরি কিনে নিতে চাইলেন। কারণটাও সহজ, আমার বাবার শেয়ার কোম্পানিতে ৬০ পার্সেন্ট অথচ টিভির শিরোনাম থেকে শুরু করে ইচ এন্ড এভরি পেপারে নাম হয় শুধু মেহতিশার বাবা, চাচার। যেহেতু আমার বাবার শেয়ার বেশি, এতদিন কিছু না বললেও তখন তিনি ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামালেন। পুরো কোম্পানিটা সেপারেট করে নিলেন। অনেক ঝগড়া বাদবিতণ্ডা হয় এই নিয়ে। আমি তখনও কোম্পানিতে জয়েন করিনি। অতশত বুঝিনা। একটা নরমাল স্কুলে টিচার ছিলাম। শখের বশে।
হঠাৎ একদিন আমার বাবার মৃত লাশ বাড়িতে আসলো। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিলো। মানতে যে কী পরিমাণে কষ্ট হয়েছে! পুলিশ তদন্ত করে বের করলো এসবের পেছনে মেহতিশার মেঝোচাচার হাত রয়েছে। সে ভীষণ কলাকৌশলী লোক। শামীউল্লাহ জামান এই ব্যাপারে প্রথমে জানতেন না, কিন্তু যখন জানলেন তখন নিজের বন্ধুর সাথে অন্যায় করে নিজের ভাইকে লুকিয়ে রাখলেন৷ কেস টাকা দিয়ে ধামাচাপা দিলেন। তখন আমিও কিছু জানিনা। ব্যবসা তখন জলে ভাসা ভেলা। কোনো কূল নেই তাঁর। এদিকটা সামলে উঠে আমি শামীউল্লাহ জামানের কাছে গেলাম। তিনি বললেন, তাঁর বন্ধুই যখন বেঁচে নেই তাহলে কীসের পুরনো কথা! আমাকে ভুলে যেতে বলা হলো। কিন্তু আমি কীভাবে ভুলবো! যার ছবি আমি আমার হৃদয়পটে অনেক রঙতুলি দিয়ে এঁকে খোদাই করেছি তার ছবি কীভাবে মোছা হয়, আমি তো সেই নিয়মই জানিনা। আমার মাথায় তখন চারদিক থেকেই শুধু ইরোর,ইরোর,ইরোর!
বাবা ছাড়া অসহায় দুনিয়ায় শক্ত হতে শিখলাম। ব্যবসায় জড়িত হয়ে কখনো হারলাম, হারালাম অনেক জিনিস। আস্তে আস্তে শিখলাম। না শিখলে খাবো কী? আমার মা বোনের মুখে অন্য কোথা থেকে তুলে দিবো! কিছুটা পরিস্থিতি সামলে যেই আমি মেহতিশাকে নিজের করতে মরিয়া হয়ে আবারও গেলাম বেহায়া হয়ে। তখন আমাকে হুমকি ধমকি দিয়ে বের করে দেয়া হলো। আমি প্রতিদিন কোম্পানিতে গিয়ে কখনো তাঁর সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করতাম। কখনোবা মারামারি করে আসতাম ৷ একদিন আমাদের মাঝে চূড়ান্ত পর্যায়ের কথা কাটাকাটি হলো। কারণটা ছিলো,তিনি মেহতিশাকে অন্য একজনের সাথে বিয়ে দিতে চাইছিলেন৷ আমি সাতদিন জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মরার মতো পড়েছিলাম৷ আর্তনাদ আহাজারি করে যখন কিছু করতে পারলাম না, তখন ঠিক করে নিলাম আমার চাওয়া যখন আমি পাবোই না তাহলে অন্তত আমার বাবার খুনীকে ছাড়বোনা। কোম্পানিতে আগুন লাগানোর ব্যবস্থা করে দিলাম। শয়’তানটা শুধু আমার বাবাকেই নয়, এর সঙ্গে ওয়াসিফ শেখের বড় ছেলে অর্পণকেও মারার চেষ্টা করছিলো। পার্সোনাল শত্রু’তার সূত্রপাতে। আরও অনেক পাপকর্মে লিপ্ত ছিলো। আমি এক ঢিলে দুই পাখি মেরে দিলাম। এক,কোম্পানির ক্ষতি করে দিলাম। দুই,ওই পাপীটাকেও মেরে দিলাম। চোখের সামনে পুড়তে পুড়তে ছাই হলো। তবে,শামীউল্লাহ জামান আমার সঙ্গে জেদ করে মেহতিশার বিয়েটা সেই আরেক ব্যবসায়ীর ছেলের সঙ্গেই দিয়ে দেয়। তারা তখনও জানেনা, যে দর্পণ ততদিনে জেনে গেছে তাদের পরিবারের মাঝেই কেউ একজন তাঁর বড় ভাইকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে। দর্পণ, ঠান্ডা মাথার খেলোয়াড়। সে চুপচাপ বিয়ে করে অসহায় সেজে রইলো। একদিকে মেহতিশাকে বিয়ে করে সংসার পাতলো। আরেকদিকে বড় ভাইয়ের খুনীকেও বের করলো। আর যখন জানলো, সেই খুনীই আর বেঁচে নেই দর্পণ তখন সবকিছু নতুন করে শুরু করার কথা ভাবলো। তবে,শামীউল্লাহ জামানকে সে খুব ঘৃণা করে। তাকেও সমান অপরাধী ভাবে। এর মধ্যে আরেকটা কথা আছে, যা আমি না নিজমুখে তোমার স্বামীই তোমাকে জানাবে। ‘
মেহতিশা নিস্তব্ধতায় মোড়ানো পুতুলের মতো বসে রইলো থম মেরে। চোখ তুলে অনন্যের দিকে তাকালো। মুখ দেখে প্রথমেই মেহতিশার মনে হয়েছিলো চেনা। কিন্তু ঠাওর করতে পারেনি। কী আশ্চর্য! গত সাত বছরে কতকিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে! মেহতিশা উঠে যায়। বের হওয়ার সময় হয়েছে। যেতে যেতে পিছিয়ে এসে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
‘বিয়ে করেননি কেনো এখনো?আপনি অনেক ভালো কাউকে পাবেন। ‘
অনন্য হাসলো। চোখদুটো লাল হয়ে আছে। নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আমার তোমাকে পাওয়া হয়নি, আমার আর কাউকে লাগবেনা! ‘
–
মেহতিশা শুয়ে শুয়ে সকালের সবগুলো কথা স্মৃতিচারণ করে। চোখ দুটো বুজে আসছে। কষ্ট গুলো কেমন যেন চিনচিন করে ব্যাথা দিচ্ছে। ভালো মানুষ গুলোর জীবনেই কেনো এতো কষ্ট থাকে! হিসাব মিলাতে না পেরে ঘুমিয়ে পড়ে সে।।
চলবে-
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।
শব্দসংখ্যা-১২১১